তুষার রানী

এক:
মায়া মুকুর আর তার ভাঙা টুকরোর গল্প

এক ছিল দত্যি। ভারি পাজি ছিল দত্যিটা। সত্যি সত্যি দত্যি তো, একেবারে আস্ত জ্যান্ত একটা দত্যি। একদিন ভারি ফুর্তি লাগল তার মনে। আর সেই ফুর্তিতে একটা আয়না তৈরি করে ফেলল সে। আজব সে আয়না। ভালো আর সুন্দর কোনো৷ জিনিসই দেখা যেত না তাতে। দুনিয়ার যত সব নোংরা আর বাজে জিনিস, আরো বেশি নোতরা আর পষ্ট হয়ে ফুটে উঠত তার বুকে। সেই আয়না দিয়ে দেখলে সুন্দর একছোপ সবজির বাগানকে মনে হত একতাল সেদ্ধ ঘণ্টার মতো, আর সবচেয়ে ভালো মানুষগুলোকে মনে হত একেবারে শয়তানের হাড্ডি__মনে হত মানুষগুলো যেন মাথার উপর ভর দিয়ে দাড়িয়ে আছে, দেহ বলতে কিছুই যেন নেই তাদের। দত্যিটা ভাবত, “বেশ তো মজা!”
দত্যিটার আবার একটা ইস্কুলও ছিল। সেই ইস্কুলে গিয়ে যারা একবার ঘুরে আসে, তাদের মুখে আর তারিফ ধরে না। আজব আজব সব কথা বলত তারা। বলত, এ ইস্কুলে একবার না গেলে সারা জন্মেও দেখতে পাবে না, দুনিয়ার মানুষের আসল চেহারা । আয়নাটার পানে চেয়ে চেয়ে তারা টই টই করে দুনিয়ার সব আনাচে-কানাচে ঘুরে আসত। আর সব কিছু তন্ন তন্ন করে দেখে আসত ! মান্তর একটা দেশ কিংবা মাত্তর একটা মানুষ দেখা বাদ থাকলেও থামত না তারা। তারপর উড়ে চলত আকাশের দিকে। পরীদের দেখার জন্যে। কিন্তু যতই উপরের দিকে উঠত, ততই পিছল হয়ে উঠত আয়নাটা। এত পিছল যে, ধরে রাখা দায় হয়ে পড়ত। তধু আরো, আরো উপরে উড়ে যেত তারা । শেষে তাদের হাত থেকে আয়নাটা ফসকে পড়ে যেত মাটির দিকে, লাখ লাখ টুকরো হয়ে। তখনি বিপদ হত সবচেয়ে বেশি। বালির কণার চেয়েও সরু সরু টুকরো ভেসে বেড়াত হাওয়ায়। কোনোরকমে একবার কারো চোখে লাগলে, সেখানেই লেগে থাকত টুকরোগুলো, আর সে তখন থেকেই সব কিছুকে উলটো দেখতে শুরু করত। তা নয়তো সব কিছুরই কেবল খারাপ দিকটা দেখত, ভালোটা নজরেই পড়ত না। আয়নাটার গুণই ছিল পুরোতে যা, উনোতেও তাই। আবার, যারা হা করে থাকত সব সময়, কিতবা বেশিরভাগ সময়, তাদের কারো কারো পেটেও ঢুকে যেতে কোনো কোনো টুকরো। তার ফল হত আরও সাংঘাতিক! সঙ্গে সঙ্গেই তার কলজে জমে যেত বরফের মতো। এখন শোন এই কলজ্েে জমে যাওয়া এক খোকার গল্প বলি।

দুই:
বিরাট শহরের ছোট্ট খোকা-খুকু

মস্তো এক শহর। সেখানে থাকত দুটি ছেলে-মেয়ে। শহরটা ছিল খুঁউ-ব বড়ো! লাখ লাখ লোকের বাস। বাড়ি-গাড়ি অগুণতি। জায়গার অভাবে ফুলের বাগান করতে পারত না অনেকেই, তাই ফুলদানিতে ফুল সাজিয়ে খুশি থাকতে হত অগত্যা । এমন জায়গাতেও সেই ছোট্ট খোকাখুকুর একটা ফুলের বাগান ছিল। অনেকগুলো ফুলদানি পর পর সাজালে যত বড়ো হয়, তার চেয়েও বড়ো ছিল সেই বাগানটা। ওরা কিন্তু ভাইবোন নয়, তবুও একজন আরেকজনকে ভালোবাসত ঠিক ভাইবোনের মতো । ওদের বাবা আর মা থাকতেন পাশাপাশি দুটি বাড়িতে_ওপরতলায়। সেখানে একটা ঘরের ছাদ গিয়ে মিশেছে আরেকটা ঘরের ছাদের সঙ্গে, আর দুটো ঘরের মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটামাত্র পানির পাইপ। ঘর দুটোতে ছিল মুখোমুখি দুটো জানলা। তাই, শুধু পানির পাইপটা টপকে যেতে পারলেই হল। এক জানলা থেকে আরেক জানলায় যাওয়া হয়ে যেত অনায়াসে ।
ওদের বাবা-মাদের ছিল আবার একটা করে বিরাট বাকস। সেই বাকসে লাগানো হত খাওয়ার জন্যে নানান রকম শাকসবজি তা ছাড়া একটা করে ছোট গোলাপের ঝাড়ও ছিল বাক্সগুলোতে। ভারী সুন্দর ফুল ফুটত দুটো ঝাড়েই। এখন একদিন হয়েছে কী, দুজনেরই বাবা-মা বাক্‌সো দুটোকে রাখলেন পাইপটার এ-পাশে সরিয়ে। এতে দুটো জান্লাই যোগ মতো। বাক্সগুলো ছিল উচু। খোকা-খুকু চড়তে পারত না তাদের উপর। তাই ওরা চড়ত বাকসোগুলোর পেছনে ছাদের উপর। তারপর বসে হাওয়া খেত গোলাপের ঝাড়ের নিচে। কখনো-সখনো আবার খেলা করত একমনে ।
কিন্তু শীত এলেই চলে যেত এমন নিশ্চিম্ত আরামের দিনগুলো।
জান্লাগুলোর শার্সি ঢেকে যেত সাদা সাদা বরফের আস্তরণে। তখন এক চমৎকার ফন্দি আটত ওরা। তামার একটা পয়সা স্টোভে একেবারে আগুনের মতো গরম করে এনে ওরা ধরত বরফ-ঢাকা শার্সিশুলোতে। উকি মেরে দেখার জন্যে বেশ বড়ো একটা ফুটো হয়ে যেত তাতে। দুটো জান্লারই ফুটোর পেছনে চক্চক্‌ করে উঠত ডাগর ডাগর দুজোড়া চোখ। চোখগুলো কিন্তু আর কারো নয়। আমাদের সেই ছোট্ট খোকা আর ছোট্ট খুকুর। ওহো, ওদের নামটাই বলা হয়নি ?

আচ্ছা শোনো: ওদের নাম কয় আর জেরদা !
“ই দেখ খোকা, কেমন ঝাকে ঝাকে সাদা সাদা মৌ-মাছিগুলো উড়ছে” কয়ের দিদিমা বললেন একদিন। বাইরে তখন পুরু হয়ে পড়েছে বরফের আস্তরণ ।
«রানি মাছি আছে ওদের?” শুধোল কয়। সে জানত আসল মৌ-মাছিদের মধ্যে রানি মাছি থাকবেই একটা।
হ, আছে বই কি,” বললেন, দিদি। তারপর বললেন. “মাছির ঝাকটা যেখানে সবচেয়ে বেশি ঘন, সব সময় সেখানেই থাকে রানি মাছিটা। অনেকদিন নিশি রাতে তারা আসে কত পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে। প্রত্যেকটা জানলার দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তারপর বরফে জমে যায় সবগুলো মাছিই। তখন কী আশ্চর্য সুন্দর দেখায় ওদের, মনে হয় যেনো এক-একটা ফুল আর পাপড়ি”
শ্্যা, হ্যা আমিও দেখেছি!” এক সঙ্গে চেচিয়ে উঠল খোকা আর খুকু দুজনেই এখন ওরা বুঝতে পারল কথাটা খাটি সত্যি !
“বলো না দিদি, বরফের রানি আসতে পারে আমাদের এখানে ?” শুধোল ছোট্ট জেরদা।
“এসেই দেখুক না,” বলে উঠল কয়। “গরম স্টোভটার ওপর বসিয়ে দেব তাকে। তারপর, আহা, কেমন গলে যাবে বেচারি!”
একদিন সন্ধ্যে বেলা। ছোট্ট কয় বাড়িতেই রয়েছে। জানলার পাশের চেয়ারটার উপরে দাড়িয়ে শার্সির ফুটোটা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল সে। চাপ চাপ বরফ পড়ছে বাইরে। তাদেরই একটা চাপ-_সবচেয়ে বড়ো চাপটা-_স্থির হয়ে রইল একটা ফুলের বাকসোর পাশ থেষে। তারপর ওটা আস্তে আস্তে আরো বড়ো হতে লাগল। শেষে তার জায়গায় দেখা গেল একটা মেয়ে, পরির মতো সুন্দরি। ফিনফিনে সাদা থানের কাপড় পরা। যেন হাজারটা তারার আলো দিয়ে বোনা তার কাপড়। পরীর মতো সুন্দরি মেয়েটা, কিন্তু বরফ দিয়ে গড়া তার শরীর-_জ্বলজ্বলে চকচকে বরফ দিয়ে গড়া। জানলার পানে তাকিয়ে মাথা ঝাকাল সে। ডাকল হাতছানি দিয়ে। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল ছোট্ট কয়ের। চেয়ার থেকে লাফিয়ে পড়ে এক ছুটে হাওয়া হয়ে গেল সেখান থেকে। যেতে যেতে তার মনে হল যেন একটা বিরাট পাখি জানলার পাশ দিয়ে উড়ে চলে গেল শাই শাই করে।
পরের দিন। তুষার পড়া বন্ধ হয়ে এল আস্তে আস্তে। তারপর দেখা গেল উজ্জ্বল নীল আকাশ। বসন্তকাল এসে গেছে। সূর্ষিমামা হামা দিয়েছেন গায়ে রাঙা জামা পরে। গাছে গাছে ফুটেছে ফুল। চড়ুই আর শালিকেরা কিচিরমিচির করে মনের আনন্দে বাধছে বাসা। আবার খুলে দেয়া হয়েছে বাড়ির জানলাগুলো। ছোট্ট খোকা-খুকুরা বসল তাদের বাগানে, উচু ছাদের মাথায়, সব কয়টা তলার উপরে। ছোট্ট জেরদা শিখেছিল একটা প্রার্থনার গান। তাতে ছিল গোলাপের কথা। নিজের গোলাপঝাড়টার কথা মনে পড়ত গাইতে গিয়ে। গানটা গেয়ে সে শোনাত ছোট্র কয়কে, আর কয়ও গেয়ে শোনাত ওকে। .
হাতে হাত রেখে আপন মনে গাইত ওরা! চুমো খেতো গোলাপের নরম পাপড়িগুলোতে। আর কথা কইত কীচা-কীচা রোদের সঙ্গে।
একদিন বাগানে বসে একটা ছবির বই দেখছে কয় আর জেরদা। তারপর হল কী, যখন ঠিক বারোটা বাজছে গির্জের ঘড়িটাতে, ঠিক তক্ষুনি হঠাৎ বলে উঠল কয়__
“উহ্‌, কী যেন একটা বাজল পেটে। আর চোখেও যেন পড়েছে কী।” ভয়ে খুকু জড়িয়ে ধরল ওকে। চোখে পলক ফেলল কয়। নাঃ, কিছুই দেখা গেল না চোখে।
“ওটা পড়ে গেছে চোখ থেকে,” ভাবল কয়। কিন্তু আসলে পড়েনি। ওটা কী তা জান? ওটা ছিল সেই মায়া আয়নার একটা ছোট্ট কুচি।
বেচারা কয়ের পেটের ভেতরেও ঢুকে গেছে একটা টুকরো। আর সঙ্গে সঙ্গেই পেটের ভেতরে একটা বরফের টুকরোর মতো হয়ে গেছে সেটা । এখন কোনো ব্যথা লাগছে না কয়ের। কিন্তু ওটা পেটের ভেতরে রয়ে গেল ঠিকই।
“কীাদছ কেন?” বলল কয়। “ইস্‌, কী কালো আর কৃৎসিত দেখাচ্ছে তোমাকে ! কেদো না, আমার তো কিছুই হয়নি। এই, দেখ দেখ* আশ হয়ে বলল কর “পোকার বে কেমন বিচ্ছিরি করে দিয়েছে এ গোলাপটা। আর এটা তো একেবারে শুকিয়ে গেছে। মা, মা, গোলাপটা কী নোতরা ।” তারপর সে লাখি মেরে উল্টে দিল বাকসোটা, ছিড়ে ফেলল দুটো গোলাপই।
“কয়, কী হল তোমার?” আরো ভড়কে গিয়ে শুধাল জেরদা। ওর ভয় দেখে আরো একটা ফুল ছিড়ে ফেলল কয়। তারপর ছুটে পালিয়ে গেল ওর কাছ থেকে।
পরে যখন আবার ছবির বইটা নিয়ে জেরদা গেল কয়ের কাছে, কয় নাক সিটকে বলল, “ওটা আবার একটা বই নাকি ! বেবিরাই শুধু ওটাকে ভালো বল্বে।” দিদি কোনো গপ্প বলতে গেলেই “কিন্তু’“কিস্ত’ করে বারবার বাধা দিতে লাগল সে। আর ফাঁক পেলেই দিদির চশমাটা নাকের ডগায় দিয়ে বুড়োমি করে দিদির ভঙ্গিতেই কথা বলতে থাকে। যা কিছু খারাপ আর কুৎসিত, তারই নকল করতে লাগল কয়। লোকে বলতে লাগল, নিশ্চয়ই সেই অলঙ্ষুনে আয়নার টুকরো ঢুকেছে ওর চোখে আর পেটে। নইলে এমন পাগলামি করবে কেন? ছোট্ট জেরদা, যে কিনা তাকে ভালোবাসে সারাটা প্রাণ দিয়ে, তাকেও ভারি বিরক্ত করতে লাগল সে।
তার খেলা-ধুলোর রীতিও গেল পালটে। আগের মতো ছোট্ট খোকাখুকুদের খেলা আর খেলত না সে। |
শীতকাল। একদিন মোটা মোটা দস্তানা পরে, ইয়া বড়ো একটা শ্রেজ গাড়ি কাধে ঝুলিয়ে এল সে। জ্েরদাকে ডেকে বলল, “বড়ো মাঠটায় খেলতে যাব আজকে । আর আর সব ছেলেও ওখানে খেলে ।” বলে হাওয়া হয়ে গেল মুহূর্তে।
বড়ো স্কোয়ারে গায়ের চাষিদের ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে নিজের শ্রেজটা বেধে দিত অনেক দূরস্ত ছেলে। এই করে বেড়াতও বেশ কিছুদূর। ভারী মজা হত এতে। সেদিন এমনি করে ওদের সঙ্গে খেলছিল কয়। হঠাৎ একটা বড়ো শ্রেজ গাড়ি এসে পড়ল ওদের মাঝে । গাড়িটা একেবারে ধপধপে সাদা । তার মধ্যে বসে একজন লোক। সাদা পশমি কাপড় জড়ানো তার গায়ে। মাথায় একটা সাদা টুপি। গাড়িটা দুম্পাক ঘুরল স্কোয়ারের চারদিকে, আর তার সঙ্গে ধরে শো শো করে এগিয়ে চলল গাড়িটা। লোকটা এবার পেছন ফিরে এমন ভাবে ঘাড় নাড়ল কয়ের পানে চেয়ে যেন কত চেনা ওর কয় তার গাড়িটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলেই এমনি ভঙ্গি করে লোকটা । তাই কয়ও থাকে যেমনকার তেমন। এভাবে শহরের গেট পেরিয়ে গেল তারা ।
তখন এমন বরফ পড়তে শুরু করেছে যে, নিজের নাকের ডগাটা পর্যস্তও ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না কয়। কিন্তু গাড়িটা তখনো চলেছে সমান জোরে। এখন সে তাড়াতাড়ি হাতের দড়িটা ছেড়ে দিল, যাতে আলগা হয়ে যায় তার গাড়িটা। কিন্ত কোনো কাজেই এল না। গাড়িটা ভারি শক্ত করে বাধা হয়ে গেছে বড়ো শ্রেজটার সঙ্গে আর হাওয়ার বেগে চলেছে সেই শ্রেজ। ভয়ে কয় তো আধখানা। কোনো উপায় না পেয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠল সে, কিন্তু কেউ শুনল না সে চিৎকার। চাপ চাপ বরফ পড়ছে আকাশ থেকে, আর শ্রেজটা এবার উড়ে চলেছে উপরের দিকে । একদম ঘাবড়ে গেল কয়। প্রার্থনা করতে চাইল, কিন্ত আককষার নামতাটা ছাড়া আর কিছুই মনে এল না তার।
ক্রমে ক্রমে বরফের চাপগুলো বড়ো হতে লাগল। শেষে তারা বরফ থেকে হয়ে গেল একপাল সাদা মুরগি। ঝট করে একলাফে সরে দীড়াল তারা । বড়ো শ্রেজটাও গেল থেমে। লোকটা এবার গাড়ি থেকে উঠে ্াড়াল। তার পশমি কাপড় আর টুপিটা ছিল পুরোপুরি বরফের তৈরি। ওগুলো খসে পড়তেই দেখা গেল লোকটা আসলে একটা মেয়ে। লম্বা হী লে
তুষার দেশের রানি__তুষারকন্যা !
“গাড়িটা চালিয়েছিলাম বেশ !” বলল সে। “কিন্তু তুমি কাপছ কেন ঠক্ঠক্‌ করে? আমার পশমি কাপড়টা পরে নাও চটপট ।” তারপর কয়কে নিয়ে নিজের শ্রেজে বসাল। পশমি কাপড়টা জড়িয়ে দিল ওর গায়ে। কয়ের মনে হল যেন বরফের সমুদ্দুরে ডুবে যাচ্ছে সে। “এখনো ঠাণ্ডা লাগছে তোমার?” শুধোল তুষারকন্যা। তারপর চুমো খেল ওর কপালে! আহ্‌, বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা সে ছোঁয়া! হাড় কাপিয়ে দিল কয়ের। কলজেটার তো আদ্দেক বরফ হয়ে আছে আগেই। মায়া আয়নার টুকরো পেটে গিয়ে। মনে হল যেন জমে যাচ্ছে সে। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে। তারপর সব ঠিক হয়ে গেল। আর একটুও ঠাণ্ডা লাগছে না কয়ের।
“আমার শ্রেজ, আমার শ্রেজটা কোথায় ?”
প্রথমে শ্রেজটার কথাই ওর মনে পড়ল। কিন্তু ওটা হারায়নি। একটা সাদা মুরগির ডানায় বেশ শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয়েছে। আর তাই পিঠে ফেলে উড়ে চলেছে মুরগির পাল। এবারে তার কপালে আরেকটা চুমো খেল তুষারবন্যা। সঙ্গে সঙ্গেই সে ভূলে গেল
জেরদাকে, দিদিকে, আর বাড়ির সব । মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল কয়। “আর তোমাকে চুমো খাব না,” বলল তুষার কন্যা। “আর একটা চুমো খেলেই মরে যাবে তুমি।”
তার দিকে চোখ তুলে চাইল কয়। কী সুন্দর আর কী মায়াভরা মুখ, মনুহভরা চোখ! মনেই হয় না তার দেহটা তুষারের__জানলার কাছে দাড়িয়ে তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল যখন, ঠিক তখনকার মতো দেখতে! একটুও ভয় লাগল না তার। পাহাড়-পুকুর আর সাগর-নদীর উপর দিয়ে উড়ে চলল তারা উক্কার মতো। নিচে পাগলা হাওয়ার মাতামাতি। নেকড়েরা ডাকছে আর পৃথিবীটা ছেয়ে যাচ্ছে সাদা সাদা বরফের কণায়। উপরে আকাশ নীল, কালো কালো কাকের ঝাক চলেছে হাওয়ায় পাখা মেলে। সবার উপরে জ্বলছে পূর্ণিমার নিটোল গোল টাদটা। এমনি করে চলতে চলতে শীতের লম্বা রাতটা কেটে গেল। সকাল
হতে দেখা গেল সেই তুষারকন্যার পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে অঘোরে ঘৃমুচ্ছে কয়।

তিন:
ডাইনি বুড়ির ফুলবাগানে

এদিকে কয় তো আর ফিরল না। তখন জেরদার মনের অবস্থা কী হল জানো? সে খোজ নিতে লাগল সবার কাছে, কয়ের কী হল ? কেউ বলতে পারল না তার কথা । কয়ের সঙ্গে খেলছিল যে ছেলেগুলো, শুধু তারা বলতে পারল দু’একটা কথা। তারা বলল তারা দেখেছে__কয় তার শ্রেজটা বাধল বড় একটা শ্রেজের সঙ্গে। তারপর দুটো শ্লেজই শাই শ্বাই করে চলে গেল বড়ো সড়কটা ধরে। সড়কটা ছেড়ে শহরের গেটটা পেরিয়েও চলে গেল গাড়ি দুটো। ব্যস, এই পর্যস্ত। আর কিছু জানে না তারা । অনেকগুলো মানুষই কাদল কয়ের জন্যে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কাদল ছোট্ট জেরদা। দিনরাত কেবল কাদল আর কীদল। তারপর ভাবল কয় মরে গেছে। ইস্কুলের পাশে দিয়ে যে ছোট্ট নদীটা বয়ে চলেছে তাতেই ডুবে মরে গেছে কয়__জেরদা ভাবল। উহ, কী আধার-করা বরফে ঢাকা শীতের দিন ছিল তখন ! কিন্তু এখন আবার এসেছে বসন্ত। গরম সূর্যের আলো-ঝলমলে দিন।
“কয় মরে গেছে,” বলল জেরদা।
“বিশ্বাস করি না,” বললে সূর্যের আলো।
“কয় মরে গেছে,” এবার চড়ুইদের ডেকে বলল জেরদা।
“বিম্বাস করি না,” বলল তারাও। তাই শেষ পর্যন্ত আর কথাটা বিম্বাস করল না জেরদা নিজেও ।
“নতুন লাল জুতোগুলো পরে যাব নদীর কাছে,” একদিন সকালে বলল জেরদা। “তারপর নদীকে বলব কয়কে ফিরিয়ে দিতে । আমার এই জুতোগুলো দেখেনি কয়।” তখনো সবে সকাল। বুড়ি দিদি ঘুমুচ্ছে অঘোরে। তাকে আদর করে চুমো খেল জেরদা। তারপর লাল
পরে একা একা শহরের গেটটা পেরিয়ে নদীর দিকে চলে গেল সে।
“সত্যি করে বল আমার ছোট্ট খেলার সাথীকে তুমিই নিয়েছ কিনা,” নদীকে মিনতি করে বলল জেরদা। তারপর আবার বলল, “তোমাকে এই লাল জুতোগুলো দিয়ে দেব যদি ওকে ফিরিয়ে দাও আমার কাছে।”
মনে হল নদীর ঢেউগুলো দুলে উঠল কথা বলার ভঙ্গিতে। তাই সে জুতোগুলো খুলে হাতে নিয়ে জোরে ছুড়ে মারল নদীর বুকে। এই জুতোগুলোকেই কিনা সে ভালোবাসত সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ছোট্র ছোট্র ঢেউয়েরা জুতোগুলো ফিরিয়ে নিয়ে এল কুলের দিকে, ওর পায়ের কাছে। ও ভাবল জুতোগুলো দূরে গিয়ে পড়েনি। নইলে ফিরে আসবে কেন ওর কাছে? কাছের ঝোপটার মধ্যে লুকনো ছিল একটা ছোট্ট নৌকো! এবার ছিল না, তাই ঝাকুনিতে কূল থেকে সরে গিয়ে ছুটে চলল তরতর করে।
ভারি ভয় পেল ছোট্ট জেরদা। কাদতে লাগল ভয়ে। কিন্তু কেউ শুনতে পেল না তার কান্না। কেবল শুনতে পেল নদীর পারের চড়ুইয়েরা। কিন্তু শুনেই-বা কী করবে বেচারিরা? ওরা তো আর কুলে বয়ে আনতে পারবে না ওকে। তাই ওরা কুল ধরে উড়ে উড়ে গাইতে লাগল যেন ওকে সাস্তনা দেয়ার জন্যেই, “এই তো আছি আমরা! ভয় কী তোমার এই তো আছি আমরা !”.
“হয়তো নদীই আমাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছোট্র কয়ের কাছে,” ভাবল জেরদা। ভেবে খুব খুশি হয়ে উঠল সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকোয় দীড়িয়ে আনমনে তাকিয়ে রইল উচু, সবুজ, ঘাসে ঘেরা নদীর পাড়ের দিকে। তারপর সে এসে পৌছল একটা বিরাট কেয়াবনের পাশে। বনটার মধ্যে ছিল লাল-নীল জানলাওয়ালা অদ্তুত রকমের একটা ঘর। ঘরটার উপরে একটা নড়বড়ে চালা। বাইরে দাড়িয়ে ছিল দুটো কাঠের সেপাই। ওর নৌকোটা পাশ দিয়ে যাবার সময় ওর হাতে কিছু অন্ত্রশম্ত্র দিয়ে দিল কাঠের সেপাইরা। ওদের জ্যান্ত ভেবে ডাকল জেরদা! ওরা কোনো সাড়া দিল না। ওদের খুব কাছে চলে এল জেরদা। ওকে এখন কুলের দিকে বয়ে নিয়ে এসেছে নদী।
থুরথুরে এক বুড়ি। প্রকাণ্ড একটা হ্যাট তার মাথায়। ফুলে ফুলে ছাওয়া সেই হ্যার্টটা। লা মলি হরে এই নানা পা দির কী করেই-বা এলে এমন ভাসতে ভাসতে এত দূরে?” তারপর এক হাটু জলে নেমে, লাঠিটা দিয়ে নৌকোটা কাছে টেনে এনে, জেরদাকে কোলে তুলে ডাঙায় নিয়ে এল বুড়ি। জেরদা বেশ খুশিই হল আবার ডাঙায় উঠতে পেয়ে। মনে মনে ভয়ও কিছু কম হল না এই অচেনা বুড়ির রাজ্যে এসে
“বলো তো খুকুমণি, কে তুমি, আর কেনই-বা এসেছ এখানে £” শুধোল বুড়ি। জেরদা তাকে বলল সব কথা। বুড়ি মাথা নেড়ে বলল, “সু, ঠু!” তারপর জেরদা তাকে জিজ্ঞেস করল, “কয়কে দেখেছ তুমি?” সে বলল, “না, । এই পথে আসেনি এখনো কয়। তবে আসবে শীগগীরই।” তারপর বলল, “দুঃখ কোরো না, লক্ষ্মী খুকু। কেয়াবনটা আর ফুলগুলোর দিকে চেয়ে দেখ। কী সুন্দর, না? ছবির বইয়ের চাইতেও সুন্দর” বুড়ি তাকে আরো বলল, লো প্রত্যেকেই একটা করে গপ্প বলতে জানে । বলে ওকে হাত ধরে ঘরটার ভেতরে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দরজাটা দিল বন্ধ করে।
ঘরের জানলাগুলো খুব উচু আর তাদের শার্সিগুলে৷ লাল, নীল, হলুদ-_হরেক রঙের। শার্সির ভেতর দিয়ে দিনের উজ্জ্বল আলো ঘরে এসে পড়ছে সাতরঙা রামধনুর চাকা একে। টেবিলের উপরে কতকগুলো মিষ্টি চেরিফল। জেরদা পেট ভরে ফল খেলো। খাওয়ার সময় ওর সুন্দর চুলগুলো একটা সোনার চিরুণি দিয়ে আচড়ে দিল বুড়ি। ওর ফুটফুটে সুন্দর মুখের দুপাশে ঝুলে রইল কুঁচবরণ চুল। শীতের সকালে শিশির-ভেজা নতুন-ফোটা গোলাপের মতো দেখাচ্ছিল ওর কচি সুন্দর মুখটা ।
“অনেকদিন ধরেই চাচ্ছিলাম তোমার মতো সুন্দর একটা ছোট্ট লঙ্ষ্মী-খুক্‌.” চুলে সিথি কাটতে কাটতে বলল বুড়ি। “এখন দেখবে কত সুখে থাকব আমরা ।” বুড়ির পাসে ৬০১৬০ তো আসল বুড়ি নয়। ডাইনি বুড়ি! জাদু-মস্তর করতে জানত সে। তবে সে খারাপ ডাইনি নয়-_এই যা। এমনি সে এক-আংটু জাদুমস্তর করত নিজের খেয়াল-খুশি মতো। এখন সে জেেরদাকে জাদু করল যাতে জেরদা পালিয়ে না যায় তার কাছ থেকে৷ তারপর সে তার বাগানে গিয়ে হাতের লাঠিটা ঘোরালো গোলাপ-ঝাড়গুলোর উপর, আর চোখের পলকে মাটির তলায় সেঁধিয়ে গেল সবগুলো ঝাড়! কোনো চিহই আর রইল না তাদের। বুড়ির ভয় ছিল, গোলাপগুলো দেখলে হয়তো নিজের বাড়ির গোলাপ-ঝাড়টার কথা মনে পড়ে যাবে জেরদার আর সে-কথা মনে হতেই কয়ের কথা মনে পড়তে কতক্ষণ ! আর তক্ষুণি যাবে পালিয়ে।
এখন জেরদাকে নিয়ে যাওয়া হল ফুলের বাগানে । আহা, কী সুন্দর ফুলগুলো, আর কী মিষ্টিই-না তাদের গন্ধ ! হরেক রকমের ফুল ফুটেছে বাগানে । তাদের কতকগ্লো আবার বারমেসে ফুল। রঙের আলপনায় ছবির বইকেও হার মানিয়ে দেয়। জেরদা তো মহাখুশি! দিনভর খেলা করল ফুলগুলোর সঙ্গে। তারপর উচু চেরি গাছগুলোর ওপাশে এক সময় সুয্যিমামা পাটে নামলেন। নামল রাতের আধার। লাল রেশমি বালিশে সিথান দিয়ে নরোম তুলতুলে একটা বিছানায় শুয়ে পড়ল জেরদা। কত স্বগ্ন দেখল ঘুমের মধ্যে। কত সুন্দর সে স্বপ্ন! বিয়ের রাতের পরিদের রানি যেমন স্বপ্ন দেখে তার চেয়েও সুনদর।
পরের দিনও তেমনি খেলা করে কাটাল ফুলগুলোর সঙ্গে। পরের দিন-_তার পরের দিনও । এমনি করে কেটে গেল অনেক দিন। সব ফুলই চেনা হয়ে গেছে জেরদার। বাগানে এত ফুল তবু যেন কী একটা ফুল নেই। কিন্তু সে ফুল কিছুতেই জেরদার মনে পড়ে না।
তারপর একদিন-না, হয়েছে কী?
ডাইনি বুড়ির ফুলে ছাওয়া সেই ষে টুপিটা-_.তার দিকে জেরদার চোখ পড়ল। দেখল ওর মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে সুন্দর একটা ফুল__একটা গোলাপ!
বাগানের গোলাপ-ঝাড়গুলো জাদু করার সময় এই ফুলটা সরিয়ে ফেলতে মনে ছিল না বুড়ির। কিন্ত এত সব গুছিয়ে মনে রাখাও কী ছাই চার কথা? এমনি একটু ছোট্ট ভুলের জন্যে কত মারাত্মক ক্ষতিই-না হয়ে যায় আমাদের!
. পঠ্যা তাই তো! বাগানে তো কোনো গোলাপঝাড় নেই।” মনে পড়ে গেল জেরদার। বাগানে গিয়ে এঝাড়, ও-ঝাড়, অনেক ঝাড়ই খুঁজল জেরদা। কিন্ত কোথাও গোলাপের ঝাড় পাওয়া গেল না একটাও । দুঃখে মাটিতে আছড়ে পড়ল জেরদা। অঝোরে কাদতে লাগল সে। তার চোখের জলের এক ফৌটা পড়ল, যেখানে একটা গোলাপের কুঁড়ি সেঁধিয়ে রয়েছে ঠিক সেই জায়গাটার ওপরে। চোখের জলের গরম ছোয়া পেয়ে কয়েকটা ফোটা ফুল নিয়ে শুট করে গজিয়ে উঠল গোলাপের ঝাড়টা। আহা, তখন কী খুশি জেরদার। গাছটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে চুমো খেল সে! আহা, নিজের বাড়ির ফুলগুলোর কথা মনে পড়ে গেল তার। তার পরেই মনে পড়ল কয়ের কথাও
“উহ্‌, কী ফন্দি করেই-না আটকে রেখেছে আমাকে !” মনে মনে বলল জেরদা। “আমি-না কয়ের খোজে বেরিয়েছিলাম! তোমরা আমার কয়ের খবর জানো?” গোলাপগুলোকে শুধোল সে। “কয় কি আজো বেঁচে আছে__বল না গো !”
“হ্যা গো খুকুমণি, তোমার কয় আজো ধেঁচে আছে।” গোলাপগুলো মাথা দুলিয়ে বলল। “মাটির নিচেই তো ছিলাম আমরা। সব লোকই মরে গেলে যায় মাটির নিচে। কিন্তু কয়কে তো দেখিনি সেখানে ।”
“আমার লক্ষ্ত্রী গোলাপ, খুব ভালো তোমরা ।” আদর করে জেরদা বলল, তারপর গেল অন্য ফুলগুলোর কাছে। তাদের কুঁড়ির পানে তাকিয়ে শুধোল, “তোমরা জানো কয় কোথায় আছে?”
_ কিন্তু ফুলগুলো তখন রোদে গা মেলে দিয়ে আপন মনে ভাবছিল শুধু তাদের নিজের নিজের গপ্প-কাহিনী, কিংবা কোনো এক রাজপুতুর আর রাজকন্যার রূপকথা। তাদের অনেক রূপকথাই শুনল জেরদা, কিন্তু কয়ের কথা কে-উ বলতে পারল না।
“ছাই গপ্প ! ও-সবতো শুনতে চাইনি তোমাদের কাছে” বিরক্ত হয়ে মাথ! দুলিয়ে বলল জেরদা। “বসে বসে তোমাদের ও-সব শুনতে আমার বয়েই গেছে।”
তারপর সে দৌড়ে গেল বাগানের একেবারে শেষ মাথায়। দরজাটা ছিল বন্ধ। কিন্ত জোরে ধাক্কা মারতেই মরচে-ধরা তালাটা গেল ভেঙে আর দরজাটা গেল খুলে। খালি পায়ে খোলা মাঠটার দিকে প্রাণপনে দৌড়ুতে লাগল ছোট্ট’জেরদা। দৌড়োয় আর বার বার পেছন ফিরে তাকায়। নাঃ, কেউ আসছে না পেছন পেছন।

দৌডুতে_-দৌড়ুতে, জেরদা হাফিয়ে যায়_আর চলতে পারে না। শেষে একটা উচু পাথরের উপর বসে জেরদা জিরোয়। চারদিক চেয়ে দেখে__গরমের দিন চলে গিয়েছে, এখন হেমত্তকাল।
জেরদা আশ্চর্য হয়ে যায়! ডাইনি বুড়ির বাগানে এটা বোঝা যায়নি। সেখানে সব খতুতেই রোদে ঝলোমলো। বারোমাস ফুল ফোটে।
“আহা, কত সময় বয়ে গেল আমার !” দুঃখ হয় জেরদার মনে।
“হেমন্ত এসে গেছে। আর বিশ্রামের সময় নেই।”
উঠে দীড়াল জেরদা। আবার পথ চলবে সে। কিন্তু, আহ্‌, কী ব্যথা ওর ছোট্ট দুটি পায়ে ! টন্টন্‌ করে উঠছে পা দুটো। ঠাণ্ডাও পড়েছে কী ভীষণ।
চারদিকে শুধু ধু ধু করা মাঠ আর মাঠ। হল্দে হয়ে গেছে সবগুলো গাছের পাতা। শিশির ঝরছে যেন না পাতাগুলো । ফুল নেই ফল নেই কোনো গাছে। শু গাছে দেখা যাচ্ছে জটা জটা সাজা মা যায় মুখ। ইস, কী ভীষণ আধার হয়ে এসেছে চারিদিক।

চারঃ
রাজপুতুর আর রাজকন্যের দেশে

জেরদা আর চলতে পারে না। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটু জিরোতে বসল এমনি সময় ঠিক ওর উল্টো দিক থেকে বরফের উপর লম্বা লম্বা পা ফেলে ভারিক্কি চালে হেলতে দুলতে এসে পৌছুল কালো একটা কাক। ওর সামনে এসেই. থমকে দাড়াল কাকটা। অনেকক্ষণ রইল এক দৃষ্টিতে। তারপর একটু হেসে, ঘাড় কাত করে বলল, “কা ! কা! নমস্কার ! নমস্কার !” এর চাইতে ভালো করে কথা বলতে পারল না কাকটা। কিন্ত তাকে বেশ যিতের মতো মনে হল জেরদার। জেরদাকে সে শুধোল একা ও কোথায় চলেছে এই বিরাট বিম্বে। “একা” কথাটা খুব ভালো করেই বুঝল জেরদা। ওর মনটা ব্যথায় কেঁদে উঠল কথাটা শুনে। তার জীবনের সব কাহিনী আর দুঃখের কথা বলল কাকটাকে। তারপর শুধোল সে কয়কে দেখেছে কিনা কোথাও। সব কথা শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেল কাকটা। তারপর হঠাৎ সে বলে উঠল,
“ই, দেখেছি তো মনে হয়! দেখেছি তো!”
“কী! দেখেছ মনে হয়? বটে ?” আনন্দে লাফিয়ে উঠল জেরদা। কাককে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল সে। কাকটার দম প্রায় বন্ধ হয়ে এল ওর দুই হাতের চাপে।
“আস্তে, আস্তে, খুকুমণি!” বলল কাকটা। “মনে হয় দেখেছি। কয়ই হবে হয়তো। কিন্তু ও নিশ্চয়ই এখন ভূলে গেছে তোমার কথা । রাজকন্যের সঙ্গে থাকে কি না!”
“রাজকন্যের সঙ্গে থাকে?” শুধোল জেবদা।
“ছু। শোনো,” বলল কাকটা। “কিন্ত তোমার ভাষায় কথা বলা কী মুস্কিল। কাকের ভাষা জানো? তাহলে বলতে পারি আরো ভালো করে।”
“না, ও-ভাষাটা শিখিনি তো,” বলল জেরদা। “তবে আমার দিদিমা বোঝেন-_বলতেও পারেন তোমাদের ভাষা | আহা কেন শিখিনি আমি !”
“না, না, তাতে কিছু অসুবিধে হবে না,” ব্যস্ত হয়ে বলল কাকটা। “যদ্দুর সম্ভব বুঝিয়ে বলব তোমায়।* কাক জেরদাকে সান্ত্বনা দেয়।
তার পর কাকটা তার জানা সব কথা বলতে লাগল-__
“আমরা ফে দেশে থাকি সেই দেশে আছে এক রাজকন্যে। রাজকন্যের ভারী বুদ্ধি। দুনিয়ায় যত খবরের কাগজ রয়েছে তার সবগুলো মুখস্ত করেছে। আর ভুলেও গেছে সেগুলো। এত-তো বুদ্ধি সেই রাজকন্যের।
“একদিন সিংহাসনে বসে রাজকন্যে আপন মনে একটা গান গাইছিল__বিয়ের গান। বুঝতেই তো পারছ কথাটার মানে কী?” কাকটা বলল। “রাজকন্যের বিয়ে করতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু রাজকন্যে এমন একজনকে বিয়ে করতে চায় যে, সব কথার চটপট উত্তর দিতে পারবে। বোকার মতো হা করে কেবল চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলে চলবে না, তা সে দেখতে যত সুন্দর হোক। তাহলে বরকে যে ভারী বোকা বোকা দেখাবে।
“রাজকন্যে সখিদের ডেকে মনের কথা বলল। শুনে সখিরা মহা খুশি। ওরা বলল, “কথাটা এদ্দিন ধরে আমরাও ভাবছিলাম । “আমি যা বলছি তার প্রতিটা কথা যে সত্যি, তাতে কোনো সন্দ নেই, বুঝলে খুকুমণি।” কাকটা বলল। “আমার বউ আবার সব সময় রাজকন্যের পুরীতে যাওয়া আসা করে কিনা, তাই অনেক খবরই তার কানে আসে। সে-ই আমায় এ খবর বলেছে।”
কাকের বউ-ও অবিশ্যি একটা কাক। কাকের বউ তো কাকই হয়। সে তো তোমরা জানোই।
“সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশ করা হল কতকগুলো খবরের কাগজ। চওড়া বর্ডার দিয়ে, রাজকন্যের সইয়ের নকল দিয়ে, খুব ফলাও করে। কাগজগুলোতে ঘোষণা করে দেয়া হল যে, দেখতে সুন্দর সব যুবকই আসতে পারে রাজপুরীতে। এসে কথা বলবে রাজকন্যের সঙ্গে । আর যে কথা বলতে পারবে সবচেয়ে সুন্দর করে আর যার কথা শুনে মনে হবে যে একটুও ভয় নেই তার মনে, তাকেই বিয়ে করবে রাজকন্যে। হ্যা, হ্যা,” জ্োরের সঙ্গে বলল কাক, “আমাকে বিশ্বাস করতে পার তুমি। আমার কথাখুলো সব সত্যি। এখানে তোমার সামনে বসে আছি__এ যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি সত্যি। ভীষণ হৈ-চৈ পড়ে গেল। দলে দলে আসতে লাগল যুবকেরা। কিন্তু পয়লা কিংবা দোসরা দিনেই নাকাল হয়ে গেল সবাই। বাইরে সড়ক দিয়ে আসবার সময় চমৎকার কথা বলতে পারত তারাও কিন্তু যখনি তারা এসে পৌছুতো রাজপুরীর গেটে, দেখত ঢাল-তরোয়াল উচিয়ে সব সেপাই শাস্তি, বিরাট লাল-হলদে সব সর্ষেফুল। তারপর যখন গিয়ে দাড়াত খোদ সিংহাসনটার সামনে__যার উপর বসে আছে রাজকন্যে, তখন আর কোনো কথাই মনে আসত না তাদের । কেবল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আওড়াত রাজকন্যেরই মুখের শেষ কথাটা। কিন্তু নিজের বলা কথাটাই অন্যের মুখে ফের শুনতে মোটেই ভালো লাগত না রাজকন্যের। লোকগুলো যেন ঘুমিয়ে পড়ত কোনো ঘুমের ওষুধ খেয়ে, ফের সড়কে গিয়ে না পড়া পর্যস্ত জেগে উঠত না আর। তখন পর্যন্ত আর খুশিমতো কথা বলতে পারত না তারা! শহরের গেট থেকে রাজকন্যের বাড়ির গেট পর্যন্ত ‘বিরাট এক লাইন বেধে দীঁড়িয়েছিল তারা। আমি নিজে গিছলাম দেখতে,” বলল কাক। “ক্ষিধেয় আর তেষ্টায় মুখ কীচুমাচু হয়ে গিছল তাদের। কিন্তু রাজপ্রাসাদ থেকে এক গেলাস জলও পেল না তারা ।”
“কিন্তু কয়, ছোট্র কয়?” শুধোল জেরদা। “কখন এল কয়? নাকি লাইনের মধ্যে ছিল সে-ও?”
“রোসো, রোসো! ওর কথাতেই তো আসছি। পয়লা দিন গেল। দোসরা দিনও গেল। তেসরা দিন এল নতুন একজন লোক। ছোট্র খাট্রো একজন লোক। কোনো গাড়ি-জুড়ি ছিল না তার। খুশি মনে হেটেই সে চলে গেল রাজপুরীতে। তার চোখগুলো ঠিক তোমার চোখের মতোই উজ্জ্বল। খুব লম্বা সুন্দর চুল তার। তবে কাপড়গুলো একেবারেই সাদামাটা”
“তাহলে সে-ই কয়!” ডগমগ হয়ে উঠল জেরদা। “এইবার পেয়েছি তাকে !” আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল সে।
“তার পিঠে একটা পুটলি,” বলল কাক।
“ুম! ওটা নিশ্চয়ই ওর শ্রেজটা !” বলল জেরদা। “শ্রেজটা নিয়েই ও বেরিয়েছিল কিনা”
“হতে পারে,” সায় দিয়ে বলল কাক। “তবে আমি খুব খেয়াল করে দেখিনি ওটা। আমার বউই. আমাকে বলেছে সব কথা। বউ বলেছে, ও গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উঠল উপরে। ঢাল-তরোয়ালধারী সেপাই-শাস্ত্রি আর সোনার জামাঞ্জুতো-পরা বান্দা-নফরদের দেখে একটুও নাকি ভয় করেনি সে। বরং একটু চিত্ত করে বলল, “ধ্যেৎ, সিড়িতে দাড়িয়ে থাকব কী? চলে যাই ভেতরে । আলোয় আলোময় হয়ে উঠল হল-ঘরটা সোনার কাপ-পেয়ালা হাতে নিয়ে খালি পায়ে ঘুরঘুর করছিল উজির-নাজির আর কোটালেরা। এসব দেখলে ভয়ে বুক শুকিয়ে যেত আর যে-কারুরই। কিন্তু ওর ভয় হল না একটুও। ওর জুতোগুলো পর্যস্ত আওয়াজ করা থামাল না।”
“নিশ্চয়ই কয় !” চেচিয়ে উঠল জেরদা। “ওর পায়ে ছিল নতুন বুট। দিদিমার ঘরে ওর জুতোর মচমচানি শুনেছি আমি।”
“হ্যা, জুতোগুলো মচমচ করছিল ঠিকই,” বলল কাক। “আর ও একটুও ভয় না করে সোজা চলে গেল রাজকন্যের কাছে। বিরাট একটা মুক্তোর উপর বসেছিল রাজকন্যে। সুতো কাটার চরকার চাইতেও বড় সে মুক্োটা। আর রাজকন্যের চারদিক ঘিরে আর তাদের বাদীরাও। আর ছিল ঘোড়সওয়ার সামস্তেরা, সামন্তদের সামস্তেরা, আর শেষ সামস্তদের সঙ্গের লোকেরা । এই লোকেদের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল আবার একজন করে নফর। ভীম পালোয়ানের মতো দড়িয়েছিল তারা সব। সামস্তদের সামস্তদের সঙ্গের লোকেদের নফরদের দাপটে কাছে থেষা যেত না রাজপ্রাসাদের। চট্িজুতো পরে চট্টাস্‌ চটাস করে সব সময় ঘুরে বেড়াত তারা।”
“উহ্‌, তাদের দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যেত সবাই, না?” নিজেই ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলে শুধোল জেরদা। “কয় পেল রাজকন্যেকে ?”
“আমি যদি কাক হয়ে না জন্মাতাম, তাইলে আমি নিজেই বিয়ে করতাম রাজকন্যেকে। অবশ্যি আমার একটা পরির মতো সুন্দরী বউ আছে,” বলল কাক। জানোই তো, কাকেরা কাকের মতো কুচকুচে কালোকেই বলে কিনা “পরীর মতো সুন্দরী, ! তারপর বলল কাক, “শুনেছি আমি যেমন বলতে পারি আমার ভাষায়, ও তেমনি সুন্দর করে কথা বলেছিল রাজকন্যের সঙ্গে। বউয়ের মুখেই শুনেছি একথা। ভারী চঞ্চল আর হাসিখুশি ছেলেটি। “আমি তোমাকে বিয়ে করতে আসিনি, এসেছি শুধু তোমার বিদ্যের কথা শুনতে,” সে বলল রাজকন্যেকে। দুজনেরই ভারী পছন্দ হয়ে গেল দুজনকে ।”
“নিশ্চয়ই সে কয়,” বলল জেরদা। “কত বুদ্ধি ছিল ওর মুখে মুখে ভগ্নাংশ পর্যন্ত করে ফেলতে পারত । আমাকে নিয়ে চলো-না ওর কাছে!” মিনতি করে বলল জেরদা।
“বলা কত সহজ 1” বলল কাক। পায়ের আঙুল দিয়ে মাথা চুলকাতে লাগল সে মহা ভাবনায়। “কিস্তু যাব কী করে বল? আমার বউয়ের সঙ্গে আলাপ করব এ নিয়ে। ও একটা পথ বের করতে পারে হয়তো। কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি তোমাকে খুকুমণি, তোমাকে ওরা রাজপ্রাসাদের ভেতরে যেতে দেবে না কিছুতেই ।”
“দেবে, দেবে,” বলল জেরদা। “আমার কথা শুনলেই কয় সোজা চলে আসবে আমার কাছে। তারপর সে-ই ভেতরে নিয়ে যাবে আমাকে ।”
“এ খানে দীড়িয়ে অপেক্ষা কর আমার জন্যে” বলে পাখা মেলে উড়ে চলে গেল কাকটা।
ফিরে যখন এল তখন সন্ধের আধার নেমে এসেছে চারদিকে।
“কা! কা!” বলল সে। “আমার বউ তোমাকে ভালোবাসা জানিয়েছে গো খুকুমণি। আর এই রুগিটা দিয়েছে তোমার জন্যে। বলল, ‘ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়ই খুকুমণির। ওকে খেতে দিও এ-টা। রান্নাঘরে ছিল অনেকগুলোই, তার মধ্যে থেকে নিয়ে এলাম একটা ।\” তুমি বোধ হয় যেতে পারবে না রাজপ্রাসাদের ভেতরে । রুপোর সেপাই আর সোনার শাস্ত্িরা যেতে দেবে না তোমাকে । তবে ভয় নেই, অন্য ব্যবস্থা আছে। কেঁদো না তুমি। খিড়ৃকির কাছে একটা ছোট্ট সিড়ি জানা আছে তোমার বউদির | সেটা দিয়ে একেবারে গিয়ে পৌছনো যায় রাজকন্যের শোবার ঘরের বারান্দায়। তারপর চাবিটা কোথায় পাবে তা-ও জানে তোমার বউদি”
তারপর কাক-বউদি জেরদাকে খিড়কি দরজার কাছে নিয়ে গেল। দরজাটা খোলাই ছিল।
ভয়ে আর আনন্দে বুকটা কেমন ধড়ফড় করতে লাগল ছোট্ট জেরদার ! যেন কোনো ভীষণ অন্যায় করতে যাচ্ছে আর কী ! তবু কয়কে দেখার কত ইচ্ছে তার !
এবার সিড়িটা বেয়ে উঠল তারা । একটা ছোট্ট পিদিম জ্বলছিল সিড়ির মাথায় মিটমিট করে। রাজকন্যের শোবার ঘরের বারান্দায় এসে এদিক-ওদিক ভালো করে দেখে নিল গিনি কাকটা। তারপর তাকাল জেরদার দিকে। জেরদা মাথা হেট করে পেন্নাম করল তাকে, যেমন শিখিয়েছেন দিদিমা ।
“আমার কর্তা খুব স্নেহ করেন তোমাকে খুকুমণি,” বলল কাকের বউ । “আহা, তোমার কাহিনী কী দুঃখের ! আচ্ছা পিদিমটা হাতে নিয়ে এসো আমার গিছু পিছু। ইদিক দিয়ে সোজা চলে যাব আমরা । কেউ দেখতে পাবে না আমাদের ।”
এবার তারা এসে পৌছল পয়লা মহলটায়। কিংখাবে মোড়া দেয়ালগুলো আর হরেক রঙের ফুল-পাতা আকা রয়েছে তার উপব। প্রত্যেকটা মহলকেই মনে হয় আরগুলোর চাইতে সুন্দর। এত সুন্দর আর ঝকঝকে যে, চোখে ধাধা লেগে যায় দেখে। মহলগুলো পেরিয়ে তারা এসে পৌছল শোবার ঘরটায়। এ ঘরের ছাদটাকে মনে হল বিরাট একটা তালগাছের প্রকাণ্ড একটা মাথার মতো। বড়ো বড়ো ছাতার মতো গোল পাতায় ভর্তি। পাতাগুলো সব দামি কাচে তৈরি। কাচগুলো সব ফটিকের মতো পরিষ্কার। ঘরের মাঝখানে সোনার পালক্কের উপর মখমলের দুটি বিছানা। দেখতে যেন সদ্য-ফোটা পদ্মফুলের মতো। সাদা বিছানাটার উপরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে রাজকন্যে। আরেকটা বিছানা ছিল লাল। পলাশফুলের মতো একেবারে টুকটুকে লাল। জ্বেরদা ভাবল কয় আছে সেখানে । একটা লাল পাতা সরিয়ে নুয়ে পড়ে দেখল সে। দেখলো শ্যামবরণ ছোট্ট একটা ঘাড়।-.কয় নিশ্চয়ই, ভাবল জেরদা। জোরে চেঁচিয়ে উঠল ওর নাম ধরে। পিদিমটা উচিয়ে ধরল ওর মুখের কাছে। ও জেগে উঠল। পাশ ফিরে তাকাল জেরদার দিকে। কিন্তু আহা, সে তো কয় নয় !
কেবল ঘাড়ের দিকটাতেই কয়ের মতো দেখাত রাজপুত্বুরকে। কিন্তু আসলে সে ছোট্ট কয় নয়। সে আরো বড়, আর, দেখতেও অনেক বেশি সুন্দর। সদ্য-ফোটা পদ্যফুলের বিছানায় ঘুম ভেঙে গেল রাজকন্যের। ঘুমজড়ানো মিষ্টি সুরে শুধোল, “ওখানে কে?” আহা, দুঃখে শোকে কেঁদে ফেলল ছোট্ট খুকু জেরদা । একে একে বলে গেল তার সব দুঃখের কাহিনী। মুক্তোর মতো দুফৌটা চোখের জল ছলছল করে গড়িয়ে পড়ল ওর দু’গাল বেয়ে।
“আহা বেচারি!” দরদে ভেঙে পড়ল রাজপুত্বুর আর রাজকন্যে। কাক দুটোর খুব প্রশংসা করল তারা। আর বলল ওদের ওপর রাগ করেনি তারা। তবে বলল আর যেন এ-রকম না করে কাকগুলো। অবিশ্যি এবারের জন্যে পুরস্কার দেয়া হবে তাদের ।
“তোমরা কি স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াবে?” শুধোল রাজকন্যে, “না কি রাজসভায় স্থায়ী কাকমন্ত্রীর আসন নেবে, তা নিলে তোমরা পাকশালের এঁটো-কীাটার একচ্ছত্র অধিকার পাবে।” ূ
কর্তা কাকের সঙ্গে একটু সলা-পরামর্শ করল তার বউ। তারপর দুজনেই মাথা নুইয়ে পেন্নাম করল রাজকন্যেকে। রাজদরবারে স্থায়ী আসনই বেছে নিল তারা। বলল, তিনকাল গিয়ে এককালে এসে ঠেকেছি এখন আমরা। শেষের দিনগুলোর জন্যে একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা থাকাই ভালো ।”
রাজপুতুর তার লাল ফুলের বিছানাটা ছেড়ে দিল জেরদাকে, ঘুমোবার জন্যে। আর কী-ই বা করা যায় তখনকার মতো। ছোট্ট দুধানি হাত বুকের ওপর জোড় করে ধরল জেরদা। আর মনে মনে ভাবল, মানুষে আর পাখিতে কত ভালোবাসে আমাকে ! কত ভালো তারা !” তারপর আস্তে আস্তে চোখ দুটি খুজে এল তার।
পরের দিন। সকালবেলা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারাটা গা ঢেকে মখমল আর জরির পোশাক পরিয়ে দেয়া হল জেরদাকে। রাজপুরীতে মহা! আনন্দে দিন কাটাবার ব্যবস্থা হল তার। কিন্তু সে চাইল শুধুমাত্র একটা ঘোড়া আর একটা ছোট্র গাড়ি, আর একজোড়া
। তারপর আবার সে বেরিয়ে পড়বে কয়ের ধোজে। কিন্তু তাকে শুধু একজোড়া বুটজুতোই দেয়া হল না, টুকটুকে লাল রঙের একটা মাফলারও দেয়া হল তাকে। আর,
ফুটফুটে সুন্দর পোশাকে সাজিয়ে দেয়া হল। তারপর যখন সে যাওয়ার জন্যে প্রস্তত
রা বারি না দির ক পিএ নিলাম গাড়িটার উপরে নীল আকাশের উজ্জ্বল তারার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল রাজপুত্র স্বয়ং এসে গাড়িতে তুলে দিল জেরদাকে, আর আশীর্বাদ করল দুই হাত তুলে। বনের কাক দুটোর পাকাপাকি বিয়ে হয়ে গেছে এখন। কর্তা কাকটা তিন মাইল গেল জেরদার সঙ্গে। জেরদার পাশেই বসেছিল সে, কারণ পেছনে বসাটা অপমানজনক মনে হচ্ছিল তার। সে এখন রাজসভার মন্ত্রী হয়েছে কি না, তাই। তার বউ আর জেরদার সঙ্গে গেল না, কারণ রাজসভায় স্থায়ী আসন পেয়ে বেশি খেয়ে খেয়ে ভীষণ মাথা ধরেছিল তার। তাই দুয়ারে বসে ডানা ঝাপ্টাতে লাগল সে, বিদায়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে। গাড়িটার ভেতরে থরে থরে সাজিয়ে দেয়া হয়েছিল হরেকরকম মিষ্টি বিম্কূট আর ফল।
“বিদায় বন্ধু, বিদায় !” বলে কেঁদে ফেলল রাজপুতুর আর রাজকন্যে। কান্না পেল ছোট্ট জেরদারও। আর কাদতে লাগল কাকটা। কেঁদে আকুল হল সবাই। এমনি গেল প্রথম তিন মাইল। তারপর “বিদায় !” বলল কাকটা। তখুনি সবচে বেশি দুঃখ লাগছে জেরদার। কাকটা উড়ে গিয়ে বসল একটা গাছের ডালে আর তার কালো কালো দুটি ডানা ঝাপ্টাতে লাগল যতক্ষণ পর্যস্ত দেখা গেল গাড়িটা। সকালের মিষ্টি কাচা রোদের মতো উজ্জ্বল
দেখাচ্ছিল গাড়িটা |

পাচঃ
ক্ষুদে ডাঁকু মেয়ের বিজন বাড়িতে

জ্লস্ত মশালের মতো পথ আলোকিত করে গহীন বনবাদাড়ের ভেতর দিয়ে চলছে গাড়িটা । দেখে চোখ ঝলসে গেল বনের কয়েকটা ডাকাতের! লোভ আর সাম্লাতে পারল না তারা।
“সোনার গাড়ি ! সোনার গাড়ি !” বলে চেঁচিয়ে উঠল তারা। দৌড়ে এসে পাকড়াও করল ঘোড়াগুলোকে। তারপর তারা খুন করে ফেলল সব কোচমান, গাড়োয়ান আর চড়নদারদের, আর গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে আনল জেরদাকে। _ “বাহ্‌, কী তুলতুলে-_কেমন সুন্দর মেয়েটা__-বেশ নাদুস-নুদুস তো !” বলল ডাকাতের সর্দার বুড়ি। লম্বা জটা-পাকানো একরাশ দাড়ি ছিল বুড়ির, আর চোখের মোটা ভূতে চোখগুলো ঢেকে গিছেল তার। জেরদার দিকে তাকিয়ে আবার বলল বুড়ি, “মেয়েটা দেখতে যেন ঠিক একটা ছোট্র ভেড়ির বাচ্চা। খেতে ভারী মজা হবে মেয়েটাকে ।”
তারপর একটা ধারাল ছুরি তুলে ধরল সে। রোদের মধ্যে কী ভয়ক্ষরভাবে চিকচিক করে জ্বলে উঠল ছুরিটা !
কিন্তু তখুনি “উহ” বলে চিৎকার করে উঠল বুড়ি। কারণ, তার পিঠে ঝোলানো তারই ছোট্র মেয়েটা জোরে কামড়ে দিয়েছে তার কানটা। “পাজি শয়তান কোথাকার !” ভীষণ গাল দিয়ে উঠল সে। জেরদাকে খুন করার আর সময় পেল না বুড়ি।
“ও খেলবে আমার সঙ্গে,” বলল ক্ষুদে ডাকু মেয়ে। “ওর মাফলারটা আর সুন্দর পোশাকটা দেবে আমাকে, আর আমার সঙ্গেই শুয়ে ঘুমোবে আমার বিছানায়।”
বলে, আবার ভীষণ কামড়ে দিল মেয়েটা। ব্যথার চোটে একেবারে তিনহাত লাফিয়ে উঠে ঘুরে দাড়াল সর্দার বুড়ি তাই-না দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল ডাকাতের দল।

“এ গাড়িটাতে চড়বো আমি,” বলল ক্ষুদে ডাকু মেয়েটা, আর তার কথাই সই। কারণ ভারি একগুয়ে মেয়েটা। অতি আদরে একেবারে বয়ে গিয়েছিল সে। জেরদাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িটাতে উঠে বস্ল সে, আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চালাতেও লাগল খুব জোরে। মাথার মাপে জেরদারই সমান মেয়েটা বিস্ত তার গায়ে ছিল ভীষণ জোর আর কাধগুলোও ছিল রীতিমতো চও্ড়া। গায়ের রং ছিল রাঙতার মতো ঝলসানো সাদা আর চোখদুটো ছিল একেবারে কাকের মতো মিশমিশে কালো। ছোট্ট জেরদার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল সে, “আমি তোমার ওপর রাগ না-করা পর্যস্ত তোমাকে খুন করবে না ওরা। তুমি একজন রাজকন্যে, না?” |
“না,” বলল জেরদা। তারপর বলে গেল তার সব কাহিনী। আর বলল কত ভালোবাসে সে ছোট্ট কয়কে।
ক্ষুদে ডাকু মেয়েটা মুখ ভার করে তাকাল জেরদার দিকে। তারপর বলল আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে, “আমি রাগ করলেও ওরা খুন করবে না তোমাকে। কারণ তখন আমি নিজেই তোমায় খুন করব।”
তারপর জেরদার চোখ মুছিয়ে দিয়ে ওর সুন্দর নরোম মাফলারটা নিয়ে নিল সে।
ডাকাতদের কেল্লার সামনে এসে দাড়াল গাড়িটা। কেল্লাটার চুড়ো থেকে গোড়া পর্যন্ত সবটাই ভাঙা। ওদের দেখে দীড়কাক আর পাতিকাক আর আরো সব ছোট ছোট পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে বেরিয়ে যেতে লাগল বড় বড় ফোকরের ভেতর থেকে। কেল্লার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মস্ত্ো বড় বড় কতকগুলো ডালকুত্তা। এক-একটা যেন আস্ত মানুষ খেয়ে ফেলতে পারে। বিকট মুখভঙ্গি করে তারা লাফিয়ে উঠল উচুতে, কিন্তু ডাকল না। কারণ, ডাকতে মানা ছিল তাদের
বিরাট ঘরটার পাথরের মেঝের ঠিক মাঝখানে একটা উনুন। গনগনে আগুন জ্বলছিল তাতে। উনুনটার উপরে একটা প্রকাণ্ড কড়াই। কড়াইটাতে মস্ত মস্ত কয়েকটা খরগোস আস্ত ভাজা হচ্ছিল তখন। খাওয়া-দাওয়া, পরে ডাকু মেয়েটা বললে জেরদাকে, “আমার আর আমার পোষা জন্তগুলোর সঙ্গে আজ রাতে ঘুমোবে তুমি” বলে ওর হাত ধরে নিয়ে গেল ঘরের এক কোণে, যেখানে একটা মস্তো খড়ের গাদা বিছিয়ে তার উপরে পাতা হয়েছিল একটা নরোম কার্পেট। কাপ্পে্টটার উপরে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েছিল একশোটা পায়রা ! ঘুমিয়েই ছিল পায়রাগুলো, কিন্তু ওরা আসতেই একটু নড়েচড়ে ঠিক হয়ে শুলো তারা।
“এগুলো সব আমার” বললে ডাকু মেয়েটা। তারপর খপ করে ধরে ফেললে হাতের কাছের একটা পায়রা । পা দুটোকে আলতো করে ধরে এমনভাবে ঝাকানি দিল যে, ঝটপট করে ডানা ঝাপটাতে লাগল পাখিটা। জেরদার মুখের কাছে ধরে আদেশ করল, “চুমো খাও পাখিটাকে !” দেয়ালের একটা বড় ফোকরে রাখা খাচার দিকে দেখিয়ে বলল, “এ দুটো কাঠ ঠোকরা। ভারি পাজি ওগুলো। খাচার দরজাটা একটু ফাক করেছ কি ফুডুৎ করে পালিয়ে যাবে । আর এই হচ্ছে আমার প্রিয় বন্ধু “বা” বলে শিং ধরে টেনে আনল একটা ব্লগা হরিণ। পেতলের চকচকে পালিশ-করা একটা চাকৃতি পরা তার গলায় । “বা-কেও বন্দি করে রাখতে হয় সাবধানে,” বললে সে, “নইলে সুযোগ পেলেই কেটে পড়বে সে-ও। প্রতি সন্ধেয় একটা লম্বা ধারাল ছুরি দিয়ে ওর গলায় সুড়সুড়ি দিই আমি, ফলে ভীষণ ঘাবড়ে যায় বেচারি ।”
বলে একটা লম্বা ছুরি বার করল সে দেয়ালের এক ফোকর- থেকে। তারপর সুড়সুড়ি দিতে লাগল হরিণটার গলায়। চার পা ছুড়ে লাফাতে লাগল বেচারি হরিণটা, আর তাই দেখে হেসে কুটিকুটি হল দস্যি মেয়েটা । তারপর জেরদাকে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
“ঘুমোবার সময়ও কি ছুরিটা সঙ্গে নিয়ে শোও তুমি ?” শুধোল জেরদা, আর ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগল ছুরিটার দিকে।
“আমি সব সময়ই ছুরিটা সঙ্গে নিয়ে ঘূমোই,” বলল ডাকু মেয়ে। “কখন কী ঘটে বলা যায় না তো! যাক, এখন আবার আমাকে শোনাও তো তোমার কয় নামের লক্ষ্মী ভাইটির কথা, আর কেনই-বা তুমি বেরিয়ে এলে এই বিরাট বিশ্বে।” জেরদা আবার তাকে শোনাল তার কাহিনী। বনের পায়রাগুলো “কু, কু” করে ডাকল তাদের খাচায়। অন্য পায়রাগুলো রইল ঘুমিয়ে। ডাকু মেয়েটা এক হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল, আরেক হাতে ধরে রাখল ছুরিটা। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম এল না জেরদার। দুচোখের পাতা এক হল না তার। বাচবে কি মরবে তাই জানে না সে। ডাকাতগুলো বসে আছে আগুনের চারদিক ঘিরে। হরদম খাচ্ছে আর নাচছে আর ফুর্তি করছে তারা। কী ভীষণ! দেখে ভয়ে এতটুকু হয়ে গেল সে।
তারপর হঠাৎ ডেকে উঠল বনের পায়রাগুলো। “কু! কু!” বলল তারা। “কয়কে দেখেছি আমরা। সাদা প্যাচাতে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার শ্রেজ গাড়িটা। তুষার রানির গাড়িতে বসে ছিল কয়। কু! কু! বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সেই গাড়িট’। আমরা ছিলাম সেই বনে। কু! কু! তুষার রানি দিলেন ফু, আর অমনি মরে গেল সবগুলো পায়রা। বেচে রইলাম শুধু দুইজন । কু! কু! আমরা দুজন। কু! কু!”
“কী বলছ তোমরা ?” শুধোল জেরদা। “কোথায় যাচ্ছিল তুষারকন্যে ঃ জানো তোমরা? জানো তার কিছু?”
“খুব সম্ভব লাপল্যান্ডেই যাচ্ছিল গো। সে-দেশে বরফ থাকে হরহামেশা। এঁ হরিণটাকেই জিজ্ঞেস কর না। দড়ি দিয়ে বাধা আছে যে হরিণটা। তোমার কাছেই আছে বাধা»
“বরফ আর তুষার থাকে হরহামেশা, দেখতে বেশ সুন্দর, খুব মজার সে-দেশ,” গানের মতো করে বলে উঠল হরিণটা।“সেখানে তুমি ঘুরে বেড়াতে পার যেমন খুশি বরফের রানি গরমের দিনে তাবু ফেলে সেখানে। কিন্ত তার আসল দুর্গটা হচ্ছে উত্তর মেরুতে, সেই যেখানে আছে একটা দ্বীপ। দ্বীপটার নাম স্প্টিস্বার্জেন।”
“আহা কয় ! ছোট !” ককিয়ে উঠল জেরদা।
“চুপচাপ ঘ্বুমোবে কি না? নইলে দোব ছুরিটা দিয়ে একেবারে এফৌড়-ওফৌড় করে !” গর্জে উঠল দস্যি মেয়েটা ।
সকালে উঠে জেরদা সব কথা বলল ডাকু মেয়েকে। বলল তাকে কী বলেছে বনের পায়রাগুলো, আর লম্বা শিংওয়ালা গলায় পেতলের চাকতি পরা হরিণটা। শুনে খুব গন্তভীর হয়ে ভাবতে লাগল মেয়ে। তারপর বলল মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে “তাইতো ! তাইতো !” বলে শুধোল হরিণটাকে, “লাপল্যান্ড চেন নাকি তুমি ?”
“আমার চাইতে বেশি আবার চেনে নাকি কেউ?” চোখ কপালে তুলে পরম আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বলল হরিণটা। তার কপালে দপ করে জ্বলে উঠল একজোড়া ড্যাবড্যাবে চোখ। “আমার জন্ম হল গিয়ে সে-দেশে” বলল সে, “আর আমি মানুষও তো হলাম সেইখানেই ! আহা, ছেলেবেলা কত ধুলো খেলাই না করেছি সে-দেশের বরফ-গলা ধুঁধূ করা মাঠের পরে !” ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে দারুণ ব্যথায় কেপে উঠল তার গলার স্বর।
“তাহলে শোনো,” ক্ষুদে ডাকু মেয়েটা বলল জেরদাকে। “সবাই চলে গিয়েছে দেখছ। কেবল মা আছে এখনো। সে থাকবেও এখানেই তবে প্রত্যেক দিনই দুপুরের দিকটাতে বড় বোতলটা থেকে খুব খানিকটা ওষুধ খেয়ে সে ঘুমোয় কতক্ষণ ! তখন দেখব আমি কী করতে পারি তোমার জন্যে।”
এই-না বলে সে লাফ দিয়ে উঠে গেল বিছানা থেকে। তারপর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আচ্ছা জোরে টানতে লাগল তার লম্বা দাড়িগুলো, আর বলল, “সুপ্রভাত, আহা আমার আদরের মা গো। আমার হোৎকা বুড়ি মা গো!” তার মা তখন নাক দিয়ে তার মুখে শ্বোচাতে লাগল। খোচাতে খোচাতে নাকটা তার ব্যথায় একেবারে লাল আর নীল হয়ে গেল। এ সবই হল কিন্তু শুধু খুশি আর আদরের জন্যে ! রে
কুড়ি মা ওষুধ খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোবার পরে ডাকু মেয়ে তার হরিণটাকে গিয়ে বলল আমার। কারণ খুব মজার দেখায় তখন তোমাকে । কিন্তু নাঃ, আর তোমাকে দুঃখু দেব না। তোমার দড়ি খুলে দিচ্ছি আমি, যাতে করে তুমি যেতে পার লাপল্যান্ডে। তবে পা চারখানাকে খুব চালু করে যেতে হবে তোমাকে, আর এই ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে যেতে হবে পিঠে করে। ওকে নিয়ে যাবে তৃষার রানির পুরীতে। ওখানেই আছে ওর খেলার সাথীটি। তুমি তো শুনেইছ, ও যা-যা বলেছে আমাকে! কারণ ও বলছিল বেশ জোরে-জোরেই, আর তুমিও শুনছিলে কান পেতে ।”
হরিণটা লাফিয়ে উঠল আনন্দে! ডাকু মেয়ে তার পিঠে চড়িয়ে দিল ছোট্ট জেরদাকে। বুদ্ধি করে ওকে বেধে দিল ভালো করে, যাতে পড়ে না যায়। বসতে দিল নিজের ছোট্ট আসনটা।
“তোমরা পশমি জুতোজোড়াটা নিয়ে যাও খুকু,” বলল সে, “কারণ খুব ঠাণ্ডা পড়ে সে- দেশে। কিন্তু তোমার মাফলারটা দেব না আমি খুকুভাই, কী সুন্দর মাফলারটা। তবে এ জন্যে তোমার কষ্ট হবে না কিছু। এই যে আমার মায়ের বড় বড় দস্তানাগুলো দিলাম তোমাকে। বাহ্‌, তোমার কনুই পর্যন্ত ঢেকে যাচ্ছে দস্তানায় ! এখন ঠিক আমার কৃচ্ছিৎ বুড়ি মায়ের মতোই দেখাচ্ছে তোমাকে !” বলে খুশির চোটে হেসে উঠল সে। কিন্তু জেরদা তখন কাদছিল আনন্দে। |
“দেখ বলছি, ছিচকীদুনে মেয়ে একদম দেখতে পারি না আমি,” বলল ডাকু মেয়ে। “না, মোটেই কাদতে পারবে না তুমি খুশি মনে যেতে হবে তোমাকে । এই দুটো রুটি আর মাংস নিয়ে যাও। ক্ষিধেয় আর কষ্ট পাবে না পথে।”
এ সবই বেধে দেওয়া হল হরিণটার পিঠে। ডাকু মেয়ে তারপর দরজাটার কাছে এসে, বড় বড় কুকুরগুলোকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ভাগিয়ে দিয়ে, ধারাল ছূরিটা দিয়ে কেটে দিল হরিণটার গলায় বাধা দড়িটা। হবিণটাকে বলল সে, “যাও এবার। কিন্তু দেখ যেন কোনো কষ্ট না হয় ওর” তারপর ওর দত্তানা-পরা দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল জেরদা, “বিদায় বন্ধু!”
হরিণটা ছুটল পাহাড-জঙ্গল, খাল-বিল পার হয়ে, নদীটা বায়ে ফেলে ডাইনের মাটার উপর দিয়ে। ছুটল ছুটল-_কেবল ছুটল সে, যত জোরে পারে। পেছনে হাকছে নেকড়েরা আর সামনে ডাকছে কাকেরা, চিলেরা। মাথার উপরে আকাশে জ্বলে উঠল লাল আলো!। যেন আগুন ধরে গেছে আকাশটায়।“ওগুলো আমার সেই সেকালের উত্বুরে বাতির সারি,” বলল হরিণটা। “দেখ কেমন জ্বলছে বাতিগুলো !” ছুটতে ছুটতেই বলল সে। বলে ছুটতে লাগল আরো-_আরো জোরে। বারি রর লু আর ছুটল। কিন্তু লাপল্যান্ডে এসে
যখন গৌছল তারা ফুরিয়ে গেল তাদের রুটি আর মাংসের খাবার।

ছয়ঃ
লাপল্যান্ডের দিদিমা আর ফিনল্যাণ্ডের ঠাকমা

জেরদাকে পিঠে নিয়ে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরের সামনে এসে হরিণটা থামল। ঘরটা এমন নড়বড়ে জরাজীর্ণ যে দেখলে যনে হয় এই বুঝি ভেঙে পড়ে। ছাদটা হেলে গিয়ে প্রায় মাটির সাথে এসে ঠেকেছে! আর দরজাটা এত নিচু যে চার-হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে-আসতে হয়। ঘরে তখন শুধু এক বুড়ি রয়েছে। গ্যাসের আগুনে সেঁকে তখন মাছ রান্না করছিল লাপল্যান্ডের এই দিদিমা । হরিণ তার কাছে এসে বলল, “পেন্নাম দিদিমা !” তারপর একে একে বলে গেল জেরদার সব কথা। তার আগে রি নিনালিল লিও সের রির ছেল নিজেরা হিসি
সরেস।
দিদিমা সব শুনে বলল, “আহা বাছার৷ ! কিন্ত তুষারকন্যের খবর তো আমি বেশি জানিনে। তার খবর আমার চেয়েও ভালো জানে আমার সই-_তোমাদের ফিনল্যান্ডের ঠাকমা। এখন তুষারকন্যেও শুনেছি সেই দেশেই আছে। রোজ সন্ধোবেলা “বেঙ্গল লাইট? দিয়ে আরতি করে। তা সে যে অনেক দূরের পথ গো নাতনি-_আরো একশো মাইল গিয়ে তবে যেতে হবে ফিনল্যান্ডের ঠাকমার বড়ি। তা, আমি তোমাদের একটা পত্তর লিখে দিচ্ছি শুটকি মাছের উপর। আমার আবার কাগজ নেই কিনা ! তোমরা সেই পত্তর নিয়ে আমার সইকে দিয়ো। তাহলে সে-ই তোমাদের সব সন্ধান বলে দেবে ।”
তারপর জেরদাকে আদর করে খাইয়ে_দাইয়ে শুটকি মাছে লিখন দিয়ে হরিণের পিঠে চাপিয়ে দিল। হরিণের পিঠে চাপিয়ে বেশ ভালে! করে বেধে দিল যাতে পড়ে না যায়। বলে দিল, “বেশ যত্বু করে সাবধানে রেখে দিয়ো কিন্তু পত্তরটা। হারিয়ে যায় না যেন।”
হরিণটা আবার চার পায়ে ঝড়ের বেগ এনে ছুটতে লাগল ।
ছুটতে ছুটতে, ছুটতে_
এক সময় এসে থামল ফিনল্যান্ডের ঠাকমার বাড়িতে। ঠাকমার বাড়িতে আবার একটাও দরজা ছিল না।
তাই জেরদা আর কী করে?
শেষ পর্যস্ত ঘরের চিমনিতেই টুক, টুক করে টোকা দিল জেরদা।
ঘরের ভেতরটা এত গরম ছিল যে, ঠাকমা নিজেই প্রায় আদুল গায়ে পায়চারি করছিল। তাই জেরদাকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার পশমি দস্তানা, জুতো, সব খুলে নিল। নইলে গরমে মরেই যেত জেরদা। আর হরিণটার মাথায় এক চাপ বরফ দিয়ে দিল। তারপর ঠাকমা জেরদার কাছ থেকে শুটকি মাছের লিখনটা নিয়ে পড়তে লাগল। শেষে বারবার, তিনবার পড়ে পত্তরটা একেবারে মুখস্ত হয়ে গেল ঠাকমার। মুখস্ত হয়ে যাওয়ার পর ঝোল-রাম্নার কড়াইয়ের ফুটন্ত জলের মধ্যে শুটকিটা ছেড়ে দিল। দেবেই-বা না কেন! কোন জিনিসই যে ঠাকমা বিনি কাজে নষ্ট হতে দেয় না।
এরপর হরিণটা সেই আগের বারের মতো ঠাকমার কাছে আগে নিজের কাহিনী বলল। তারপর বলল জেরদার দুঃখের কাহিনী। ঠাকমা তার ধূর্তোমিভরা চোখ তুলে পিটপিট করে ওদের দিকে চেয়ে সব শুনে গেল একে একে । একটা কথাও বলল না। তখন হরিণটা বলল, “ঠাকমা, তোমার পেটে অনেক বিদ্যে, আমি জানি। মাত্র একতার পাকানো সুতো দিয়ে তুমি পৃথিবীর সব হাওয়া-বাতাসকে বেঁধে ফেলতে পার, তা কি আর আমি জানিনে ভেবেছ। সব জানি ! কোনো সওদাগর যদি সেই সুতোর পয়লা পাক খোলে তা হলে তার পালে চমৎকার হাওয়া লাগবে, দ্বিতীয় পাক খুললে জোরে জোরে হাওয়া বইতে থাকবে। আর শেষের দুটো পাক খুললে এমন ঝড় বইতে থাকবে যে সাগর উাল-পাথাল হবে, আদ্যিকালের বিরাট বিরাট গাছ উপড়ে নিয়ে সমুদ্রে আছাড় দিয়ে ফেলে দেবে। কেমন ঠিক বলি নি ঠাকমা? হু, সু, আমি আমি যে সব জানি! দাওনা ঠাকমা ওকে একটা মন্তর, যাতে গায়ে একশ পালোয়ানের জোর পায়। আর সেই জোরে তুষার রানিকে হারিয়ে, ফিরিয়ে আনবে ওর কয়কে!
শুনে ফিনল্যান্ডের ঠাকমা বলল, “একশ জনের জোর? উন্থু, কিছু লাভ হবে না তাতে”
বলে, তাকের উপর থেকে পেড়ে আনল একটা বিরাট কাগজের পুটলি। তারপর, সেই পুটলি থেকে একতাড়া কাগজ বের করে মেঝের ওপর বিছিয়ে একমনে কী সব পড়তে লাগল ঠাকমা। কাগজের উপর আজব আজব হরফে লেখা যত রাজ্যের মন্তর। পড়তে, পড়তে, পড়তে ঠাকমার কপালে বিন্দু বিদু ঘাম জমে উঠল। তবু ঠাকমার পড়া শেষ হয় না।
শেষ হয় না তো, হয়ই না।
কিন্তু হরিণটা জেরদার জন্যে এত মিনতি করতে লাগল আর জেরদাও এমন করুণ নয়নে কাদো কাদো মুখে তার দিকে তাকাতে লাগল যে শেষ পর্যন্ত ঠাকমার মনটা একেবারে গলে গেল।
তখন, ঠাকমা হরিণটাকে ঘরের এক কোণে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার মাথায় আর এক চাপ বরফ দিয়ে কানে কানে বলল, “ছোট্ট খোকন কয় তুষারকন্যের কাছেই আছে। জায়গাটা কয়ের খুব ভালো লেগে গেছে। তুষারকন্যের মায়ায় কয় ঘুগ্ধ হয়ে আছে। ওর এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা জায়গা, তুষারকন্যের ওই রাজত্ব আর রাজপুরী। ভাঙা আয়নার টুকরোটার জন্যেই এ-সব ঘটতে পেরেছে। আয়নার একটা কণা ওর চোখের তারায় আর একটা কণা ওর কলজের সাথে এখনও আটকে আছে।
“্যদ্দিন পর্যন্ত টুকরোগুলো অমনিভাবে লেগে থাকবে, তদ্দিন পর্যস্ত ওর মায়ার ঘোর কাটবে না__তুষারকন্যের বশ হয়ে থাকবে।”
“কিন্তু তুমি জেরদাকে কিছু একটা মন্তর শিখিয়ে দাও না, যাতে রানির চাইতেও ওর বেশি শক্তি হয়, রানির মায়া কাটিয়ে দিতে পারে।” হরিণ মিনতি করে বলল ঠাকমাকে।
ঠাকমা বললেন, “ওর নিজের যা শক্তি আছে তার চেয়ে বেশি শক্তি আমি কোথায় পাব ! দেখছ-না কত বড় শক্তি ওর। মানুষ আর পশু সবাই ওর বশ, সবাই ওকে ভালোবাসে, মানে। এর চেয়ে বড় শক্তি আর আছে নাকি? ওর এই শক্তির আসল কারণ কী জানো? কারণ হচ্ছে, ও খুব ভালো আর খুব সুন্দর ছোট্ট খুকু !
“এখন ও যদি নিজেই তুষারকন্যের দেশে গিয়ে কয়ের চোখ আর কলজে থেকে মায়া আশা নেই। ও যদি নিজে না পারে তা হলে আমাদের দিয়ে আর কোনো আশা নেই।”
কথাগুলো বলে ঠাকমা হরিণকে তুষারকন্যের পুরীর পথ বলে দিল, “এখান থেকে সোজা দু মাইল গেলে তুষারকন্যের বাগান পাবে। বাগানের গোড়াতেই পাবে একটা লাল ফুলের ঝোপ! জেরদাকে পিঠে করে নিয়ে গিয়ে ঝোপটার পাশে নামিয়ে দিয়ে তুমি পা চালিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। খবরদার, দাড়িয়ে দাড়িয়ে আবার গপ্প জুড়ে দিয়ো না যেন।”
এই-না বলে, ঠাকমা জেরদাকে আবার তুলে দিল হরিণের পিঠে। আর, হরিণ, জেরদাকে নিয়ে ঝড়ের বেগে যেন উড়ে চলল তুষারকন্যের বাগানের দিকে।
“আমার জুতো ! আমার দস্তানা ! ওহ, সব ফেলে এসেছি।” দারুণ শীতে আর্তনাদ করে উঠল জেরদা। কিন্তু হরিণটার আর থামতে, কি ফিরে যেতে সাহস হল না।
এক দৌড়ে এসে থামল, সেই লাল ফুলের ঝোপটার পাশে, যেটার কথা ঠাকমা বলে দিয়েছে। থেমে, জেরদাকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিল। নামিয়ে আদর করে চুমো খেলো! ওকে। যুস্তার মতো কয়েক ফৌটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল ওর দুশ্গাল বেয়ে। চোখের জল মুছে, পেছন ফিরে, আর এক দৌড়ে ঠাকমার বাড়িতে ফিরে গেল।
আর, জেরদা ঠাণ্ডা, বরফ-ঢাকা ফিনল্যান্ডের খোলা মাঠে একা দাড়িয়ে রইল। জায়গাটায় গায়ের রক্ত-জমে-যাওয়া শীত। এই শীতে কিনা জেরদার না আছে জুতো, না আছে দত্তানা। কী যে এখন করবে, আর কোন পথে এগিয়ে যাবে জেরদা ভেবে পায় না। তারপরই হঠাৎ সামনের দিকে দৌড়ুতে লাগল সে।
দৌডুতে দৌড়ুতে গিয়ে পড়ল বিরাট একদল বরফের টুকরোর মাঝখানে । বরফগুলো সারিটা উজ্জ্বল এক সার মালার মতো জ্বলছে । আসলে বরফের টুকরোগুলো তখন মাঠের মধ্যে ছুটোছুটি করছিল। বরফের টুকরোগুলো যতই কাছে এগিয়ে আসে ততই বড় হয়ে উঠতে থাকে। আসলে, বরফের এই টুকরোগুলো সব তুষারকন্যের সেপাই-শান্ত্রি। তাদের রানির পুরী পাহারা দিচ্ছে। কী অদ্ভুত গায়ের গড়ন এক-এক জনের। তাদের কাউকে দেখাচ্ছে কুৎসিৎ কাটাওয়ালা সজারুর মতো, কাউকে বেড়ি-পাকানো, ফণা-তোলা সাপের মতো আবার কাউকে-বা দেখাচ্ছে ঝাকড়া-চুলওলা মোটাসোটা তাল্পুকের মতো। সবগুলোই চকচকে সাদা, জ্যান্ত বরফের টুকরো।
জেরদাকে দেখে তুষার রানির সেপাই- শাস্ত্র চারদিক থেকে ছুটে এসে ঘিরে ধরল।
জেরদা তখন আর কী করবে, আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করতে লাগল। জেরদা প্রার্থনা করে, আর, দারুণ ঠাণ্ডায় ওর মুখ দিয়ে ধোয়ার কুগুলির মতো নিশ্বাস বেরুতে থাকে । এই ভাবে জেরদা নিজের নিশ্বাসটাও দেখতে পায়।
জেরদা দেখে, আর, প্রার্থনা করে।
আর, সেই নিশ্বাস, আরো ঘন হয়ে উঠতে উঠতে শেষ হয়ে যায় ডানাকাটা পরী। এমনি করে নিশ্বাস থেকে অনেকগুলো পরি তৈরি হয়ে গেল। পরিগুলো মাটি ছোঁয়ার সাথে সাথে হয়ে উঠল মস্তো বড়ো। তাদের হাতে ঢাল-তরোয়াল, মাথায় লোহার টুপি। জেরদা যতই প্রার্থনা করে চলে, পরীরাও ততই সংখ্যায় বাড়তে থাকে। বাড়তে, বাড়তে শেষে পরীদের বিরাট একটা বাহিনী দাড়িয়ে গেল ওর চারপাশ ঘিরে। তুষার রানির বরফের সেপাইগুলোকে দারুণ আঘাত করতে লাগল তারা। হাজার টুকরোয় খান খান হয়ে গেল রানির সেপাইগুলো।
এবার সাহসে ভর করে পরম নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলল জেরদা। ডানা-কাটা পরীরা আলগোছে চাপড়ে দিতে লাগল ওর হাত আর পা-গুলো। তাই জেরদার আর খুব বেশি শীত লাগল না। পা চালিয়ে এগিয়ে চলল তুষার রানির পুরীর দিকে ।

সাত:
তুষার রানির পুরীতে

তুষার রানির পুরী। বরফের তৈরি তার দেয়াল, আর দরজা জানালা, শার্সি__সব, ফুরফুরে হাওয়ায় তৈরি। শও মহলা পুরীর মহলের পর মহল শুধু তুষার দিয়ে তৈরি। তার মধ্যে শি লাকি
চোখ ধাধানো আলোয় তুষারকন্যের শও মহলা পু |
যার রর মস্তো ম-স্তো একশটা মহল, দিনরাত খা খা করে__কাকপক্ষী জনমনুষ্যের চিহ্নি নেই। চার মিরার নে নরক
তুষারকন্যের এমন ঘে পুরী, তাতে রাজ্যির শীত ঠাসা। সারাটা পুর |
তি ক্লোন লানি নর আসর পর্যস্ত না। তেমন আসর বসলে ঝড়ের হাওয়ারা হয়তো গান গাইত অ নূর নিছে শে তর দিযে রে তাল ভার রে পারত!
কোথায় কী–?
একটু যে লুকোচুরি কানামাছি খেলবে, তার জন্যেও কোথাও কেউ নেই। সাঝের বেলা শেয়াল-কন্যেদের চায়ের আসর কোনোদিন বসে না।
তুষার দেশের রানি__তুষারকন্যের শও মহলা পুরী তো পুরী নয়, নিঝুম পুরী সব শুমশাম। সে পুরীতে শীতের রাজত্বি।
আর, সেই ফে মস্তো মহল-__
তার মধ্যিখানে রয়েছে এক হুদ! ঠাণ্ডায় জমে গিয়েছে হ্রদের জল। হাঙ্জার হাজার টুকরোয় ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে। আর এমন মজার সব টুকরাগুলো ঠিক এক ছাচের এক ছাদের। মনে হয় যেন কোনো শিল্পী হাতে ধরে তুলির টানে টানে ওগুলো বানিয়েছে।
এরি মধ্যিখানে তুষারকন্যের সিংহাসন।
পুরীতে এলে এইখানেই বসে তুষারকন্যে। কন্যে এই হৃদের নাম দিয়েছে “ঘুক্তি-যুকুর। কন্যে বলে, সারা পৃথিবীতে এমন আয়না নাকি আর দু’টি নেই।

সেই যে কয়, এই তুহিন পুরীতে ঠাণ্ডায় একেবারে কালী বরণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কয় মায়ায় আচ্ছন্ন, শোদবোধ সব ওর নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তুষারকন্যে চুমু দিয়ে কয়ের গা থেকে সব শীত টেনে নিয়েছে।
আর শোদবোধ থাকবেই_বা কেন, কল্জেটা যে কয়ের জমে বরফ হয়ে গিয়েছে
কয় একা একা বসে বরফের কতকগুলো পাতলা, চ্যাপ্টা টুকরো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। নানানভাবে ওগুলো জোড়া লাগাচ্ছে__আবার ভেঙে ফেলছে। টুকরোগুলো দিয়ে কী যেন একটা বানাতে চায়।
বরফের টুকরোগুলো নিয়ে এক মনে খেলা করছে কয়। কয় মনে মনে ভাবে, এই ছকগুলোর মতো-_আশ্র্য আর সুন্দর কিছুই নেই।
হবে-না কেন?
কয়ের চোখে যে মায়া আয়নার সেই টুকরো তখনও লেগে রয়েছে। বরফের ছকগুলো দিয়ে সে একটা কথা বানাতে চায়ু, কিন্তু এত যে ভাঙছে-গড়ছে তা যদি কথাটা বানাতে পারে! “অনাদি অনস্ত’-_এই কথাটা বানাতে হবে। তুষারকন্যে বলেছে, “ছক সাজিয়ে কথাটা যদি লিখতে পার, তবেই তোমার মুক্তি”
কথাটা লিখতে পারলে তৃষারকন্যে কয়কে একজোড়া নতুন স্কেট আর এই পৃথিবীটাও উপহার দেবে বলেছে।
তারপর তৃষারকন্যে আবার চলে গেল। যাবার সময় কয়কে বলল, “এবারে গরম দেশে যাচ্ছি? বলে, তুষার দেশের রানি হাওয়ার ডানায় ভর করে উড়ে গেল। মাইলের পর মাইল লম্বা সেই ম-স্তো মৃহলটার মধ্যে কয় একা বরফের টুকরোগুলোর পানে এক ধ্যানে চেয়ে ভাবছে তো ভাবছে, নড়ন নেই চড়ন নেই। চোখে তার পলক পড়ে না। দেখে মনে হয় যেন বরফের মতো জমে গেছে।
এমন সময়__
সেই খ-স্তো ফাকা মহলটার মধ্যে এসে ঢুকল ছোট্ট জেরদা। মহলের মধ্যে ঢুকেই তার চোখ পড়ল কয়ের ওপর। আর যেই-না দেখা ওমনি এক দৌড়ে কয়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ল। তারপর ওর গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে কত কথা বলতে লাগল। কিন্তু কয়ের মুখে রা নেই। তেমনি চুপচাপ বসে রইল। শেষে আর জেরদা সইতে পারে না। দুঃখে ওর বুক ফাটে, চোখ বেয়ে জল উপচে পড়ে কান্নায়। আর সেই চোখের জল গড়িয়ে গিয়ে পড়ল কয়ের বুকে। তারপর বুক চুইয়ে গিয়ে কলজেয় লাগল সেই জল আর অমনি ভেসে গেল কলজেয় আটকে থাকা মায়া আয়নার সেই টুকরোটা।
যেই-না মায়া আয়নার টুকরো ভেসে যাওয়া আর সঙ্গে সঙ্গে কয় জেরদার পানে চোখ লা চালকের চৌধাধুলে চাইতে উবে আতর জেরার জপ ধরি সেন গেয়ে উঠল।
গান শুনে কয়ও কান্নায় ভেঙে পড়ল। কয় এমন কান্নাই কাদল যে, চোখের জলের সাথে বেরিয়ে এল আয়নার অপর টুক্রোটা, চোখের সাথে যেটা লেগে ছিল।
ওটা বেরিয়ে যেতেই কয় জেরদাকে চিনতে পারল। আনন্দে লাফিয়ে উঠল কয়। বলল, “জেরদা, জেরদা, এদ্দিন কোথায় ছিলে তুমি।” তারপর চারপাশে চেয়ে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল, \”খ্যা, এ আমি কোথায় এসেছি। ইস জায়গাটা কী ঠাণ্ডা। আর দেখ, জায়গা কী বিচ্ছিরি রকমের বড়, আর কেমন ফাকা ।” তারপর আদর করে জেরদাকে জড়িয়ে ধরল। জেরদা আনন্দে একবার হাসে একবার কীদে।
ওরা এত খুশি হয়ে উঠল যে, সেই খুশির ছ্রোয়ায় চারপাশের বরফগুলো আনন্দে নেচে উঠল। তারপর নাচতে-_নাচতে-_নাচতে ক্লান্ত হয়ে বরফের টুকরোগুলো বিশ্রামের জন্যে গা এলিয়ে দিল।
আর অমনি__কী আশ্চর্য !
টুকরোগুলো পর পর এমনভাবে শুয়ে পড়ল যে, ঠিক সেই কথাটা লেখা হয়ে গেল।
এক্ষুনি হয়তো তুষারকন্যে বাড়ি ফিরবে।
যে কথা লেখা হলে কয়ের মুক্তি মিলবে, ওই তো সেটা__চকচকে বরফের হরফে লেখা হয়ে পড়ে আছে। তবে আর ভাবনা কী?
কয় আর জেরদা হাত ধরাধরি করে তুষারকন্যের পুরী ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাইরে এমন যে ঠাণ্ডা হাওয়া, ওরা বেরিয়ে আসতেই পথ ছেড়ে সরে দীড়াল, আর সুধ্যি মামা উকি দিয়ে দেখতে লাগল। ওদের পথ আলোয় আলোয় ভরে গেল। চলতে চলতে এক সময় ওরা এসে পড়ল লাল ফুলের ঝোপটার পাশে। সেখানে সেই লম্বা শিংওলা ব্গা হরিণটা ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সাথে করে এনেছে তার টুকটুকে রাঙা বউ।
এতদূর হেটে এসে কয় আর জ্রেরদার খুব খিদে পেয়েছে। বলগা হরিণের রাঙা বউ শুকনো মুখ দেখে ওদের দুধ খাইয়ে দিল। তারপর দুজনাতে কয় আর জেরদাকে পিঠে নিয়ে ছুটতে লাগল।

আট:
আমার কথাটি ফুরোল

ছুটতে ছুটতে প্রথমে এসে থামল ফিনল্যান্ডের ঠাকমার বাড়ি। ওদের দেখে ঠাকমার ফোকলা গালে হাসি আর ধরে ন|। আদর করে গরম ঘরে নিয়ে যায়__ঠাকমার গরম ঘরে গিয়ে ওরা দিব্যি চাঙা হয়ে উঠল।
ঠাকমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা আবার বেরিয়ে পড়ল ফাওয়ার সময় ঠাকমা ওদের দেশের পথের অনেক হদিস দিয়ে দিলেন। তারপর, সেখান থেকে কয় আর জেরদা এসে পৌছুল লাপল্যান্ডের দিদিমার বাড়ি। কয়কে নিয়ে জেরদা ফিরে এসেছে দেখে দিদিমা ভারি খুশি। তক্ষুনি ওদের নতুন পোশাক তৈরি করে দিলেন। পোশাক তৈরি হয়ে গেলে দিদিমা বসলেন ওদের শ্রেজ গাড়িটা মেরামত করতে।
কয় আর জেরদা আবার পথে বেরিয়ে পড়ল। বল্গা হরিণ, হরিণের টুকটুকে রাঙা-বৌ আর দিদিমা ওদের একেবারে লাপল্যান্ডের শেষ সীমা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। তখন সেখানে বসন্তের প্রথম সবুজ ঘাস দেখা দিয়েছে। ওখানে এসে তারা হরিণ, হরিণ-বৌ আর লাপল্যান্ডের দিদিমার কাছ থেকে বিদায় নিল।
“বিদায়!” বলল সবাই।
ওরা আবার পথ চলতে লাগল। বসন্তের হাওয়া বইছে চারদিকে । বনে বনে ফুলের মেলা। মাঠে মাঠে দেখা দিয়েছে সবুজ ঘাসের আস্তরণ। কিচিরমিচির করে গাইছে ছোট ছোট পাখিরা।
চলতে চলতে ওরা এক বনের ধারে এসে পৌছল। আর ঠিক সেই সময় বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা ঘোড়া । ঘোড়ার পিঠে বসে আছে একটা মেয়ে । এগিয়ে আসতেই জেরদা চিনতে পারল, ডাকাতদের সেই ক্ষুদে মেয়েটা যেন। তাই তো, সেই ক্ষুদে মেয়েটাই তো, জেরদা ওকে এখানে দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে উঠল।
ওদের দেখে মেয়েটা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে ঈাডাল। বাড়িতে বসে থেকে থেকে ঘেন্না ধরে গেছে দস্যি মেয়ের। তাই এখন সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর যত সব অচিন দেশ দেখতে বেরিয়ে পড়েছে। সবার আগে এসেছে উত্তরে । এখানে ভালো না লাগলে যাবে আর কোনো দেশে।
“তোমাকে বেশ লাগে কিন্তু দেখতে 1” ছোট্ট কয়কে বলল দস্যি মেয়েটা ।
জেরদা ওর চিবুক নেড়ে শুধোল রাজপুতুর আর রাজকন্যের কথা। জানতে চাইল কেমন আছে তারা।
“বিদেশে বেড়াতে গেছে,” বলল ক্ষুদে ডাকু মেয়ে।
“আর কাকটা?” শুধোল জেরদা।
“মরে গেছে বেচারি !” বলল ডাকু মেয়ে। “তার বউটা বিধবা হয়ে এখন শুধু উড়ে বেড়ায় শোকে, পায়ে একটা কালো সুতো বেঁধে।
কাকটা মরে গেছে শুনে জেরদার ভারি দুঃখ হল। মুক্তোর মতো ফৌটা ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল ওর গাল বেয়ে। আহ, কী ভালোই_না বাসত ওকে কাকদাদা আর কাক বৌদি।
“কই, তোমার কথাটা তো এখনো শোনা হয়নি! কী করে কোথায় গিয়ে পেলে ওকে ?” শুধোল ওকে ক্ষুদে ডাকু মেয়ে।
জেরদা আর কয় তাকে সব কথা খুলে বলল একে একে।
“একটুখানি গোলমাল, ঝকমারি, ফিসফাস।
তারপর সব কিছু ঠিকঠাক শেষমেস।”
পদ্যের মতো মিল দিয়ে বলে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল ডাকু মেয়ে। তারপর ওদের দুজনার হাত ধরে বলল, ওদের দেশে গেলে কয় আর জেরদার সাথে দেখা করে আসবে।
বলে, ঘোড়ার পিঠে চেপে ডাকু মেয়ে আবার পথ চলল, ধুলো উড়িয়ে ছুটল তার ঘোড়া ।
কয় আর জেরদাও আবার পথ চলে। চলতে চলতে একই সময় ওদের কানে এল গির্জের ঘণ্টা, আর, ওরাও চিনতে পারল উচু উচু পাহাড়ের সুচোল চুড়োগুলো আর তারই পাশে ওদের বিরাট শহরটা।
ওদের সেই শহর। শহরে পৌছে তারা ছুটল দিদিমার দোরগোড়ায়। সিড়িটা বেয়ে উপরে উঠল। উঠে, ঘরে ঢুকল। সব কিছু সেই আগের মতোই. রয়েছে সেখানে। মস্ত্ো বড়ো দেয়ালঘড়িটা তেমনি আগের মতো বেজে চলেছে ।“টিক ! টিক !” তার হাতের মতো কাটা দুটোও ঘুরে চলেছে তেমনি। কিন্তু বাড়ি এসে এ-ঘর, ও-ঘর ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ করল, এখন বেশ বড় হয়েছে তারা ।
ছাদের চিলেকোঠায় খোলা জানলাটার পাশে, গোলাপঝাড়টায় ফুটেছে অনেকগুলো ফুল। ঝাড়ের পাশে তেমনি পাতা রয়েছে তাদের আসন দুটো।
কয় আর জেরদা নিজের নিজের আসনে গিয়ে বসল। আলো ঝলমলে রোদে গা মেলে দিদিমা তখন বাইবেল গড়ছিলেন।
কারো মুখে কথা নেই। শুধু গাছে গাছে ফুলেরা দুলে উঠে খেলা করে হাওয়ার সাথে।