দরদী বন্ধু

ইরাকের এক সম্পদশালী লোক। নাম খোযায়মা বিন বিশর। তাঁর ছিল প্রচুর ধন-দৌলত ও বিত্ত-বৈভব। কিন্তু ছিল না কৃপণতা ও রুঢ়তা। ছিল না অহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতা। অর্থের প্রাচুর্যে অনেক মানুষ বিলাসী হয়, অনেকে অপব্যয়ী হয়। আবার অনেকে হয় নির্দয়-নিষ্ঠুর। কিন্তু খোযায়মার মধ্যে এর কোনোটাই ছিল না। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন প্রাণভরে। দান করতেন অকাতরে। দানের প্রত্যাশা নিয়ে লোকজন তাঁর কাছে আসত। ভিড় জমাত। কিন্তু তিনি কাউকেই বিমুখ করতেন না। খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। বঞ্চিত করতেন না তাঁর দান ও ধন থেকে; ভালোবাসা ও অনুগ্রহ থেকে। মাটির মতো সহজ-সরল এ মানুষটির দান ছিল সবার জন্য, সবসময়ের জন্য। তাঁর করুণা ও অনুগ্রহ ছিল দিবা-রাত্র ও সর্বত্র। এভাবে মানুষকে দান করে, ভালোবাসায় সিক্ত করে সুখেই কাটছিল তাঁর জীবন। দান করলে ধন বাড়ে, ধনে বরকত হয়, কমে না,এটাই সাধারণ রীতি। এটাই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। আল্লাহ পাকের এ নিয়মই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে; বরং বলা যায় সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে। তবে মাঝে মধ্যে আল্লাহ পাক এ নিয়মের ব্যতিক্রমও করেন। তখন উদ্দেশ্য হয় বান্দাকে পরীক্ষা করা এবং এই পরীক্ষার মাধ্যমে তাকে মর্যাদার সুউচ্চ আসনে সমাসীন করা। খোযায়মা বিন বিশ্রের বেলায়ও এমনটি হয়েছিল। আল্লাহ পাক তাঁকে পরীক্ষা করেছিলেন; কঠিন পরীক্ষা। খুশির কথা, সেই পরীক্ষায় তিনি কৃতকার্যও হয়েছিলেন। খোযায়মার পরীক্ষা শুরু হলো। মাল কমতে লাগল। এই যে কমা শুরু হলো আর বন্ধ হলো না। অর্থ-সম্পদ কমতে কমতে একদিন তিনি নিঃস্ব হলেন। গরীব হলেন। হয়ে গেলেন একেবারে রিক্তহস্ত। ফলে অভাব-অনটন দেখা দিল। ক্ষুধা-অনাহার সঙ্গী হলো। খোযায়মার এই দুর্দিনে আÍীয়-স্বজনরা এগিয়ে এল। এগিয়ে এল বন্ধু-বান্ধবরাও। আর স্ত্রীর করুণ মুখপানে তাকিয়ে তিনিও তাদের দান গ্রহণে ‘না’ বলতে পারলেন না। পারলেন না, কোনো ধরনের ‘অপারগতা’ প্রকাশ করতে। কিন্তু রক্তের টান আর কতকাল? বন্ধু-বান্ধবের সাহায্য আর কতদিন? একসময় রক্তের আÍীয়রা দূরে সরে গেল। বন্ধু-বান্ধবরাও পিছিয়ে গেল। ধীরে ধীরে বন্ধ হলো অনুগ্রহের দুয়ার। খোযায়মার আলো ঝলমল সংসারে নেমে এল তিমির অন্ধকার। যে ব্যক্তির অবারিত দানে সিক্ত হতো কাছের-দূরের অসংখ্য মানুষ, যার দানের প্রত্যাশায় নিত্যদিন ভিড় জমাত অগনিত বনী আদম, যার দয়া আর অনুগ্রহে নতুন প্রাণ ফিরে পেত, এতিম, অসহায় ও অভাবী লোকজন, যার সাহায্যে উপকৃত হতো হাজারো ইনসান, সেই লোকটির আজ চলার মতো পয়সা নেই, খাওয়ার মতো অন্ন নেই, পরিধানের ভালো বস্ত্র নেই, রান্না করার কিছু নেই। ওহ! একজন বিত্তশালী লোকের জন্য এর চেয়ে কঠিন পরীক্ষা আর কী হতে পারে? কিন্তু খোযায়মা এই কঠিন অবস্থায়ও ভেঙ্গে পড়লেন না। হতাশ হলেন না। কেনই বা তিনি হতাশ হবেন? মানুষের দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে বলে কি আল্লাহর দুয়ারও বন্ধ হয়ে যাবে? না, তা হবে না। হতেই পারে না। আল্লাহর দুয়ার সর্বদাই খোলা থাকে। বন্ধ হয় না কখনো। একজন প্রকৃত মুমিন এই বিশ্বাসকেই সারাক্ষণ লালন করে তার হৃদয়ের মনিকৌটায়। খুযায়মার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এ পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হবেন, পাশ করবেন। এবং ভালোভাবেই পাশ করবেন। কিন্তু তার স্ত্রী? সে কি পারবে ধৈর্যধারণ করতে? পারবে কি সীমাহীন কষ্ট বরদাশ্ত করতে? যদি না পারে? আর পারলেই বা কতদিন পারবে? খোযায়মা তাঁর জীবন-সঙ্গিনীকে আর কষ্ট দিতে চাইলেন না। চাইলেন না তাকে দুঃখ-মসীবতের অংশীদার বানাতে। তাই একদিন তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন। কাছে বসালেন। একান্ত কাছে। তারপর পরম মমতার সুরে বললেন, প্রিয়তমা! এ পর্যন্ত তুমি অনেক কষ্ট স্বীকার করেছ। অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছ। আমি চাই না যে, আমার সঙ্গী হয়ে তুমি আরো কষ্ট ভোগ করো, আরো বিপদ-মুসীবতের সম্মুখীন হও। বরং আমি চাই যে, দুঃখ-কষ্ট যা হওয়ার, আমারই হোক, তোমার না হোক। আমার ইচ্ছা হলো, তুমি তোমার পিত্রালয়ে চলে যাও। সেখানে আরামে দিনাতিপাত করো। সুখে-শান্তিতে বসবাস করো। আর আমি? হ্যাঁ, আজ থেকে আমি আল্লাহ ছাড়া আর কারো সাহায্য নেব না। দরজা বন্ধ করে ঘরেই বসে থাকব। হয় আল্লাহর সাহায্য আসবে, নয় সেখানেই আমার মৃত্যু হবে। স্ত্রী বললেন, প্রিয়তম! আপনি কী করে ভাবতে পারলেন যে, আমি আপনাকে কষ্টে রেখে স্বার্থপর লোকদের মতো কেটে পড়ব? বাপের বাড়ি চলে যাব? না, তা কখনোই হতে পারে না। বরং আপনার সুখের সময় আমি যেমন আপনার পাশে ছিলাম, তেমনি দুঃখের সময়ও আপনার পাশেই থাকব। যদি মরতে হয়, একসাথেই মরব। আমার ঘর আপনার সাথে, আমার করবও হবে আপনার পাশে। দোয়া করি, আল্লাহ পাক যেন আমাদেরকে পরকালেও একসাথেই রাখেন। স্ত্রী কথায় খোযায়মা যারপর নাই আনন্দিত হলেন। বললেন, তোমার প্রতি আমার ধারণা এমনই ছিল। তবু তোমার মনের কথাটা পরিস্কার করে জেনে নিলাম। সেদিন থেকে অকৃতজ্ঞ মানুষদের সাথে অভিমান করে ঘরকে ‘কবর’ বানিয়ে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকলেন তারা। হায়! এতবড় দানশীল মানুষের আজ এই দশা! এত কষ্ট!! আফসোফ! গোটা জীবন যিনি মানুষের উপকার করলেন, ধনে-দানে ধন্য করলেন- সেই উপকারী বন্ধুর চরম দুর্দিনে কেউ আজ খোঁজ-খবর নিল না, কেউ পাশে এসে দাঁড়াল না, সবাই কেটে পড়ল!! পাঠক! এসব অকৃতজ্ঞ মানুষের প্রতি খোযায়মার যদি অভিমান হয়, তাহলে কি বড় অন্যায় হবে? ০০০ তখন আরব উপদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন ইকরামা ফাইয়ায। দানের ব্যাপারে তিনিও ছিলেন মুক্তহস্ত। মানব কল্যাণে ধন-সম্পদ ব্যয়ের মধ্যে তিনিও খুঁজে পেতেন, তৃপ্তি ও আনন্দ। লাভ করতেন গভীর প্রশান্তি। একদিন তিনি পরিষদ নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় তাঁর মনে হলো খোযায়মার কথা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, খোযায়মাকে বেশ কয়েকদিন যাবত দেখছি না যে! তাঁর কোনো অসুখ-বিসুখ হয় নি তো? একজন বলল, আমারও তো একই জিজ্ঞাসা। দূরের কোনো সফরে গেছেন কিনা কে জানে! আরেকজন বলল, আমার জানা মতে, শহরেই তিনি আছেন। তবে মানুষের সাথে অভিমান করে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে দরজা বন্ধ করে ঘরে পড়ে আছেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছেন, দরজা খুলে আর কখনো মানুষের সমাজে বের হবেন না। কেন কেন? চরম উৎকণ্ঠা ও বিস্ময় নিয়ে কারণ জানতে চাইলেন ইকরামা ফাইয়ায। লোকটি তখন শাসনকর্তাকে সবকিছু খুলে বলল। সবশুনে তিনি বললেন, খোযায়মাকে সাহায্য করার মতো ধনী লোক কি এই শহরে নেই? হুজুর! লোক তো আছে। আছে ধনও। কিন্তু লোক আর ধন থাকলেই তো চলবে না! মনও লাগবে!! কথাবার্তার এ পর্যায়ে এসে ইকরামা ফাইয়ায একদম নীরব হয়ে গেলেন। মনে হলো, কী যেন চিন্তা করছেন তিনি। খানিক পর নীরবতা ভঙ্গ করে পুনরায় কথা শুরু করলেন তিনি। তবে খোযায়মার প্রসঙ্গ নিয়ে নয়, অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে। এতে পরিষদের সবাই বেশ অবাক হলো। আর যারা ভেবেছিল, এবার হয়তো খোযায়মার দুঃখের অবসান হবে, তারাও বেশ হতাশ হলো। ০০০ এদিকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই একে একে তিনদিন না খেয়ে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়লেন। তবে স্ত্রীর দুর্বলতা ছিল অপোক্ষকৃত বেশি। তার চেহারার দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না। স্ত্রীর এই করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে খোযায়মা আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি অস্থির হয়ে ভাবলেন, আমার মৃত্যু হয় হোক, কিন্তু অনাহারে থেকে প্রিয়তমা স্ত্রীর করুণ মৃত্যু, সে আমি সইব কেমন করে? তার প্রাণ রক্ষার জন্য কিছু একটা আমাকে করতেই হবে। খোযায়মা দরজা খুললেন। ঘর থেকে বেরুলেন। ক্ষণিকের তরে ভুলে গেলেন আগের সেই প্রতিজ্ঞার কথা। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? কার কাছে সাহায্য চাইবেন? এ মুহূর্তে তাঁর মনে হলো, তাঁর দান ও সহযোগিতায় যারা বড় হয়েছে, যাদের আজ কোনো অভাব-অনটন নেই, তাদের কাছেই যাবেন। তাদের কাছেই সাহায্য চাইবেন। একথা ভেবে অনাহারকিষ্ট দেহের ভার বহুকষ্টে বহন করে কিছুদূর এগুলেনও, কিন্তু আÍমর্যাদার ভার বহন করা তাঁর পেক্ষ আর সম্ভব হলো না! এতদিনের ‘উপরের হস্ত’ আজ পরিণত হবে ‘নিচের হস্তে’? এতদিনের দাতা আজ হবেন গ্রহীতা? তাও আবার একদল অকৃতজ্ঞ মানুষের দুয়ারে উপস্থিত হয়ে? অসম্ভব! তা হতেই পারে না। ধনে গরীব হলেও মনে তো তিনি গরীব হননি! অথচ মনের প্রাচুর্যই হলো বড় প্রাচুর্য! তাহলে কেন তিনি ধনের জন্য মনকে কুলষিত করতে যাবেন– এই অকৃতজ্ঞদের কাছে? খোযায়মা আবার ফিরে এলেন তাঁর ‘ঘরের কবরে’! ভরসা করে বসে রইলেন একমাত্র আল্লাহর উপরে॥ ০০০ গভীর রাত। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে শুয়ে আছেন। ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ঘুম আসছে না। এমন সময় কে যেনো দরজায় আওয়াজ দিল। খোযায়মার দেহে শক্তি নেই। নড়াচড়ার মতাটুকুও নিঃশেষ প্রায়। তবু অনেক কষ্টে দরজা খুললেন। দেখলেন, মুখোশপরিহিত এক ঘোড়সওয়ার। দরজা খুলতেই ঘোড়সওয়ার এগিয়ে এল। কিন্তু ঘোড়া থেকে নামল না। কোনো কথাও বলল না। এ অবস্থা প্রত্য করে খোযায়মা বেশ বিস্মিত হলো। তাঁর বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই ঘোড়সওয়ার একটি ভারী থলে তাঁর দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু খোযায়মা থলের দিকে হাত না বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি? কী আপনার পরিচয়? ঘোড়সওয়ার বলল, আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। আল্লাহ পাকই আমাকে আপনার দুয়ারে নিয়ে এসেছেন। আর এই যে থলেটি দেখছেন, এটি একজন ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষ থেকে এক ‘মানব-দরদী’র জন্য সামান্য হাদিয়া। দয়া বা দান নয়। আল্লাহ ছাড়া কেউ এর সাক্ষীও নেই। আপনার পরিচয় না জেনে আমি এটা গ্রহণ করব না। খোযায়মা সসংকোচে বললেন। আমি মানুষের অকৃতজ্ঞতার মাশুল আদায় করি– এ-ই আমার পরিচয়। আরেকটু খুলে বলুন। মাফ করুন। এ বলে থলেটি খোযায়মার সামনে রেখে ঘোড়সওয়ার চোখের পলকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন এবং মুহূর্তেই অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন।

কে এই দরদী বন্ধু? কে এই আঁধার রাতের ঘোড়সওয়ার? তিনি কি মাটির মানুষ, না আসমানের ফেরেশ্তা? দেখতে তো মাটিরই মানুষ! কিন্তু যদি বলি, মহত্ত্বে ফেরেশ্তা থেকেও উঁচুতে তার অবস্থান, তাহলে ‘না’ বলার কোনো উপায় আছে কি? কিন্তু তাঁর পরিচয়? হ্যাঁ, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন আরব উপ-দ্বীপের শাসনকর্তা ইকরামা ফাইয়ায। সেদিন খোযায়মার অভাবের কথা শুনে চার হাজার স্বর্ণমুুদ্রার একটি থলে নিয়ে নিজেই তিনি হাজির হয়েছিলেন তাঁর ভাঙ্গা কুটিরে! তারপর ফিরে এসেছিলেন একবুক তৃপ্তি ও গভীর প্রশান্তি নিয়ে। ০০০ শহরের শাসনকর্তা ইকরামা ফাইয়ায যখন থলে নিয়ে নিজ বাসভবন থেকে বের হয়েছিলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন, কেউ তাকে দেখেনি, কেউ টের পায়নি। কিন্তু আর যা-ই হোক, সজাগ ও বুদ্ধিমতি স্ত্রীর চোখ ফাঁকি দেওয়া কি এত সহজ? না, মোটেও সহজ নয়। তাইতো দেখা গেল, ফিরে আসার পরপরই স্ত্রী অতি সন্তর্পণে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, এতো রাতে এই বেশে কোথায় গিয়েছিল শহরের মহামান্য শাসনকর্তা? এই তো জরুরি একটা কাজে! মনে হয়, কিছু লুকানোর চেষ্টা চলছে। প্রেমাম্পদ! আমি তো আপনার জীবনসঙ্গিনী, অর্ধাঙ্গিনী। আমার কাছ থেকে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা উচিত হবে কি? তুমি জানতে চেষ্টা করো না। লুকানো জিনিসকে লুকিয়েই থাকতে দাও। এ আমার কৌতূহল। আর আপনি তো জানেন, মেয়েরা তাদের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারে না! চেষ্টা করে দেখো। চেষ্টা করলেও কাজ হবে না। অন্ততঃ আপনার বেলায়। সুতরাং দেরী না করে বলে ফেলুন, কী উদ্দেশ্য ছিল আপনার এই ছদ্মবেশী গোপন অভিযানের? ইকরামা চেয়েছিলেন, তার এই দানের কথা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানবে না। কিন্তু এখন? হ্যাঁ, এখন তিনি না জানিয়ে পারলেন না। কেননা, কে জানে স্ত্রীর মনে সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হয় কিনা? তাই তিনি বললেন, শুনতেই যদি চাও, তাহলে আল্লাহর নামে শপথ করে বলো, কোনোদিন কারো কাছে তা প্রকাশ করবে না। স্ত্রী মৃদু হেসে বললেন, আপনার ইচ্ছাকে অবশ্যই আমি সম্মান করব। ০০০ ইকরামা একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর প্রিয় জীবনসঙ্গিনীর চোখে চোখ রেখে বললেন, প্রেয়সী আমার! তুমি কি জানো, উত্তপ্ত মরুভূমিতে একজন মুসাফিরের জন্য একটু ছায়ার কত প্রয়োজন? হোক না তা বাবলা গাছের ছায়া! লাখ দিনারের বিনিময়ে হলেও কি সে তা পেতে চাইবে না?

লাখ দিনার কেন? আরও বেশি হলেও চাইবে। কেননা এ সময় তো প্রাণ তার ওষ্ঠাগত থাকে। আর প্রাণ চলে গেলে লক্ষ দিরহাম কী কাজে লাগবে তার? ধন্যবান তোমাকে। এবার হাশরের দিন ও হাশরের মাঠের ভয়াবহ অবস্থাটা একটু চিন্তা করে দেখো তো! যেখানে সূর্য চলে আসবে মাথার উপরে! যেখানে লোকজন হাবুডুবু খাবে নিজের ঘামে! যেদিন কোনো ছায়া থাকবে না আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া! যে দিনটা হবে দুনিয়ার পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান!! প্রিয়তম! সেই কঠিন দিনে আরশের একটুখানি ছায়া লাভের সওদা করতেই বেরিয়েছিলাম আমি। তুমি তো এই হাদীস নিশ্চয়ই পড়েছ যে, যারা দান করে অতি গোপনে, এমনকি ডান হাতে দান করলে বাম হাতও টের পায় না, তাদেরকে ডাকা হবে সেদিন আরশের ছায়াতলে। এতটুকু শুনতেই আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বুদ্ধিমতী স্ত্রী বলে ওঠল, বুঝেছি প্রিয়তম! আর বলতে হবে না। সত্যি আপনি বড়ো ভাগ্যবান। আর আপনার মতো মহৎপ্রাণ লোকের স্ত্রী হতে পেরে আমিও বড়ো ভাগ্যবতী। আহা! সৎপথে স্বামীর দান করা দেখে জগতের সকল স্ত্রী যদি এমনই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করত!! সবাই যদি স্বামীর দান করার বিষয়টিকে এভাবেই হাসিমুখে বরণ করত!!! ০০০ সে সময় খলীফা ছিলেন সোলায়মান বিন আব্দুল মালিক। যিনি এককালে ছিলেন খোযায়মার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাই মুখোশধারী ঘোড়সওয়ার চলে যাওয়ার পর তিনি খুব একটা দেরী করলেন না। দু’দিন পরেই ‘আঁধার রাতের দরদী বন্ধু’ ও তার খবর নিয়ে হাজির হলেন খলীফা সোলাইামানের কাছে। অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে খলীফাও তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। আদর-আপ্যায়ন ও খানিক বিশ্রামের পর দু’বন্ধুর কথাবার্তা শুরু হলো। কথাবার্তা ও আলাপচারিতার এক পর্যায়ে খোযায়মার মুখ থেকে মুখোশধারীর গল্প শুনে খলীফা খুবই কৌতূহলী হয়ে ওঠলেন। বললেন, ‘বন্ধু! যেভাবে পারো, মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারের পরিচয় খুঁজে বের করো। উপযুক্ত পুরস্কার তার প্রাপ্য’। আরো কিছু কথাবার্তা বলে খলীফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁর দরবার থেকে বের হয়ে এলেন খোযায়মা। এবার তাঁর নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার পালা। ফিরে যাওয়ার পালা। কিন্তু তাঁর জন্য এখনই এবং এ মুহূর্তেই যে অপোক্ষ করছে এক নতুন চমক, অবিশ্বাস্য পুরস্কার, তা কে জানে? রওয়ানা হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হলো খলীফার সীল ও স্বার সম্বলিত একটি ‘পরওয়ানা’। যাতে লিখা ছিল, ‘আজ থেকে তুমি আরব উপদ্বীপের নতুন শাসনকর্তা।’ প্রিয় পাঠক! পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে, বিপদের সময় ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলে আল্লাহ পাক এভাবেই পুরস্কৃত করেন তার বান্দাদেরকে। তিনি কাউকে পুরস্কৃত করতে চাইলে এভাবেই করেন। মানুষের কল্পনাও অনেক সময় তাঁর সাহায্য ও অনুগ্রহের সীমানা স্পর্শ করতে পারে না। চিন্তা করে দেখুন তো! আল্লাহ পাকের করুণা কত অসীম! তাঁর দান কত মহান!! দু’দিন আগেও যে খোযায়মা অনাহারে দিন কাটিয়েছেন, আজ সে খোযায়মাই খলীফার দরবার থেকে শাসনকর্তা হয়ে ফিরে আসছেন! দান করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পরও যিনি মানুষের কাছে হাত পাতেননি; ভরসা করেছেন শুধু আল্লাহর উপর, এমন ব্যক্তির জন্যে তো এ ধরনের পুরস্কারই মানায়। বরং বলা যায় এমন পুরস্কারই তাঁর ন্যায্য পাওনা। সবরের গাছে তো মেওয়া ফলবেই! তাওয়াক্কুলের বাগানে তো ফুল ফুটবেই!!

০০০

খোযায়মার পরীক্ষা তো শেষ হলো। এবার শুরু হলো ইকরামার পরীক্ষা। কী ছিল সেই পরীক্ষা? কেমন ছিল সেই পরীক্ষার ধরন? ইকরামার পরীক্ষাও কি খোযায়মার পরীক্ষার মতো কঠিন ছিল? হ্যাঁ, কঠিনই ছিল তাঁর পরীক্ষা। শক্তই ছিল তাঁর ইম্তেহান। পরীক্ষার প্রথম ধাপ তো এই ছিল যে, খোযায়মাকে যে উপদ্বীপের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হলো, এতদিন সেই উপদ্বীপেরই শাসনকর্তা ছিলেন ইকরামা ফাইয়ায। যেদিন খোযায়মার হাতে নতুন শাসনকর্তা হওয়ার ‘পরওয়ানা’ তুলে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেদিনই ইকরামার হাতে পৌঁছে গিয়েছিল তার ‘অব্যহতিপত্র’। প্রিয় পাঠক! কল্পনা করুন তো!! যে খোযায়মার দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে রাতের আঁধারে স্বর্ণমুদ্রার থলে নিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন, সেই খোযায়মাকেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হলো! আর তাকে করা হলো, বরখাস্ত!! ওহ! আল্লাহর লীলা কত বিচিত্র!! অবশ্য খোযায়মার কাছে তখনও উদ্ঘাটিত হয়নি সেই রহস্য!

০০০

খোযায়মা এখন নতুন শাসনকর্তা। দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললেন তিনি। গন্তব্য ‘রাকা’ শহর। যেখানে রয়েছে শাসনকর্তার কার্যালয় ও বাসভবন। এ খবর জানতে পেরে শহরের জনগণ বাইরে বেরিয়ে এল এবং শহরের নিকটবর্তী হতেই তারা নতুন শাসনকর্তাকে স্বাগত জানাল। আশ্চর্যের কথা হলো, জনতার সেই ভিড়ে ছদ্মবেশে মিশে ছিলেন সাবেক শাসনকর্তা ইকরামা ফাইয়াযও! আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, তখন ইকরামার মনে কোনো ক্ষােভ ছিল না! ছিল না পদ হারানোর বেদনা বা বিরক্তির কোনো চিহ্ন!! বরং তাঁর হাসি ছিল আগের মতোই অকৃত্রিম, আগের মতোই দিলখোলা। আল্লাহু আকবার! কত মহান, কত উদারচিত্তের মানুষ ছিলেন তাঁরা!

০০০

তখন নিয়ম ছিল নতুন শাসক পুরাতন শাসকের কাছ থেকে কড়ায় গণ্ডায় হিসেব বুঝে নিতেন এবং কোনো রকম অনিয়ম ধরা পড়লে তড়িৎ বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। খলীফার পক্ষ থেকে তেমন মতাই তাকে দেওয়া হতো। সেই নিয়ম অনুযায়ী নতুন শাসক খোযায়মা পুরাতন পুরাতন শাসক ইকরামার কাছে হিসেব তলব করলেন। হিসেব নিতে গিয়ে খোযায়মার মনে হলো, খরচ খাতের একটি জায়গায় অনিয়ম হয়েছে। এদিকে সাবেক শাসনকর্তা ইকরামাও তার সন্তোষজনক কোনো জবাব দিলেন না। লুকিয়ে রাখা ‘আসল কথা’টি লুকিয়েই রাখলেন। ভাবলেন, যে কথা আমি ও আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানে না, যে কাজের সাক্ষী একমাত্র মহান আল্লাহ পাক, সেই কথা, সেই কাজ গোপনই থাকুক। যদি এজন্য আমার সামনে নতুন কোনো বিপদ আসে, আসুক। তাতে আমার কোনো পরওয়া নেই। কারণ, হাশরের ময়দানে তো আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারব, হে মাওলায়ে পাক! আঁধার রাতে একমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য যে কাজটি আমি করেছিলাম, সেটি আমি অপারগ হয়ে একমাত্র স্ত্রী ছাড়া আজো সবার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছি। ফল যা হবার তাই হলো। আরেকবার ইকরামার ভাগ্য-বিপর্যয় ঘটল। জেল গেইট পার হয়ে তাঁকে যেতে হলো আরো অনেক ভিতরে, কারা অভ্যন্তরে! ওহ! নিজেকে এবং নিজের সৎকর্মকে লুকিয়ে রাখার কী কঠোর সাধনা! আরশের ছায়া প্রাপ্তির আশায় কত ভয়াবহ পরিস্থিতিকে মেনে নিচ্ছেন এক আল্লাহওয়ালা শাসক!! আহা! যদি এমন মানুষ দ্বারা জগতটা পূর্ণ হতো!! অন্ততঃ অধিকাংশ মানুষ যদি এমন হতো, তাহলে অশান্তি ও বঞ্চনার এই পৃথিবীতে কি শান্তির সুবাতাস বইত না? পরিবার, সমাজ ও দেশ কি আরো সমৃদ্ধশীল হতো না?

০০০

কারাগারের অন্ধ কুঠরীতে ইকরামা এখন বন্দী। ফুলের øিগ্ধ সুবাস আর রেশম কোমল বিছানায় কেটেছে যার জীবন, তিনি এখন শক্ত রুটি খেয়ে আর চটের বিছানায় শুয়ে দিন কাটান। একসময় যার মজলিশ মানুষের আনাগুনায় মুখরিত থাকত, যার অঙ্গুলি হেলনে উঠ্বস্ করত হাজারো মানুষ, সেই তিনি আজ নির্জন কামরায় অনুমান করে দিন রাতের পার্থক্য করেন! অদ্ভুত! বড় অদ্ভুত মানুষের জীবন!! কিন্তু এই কঠিন অবস্থার মধ্যেও ইকরামা স্থির- প্রশান্ত। একেবারেই ভাবলেশহীন তিনি। এরূপ ভয়ানক পরিস্থিতিতে নিপতিত হওয়া সত্ত্বেও এমন অপূর্ব ও নিরুদ্বিগ্ন সুন্দর মুখচ্ছবি খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু ইকরামার স্ত্রী? প্রাণের স্বামী বন্দী হওয়ার পর তার মাথায় যেন বিপদ-মুসীবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ল। আসলে কোনো সম্ভ্রান্ত মানুষ যখন বন্দী হন, তখন তার যতো না কষ্ট হয়, তার চেয়ে বহুগুণে বেশি কষ্ট হয় ‘গৃহ-কারাগারে’ আবদ্ধ তাঁর পরিবার পরিজনের। কেননা এ সময় তারা প্রিয়জনের বিচ্ছেদ-যন্ত্রণার পাশাপাশি মন্দ প্রতিবেশীদের বিদ্রুপ-যন্ত্রণায়ও ভোগেন। ইকরামার স্ত্রীও এমনই যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে চললেন। প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা ভালো তারা অবশ্য তাকে যন্ত্রণা দেয় না বরং উল্টো সুন্দর সুন্দর পরামর্শ দেয়। কেউ কেউ বলে, আপনি নতুন শাসনকর্তা খোযায়মার কাছে যান। কেননা তিনি দয়ালু মানুষ। অবলা নারীর অসহায়ত্ব অবশ্যই তাঁর হৃদয়কে নাড়া দিবে। ফলে আপনার স্বামীর মুক্তির ব্যাপারটি নতুন করে বিবেচনায় নিবেন তিনি। ইকরামার স্ত্রী এসব পরামর্শ শোনেন আর ভাবেন, তার কাছে তো স্বামী-মুক্তির আরেকটি মজবুত উপায়ও রয়েছে। যা অবলম্বন করলে শুধু স্বামী-মুক্তিই নয়, দুঃখের জীবন শেষ হয়ে তাদের জীবনে পুনরায় উদ্ভাসিত হতে পারে শান্তি-সুখের রঙিন আলো! নতুন শাসককে তিনি যদি শুধু বলেন, ‘হে অকৃতজ্ঞ আমীর! মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারকে স্মরণ করো। স্মরণ করো, আঁধার রাতের দরদী বন্ধুকে’ তাহলেই তো সব বিপদ দূর হয়ে যেতে পারে। আসান হয়ে যেতে পারে যাবতীয় সমস্যা। কিন্তু বলতে যে মানা! তিনি যে ওয়াদাবদ্ধ!! স্বামী যে বলেছেন, আমার এই গোপন অভিযানের খবর আল্লাহ ছাড়া আর কেউ যেন না জানে! স্বামীকে দেওয়া প্রতিশ্র“তির অমর্যাদা, কী করে করতে পারেন তিনি? হোক না তা স্বামীর জীবন রাক্ষর জন্যেই! ‘জীবন’ বড় না ‘ওয়াদা’ বড়?

০০০

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? কতদিন স্বামীকে জেলে রেখে স্ত্রী আরামে থাকতে পারে? কতদিন তাঁর বিরহ-যন্ত্রণা ভোগ করতে পারে? এক এক করে তো আজ ত্রিশটি দিন গত হলো। পূর্ণ একটি মাস যন্ত্রণার আগুনে দগ্ধ হলো ইকরামার স্ত্রী। এবার কী হবে? হ্যাঁ, যা হবার তাই হবে। যা হবার তাই হলো। স্বামীর প্রতি নারীর চিরন্তন মমতা ভেঙ্গে দিল– প্রতিশ্র“তির প্রাচীর! ভাসিয়ে নিল ধৈর্যের বাঁধ!! ইকরামা ফাইয়াযের স্ত্রী তার খাস দাসীকে ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। তারপর তাকে পাঠিয়ে দিলেন নতুন শাসনকর্তা খোযায়মা’র মহলে। বুদ্ধিমতি দাসী খোযায়মার সামনে হাজির হয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, মুহতারাম আমীর! সেই মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারকে স্মরণ করুন। দাসীর কথায় চমকে উঠলেন খোযায়মা। কণ্ঠ তাঁর অস্থির হয়ে ওঠল। জিজ্ঞেস করলেন, কে তিনি? কোথায় তিনি? আজ অনেকদিন যাবত তাঁকে আমি খুঁজে ফিরছি। তাঁকে যে আমার বড্ড প্রয়োজন!! দাসী বলল, তিনি তো আপনার আদেশে আপনার কারাগারেই বন্দী আছেন! কী বললে আমার আদেশে আমার কারাগারে বন্দী? হ্যাঁ। তাঁর নাম বলো তাড়াতাড়ি। ইকরামা। ইকরামা ফাইয়ায। ইকরামা!! ‘ইকরামা’ নামটি শুনতেই গোটা জগত যেনো খোযায়মা’র সামনে দুলে ওঠল। তাঁর মনে পড়ে গেল, কোষাগারে রক্ষতি চার হাজার দিনার সংক্রান্ত ‘অসীয়ত নামা’র কথা। যার কোনো সদুত্তর তিনি ইকরামার কাছে পাননি। এখন সবকিছু যেনো তাঁর সামনে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয়ে গেল। খোযায়মার আর দেরী সহ্য হলো না। তিনি ছুটলেন কারাগারের দিকে। উপস্থিত লোকজনও হতভম্ব হয়ে অনুসরণ করল আমীরকে। অবশেষে ইকরামাকে কারামুক্ত করে তার সামনে যখন খোযায়মা দাঁড়ালেন, তখন লজ্জায় আর অনুশোচনায় মাথা উঠাতে পারছিলেন না তিনি। শুধু অবনতমস্তকে বলতে পেরেছিলেন, আমার ভুল ক্ষমা করো বন্ধু! ইকরামা কোনো উত্তর দিলেন না। তাঁর মুখমণ্ডলে মুক্তির আনন্দও দেখা গেল না। তিনি শুধু আফসোস করে বললেন, বুদ্ধিমতি স্ত্রী একি করল! এরপর কী হলো? এরপর খোযায়মা কালবিলম্ব না করে ইকরামাকে নিয়ে খলীফার দরবারে হাজির হলেন। সালাম ও আদব নিবেদনের পর বললেন, আমীরুল মুমেনীন! সেই মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারের পরিচয় আমি পেয়েছি। তিনি আর কেউ ননÑ তিনি হলেন, সাবেক শাসনকর্তা, ইকরামা ফাইয়ায! ইকরামা ফাইয়ায!! খলীফার কণ্ঠে সীমাহীন বিস্ময়। সামান্য সময় পর ইকরামা হাজির হলেন খলীফার দরবারে। তাঁকে দেখেই খলীফা উচ্ছসিত কণ্ঠে বললেন, ইকরামা! তোমার মহত্ত্ব আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। বলো, কী পুরস্কার চাও তুমি। আমীরুল মুমেনীন! আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া আর কোনো পুরস্কার চাই না। ইকরামার এ কথায় খলীফা আরেক দফা মুগ্ধ হলেন। কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, কিন্তু আমি তোমাকে পুরস্কৃত করতে চাই। তোমার মতো মহৎপ্রাণ ব্যক্তিরা পুরস্কৃত না হলে আমার হৃদয়ে কখনোই প্রশান্তি আসবে না। এরপর খলীফা ইকরামা ফাইয়াযকে আরমেনিয়া ও আজার-বাইজানসহ আরব উপ-দ্বীপের শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেন। আর বললেন, খোযায়মার ভাগ্য এখন তোমার হাতে। তাকে বরখাস্ত করা কিংবা সহকারীরূপে স্বীয় পদে বহাল রাখা, এ দুয়ের যে কোনো একটি গ্রহণ করতে পারো তুমি। খলীফার কথা শুনে ইকরামা ফাইয়ায আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন এবং খোযায়মার হাত ধরে বললেন, তোমার চেয়ে ভালো মানুষ কোথায় পাবো আমি? এ বলে তিনি তাকে বুকে টেনে নিলেন। খলীফা সোলায়মানের মৃত্যু পর্যন্ত ইকরামা ও খোযায়মা স্ব স্ব পদে বহাল ছিলেন। আর তাঁদের বন্ধুত্ব? সে কি আর বলতে হয়? এমন দু’টি পবিত্র হৃদয়ের মাঝে যে বন্ধুত্বের বন্ধন, তা কি কখনো ছিন্ন হতে পারে?