পহেলা ফাল্গুন

১.
অরিত্রের ঘুম ভেঙেছে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে।চরম আতঙ্ক আর অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে রুশার দিকে। একটু আগেই মেয়েটা ওর বুকের উপর মাথা রেখে কেঁদে চোখ ভাসিয়েছে।অশ্রু যখন অরিত্রের বুকে পড়েছে তখন হালকা ঠান্ডায় অরিত্রের ঘুম ভেঙে গেছে।
অরিত্র জানে মেয়েটা এখন তার কাঁদা থামাবে না,তাকে থামাতে হলে এখন গল্প শোনাতে হবে। রুপকথার গল্প।বিয়ের ২য় রাত থেকেই রুশার এই আবদার মাথা পেতে নিয়েছে। মাত্র ২ মাসের প্রেমে রুশার সাথে অরিত্রের বিয়ে হয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় না জেনেছে রুশার পরিবার না জেনেছে অরিত্রের।অভিভাবক বলতে কাজির কাছে নিরব, শাহেদ,তমা,ছোঁয়া এই চারজন দস্তখত দিয়েছে।

-রুশা,আজ গল্প না শুনলে হয় না?সকালে তো ক্লাস আছে আমার,ফান্ডামেন্টাল স্ট্যাটিস্টিকসের তিনঘন্টার ব্রেকফ্রী ক্লাস।
-বিয়ের আগেও ক্লাস থাকতো,তখন সারারাত হোয়ার্টসএপে স্ট্রিমিং করতা মনে আছে?
রুশার কথার সাথে তর্ক করলে সময়ই যাবে এর বেশি লাভ হবে না এটা ভালো করেই জানে অরিত্র।
-এই অরু!চলো না আজ একটু বাইরে হাঁটি।
-ঘড়ি দেখেছো?রাত ২ টা ১৭ বাজে, এখন বের হওয়া যাবে না।
-বিয়ের আগে বললেই তো বের হয়ে যেতে।এখন পুরোনো হয়ে গেছি তাই না?
-আরে মুশকিল,সকালে ক্লাস আছে বললাম তো,আর তোমরা মেডিকেলের স্টুডেন্টদের মধ্যে এস্হেটিক ব্যাপার আসে কিভাবে বলবা?
-ওকে ঘুমাও।
-রুশা,রেডি হ…
কথাটা অরিত্র শেষ করতে পারেনি,গাঢ় চুম্বন আর আলিঙ্গনে দুটি সত্তা ততক্ষণে একহয়ে মিশেগেছে। রুশাকে অরিত্রর মায়াবতীর মত লাগছে। টানা টানা চোখ,পাতলা না। মোটা চোখ,যে চোখের অশ্রু অরিত্রর প্রিয়। অরিত্র জানে রুশার পাগলামি একদিন থেমে যাবে,থেমে ওর নিজের চঞ্চলতা।

২.
ওরা হাটঁছে বাংলামোটরের দিকে,ইস্কাটন পার হয়েছে। রাস্তা পুরো ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দু-একটা গাড়ি আসছে। কোলাহলের ঢাকায় এইসময়টা খুবই উপভোগ্য। রাস্তায় শুধু সোডিয়াম বাতির আভা সাথে ওদের ছায়া।খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দুজনকে।
-আর কত হাঁটব?অরু,রিক্সা ডাকো।
-আমি বের হতে চাই নি,তুমি ডাকো।
-আমি ডাআআকবো?সিরিয়াসলি?
-না না না,আমি ডাকছি।তোমার তো একটু হাঁটলেই পা ব্যাথা করে।হাজার হলেও নিজস্ব বউ তো?কষ্ট কি সহ্য হয়?
-আধিক্যেতা বাদ দিয়ে রিক্সা ডাকো।

ওরা এখন যাবে লালবাগের দিকে,হাইকোর্টের সামনে থেকে হালকা নাস্তা করে আবার এগোবে।হাইকোর্টের সামনে ধোঁয়া ওঠা কাবাব সাথে ছোটো পরোটা রুশার খুব প্রিয়।এই শীতের রাতে নিরীহ অরিত্রকে রুশা সপ্তাহে তিনদিন কাবাব আনতে পাঠায়।অরিত্র চোখ গরম করতে করতে চলে আসে।সারাদিন ক্লাস,টিউশনি করিয়ে বউয়ের জন্য মাঝরাতে যখন মালিবাগ থেকে হাইকোর্ট গিয়ে কাবাব আনতে হবে তখন মনের অজান্তেই যেকোনো ছেলে নিজের বউকে ডাইনী উপমা দেবে।অরিত্র অতদূর যায়নি তবে খাদক উপমা দিয়েছে।

-রুশা,তোমার হাত ধরে থাকলে আমার আর শীত লাগে না।
-ওহ,জড়ায়ে ধরলে কি তাইলে পুড়ে যাও?
-আরে না,বললাম হাত ধরলে ভয় কাজ করেনা।
-সত্যি?
-হ্যাঁ।

আচমকা অরিত্রের হাত চেপে ধরেছে রুশা,রুশার মুখে হাসি।অরিত্র বুঝতে পেরেছে সামনে অদ্ভুত কিছু একটা অপেক্ষা করছে তার জন্য।

-এই যে হাত ধরলাম এবার ঐ পুলিশের সামনে আমারে দৌড়াতে দৌড়াতে নিয়ে গিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে আসো। আমি হাত ধরলে তো তোমার ভয় লাগেনা।
অবিশ্বাসের চোখে রুশার দিকে তাকিয়ে আছে অরিত্র।মেয়েটা হাসছে,চোখ উজ্জ্বল।বড়বড় চোখে যেন বিজয়ের উল্লাস।ঠোঁট তালে তাল দিচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর আন্দোলিত হচ্ছে।মেয়েটার সেন্স অফ হিউমারের প্রশংসা সেই পরিচয়ের প্রথম থেকেই করে অরিত্র।
-তুমি মাঝে মাঝে এমন কথা বলো যে আমি নিজেই তোমাকে আমার শত্রু ভেবে ফেলি।
-ওরে আল্লাহ,তুমি জানো না বউরা স্বামীদের শত্রু হয়?যায়হোক আজ লালবাগ যেয়ে কাজ নেই।বাসায় চলো।
-কেন?চলেই তো এলাম।
-না, বাসায় চলো।
রিক্সা এখন আবার মালিবাগের সেই ঝুপটি ঘরের দিকে এগোচ্ছে।রিক্সাচালকের প্রতি প্যাডেলে হাজারো গল্পের বুনন আঁকছে হাজারো গল্প কথক।অরু-রুশার মতো একরুম উইথ এটাচড বাথের গল্পের শুরুটাও হয় এমন কোনো রিক্সার প্যাডেলে।

৩.
আজ বইমেলা শুরু হয়েছে।তারিখটা যদিও ২ ফেব্রুয়ারি। সিটি নির্বাচনের জন্য এবার বইমেলা একদিন পেছানো।অরু-রুশার তালিকায় থাকা অর্ধেকের বেশি বই-ই মেলা শুরুর আগেই হাতে পৌঁছেছে,অনলাইন শপগুলো প্রি-অর্ডারে ছাড়সমেত বই দেওয়ায় এ সুযোগটায় লুফে নিয়েছে অরু-রুশা।তবে মেলাতে যেতে তো হবে।সেক্ষেত্রে রুশা কঠোর ভাবে নিষেধ মেলায় একা যাওয়া।বইমেলায় পহেলা ফাল্গুন একসাথে যাবে রুশা-অরু।১৩ ফেব্রুয়ারি রুশার প্রথম পোস্টমর্টেম ক্লাস।১৪ তারিখ পহেলা ফাল্গুন।এই মেডিকেলের স্টুডেন্টদের মাথায় শুধু মেডিকেল রিলেটেড কথাবার্তা ছাড়া কিছু আসেনা।ঘুরতে যাবা”আজ প্রফের পর।চলো খেতে যায় বাইরে?আইটেম আছে তিনটা কালকে।চলো গ্রামে যায়?শনিবার কার্ড।এত্তসবের মাঝেও অরু-রুশা একটা পারফেক্ট জুটি।
-কালকে আমি মেলায় যাবো রুশা।
-কালকে কি পহেলা ফাল্গুন?
-না তো।
-তোমাকে পহেলা ফাল্গুন এর আগে মেলায় যেতে নিষেধ করা হয়েছে।ভুলেও এর আগে ওমুখো হয়ো না।হলে তুমি থেকে তুই তে নামতে আমার ঘড়ি ধরে ১ ন্যানোসেকেন্ড লাগবে।
-আচ্ছা হয়েছে,ক্লাস করি নিউমার্কেট। আর শাহবাগ মেলায় যেতে পারব না!আল্লাহর কাছে এরকম দজ্জাল বউ চেয়ে আসছিলাম?
-তুমি ভুলেও যেতে পারো।চলো তোমার হাতে মেহেদী দিয়ে লিখে দেই।
-ক্লাসের সবাই কি বলবে?
-এখন ঘুমাও,সকালে আমার আইটেম দুইটা।
-একটু “আজ তোমার নিমন্ত্রণ ” পড়ে শোনাবা?৩-৪ মিনিটের ব্যাপার।
-ওলে বাবুতা লে।কালকে আইটেম বলছি না।
-হুমম।
অভিমানের সুরে অরিত্রের হুমম বলার সাথে রুশা পরিচিত।এই অভিমান ভাঙাতে রুশাকে এখন হুমায়ূন আহমেদের আজ তোমার নিমন্ত্রণ পড়ে শোনাতে হবে।ও জানে এই অভিমান কতটা বিশুদ্ধতায় ভরা।যাতে কোনো পাপ নেই,নেই অপরাধবোধ।

৪.
১৩ ফেব্রুয়ারি

১১ তারিখ থেকে অরিত্র নিখোঁজ।বিয়ের ২ বছরের মধ্যে ও কখনো এভাবে না বলে কোথাও যায়নি।ফোন টাও অফ।রুশা প্রায় সব বন্ধুদের কাছে খবর পাঠিয়েছে।অরিত্রের পরিবারকেও জানিয়েছে।জিডি করা হয়েছে রমনা থানায়।দুদিনে কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি অরিত্রের।

দুপুর ৩টে নাগাদ একটা লাশ পৌঁছেছে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে,চেহারা বোঝা যাচ্ছে না।পুলিশ কেস,তাই পোস্টমর্টেম হওয়ার কথা।

অরিত্রের মনে হতো রুশাকে সাদা এপ্রোনে মায়াবতীর মত লাগে। তবে কাকতালীয় হলেও সত্যি রুশা কখনো অরিত্রর সামনে এপ্রোন পরে যায়নি।রুশা একটা চেয়ারে বসে ভাবছে আজ অরিত্র সন্ধায় বাসায় আসবে, ও এপ্রোন পরেই ওর সামনে যাবে।কপালে একটা কালো টিপ দিবে।হাতে নীল চুড়ি,চোখে মোটা কাজল পরে ওকে কি আসলেই মায়াবতী লাগবে?

রুশা এবং ওর বন্ধুরা মুখে মাস্ক,হাতে গ্লাভস পরে দাড়িয়ে আছে ডোমের পাশে,সাথে ওদের স্যার ড.জিয়া করিম।সবার মনেই কৌতুহল।কি বিভৎস চেহারা।মুখের সামনের দিকটা পুরো থেতলানো।ঝলসে গেছে। ড. জিয়া করিম মেয়েদের সামনে দাড়াতে নিষেধ করলেন।পায়ের থেকে দেখা শুরু করেছেন ডাক্তার,সবাইকে বোঝাচ্ছেন আর চলছে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিশ্লেষন।
রুশার কেমন জানি গা গুলিয়ে আসছে।খুব কাছের কাউকে হারানোর তীব্র একটা ব্যাথা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে ওর বুকের ভেতরটাতে।কেন এমন হচ্ছে ও জানে না। হাতের পঁচা কাপড়টা সরাতেই রুশা তার জীবনের সবথেকে বড় ধাক্কাটা পেল।সে খুব করে চাচ্ছে তার সেন্স ধরে রাখতে।তার ইচ্ছে হচ্ছে ঘটনাটা একটা দুঃস্বপ্ন হোক।সবাই চুপ হয়ে আছে।সদ্য ৩ দিন আগে দেওয়া মেহেদী টা লাশের হাতে এখনো চকচক করছে।মায়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে পুরো লাশকাটা ঘর।তারমধ্যে সবথেকে উজ্জ্বল লেখাটা এখন পুরো পরিবেশ ভারি করে ফেলেছে।ডাক্তারী হাতে লেখা “রুশার আদেশ পহেলা ফাল্গুনের আগে বইমেলা হারাম।”