পলাতক শয়তান

এটা আমার পিচ্চিবেলার কাহিনি।
অনেকে বলে আমি নাকি তখন খুব দুষ্ট ছিলাম। এই সব শোনা কথায় তোমরা কান দেবে না। লোকে অমন ফালতু কথা প্রচুর বলবে। খোঁজ নিয়ে দেখ ,লোকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়েও বাজে কথা বলে। উনি নাকি জমিদারের ছেলে বলে সারা দিন শুয়ে বসে থাকতেন। আর লুচি – পায়েস খেতেন। ডাহা মিথ্যা কথা। উনি দিন রাত লিখতেন। পৃথিবীর অন্য কোন মানুষ একা এত বই লিখে রেখে যেতে পারেননি। কেউ না।
বাদ দাও সেই সব। আমি আমার গল্প বলি।
ক্লাস ফোরে পড়ি, বেশ মারামারি করতাম।এটা আমাদের এলাকার ঐতিহ্য। একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে মারামারি হয়েছিল পাশের মিশনপাড়ার ছেলেদের সাথে। ঐ পাড়ার নাম মিশনপাড়া । কারন একটা বড় রামকৃষ্ণ মঠ আছে ওখানে।
খেলার সময় ওরা আমাদের ইচ্ছা করে ব্যাথা দিচ্ছিল সেই জন্যই ঝগড়া। ঝগড়া থেকে মারামারি। সেই থেকে ওদের কাউকে আমাদের মহল্লায় পেলে আমরা ধাওয়া করতাম। আবার ওরা আমাদের কাউকে পেলে ধাওয়া করতো।
বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ব্যাপার। তোমরা বুঝবে না।
মাঝে ওদের মহল্লার আবু বককরকে একা পেলাম আমরা। দোকান থেকে দুই পোয়া আটা কিনে বাসায় ফিরছিল। আমরা ওকে ধরে ‘মু হা হা হা’ করে হেসে ওর মাথায় সব আটা ঢেলে দিলাম। সাদা ভূত হয়ে ফিরে গেল আবু বককর। আমরা পিশাচের মত হাসলাম। কারন গত মাসে আমাদের বন্ধু কাইল্লা বিপ্লবকে ওরা ড্রেনে ফেলে দিয়েছিল। বেচারা এমনিতেই কালো । আরও কালো হয়ে গিয়েছিল যখন ড্রেনে পড়েছিল। জামার পকেটে শামুক ঢুকে গিয়েছিল ড্রেন থেকে। প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে। তোমরা তো জানো – বন্ধুর জন্য মিলন নরকেও যেতে পারে।
এরপর থেকে সাবধান রইলাম। কারন ওরা তক্কে তক্কে আছে।
এর মাঝে এক কাণ্ড হল। বিকেলে পুরানো বই কিনে ফিরছিলাম। মোড়ের সামনে দেখি ইশকুলের নজরুল স্যার। হাতে বাজারের ব্যাগ। লাউয়ের গলা দেখা যাচ্ছে ব্যাগের ভেতর থেকে। সবুজ রঙের ব্রনটোসরাসের মত উঁকি দিচ্ছে।কার সাথে যেন নজরুল স্যার কথা বলছেন। প্যাঁচাল শেষ হয় না। কথা বলছেন তো বলছেন ই। দেশের অবস্থা ভাল না। জিনিস পত্রের দাম যেটাকে দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতি না কি যেন বলে হেন তেন নানান বিষয় নিয়ে উনাদের আলাপ চলছিল । বই নিয়ে ধরা পড়লে বিপদ। পরদিন ইস্কুলে মেয়েদের সামনে অপমান করবেন।মেয়েদের দিয়ে কানমলা খাওয়াবেন।
ঠিক করলাম, একটু ঘুরে মিশনপাড়া দিয়ে বাসায় ফিরব। ঝুকি তো আছেই। শত্রুপক্ষের মহল্লা।
কায়দা করে বই দিয়ে মুখ ঢেকে ফিরছিলাম।শত্রুদের কাউকে দেখছি না। প্রায় চলে এসেছি। অমন সময় চিৎকার- ঐ যে মিলন । ধর ওরে।
চেয়ে দেখি এক গাদা ফচকে ছোঁড়া ধাওয়া করছে আমাকে। সবার সামনে আবু বককর। ওর মুখ ভর্তি রাগ, হিংসা, আরও কি কি যেন। চায়ের দোকান থেকে একটা চেলা কাঠ তুলে নিল আবু বককর।
বইটা পেটের কাছে গুঁজে ঝেড়ে দৌড় দিলাম। পিছনে ওরা। হল্লা করছে।
খানিক পর বুঝলাম ভুল কোথাও ঢুকে গেছি। রাস্তা চিনি না। সামনে কানা গলি। একটা মাত্র দরজা। যা হবে ভেবে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। বললে বিশ্বাস করবে না।থকাস করে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে দেখি, দরজার ঐ পাশে দেয়াল। রাস্তা নেই।
হায় হায়। ভূতুরে ব্যাপার নাকি ? নাকি সায়েন্স ফিকশন ? আতঙ্কে যেন মারা যাব আমি। কিভাবে সম্ভব এমন? দরজা আছে, কিন্তু ভেতরে দেয়াল।
দিশেহারা হয়ে গেছি। অমন সময় দেখি রোগা মত এক খ্যাঁকরে চেহারার লোক বের হয়ে এলো পাশের এক বাড়ি থেকে।লুঙ্গী পড়নের।খালি গা। গায়ের রঙ কালো কুচকুচে। মুখে কাঁচা পাকা দাঁড়ি গোঁফ। গলায় তুলসির মালা। কানে কাঠ পেন্সিল গুঁজে রাখা। হাতে হাতুরি আর বাটাল।
মিহি গলায় লোকটা বলল- মাত্র দরজা বানানো শেষ করে আস্ত দরজা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখেছি।একটু শুকিয়ে গেলেই বার্নিশের কাজ ধরব।