জিনিসটা বড় একটা মেহগনি বাক্সে থাকতো। চারকোণা পালিশ করা বাক্স। ধরার জন্য একটা হাতল আছে। উপরের ঢাকনি খোলা যায়।
সমস্যা হল প্রতেকবার রেকর্ড বদলানোর সাথে সাথে পিন বদলাতে হত। পিনগুলো ষ্টীলের।
আর বাজানো শেষ করার পর পরই রেকর্ডটা শক্ত একটা পিচবোর্ডের বাক্সে রেখে দিত হত। যদি ভুলে সেই পিচবোর্ডের বাক্সে না রাখা হত তবে গরমে বা ঠাণ্ডায় বা বাদলার ভেজা দিনগুলোর জন্য সব রেকর্ড কুঁচকে ত্যারা ব্যাকা হয়ে দেখার মত জিনিস হত। মনে হয় কোন আধুনিক শিল্পী বিমূর্ত কোন শিল্পকর্ম করেছে।
পিন নষ্ট হয়ে গেলে পিন পাল্টানোর কাজটা বেশ ভাল লাগত আমার।
গান শেষ হলে রেকর্ড উল্টে দেওয়া বা বাক্স থেকে নতুন রেকর্ড বের করে আনা ও বেশ দারুন দায়িত্ব মনে হত ।
তবে বিরক্ত লাগতো যখন রেকর্ডের খাঁজ কেটে যেত।
তখন একটাই লাইন বারবার বাজতে থাকতো। অথবা দম শেষ হয়ে এলে গান আস্তে আস্তে মোটা হতে থাকতো। যেন গায়কের কষ্ট হচ্ছে গান গাইতে। বা সরু মিহি হয়ে যেত।যেন গায়ক দুষ্টুমি করছে।
পছন্দের গান বাজানোর সময় দম যেন শেষ না হয় তাই সতর্ক থাকতাম। বিশেষ করে নেলসন এডির
দ্যা হিল অভ দ্যা হোম বা দ্যা মাউনটেন গানটা যখন বাজাতাম।
গুজরাটের কাছে জামনগরে যখন থাকতাম বাড়িতে কলের গান আনা হয়েছিল। আমি আর মা বাবার কাছ থেকে কলের গান বাজানোর কায়দা শিখে নিলাম, অনেক চেষ্টার পরও মা বাজাতে পারতো না।
কলের গানের সব কিছুই ভাল লাগতো আমার। এমন কি রেকর্ডগুলো যখন স্পেশাল নরম কাপড় দিয়ে মুছে রাখতাম তখনও ভাল লাগা কাজ করতো।
আমাকে প্রথম যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা হল ক্যাটালগ বানানো। মানে বাড়িতে আমাদের সংগ্রহে যত রেকর্ড আছে সবগুলোর নাম মোটা বাঁধাই করা খাতায় সুন্দর ভাবে লিখে রাখা।
তখন মোট পনেরোটা রেকর্ড ছিল।
ক্যাটালগটা বেশ ভালবাসা আর যত্ন নিয়ে বানিয়েছিলাম। আর কোন কাজ এমন গভীর আগ্রহ নিয়ে করেছি তেমন মনে পড়ে না।
বাবা অপেরা পছন্দ করত। আমি নেলসন এডি বা ডায়ানা ডারবিন এর পালা গান টাইপের কোরাস পছন্দ করতাম।
সব ধরেনই গান বাজত। গানের সাথেই বেড়ে উঠছিলাম।
একা বেড়ে উঠছিলাম আমি। সমবয়সী কোন বন্ধু ছিল না আশেপাশে।
কাজেই সেই কলের গান আর রেকর্ডগুলো আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ক্যাটালগটা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে উঠলাম। বড় হতে লাগল সেটা। রেকর্ডের পাশে লিখে রাখতে লাগলাম কোন কোম্পানির রেকর্ড। গায়ক কে। গানের কথা আর সুর কে করেছে। এমন কি গানের কথাগুলো ও।
জাম নগর থেকে যখন চলে এলাম সাথে করে কলের গান নিয়ে এলাম। তিন দিন আর তিন রাত পর দেরাদুনে পৌঁছলাম। বেশ কয়েক বাস ট্রেন বদলাতে হল।কলের গানটা যত্ন করেই নিয়ে এলাম।
দেহারে দাদুর বাসা হিমালয় পাহাড়ের গোঁড়ায়।
‘হিলস অভ হোম’ সেই গানের মত । দাদুর নিজের কলের গান আর বেশ রেকর্ড ছিল। তবে দাদুর রুচি আমার চেয়ে আধুনিক। বেশ ঝাঁক ঝমক মার্কা গান শুনত সে।
পুরানো দিনের কথায় বিরক্ত হতে পারো তোমরা। কিন্তু অতীত দিনের এই সোনালী স্মৃতি আমাদের জীবনের অনেক বড় একটা সম্পদ। মনের সিন্দুকে পড়ে থাকা মণিমুক্তার মত ।
আমাকে বোর্ডিং ইস্কুলে পাঠানো হল। টানা লম্বা নয়টা মাস আমি কলের গানটা মিস করলাম।
শীতের ছুটিতে বাড়ি ফিরে দেখি- ওমা, আরও নতুন অনেক রেকর্ড কেনা হয়েছে।
নতুন রেকর্ড কেনা একটা বাতিক হয়ে গেছে দাদুর।
আর এর মাঝে টানা পাঁচ বছরের জন্য ইনডিয়া ছেড়ে চলে গেলাম।
দাদু দিদা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। মা আমাদের সেই কলের গানটা বিক্রি করে ঝাঁ চকমকে নতুন একটা রেডিও কিনল।
কিন্তু রেডিও আমার পছন্দ না।
আমি পাগলের মত খুঁজতাম। মনে হত আমাদের সেই পুরানো কলের গানটা কোথাও না কোথাও পেয়ে যাব। হয়তো কোন দোকানে। বা অ্যানটিক শপে। বা কোন বাতিল জিনিস বিক্রির দোকানে। হয়তো কারও চিলেকোঠায়।
ওটা পেলেই আমি কিনে ফেলব। দাম যতই চেয়ে বসুক। আমি কিনবই।
পুরানো সেই রেকর্ডগুলো আছে আমার কাছে। কলের গানটা পেলেই হয়।
আমি কিনবই।
এমন কি এক বাক্স পিন পযন্ত কিনে রেখেছি আমি।
শুধু সেই পুরানো কলের গানটা পেলেই হল।
আমি আশায় আছি ।
রাস্কিন বন্ড এর – The Old Gramophone অবলম্বনে