সম্পদ লিপ্সার ভয়ঙ্কর পরিণতি

সা’লাবা ইবনে আবু হাতিম। রাসূলের জামানার অন্যতম মুনাফিক। মুখে এক কথা বাইরে আরেক কথা। স্বার্থানে¦ষী এ মানুষটি আপন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মুমিনের সূরত এখতিয়ার করেছিল। কিন্তু তার ভিতরটা ছিল কুফুরীর কালিমায় ঢাকা। পুরোপুরী যোগাযোগ ছিল কাফেরদের সাথেই। তার যত ভালবাসা, যত প্রেম, হৃদয়ের যত টানÑ সব ছিল তাগুতী গোষ্ঠির জন্যে, খোদাদ্রোহী কাফের-মুশরিকদের জন্যে। মুখের চটকদার কথা ছাড়া ইসলাম কিংবা মুসলমানদের জন্য তার কোনো দয়া বা মমতা ছিল না।
একদিনের ঘটনা। প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে আছেন। সা’লাবা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। আরজ করলÑ
হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করুন। তিনি যেন আমাকে ধনী বানিয়ে দেন। সম্পদের পাহাড় নসীব করেন।
হক আদায় করতে পারো এমন অল্প সম্পদ, হক আদায় করতে অম এমন অধিক সম্পদের চাইতে অনেক ভালো। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সা’লাবাকে ল্য করে বললেন।
তা ঠিক। তবু আপনি আমার জন্য দোয়া করে দিন। সা’লাবা পুনরায় একই আবেদন করল।
সা’লাবা! তুমি কি আল্লাহর রাসূলের পথ ধরে চলতে রাজী নও? সন্তুষ্ট নও? সে সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন, যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তবে মদীনার পাহাড় সোনা হয়ে আমার পিছনে পিছনে ঘুরত। আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে উহাকে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আসল কথা হলো, এমন ধনী হওয়া আমার পছন্দ নয়।
এ কথা শোনার পর সা’লাবা বলল, সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য নবী করে পাঠিয়েছেন, আল্লাহ যদি আমাকে সম্পদ দান করেন, তাহলে আমি তার সকল হক আদায় করব।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা আর সামনে বাড়ালেন না। সা’লাবা ইবনে আবু হাতিমের জন্য দোয়া করে দিলেন। বললেনÑ “হে আল্লাহ! সা’লাবাকে তুমি সম্পদ দান করো।”
নবীজীর দোয়া পেয়ে সা’লাবা মহা খুশি। আনন্দের আতিশয্যে তার দু’পা যেন মাটিতে পড়তে চায় না। সবাইকে বলতে থাকে নবীজীর দোয়ার কথা।
মহানবীর দরবার থেকে ফিরে এসে সা’লাবা বাজারে গেল। কিছু বকরী ক্রয় করল। তারপর বাড়িতে এনে পূর্ণোদ্যমে শুরু করল বকরী পালন।
দিন যায়। মাস যায়। সময় চলতে থাকে আপন গতিতে। সা’লাবার ছাগল বেড়ে চলে। বংশ বৃদ্ধি পায় পোকা মাকড়ের মতো। ছাগলের পাল বড় হয়। বাড়িতে জায়গা ধরে না। এমনকি এক পর্যায়ে এই বিশাল ছাগলের বহর নিয়ে মদীনায় অবস্থান করাও তার জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে।
সা’লাবা চিন্তিত হয়। এতবড় ছাগলের পাল নিয়ে যাবে কোথায়? শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তাভাবনা করে মদীনার পাক লোকালয় ছেড়ে খোলা ময়দানে চলে যায়।
মদীনায় অবস্থানকালে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে নববীতে এসে জামাতের সাথে আদায় করত সা’লাবা। কিন্তু দূরে চলে যাওয়ার কারণে এখন আর তা হয়ে ওঠে না। শুধুমাত্র যোহর ও আছরের নামাজ মদীনায় এসে আদায় করে। অন্য নামাজে শরীক হয় না বা হতে পারে না।
এদিকে ছাগলের সংখ্যা কিন্তু বন্যার পানির মতই তর তর করে বেড়ে চলে। ফলে বাধ্য হয়ে তাকে মদীনা থেকে আরও দূরে চলে যেতে হলো। কারণ আগের অবস্থানস্থলে ছাগলের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না।
দূরে চলে যাওয়ায় সা’লাবার মদীনায় আসা আরও কমে গেল। কমে গেল জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের পরিমানও। সে এখন প্রতি শুক্রবারে জুমআর নামাজ আদায়ের জন্য মদীনায় আসে। সপ্তাহের বাকী চৌত্রিশ ওয়াক্ত নামাজই সে আপন স্থানে আদায় করে নেয়। অবশ্য সবগুলো নামাজ পড়ে কি না তারই বা খোঁজ কে রাখে!
ক্রমাগত বেড়ে চলল ছাগলের পাল। সা’লাবা সরে যেতে লাগল দূর থেকে বহু দূরে। এমনকি এক পর্যায়ে শুক্রবারেও মদীনায় আসা বন্ধ করে দিল। তখন শুধু পথচারীদের কাছে জানতে চাইতো মদীনার সংবাদ।
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করলেন, সা’লাবার খবর কী? তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে ছাগল পালে। তার ছাগলের পরিমাণ আস্তে আস্তে এত বেড়ে গেছে যে, মদীনায় থাকা তার পে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই সে বাধ্য হয়ে মদীনার বাইরে চলে গেছে। একথা শোনার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার বললেনÑ “সা’লাবার জন্য আফসোস! সা’লাবার জন্য আফসোস! সা’লাবার জন্য আফসোস!”
এর কিছুদিন পরের কথা। যাকাতের বিধান অবতীর্ণ হলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’ব্যক্তিকে সা’লাবার কাছে যাকাত আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন। তারা দু’জন সা’লাবার কাছে গিয়ে নবীজির যাকাত সংক্রান্ত চিঠি পড়ে শোনালেন। চিঠির বক্তব্য শোনে সা’লাবা বলল, এ তো দেখছি ট্যাক্স ছাড়া আর কিছুই নয়। যা অমুসলমানদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। আমার ভালো করে বোধগম্য হচ্ছে না যে, নবীজি আমার কাছে কী চাচ্ছেন! আচ্ছা, তোমরা এখন যাও। পরে এসো। চিন্তা ভাবনা করে দেখি কী করা যায়।
একথা বলার পর যাকাত উসুলকারী লোক দু’জন বনু সুলাইমের এক ব্যক্তির কাছে গেলেন। সুলাইম গোত্রের লোকটি তাদেরকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করল। তারপর নিজের পালিত উট-বকরীসমূহের মধ্যে যেগুলো উৎকৃষ্ট ছিল, তা থেকে যাকাতের নেসাব অনুযায়ী পশু বাছাই করে তাদের নিকট নিয়ে এল। তারা বললেন, আমাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে, পশুসমূহের মধ্যে যেটি উৎকৃষ্ট, সেটি যেন না নেই। কাজেই আমরা এগুলো নিতে পারি না। সুলাইমী লোকটি বারবার অনুনয় বিনয় করে বললেন, আমি নিজের খুশিতে এগুলো দিতে চাই; আপনারা দয়া করে কবুল করে নিন। অতঃপর দু’কর্মকর্তা অন্যান্য মুসলমানদের থেকে যাকাত আদায় করে ফেরার পথে আবার গেল সা’লাবার কাছে। কিন্তু এবারও সা’লাবা যাকাতকে ট্যাক্স বলে উড়িয়ে দিল। বলল, এ তো একরকম জিযিয়া-করই হয়ে গেল, যা মুসলমানদের কাছ থেকে নেওয়া উচিত নয়। যাহোক, এখন তোমরা যাও। আমি পরে চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নেব।
যাকাত আদায়কারী কর্মকর্তাদ্বয় ফিরে এলেন মদীনায়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানালেন পুরো কাহিনী। সব শোনে তিনি ‘হায় সালাবা’ বলে দরদভরা কণ্ঠে আপে করলেন। আর সুলাইমী লোকটির উপর খুশি হয়ে তার জন্য বরকতের দোয়া করলেন।
পাঠকবৃন্দ! আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে যে, সম্পদের জন্য দোয়া চাওয়ার সময় সা’লাবা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সুষ্ট ভাষায় অঙ্গীকার করে বলেছিল যে, ‘আল্লাহ যদি আমাকে সম্পদ দেন তাহলে আমি উহার সকল হক আদায় করব।’ কিন্তু সে তাঁর ওয়াদা রা করে নি। সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হলো সে। তার এ সত্যচ্যুতি প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে আয়াত নাযিল করেনÑ
‘‘ তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ এমন রয়েছে যারা আল্লাহ তাআলার সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তিনি যদি আমাদেরকে ধন-সম্পদ দান করেন, তবে অবশ্যই আমরা দান-খয়রাত করব এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। অতঃপর যখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে সম্পদ দান করলেন, তখন তারা কার্পণ্য করতে শুরু করেছে এবং কৃত ওয়াদা ভেঙ্গে দিয়ে (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য থেকে) বিমুখ হয়ে গেছে।” [ সূরা তওবা: ৭৫-৭৭]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সা’লাবার জন্য আফসোস করছিলেন, তখন সেখানে সা’লাবার কতিপয় আÍীয়-স্বজনও উপস্থিত ছিল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আফসোস শুনে তাদের মধ্য থেকে একজন সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা হয়ে সা’লাবার নিকট পৌঁছল। তারপর সা’লাবাকে তিরস্কার করে বলল, তোমার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আয়াত নাযিল হয়ে গেছে।
সা’লাবা ঘাবড়ে গেল এবং তৎণাৎ মদীনায় হাজির হয়ে নিবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার যাকাত গ্রহণ করুন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে তোমার যাকাত কবুল করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। একথা শুনার পর সা’লাবা নিজের মাথায় মাটি নিপে করতে লাগল। চিৎকার করে আওড়াতে লাগল আপে বাণী।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা তো তোমার নিজেরই কৃতকর্ম। তোমারই মন্দকর্মের ফসল। আমি তোমাকে যাকাত আদায়ের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি তা মান্য কর নি। এখন আর তোমার যাকাত কবুল হতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সা’লাবা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেল।
এ ঘটনার কিছুদিন পরই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে গেলেন দুনিয়া থেকে। অতঃপর আবু বকর রা. খলীফা হলে সা’লাবা তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে যাকাত কবুল করার আবেদন জানায়। হযরত আবু বকর রা. তার যাকাত কবুল করলেন না। বললেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার যাকাত নেন নি, আমরা নেই কী করে?
হযরত সিদ্দীকে আকবরের ওফাতের পর সা’লাবা ফারুকে আজম রা. এর দরবারে উপস্থিত হয়ে যাকাত কবুলের আবেদন করে। ওমর রা. তাকে ঐ উত্তরই দেন, যা সিদ্দীকে আকবর রা. দিয়েছিলেন। এরপর হযরত উসমান রা. এর খেলাফত কালেও সে এ নিবেদন করে। কিন্তু তিনিও একই কথা বলে যাকাত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। হযরত ওসমান রা.-এর খেলাফতকালেই সা’লাবার মৃত্যু হয়। (দেখুনÑ ইবনে কাছীর, নতুন সংস্করণ, পৃষ্ঠা- ৬২২ তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা-৫৮৩)
বিশেষ দ্রষ্টব্য : এ ঘটনাটি হৃদয় গলে সিরিজের ২০নং খণ্ড থেকে পোস্ট করা হলো]