ঘরটা পুরো অন্ধকারে ঢাকা ছিল। নাহ! ভুল বললাম বোধহয়! একপাশের কোণে প্রায় নিভু নিভু একটা হারিকেন জ্বলছিল, শুরুতে ঠিক চোখে পড়েনি। ঘরটার ডান কোনে একটা টেবিল, জমানো বইয়ের স্তুপ আর একগাদা কাগজের ভিড়ে খুব শান্ত হয়ে বসে আছেন একজন লোক। লোকটার চোখ বন্ধ করা। অন্ধকারে, হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় অবশ্য ঠিক ভালো করে বুঝা যায়না। তবু, কেন যেন মনে হলো কোন এক অভিমানে কিংবা ক্রোধে আবার কে জানে, হয়তো হতাশায় চোখ বন্ধ করে রেখেছেন তিনি।
আমি বেশ খানিকখন ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। লোকটাকে ঠিক ডাকব কীনা বুঝতে পারছিনা। এই সময়ে ডাকাটা কি উচিত হবে? ভাবলাম।
আবার না ডেকেও তো কোন উপায় দেখছিনা। এই লোকটার সাথে আমার কথা বলা খুব দরকার। আমি আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম।
সাহস করে ডাকলাম, শুনছেন?
– কি চাই?
বাজখাই গলায় খানিকটা যদিও চেচিয়েই বললেন লোকটা। কিন্তু তবু কোথায় যেন একটু প্রশ্রয়ের রেশ পেলাম।
– একটু বসতে পারি? আপনার সাথে কিছু কথা বলার ছিল।
কথাগুলো বলে উত্তরের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। বেশ খানিকটা সময় চলে গেল, ওদিক থেকে কোন উত্তর পেলাম না। ঘোঁত! করে গলায় শব্দ করলেন একবার কেবল। বোধহয় খুব কঠিন কিছু বলতে গিয়ে শেষমেষ নিজেকে থামিয়ে নিলেন। খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কি করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। শেষমেষ খানিকটা কাচুমাচু করেই বসে পড়লাম।
– কি জন্য এসেছেন?
চোখ খুললেননা, একটুও নড়াচড়া করলেননা। প্রশ্ন করেছেন ঠিকই, কিন্তু আমার ধারনা তিনি উত্তরের জন্য অপেক্ষায় নেই। কারণ আমার ধারনা কি জন্য এসেছি সেটা তিনি ইতোমধ্যেই জানেন। বসতে পেয়ে কিছুটা যেন স্বস্তিবোধ করলাম।
– আমি কেন এসেছি আপনি জানেন না?
এবার একটু জোর দিয়েই বললাম। উত্তর এলো সঙ্গে সঙ্গেই,
– জানি!
চমকে উঠলাম। আমার পুরোপুরি ধারনা ছিল, তিনি অস্বীকার করবেন। অবশ্য স্বীকার করাতে আমার লাভই হলো। ভরসা পেলাম। উদগ্রীব হয়ে বললাম, জানেন যখন আমাদের একটু সাহায্য করুন!
– কিভাবে?
– আমাদের মুক্ত করুন। একের পর এক তৈরি হয়ে আমরা সব ঘোঁট পাকিয়ে উঠছি! আমাদের প্রকাশ করুন, মানুষের কাছে পৌছে দিন।
অনুরোধ করলাম। খানিকটা যেন আশার সঞ্চারও হলো। উত্তরের জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম। সেইসাথে কোথায় যেন একটু লোভও হলো। মুক্তির আশা! কি বলবেন ওনি? অবশেষ কি শুনব সেই কথাটা? যেটার জন্য এতোদিন অপেক্ষায় থাকা?
– পারবোনা!
নির্লিপ্ত উত্তর এলো। এতো দ্রুত, এতো অবলীলায় তিনি আমার স্বপ্নটাকে নাকোচ করে দিলেন যে আমি চমকে উঠার সময়টুকুও পেলাম না। কিছুটা সময় পেরোল। চুপচাপ। কেউ কোন কোন কথা বললাম না। কথাটা আমি শুনেছিলাম শুধু, এবার যেন বুঝতে শুরু করলাম। ওনার নির্লিপ্ত “পারবোনা”-র মানে আমার কাছে কতটা ভয়াবহ! কতটা দুঃসহ! দিনের পর দিন মুক্তির আশা লালন করে একটা বাক্যের পাঁকে বারবার মিলিয়েই কি যাব শুধু?
ভয় আমার কেটে গিয়েছিল অনেক আগেই। এবার ক্রোধ হলো। অভিমানতো ছিলই। তাই কখনও যা করিনি, এবার তাই করলাম।
– কেন নয়? আমাদের কি দোষ?
গলার স্বর উচু করে বললাম আমি। বলতে গেলে খানিকটা চেঁচিয়েই। লোকটার চোখ এতোখন বন্ধই ছিল। এতো কথার মাঝেও তেমনি অনড় হয়েই বসেছিলেন। এবার যেন একটু গায়ে লাগল তাঁর। ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। চোখও খুললেন। ঠান্ডা চাহুনি, সেখানে ক্রোধ ঘৃণা অভিমান মিলে এক অদ্ভুত শীতলতা। সবকিছু যেন বহুদিন ধরে জমে আছে, যেকোন সময় উগড়ে পড়তে চাইছে কিন্তু আবার যেন নিশ্চল হয়ে থাকছে। আমার ভয়টা আবার ফিরে এলো। ক্রোধ মিলিয়ে গেছে অনেক আগেই। হঠাৎ অমন করে চেঁচানোর জন্য অনুতাপও যেন লাগলো কিছুটা।
– সত্যিই জানতে চান?
অদ্ভুত ঠান্ডা একটা কন্ঠস্বর। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কি বলব, ভেবে পেলাম না। চুপ করে রইলাম?
– বলছি, শুনার সাহস আছে?
এবার ঠিক উলটো ঘটলো। জমানো সেই ক্রোধ ঘৃণা অভিমান এবার যেন ফেটে পড়লো। আমি জমে গেলাম।
– বাজারে তো তোমাদের কেউ খাচ্ছেনা আর? দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরে তোমাদের যে লেখব সে কাগজের পয়সা কে দিবে? কেউ কিনবে তোমাদের?
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। লোকটা ক্রোধে স্বরে কথা বলছেন, কিন্তু তাঁর ক্রোধ আমার চোখে পড়ছেনা। আমি দেখছি তাঁর চোখ। সব আক্রোশ, ঘৃণার আড়ালে যে একরাশ অভিমান জমে আছে সেটা কার প্রতি? আমাদের?
আমি একটি গল্প, আমি ফিরে যাচ্ছি। আমার পিছু পিছু আমার সকল চরিত্ররা। আমাদের যিনি ভাবছেন, তিনি আমাদের নিয়ে আর লিখবেন না। তাহলে কি আমরা হারিয়ে যাব?