মায়ের জন্য ভালবাসা

তোমরা অনেকেই প্রশ্ন কর, আমার লেখায় গাছ, লতা পাতা এই সব হাবিজাবির অত বর্ণনা ঘুরে ফিরে আসে কেন ?
বলা মুশকিল, হতে পারে সবুজ প্রকৃতির মধ্যে বড় হয়েছি বলে। অনেক সুন্দর ছিল তখনকার পরিবেশ। পথে ঘাটেই দেখা যেত রাংচিতার ঝোপ। নুনিয়া শাক। বাক্সা ঘাসের দঙ্গল। পুকুরে সবুজ পাতা ঝিঁঝিঁ দেখতাম অহরহ। শ্যাওলার ভেতরে লুকিয়ে গোল্লা ছুট খেলে রঙিন শাড়ি খলসে মাছ। কাচ পোকা তরতর করে হেঁটে যেত পুকুরের জলের উপর দিয়ে। যেন আয়নার উপর দিয়ে হাঁটছে।
আজ আর তেমন দেখা যায় না। মনে রাখবে মানুষ খুব বোকা প্রাণী। সব সময় পরিবেশ নষ্ট করে নিজেদের ক্ষতি করে। আর এর ফল কখনই ভাল হয় না।
আমরা তখন নগর খানপুর নামে এক জায়গায় থাকতাম । বাড়ির সামনে শীতলক্ষ্যা নদী। রাতের বেলা ইস্টিমারের ভৌ শব্দ শুনতে পেতাম ঘুমের মধ্যে। শীত কালে কেমন হিম ধরা একটা অচেনা বাতাস উড়ে আসতো নদীর ওপার থেকে। আর ছিল বিশাল এক তেপান্তরের মাঠ। বাংলার মাঠ বলতাম। কত হলুদ দুপুর, কমলা শীতের বিকেল আর বর্ষার নীল সন্ধ্যায় এই মাঠে সময় কাটিয়েছি। প্রকৃতির প্রথম পাঠশালা বলতে একটা কথা আছে। বাংলার মাঠ তেমন একটা জায়গা। অনেক অনেক গাছ পালা ছিল ওখানে। কত পাখি। প্রজাপতি। লাল ফুটকিওয়ালা পোকা। পিঁপড়ে। একদম বিদেশী ছবিওয়ালা বইয়ের মত।
আমি সারা দুপুর খুঁটে খুঁটে সেই সব গাছ পালা দেখতাম। একদিন আবিস্কার করলাম অদ্ভুত এক পাতা। দেখেই চিনলাম। তেজপাতা। অনেক দাম। রান্না করার সময় মায়ের খুব কাজে লাগে। ডাল বাগার না মাগার কি যেন করে ? ঐ যে শুকনো মরিচ আর তেল দিলে ডাল চিড় বিড় করে গর্জে ওঠে , তখন ও তেজপাতা লাগে। জিনিসটা দামি। কারন বাসন্তী পিসির মা সব সময় তেজপাতা ধার চাইতে চলে আসেন আমাদের বাড়িতে। সব সময় বলেন- বাজার থেকে কিনলেই তেজপাতা ফেরত দেবে। উনারা কেনে না। ফেরত ও দেয় না।
তো , এমন তেজপাতা গাছ আবিস্কার করে আমি মহাখুশি। আরে, এই জন্যই তো আগের দিনের লোকজন দূর দূর দেশে যেত। অনেক দামি মসলা নাকি পেত তারা। হতেই পারে। আমি যেমন সামান্য হেঁটে বাংলার মাঠে এসেই তেজপাতা আবিস্কার করে ফেললাম।
মুঠো ভর্তি করে ভাল দেখে বেছে বেছে অনেক পাতা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। খুশি মনে মাকে দেখালাম। মা হেসে বলল, ওটা নাকি তেজপাতা না। বন তেজপাতা। দাঁতরাঙ্গা বলে অনেকে। বিজ্ঞানিরা বলেন – Melastoma malabathricum । বিজ্ঞানিরা সহজ জিনিসের কঠিন নাম দেয় । খামাখাই। কবিরা যেমন সহজ জিনিস কঠিন করে বলে । বাতাসকে বলে সমীরণ। জানালাকে বলে বাতায়ন। কি বিচ্ছিরি শব্দ- বাতায়ন। মশক ঢুকছে বাতায়ন বন্ধ কর। হ্যাহ।
বন তেজপাতা এমনিতেই হয়ে থাকে। রান্নায় দেয়া যায় না। আর আমি বোকা , তাই খেয়াল করিনি পাতাগুলো তেজপাতার চেয়ে মোটা। কিন্তু বিশ্বাস কর, এই গাছে অপূর্ব সুন্দর বেগুনি রঙের ফুল ধরে। আর কবিরাজরা নাকি এই গাছের পাতা ফল দিয়ে কি সব ওষুধ বানায়। সেই ওষুধ খেলে কত জটিল আর কুটিল রোগ সেরে যায়।
সেইবার খুব লজ্জা পেলেও পরের বার দারুচিনি গাছ পেলাম। দারুচিনিও দামি মসলা। গাছের বাকল তুলে পকেট ভর্তি করে বাসায় এলাম। রান্নাঘরে গিয়ে মা কে দিলাম। মা হেসে ফেলল। ওগুলো নাকি ইউক্যালিপটাস গাছের বাকল। হায় হায়। তবে এই গাছটা ভাল না। প্রচুর জল খায়। মাটি শুকিয়ে যায়। অন্য গাছদের জন্য খারাপ।
পরের বার শিম গাছ আবিস্কার করলাম। বাতিল হয়ে যাওয়া রঙের ব্রাশের মত হলুদ ফুল হয়ে আছে। আর শিম শুঁকিয়ে শুটকির মত হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কেউ এখনও এই গাছের খোঁজ পায়নি বলে। আমি অনেক শিমের শুটকি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মা হেসে বলল- এটা শিরিষ গাছের ফল। শিম শুটকি না। খাওয়া যাবে না। তবে প্রতিবেশী পিচ্চি ভ্যাবলা এসে নিয়ে গেল ওগুলো। ওর পোষা টিয়া পাখি নাকি এই ফল খায়। যতসব।
এই গাছটাকে অনেকে রাজকড়ই বলে। আমাদের দেশের গাছ না। সেই আফ্রিকার মাদাগাস্কার থেকে ১৮৪১ সালে আমাদের বাংলায় এসেছে।
তো, এখন আমি বড়। মা আমাকে অনেক জ্ঞানী মনে করে। আমি অনেক দেশ ঘুরেছি, রাজ্যের বই পড়ি।হেন তেন। মাকে আমি কত বিষয়ে জ্ঞান দেই। কত গল্প বলি। প্রতিবার নতুন নতুন দেশ থেকে ফিরেই মজার মজার গল্প বলি মা-কে। মা ভাবে -আহা, ছেলে না জানি কত কিছু জানে। আমি কিন্তু তখনও বোকা ছিলাম এখনও বোকা আছি। আরও একটা মিল আছে, এখনও মাকে অবাক করে দিতে চাই। চেষ্টা করি। এখন যাই করি মা অবাক হয়।
মাকে অনেক ভালবাসি। সারা দুনিয়ার মসলা , দারুচিনি ,তেজপাতা দিতে চাই। আর চাই ভালবাসা দিতে।