কয়েক ফোঁটা জোসনার রঙ – ২

মাছ ধরার নাকি রাশি থাকে। কোন রাশি কে জানে। মীন রাশি হতে পারে। ঐ রাশির ছবিতে তো দুটো জোড়া মাছ দেখি সব সময়।
কেউ কেউ বলতো শঙ্করের বাপের মাছের রাশি আছে। যাদের মাছের রাশি আছে তাদের কোন চিন্তা নেই । পানিতে ছিপ ফাতনা না ফেললেও মাছ উঠে যাবে। আবার কেউ কেউ অন্য কথা বলতো। বলতো, শঙ্করের বাপ খুব ভাল মাছের চার বানাতে পারে। আর সবাই কেঁচো বা বাসি পাউরুটির দলা ব্যবহার করতো চার হিসাবে। চার আবার দুই রকমের হত। মিষ্টি চার আর পচা চার। পচা গুড় , সরিষার খৈল অমন হাবিজাবি ব্যবহার করে মিষ্টি চার বানায়। মৃগেল, সরপুঁটি আর রুই মাছ মিষ্টি চার পছন্দ করে। কাতল, বোয়াল এরা পছন্দ করে পচা চার। কেঁচো , গরুর মগজ দিয়ে পচা চার বানায়।
শঙ্করের বাপকে কোন রকম চার ব্যবহার করতে দেখিনি। কনডেনস মিল্কের কৌটায় কয়েকটা কেঁচো আর বাসি পাউরুটির সাথে পিঁপড়ার ডিম মিশিয়ে আনত। বড়শি ফেলার মিনিট খানেকের মধ্যেই ফাতনা ডুব দিত। কায়দা করে টান দিতেই কালো পানির উপর রুপালি ঝিলিক দেখা যেত। কালো মেঘের দলায় যেমন বিজলি চমকে উঠে। হাতের তালুর মত বড় বড় সরপুঁটি ধরত শঙ্করের বাপ। কি রঙ ! যেন দুধের সরের মাছটা। সবচেয়ে বেশি ধরত নেপালি চাকুর মত ফলুই মাছ। আর সবাই যখন টাকি মাছ ধরছে তখন একটার পর একটা ভিন্ন রকম মাছ এসে ধরা পড়ছে শঙ্করের বাপের ছিপে। নিয়তির অমোঘ টানের মত।
বেশি মাছ ধরত না বুড়ো।
খুব বেশি হলে চারটে মাছ ধরা হলেই জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরত বুড়ো। দূর থেকে বাপকে আসতে দেখলেই দৌড়ে চলে আসতো পিচ্চি তিন মেয়ে। সবাই সাহায়্য করতে চাইত বাপকে। কেউ চটের ব্যাগটা ধরত, কেউ খালি কনডেনস মিল্কের কৌটা হাতে নিত। শেষ জন হয়তো দৌড়ে যেত মাকে খবর দিতে।
কপালে সস্তা মেতে সিদুর দেয়া শঙ্করের মা কি যে খুশি হত তখন। আহা। রান্নায় বসে যেত দ্রুত। বস্তিতে বারোয়ারী মাটির চুলা। গোলাপের পাপড়ির মত গনগনে কয়লা চুলার ভেতরে। মউসুমি সবজি দিয়ে মাছের ঝোল আর ফ্যানসা নরম ভাত রান্না হত। হারিকেনের কমলা রঙের আলোতে খেতে বসে যেত সবাই। এক মাত্র ছেলে শঙ্কর ো চলে এসেছে ততক্ষণে। পুকুরে দুই ডুব দিয়ে বসে গেছে সবার সাথে।
পৃহিবিতে কত মানুষ কত ভাবে আহার করে। সব চেয়ে দুঃখী, যারা একা একা খাবার খায়। সামনে যাদের কেউ থাকে না, মমতা দিয়ে পাতে এক ফালি মাছ বা জুইফুলের মত ভাত যাদের কেউ তুলে না দেয় তারা বড্ড দুঃখী। অতীতের অনেক কাহিনিতে দেখা গেছে নগ্ন নির্জন রাজপ্রাসাদে কোন রাজা মুঠো মুঠো ক্যাভিয়ার খাচ্ছিল একা বসে। কিন্তু মন পরে আছে অতীতের দারিদ্র্যমাখা দিনে। যখন শুধু মাত্র পাউরুটি আর মাখন খেয়েছিল পরিবারের সবাই মিলে। দুঃখী মানুষেরা একা খায়।
অমন অনেক দুঃখী মানুষকে আমি একা খেতে দেখেছি। ট্রেনের ইসটিশনে , ফুটপাথে পথে ঘাটে। কাজেই শঙ্করেরা ছিল সুখী । আজ কি হয়েছে কে জানে !
আজ শঙ্করকে দেখে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। চিনতে পারছিলাম না। লম্বা ঢোলা ট্রেটনের ফুল প্যান্ট আর পুরানো কিন্তু পরিষ্কার হাফ হাতা জামা পড়তে দেখতাম সব সময়। আজ প্রথম বার পুরানো একটা পাঞ্জাবি পড়তে দেখলাম। তারচেয়ে বড় কথা মাথায় সাদা রঙের টুপি। চোখে সুরমা ।
শঙ্করের পাশে পাশে বুক চিতিয়ে হাঁটছে এক হুজুর। সবাই বলছে এই হুজুরই কলেমা পড়িয়ে শঙ্করকে মুসলমান বানিয়েছে। হুজুর খুশি। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে রোজ হাস্রের ম্যদানে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। একজন কাফেরকে সঠিক পথে আনার জন্য বেহেস্ত পাওনা তার।
শঙ্করকে ঘিরে অনেক বড় সড় জটলা। মহল্লার বুড়ো হাবড়া কয়েকজন শঙ্করের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিচু গলায় পরামর্শ দিচ্ছে কি কি যেন । পুরো মহল্লা সরগরম হলেও শঙ্করের চেহারায় কোন ভাব নেই। নিলিপ্ত ভাবে চারিদিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু ওর মা, বাবা বা ক্রন্দনরত পিচ্চি তিন বোনের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। যেন সেই পাঁচজনের কোন অস্তিত্ব ই নেই । ছিল না কোন কালে। ওর কানে যেন মোম গলিয়ে ঢেলে দেয়া হয়েছে। সেই অডেসি মহাকাব্যের মত।
কোন একটা দ্বীপের পাশ দিয়ে কখনই কোন জাহাজ যেতে পারে না। দ্বীপ থেকে মায়াবী অপার্থিব সুরে গান ভেসে
আসে। আর সেই গানের সুরে নাবিকদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। উত্তাল সাগরে ঝাঁপিয়ে পরে। বাধ্য হয়ে মহাকাব্যের নায়ক তার জাহাজের নাবিক আর মাঝিমাল্লাদের কানে তরল মোম দিয়ে বন্ধ করে দেয়। কেউ যেন শুনতে না পারে বিভ্রম সৃষ্টি করা মায়াবী সেই সঙ্গীত।
অবাক হয়ে শঙ্করকে দেখছিলাম । ওর নাম এখন শঙ্কর না। দীন ইসলাম। কি অদ্ভুত ! অথচ ওর বাপ মা আর্যদের প্রাচীন দেবতার নামে নাম রেখেছিল। আর্যদের আদি দেবতাদের একজন এই শঙ্কর। মহাদেব, শিব, নীলকণ্ঠ কত বিচিত্র নাম তার।
পাঁচ হাজার বছর আগের বৈদিক সাধুরা বিশ্বাস করতেন ঈশ্বরের তিনটে রুপ আছে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর।
ব্রহ্মা প্রতি মুহূর্তে এই বিশ্ব সংসার সৃষ্টি করেই যাচ্ছেন। উনার কাজই সৃষ্টি করা। নতুন নতুন বিশ্ব সংসার আর প্রান।
বিষ্ণু এই ত্রিভুবনের পালন কর্তা। সব কিছুই রক্ষা আর প্রতিপালন করছেন তিনি। ক্ষীরের সাগরে অনন্ত নাগের উপর ঘুমিয়ে আছেন । হাতে শঙ্খ, পদ্ম , চক্র আর গদা। যখন সৃষ্টির সংকট হয় তখন ধূলা মাটির পৃথিবীতে নেমে আসেন তিনি। বিচিত্র সব রুপ নিয়ে। কখন মাছ হয়ে এসে মহাপ্লাবনের সময় পূর্ণবানদের রক্ষা করেন। আবার কখন হলুদ কাপড় পরা কৃষ্ণ হয়ে কুরুক্ষেত্রে পাপীদের বিনাশ করেন।
আর শেষ হচ্ছেন মহাদেব। শঙ্কর। পুরানের মতে হিমালয়ের বরফ পরা শিখরে বাঘের ছালের উপর চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে আছেন তিনি । গলায় মাফলারের মত পেঁচিয়ে আছে ভয়ংকর একটা সাপ। পাশেই ত্রিশূলটা গাঁথা। ডমরু নামে পিচ্চি একটা বাদ্যযন্ত্র ঝুলে আছে। ওটা মুঠো পাকিয়ে নড়াচড়া করলেই টম টম শব্দ করে বেজে উঠে।
মহাপ্রলয়ের দিনে উঠে দাঁড়ান মহাদেব। উনার কাজই সৃষ্টি ধ্বংস করা। প্রলয় নৃত্য করতে করতে সব ধ্বংস করেন ভদ্রলোক। সৃষ্টি ধ্বংস করার পর সব ডুবে যায় অন্ধকারে। ৪৩২ কোটি বছর কাটে অন্ধকারে । তারপর নতুন করে সৃষ্টির কাজ ধরেন ব্রহ্মা ।
অন্তত পুরান এই রকম বলে। বিশ্বাস করা না করা যার যার মর্জি। কোন ধর্মই জোড় করে কিছু চাপিয়ে দেয় না। বা বিশ্বাস ক্রাতে চায় না। হ্যাঁ, নরকের ভয় বা স্বর্গের লোভ হয়তো দেখায়। ওটার দরকার আছে । নইলে মানুষ আর পিশাচের মধ্যে তফাৎ থাকে না ।
বস্তির এই শঙ্কর সন্ধ্যায় সময় মহল্লার মসজিদে নিলিপ্ত ভাবে নামাজ পড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। বুড়ো বাপ, মা বা পিচ্চি তিন বোনের দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত মিলল না ওর। সে রাতে শঙ্করের পরিবার উপোস করে রইল। অন্ধকার ঘরের দাওয়াতে হতাশ ভাবে বসে রইল বুড়ো বাপ। কি ভাবছিল বেচারা সেই সময় কে জানে !
মা খানিক পর পর আর্তনাদ করে উঠছিল- ‘ বাবা শঙ্কর রে।’
পিচ্চি তিন বোন কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে হারিয়ে গেল ঘুমের অতলে। সেই রাতে অচেনা রকমের দুঃখ কষ্ট বাসা বাঁধল শঙ্করের বাপ মায়ের ঘরে। পরদিন থেকে আর কখনই শঙ্করকে দেখিনি। তবে লোক মুখে খবর পেয়েছিলাম। অনেকেই শঙ্করকে বাহবা দিয়েছিল, পূর্ব পুরুষদের ভুল ধর্ম ত্যাগ করে সত্যের আলোতে নিজেকে শুদ্ধ করে নিতে পেরেছিল বলে। নিঃসন্দেহে মরার পর অনন্তকাল বেহেস্তে থাকবে শঙ্কর। বেহেস্তের বগানে সকাল বিকাল হাঁটাহাঁটি করবে। ওকে সেবা করার জন্য প্রস্তুত থাকবে হাজার হাজার সুন্দরী হুরী আর গেলমান। সালসাবীল নামক ঝরনার পানি দেয়া হবে ওকে কাচের নীল পাত্র ভর্তি করে।
আমি খোঁজ পেলাম কোন একটা মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়েছিল শঙ্কর। সেই মেয়ে শঙ্করকে ধর্মান্তরিত হবার জন্য চাপ দিচ্ছিল। এক দিকে বুড়ো বাপ মা আর পিচ্চি তিন বোন। অন্য দিকে সদ্য জন্ম নেয়া প্রেমিকা। খুব চিন্তা করতে হয়নি শঙ্করকে। যৌবনের ধর্ম সেরা ধর্ম। বাপ মা আর পূর্ব পুরুষদের ধর্মের চেয়ে লাউ ডগার মত প্রেমিকাটা বেশি প্রিয় ওর কাছে।
আশা করি শঙ্কর সুখেই ছিল।
তবে পৃথিবীতে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে গেছে ওর পরিবার। উপার্জনের কেউ ছিল না। কোন একটা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কাপড় সেলাই করার কাজ ধরল শঙ্করের মা। বোতাম প্রতি বা সেলাই প্রতি মজুরি পেত সে। বুড়ো বাপ ছুটা কাজ করতো। যা পেত তাই। তিন বোনকে মানুষের বাড়িতে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। সন্ধ্যায় সময় কাজ শেষ করে ফিরত ওরা সন্ধ্যা তারার মত । বাসি খাবার নিয়ে আসতো বোনদের কেউ কেউ। আগের মত নিয়মিত মাছ ধরতে যেত না বুড়ো বাপ। কি একটা অবসাদে ধরেছিল বেচারাকে । মাঝে মাঝে ছিপ বড়শি নিয়ে বের হত। নিজের পছন্দের জায়গায় বসে থাকতো উদভ্রান্তের মত । চতুর সরপুঁটি তার বড়শিতে কামড় দিয়ে পালিয়ে যেত। ফিরেও তাকাত না বুড়ো । আয়নার মত কালো জলে ঘাই দিত রুপালি মাছের লেজ। তাতেও চমকে উঠত না শঙ্করের বাপ। মাঝে মাঝে বুকের অতল থেকে বের হয়ে আসতো এক একটা দীর্ঘশ্বাস।
পুকুর পারে গফুর হাজির বাড়ির জানালার কাচে ডুবে যাওয়া সূর্যের আলো পড়তো। মনে হত অদ্ভুত দুর্লভ কমলা রঙের রত্ন পাথর দিয়ে জানালাগুলো তৈরি করা হয়েছে। সেখানে আনমনে চেয়ে থেকে হাহাকার করে উঠতো বুড়ো- শঙ্কর, বাপ আমার।
পুকুরের দুই পাড়ের জলজ ঘাসের মধ্যে হারিয়ে যেত পরাজিত বুড়ো মৎস্যশিকারির দীর্ঘশ্বাস ।