সন্দেশপুরের ড্রাগন

কার্ত্তিক মাস শেষ হতে না হতেই সন্দেশপুরে ঝুপ করে শীত পরে গেল। যেমন তেমন শীত না। খবরের কাগজে যেমন লেখা থাকে- তীব্র শীতের প্রকোপে জনজীবন অতিষ্ঠ …হেন তেন। সেই রকম শীত।
সারাক্ষণ শনশন করে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে লাগল। রাজপ্রাসাদের নানান জায়গা দিয়ে শীতের বাতাস সুরসুর করে ঢুকে পড়লো ভেতরে। পুরো রাজপ্রাসাদটা বরফের টুকরোর মত ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
জাদুকরের রুম ছিল মিনারের উপর। শীতের বেশির ভাগ ধাক্কা তার উপর দিয়েই যায়। কাঁপতে কাঁপতে একদিন নিচে গিয়ে সোজা হাজির হল রাজার কাছে।
‘ মহারাজ ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে।’ বিলাপ করে বলল সে। ‘ মিনারের উপর আমার কামরায় আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করুন।’
‘ কোন ভাবেই সম্ভব না।’ গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলল রাজা। ‘ এটা তো মাত্র কার্ত্তিক মাস। মাঘের শেষে আমরা আগুন জ্বালাব। কারন খনা বলেছে মাঘের শীত বাঘের গায়ে। আমরা তো বাঘ না। আমাদের ঠাণ্ডা লাগবে আরও বেশি। তাছাড়া লাকড়ির দাম অনেক বেড়ে গেছে।’
‘ আমার ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছে।’ কাঁদো কাঁদো সুরে বলল রাজকুমার হলুদকমল।
‘ আমারও।’ বললেন রানী।
‘ আমার মনে হচ্ছে আমরা উত্তর মেরুতে আছি।’ বিরক্ত হয়ে বলল প্রহরী পিচ্চি।
‘ পুরো রাজপ্রাসাদ যেন আস্ত একটা ফ্রিজ।’ বলল চাকর মাকড় আলী।
‘একদম ফালতু কথা।’ বিরক্ত হয়ে বলল রাজা। ‘ এস্কিমোরা এর চেয়ে বেশি ঠাণ্ডায় থাকে। ডিসকভারি চ্যানেলে আমি নিজের চোখে দেখেছি। এটা কোন ঠাণ্ডাই না। সবাই এক ঘণ্টা পর পর এক বাউল ভর্তি করে সবজির স্যুপ খাও আর প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর এক মগ করে গরম জল খাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
রাজা নিজেই ছয়টা জাম্পার গায়ে দিয়েছে। পায়ে তিন জোড়া করে মোজা। আর তিনটে কম্বল পেঁচিয়ে সোফায় বসে আছে। দেখাচ্ছে বিশাল এক ভাল্লুকের মত।
‘দুঃখিত মহারাজ।’ বিনয়ের সাথে বলল বাবুর্চি আনারস চট্টোপাধ্যায় । ‘ আমাদের কোন রকম গরম খাবার বা পানীয় নেই। সব চুলা বন্ধ। এক ছটাক কয়লা নেই পুড়িয়ে খাবার গরম করব।’
‘ খাবারের স্টকে আছে কি তবে ?’ জানতে চাইল রাজা ।
‘ প্রচুর স্ট্রবেরি আইসক্রিম আছে। টক দই আছে কয়েক পাতিল। ও হ্যাঁ, কয়েক বালতি বেলের শরবৎ ও আছে।’ হাসিমুখে জবাব দিল বাবুর্চি।
‘ খুব খারাপ। চিন্তিত মুখে বলল রাজা। ‘ আচ্ছা বাগানে গিয়ে কিছু শুকনো কাঠ যোগার করে এনে মহারাজের জন্য এক বাউল ফুলকপির স্যুপ বানাও। আর শুধু মাত্র আমার রুমেই আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা কর।’
‘ আমার রুমেও আগুন চাই।’ বলল রাজকুমার।
‘ মিনারেও চাই।’ বলল জাদুকর।
‘ পুরো প্রাসাদেই চাই।’ বলল রানী।
‘ আচ্ছা তাহলে দারোয়ান পিচ্চি আর মাকড় আলীকে নিয়ে বাগানে গিয়ে যত বেশি পার মরা গাছ যোগার কর।’ বিমর্ষ মুখে বলল রাজা।
কুড়াল হাতে সবাই দৌড়ে বাগানে চলে গেল। কাটতে লাগল পেল্লাই সব গাছ।
পিচ্চি অবাক হয়ে দেখে বাইরে সিঁড়ির নিচে কেমন বিচ্ছিরি একটা পাখি পরে আছে । পাখির মুখটা সরু। শরীর ভর্তি পয়সার মত আঁশ। একদম দুর্বল। মনে হয় খিদে পেয়েছে।
‘ কি পাখি এটা ?’ অবাক হয়ে বলল পিচ্চি।
‘ মনে হচ্ছে অচিন পাখি। ’ বেহায়ার মত হেসে বলল চাকর মাকড় আলী। কাক আর চড়ুই ছাড়া অন্য পাখি চেনে না বেচারা।
‘ আরে এটা তো ড্রাগনের বাচ্চা।’ বলল জাদুকর। ‘ শীতে দুর্বল হয়ে গেছে। অনেক দিন পর ড্রাগনের বাচ্চা দেখলাম। মনটা ভাল হয়ে গেল। পরিবেশ দূষণের কারনে আজকাল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ড্রাগন। ওরা গরমের দেশে থাকে। শীতে থাকতে পারে না। ’
‘ ওর ঘুম ভাঙানো যায় না ?’ জানতে চাইল রাজা।
বাচ্চা ড্রাগনের গায়ে আলতো করে চাপড় দিল জাদুকর। ওটা দুর্বল ভঙ্গিতে চোখ পিটপিট করে চাইল। পুতির মত লাল চোখ, বেচারা ক্লান্ত। আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
‘ওটাকে জাগানোর ব্যবস্থা কর।’ আদেশ দিল রাজা।
‘ মনে হয় খিদে পেয়েছে ওর।’ বলল পিচ্চি। ‘ দেখে মনে হয় বেশ কয়েকদিন না খেয়ে আছে।’
‘ তাই যদি হয় নিয়ে খাওয়া দাও ওকে।’ বলল রাজা। ‘ ড্রাগনের বাচ্চা কি খায় ?’
‘ মাংসের চাপ আর সিঙ্গারা খায় অমনটা শুনেছি।’ বলল পিচ্চি।
‘ সিঙ্গারা আর চাপ দেয়া যাবে না।’ বলল বাবুর্চি। ‘ স্ট্রবেরি আইসক্রিম আছে। দেব ? দিলে খাবে ওটা ?’
বাচ্চা ড্রাগনটাকে আইসক্রিম দেয়া মাত্র বমি টমি করে কেলেঙ্কারি কাণ্ড করে ফেলল। বেচারা তখন পুরা রাজ প্রাসাদের সব কামরায় খাবারের খোঁজে দৌড়াতে লাগল। খিদের চোটে রাজকুমারের খেলার মার্বেল গিলে ফেলল কয়েকটা।
‘ কি করা যায় এখন ?’ হতাশ গলায় বলল পিচ্চি।
‘ আমার কাছে কিছু তক্তি বিস্কুট আর চিতুই পিঠা আছে ।’ বলল জাদুকর ‘ দিয়ে দেখি খায় কি না।’
কাঠের বাক্সে ছিল চিতুই পিঠা আর বিস্কুট। ঠাণ্ডায় চামড়ার জুতার মত শক্ত হয়ে গেছে সেই বিস্কুট আর পিঠা। রাখা হল ড্রাগনের সামনে। খাবার দেখে চোখ পিট পিট করে সামনে চলে এলো বাচ্চা ড্রাগনটা। হা করে ফু দিতেই মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হয়ে এলো।
‘ খাবার গরম করে নিচ্ছে রে।’ চেঁচিয়ে উঠলো পিচ্চি।
‘ সেই সাথে আমার কম্বল পুড়িয়ে ফেলেছে।’ কেঁদে ফেলল জাদুকর।
আস্তে আস্তে অনেক সময় নিয়ে খাবার শেষ করলো ড্রাগনের বাচ্চা। চেহারায় সুখী একটা ভাব ফুটে উঠলো। পেট ভরা থাকলে সবার চেহারায় অমন সুখী ভাব দেখা যায়। ঘুমিয়ে পড়লো তারপর।
পোড়া কম্বল নিয়ে বাবুর্চি রান্নাঘরের জমানো কাঠে আগুন জ্বালিয়ে দিল। সেই আগুন নিয়ে প্রাসাদের সব ঘরে অল্প অল্প কাঠের টুকরো রেখে আগুন জ্বালিয়ে দিল পিচ্চি। সন্দেশপুরের প্রাসাদটা দেখতে সুন্দর লাগছিল তখন। ঝলমল করছিল। আর আরামদায়ক রকমের উম।
‘ আমরা কাঠ কেটে আনলেই সমস্যার শেষ হয়ে যায়। ড্রাগনের বাচ্চাটা দেশলাই হিসাবে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। সবাই আরামে থাকতে পারব।’ বলল পিচ্চি।
রাজা কোন রকম তর্ক করলো না।
সেই শীতকালটা সন্দেশপুরের রাজপ্রাসাদে সবাই বেশ আরামে আর আনন্দে কাঁটালো।
(Emma Laybourn এর The Dragon under the Stairs অবলম্বনে )