সুগ্রহ

এখন অনেক রাত। চুপচাপ রুমের জানলাটা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আব্দুল হাকিম। উদ্দেশ্য প্রতি মাসের মত আজও আকাশের গায়ে ঐ সোনালী রঙের উজ্জ্বল আভাটার দেখা পাওয়া। যা কি-না ও আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে প্রথম দেখতে পেয়েছিল হঠাত্ করেই। সেই থেকে প্রতি মাসের এদিনটায় ও গভীর রাতে জানলা খুলে বসে থাকে শুধু এক পলক ঐ আলোক রশ্মিটাকে দেখবে বলে। আসলে ওটা এত সুন্দর এবং জমকালো যে , দেখলেই প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। মনের মধ্যে বয়ে যায় এক সুশীতল চমত্কার নির্মল হাওয়া। যা বার বার মনে করিয়ে দেয় মহান স্রষ্টা আল্লাহর সৃষ্টির রহস্যের কথা। আব্দুল হাকিম ঐ রশ্মিটাকে নিয়ে অনেক ভেবেছে , কিন্তু কোন কুল কিনারা করতে পারেনি এখনো। আজ তাই একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে যে , রশ্মিটাকে প্রথমে সে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবে , তারপর যে করেই হোক রহস্য সে উদঘাটন করেই ছাড়বে। কিন্তু এখনোতো ঐটাকে দেখাই যাচ্ছেনা! তাছাড়া অন্য মাসেতো এতো দেরি হয়না! তবে কি আজ দেখতে পাবেনা সে? দূর ছাই , কিসব ভাবছি! এক বছরের মধ্যে কখনোতো এমন হয়নি। দেখতে পাবই ইনশাআল্লাহ। আব্দুল হাকিম মনে মনে এসব ভাবছে আর প্রবল আগ্রহ নিয়ে বসে আছে আকাশের দিকে মুখ করে।

এদিকে কখন যে রাত গড়িয়ে এল , টেরই পায়নি আব্দুল হাকিম। বুঝতে পারল যখন মসজিদের মিনার হতে ফজরের আযানের সুমধুর ধ্বনি কানে এসে বাঁজল। তো কি আর করার , প্রচন্ড আক্ষেপ আর আফসোস নিয়ে ওযূ সেরে চলে গেল মসজিদ পানে। নামায শেষ করে যথারীতি রুমে প্রবেশ করে জানলাটা দিয়ে আরেকবার তাকাল আকাশের দিকে। এরপর একটা অর্ধঃশ্বাস ফেলে লাইটটা অফ করে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত ঘুম পরীরা যেন জায়গা করে নিল আব্দুল হাকিমের ছোট দুটি চোখে।

হঠাত্ ঘুম ভেঙে গেল আব্দুল হাকিমের। কি ব্যাপার? এত সুন্দর সুমিষ্ট আতরের খুশবু আসছে কোথা থেকে! ভাবতে ভাবতে মাথাটা একটু উঁচিয়ে চারপাশ ভালো করে দেখতে লাগল ও। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলনা। গন্ধটা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল আরো। ওমা একি! আমি এ কোথায় শুয়ে আছি? চারিদিকে এত সোনালী আলোয় আলোকিত কেন? তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখছি? নিজেকে প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিয়ে হাতটায় আলতো করে একটু চিমটি কাটল , নাহ! জেগেইতো আছি! অবাক কান্ড! কিন্তু এ আমি কোথায় এলাম? আর কেমন করেইবা এলাম? তবে এর চার পাশের আলোগুলো যেন ঠিক আকাশের বুকে ভেসে উঠা আলোর মতো!

এমন সময় কেউ একটা যেন গলা খাকড়ি দিয়ে উঠল।আব্দুল হাকিম একটু বিচলিত হয়ে পুনরায় সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠল, কে? কোন শব্দ নেই। প্রায় ৩০ সেকেন্ড পরে সেই খাকড়ি দেয়া কন্ঠস্বরটা জানান দিল, ভয় পাবেন না প্লিজ। আমরা আপনার কোনই ক্ষতি করবোনা। আব্দুল হাকিম এবার জানতে চাইল, কিন্তু আপনারা কে?আর আমি এখানে কি করে? এবার সেই একই কন্ঠস্বর বলে উঠল, আসলে আমরা সুগ্রহের মানুষ।আর আপনাকে আমরাই নিয়ে এসেছি। সুগ্রহ! এটা আবার কোথায়? কখনো নাম শুনিনিতো! তা আমাকে এখানে আনলেন কেন?-আব্দুল হাকিমের জিজ্ঞাসা। আসলে আমরা আপনাকে এখানে এনেছি আমাদের একটা বিশেষ প্রয়োজনে, কাজ শেষ হয়ে গেলেই দিয়ে আসব। সেই কন্ঠস্বরটা উত্তর করল। আব্দুল হাকিমের পাল্টা প্রশ্ন-আমি আবার কোন কাজে পারদর্শি যে, আমাকে ভূগ্রহ থেকে একেবারে সুগ্রহে তুলে আনলেন? -আসলে আপনিই পারেন আমাদেরকে সহায়তা করতে। -মানে? -পরিষ্কার করে বলছি। আসলে আমরা দীর্ঘকাল জুড়ে বিজ্ঞান সাধনায় মগ্ন ছিলাম অদ্ভূত সব ক্ষমতা লাভের জন্য। বছর খানেক আগে আমরা এতে পুরোপুরি সফল হতে পেরেছি। কিন্তু এরপর আমরা অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে জানতে পেরেছি যে, আসলে আল্লাহ নামে একজন মহান স্রষ্টা আছে। সেইসাথে এও জানতে পারলাম যে , পৃথিবী নামক একটি গ্রহে অসংখ্য আল্লাহ ভক্ত লোক বাস করে। তাই আমার উপর দায়িত্ব পড়ে আমি যেন এমন কাউকে সেখান থেকে নিয়ে আসি , যে কি-না আমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে বিশদ শিক্ষা দিতে পারবে। এরপর আমি দীর্ঘ একটি বছর পৃথিবীর প্রতিটি এলাকায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরেছি এমন কাউকে। সবাইকে বিশদ পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয়েছে , আপনিই সে ব্যক্তি যিনি আমাদেরকে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে শিক্ষা দিতে পারেন। – আব্দুল হাকিম এবার বিনয়ের সুরে বলে উঠল , সকলের মধ্য থেকে আমাকে নির্বাচন করার জন্য ধন্যবাদ। সেইসাথে মহান প্রভুর দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া। কিন্তু আমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে? যদি ঠিকঠাক জবাব পাই , তাহলেই কেবল আমি আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারি। – আপনি নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। – আচ্ছা তুমিই কি তাহলে সেই আলো , যাকে আমি দেখার জন্য উদগ্রীব থাকতাম? তাছাড়া তোমরা কি শুধু আলোক রশ্মিই , না-কি তোমাদের কোন কায়া আছে? আর থাকলে দেখতেই বা কেমন? আমি দেখতে চাই। আসলে এতক্ষণ হল তোমার সাথে কথা বলছি , অথচ আলোক রশ্মি ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা! – বুঝতে পেরেছি , আসলে আমিই সে আলো। আর আমরা কেবল আলোক রশ্মি নই , আমাদের নিজস্ব কায়া রয়েছে। বলার সাথে সাথে আলোক রশ্মিটা কেমন যেন বড় হয়ে যেতে যেতে একটা মানুষেরই মতো প্রাণীর আকার ধারণ করল। সবই ঠিক আছে , কেবল দেহখানা যেন উজ্জ্বল সোনালি রঙের। তাছাড়া দেখতে এতই সুন্দর যে , আল্লাহর কাছে সেজদায় লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তুমি সত্যিই মহান রহস্যের আধার। – নিন , এবার খাওয়া দাওয়া সেরে নিন , আজ থেকেই আপনার পাঠদান শুরু হবে। বাহিরে আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

দেখতে দেখতে অনেক দিন হয়ে গেল , এর মধ্যে সুগ্রহের সকলেরই শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। তারা এখন একচ্ছত্র মালিক মহান আল্লাহর একনিষ্ঠ পূজারি। আজ আব্দুল হাকিমের দেশে ফেরার পালা। এখানে সবার সাথে একত্রে ছিল কি-না , কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে। সুগ্রহের অধিবাসীরা অনেক করে বলেছিল , আপনি এখানে থেকে যান। কিন্তু তা কি কখনো হয়? আব্দুল হাকিমের এখন অনেক কাজ। তাকে দেশে ফিরতেই হবে। ফিরে সবাইকে সুগ্রহের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলতে হবে , হে ভূগ্রহবাসী! তোমরা এসে দেখে যাও এরা কেমন আল্লাহভীরু , যারা বিজ্ঞানের দিক থেকে তোমাদের চেয়ে কোটি বছর এগিয়ে। আর তোমরা! ছি : ধিক তোমাদের! ধিক তোমাদের নাস্তিকতার বিজ্ঞানকে!