Site icon খিচুড়ি

জঙ্গলে মঙ্গল নেই – দ্বিতীয় পর্ব

দুই

গতকালই অফিসের সমস্ত কাগজপত্র গুছিয়ে অন্য এক কলিগকে খুব অনুনয় বিনয় করে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে আসিফ। বহুদিন পর দূরে কোথাও কাজে যাওয়া। আর যদি সেটা পার্বত্য চট্টগ্রামে হয় তাহলে তো কথাই নেই। আসিফের মায়ের খুব শখ ছেলে ফরেস্ট বিভাগে চাকরি করবে,পাহাড়ের কাছাকাছি কোন সরকারি কোয়াটার পাবে। আর সেখান থেকে পাহাড় সাগর নদী ও বন জঙ্গল সবটা দেখা যাবে। বাকী জীবনটা তিনি এভাবেই সুখ করে কাটাতে চান । মায়ের স্বপ্ন পুরোপুরি সত্যি না হলেও আংশিক হয়েছে। সে এখন বন বিভাগের কর্মকর্তা। কলমের একটা দাগেই অনেক কিছু হয়ে যায়। আসিফ মনে মনে ভাবছে,সফরের এই সুযোগটা মোটেও খারাপ নয়। ঘুরেও আসা হবে এলাকাটাও চেনা হবে। সুবিধা করতে পারলে না হয় ওখানেই চাকরিটা নিয়ে বদলি হওয়ায় চেষ্টা করবে। মনে মনে হাসতে লাগলো আসিফ। তখন হয়তো মায়ের মুখে একটা অমায়িক হাসি দেখতে পাবে সে। জঙ্গল হয়েছে তো কি হয়েছে। সেখানে তো আর বাঘ ভাল্লুক এসব থাকবেনা নিশ্চয়ই। কোলাহল মুক্ত এলাকা আর সবুজের মায়াময়রূপ তারও বেশ পছন্দের। তাছাড়া সবমিলিয়ে ভালোই হবে। জঙ্গলই যদি মানুষের মঙ্গল বয়ে আনে তাতে অবশ্য ক্ষতির কিছু নেই। লোকে বলে না.. “জঙ্গলেই মঙ্গল ” । কেমন যেন পাহাড় নদীও জঙ্গলের মায়া এখন আসিফকেও টানছে।

কংক্রিটের শহরের যান্ত্রিকতায় জীবন বড্ড ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। ব্যাগটা কাঁধে তুলে ধীরে সুস্থে চলে এলো কমলাপুর রেলস্টেশনে। জীবনের এতোটা পথ পারি দিয়েও রেলগাড়িতে সফরের সৌভাগ্য তার কখনো হয়ে উঠেনি। লম্বা একটা হুইসেল দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। ঝকঝক শব্দে মনের আনন্দ কতটা উপভোগ হচ্ছে তা বলে বুঝাবার মতো নয়। কখনো জানালা দিয়ে দেখছে আবার কখনো ফুরফুরে হাওয়ায় উড়তে ইচ্ছে করছে। দূরের দৃশ্য দেখতে মন এতোটাই প্রভাবিত হলো যে কখন ঘুমিয়ে পড়লো বলতে পারবে না। ঘুম ভাঙতেই সব কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে। সূর্যটা আর আকাশে দেখা যাচ্ছে না। সন্ধ্যা নামছে বোধ হয়। উঁকিঝুঁকি মেরে চাঁদের অপেক্ষা করছে আসিফ। আকাশ মেঘলা থাকায় চাঁদ দেখা গেলো না। তবে জানালায় ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসে আবারও হারিয়ে গেলো আসিফ। এবার আর ঘুমা ভাঙলো না। একেবারে চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে গাড়িটা থেমে গেল। লোকের হট্টগোলে ঘুম পালিয়েছে। ব্যাগ নিয়ে নেমে পরলো সে। স্টেশন থেকে বের হতেই ফোন বেজে উঠলো। অমিতাভ চ্যাটার্জী ফোন করেছেন। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে মজিবর তাকে নিতে আসবে এটা জানিয়ে লাইন কেটে দিলেন তিনি। কোন কিছু ভাববার আগেই একটা লোক হুট করে সামনে এসে দাঁড়ালো। কালো চাদর মোড়ানো। জলজলে চোখ। আধাপাকা চুল। আসিফ চমকে উঠলো। অনেক রাত হয়েছে। স্টেশনে লোকের সমাগমও কম । চারিদিকে কুয়াশায় কেমন ধুয়াসা হয়ে আছে। হঠাৎ লোকটা তাকে লক্ষ করে বললো,আপনে আসিফ তালুকদার? জী। আমি মজিবর। আপনেরে নিতে এসেছি। বাহিরে গাড়ি অপেক্ষা করতাছে। চলেন এইহানে বেশীক্ষন থাকন ঠিক হইবো না। জায়গাটা সুবিধার না। নেশাখোরদের খপ্পরে পরলে খবর আছে। আসিফ আর মজিবর গাড়িতে উঠে বসলো। মজিবর নিজেই ড্রাইভ করছে। কিন্তু লোকটা আমাকে কিভাবে চিনলো!হয়তো স্যার বলে দিয়েছেন তাই কালবিলম্ব না করে সরাসরি নিয়ে চলছেন। একটা কালো চাদরে তার মুখটা ডাকা ছিল। তাই কুয়াশায় চেহারা বোঝা যাচ্ছিলো না।

রাত এখন অনেকটা নিরব। শুধু গাড়ির খটখটে শব্দটাই শোনা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে দুই একটা বাজার হাট থাকলেও জনমানবহীন। কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছে। মজিবর তার সাথে এখন আর কোন কথা বলছে না। কিছু জানতে চাইলে হুঁ আর হ্যাঁ বলেই চুপ হয়ে যাচ্ছে। দূরে কোথাও কেও গুমরে কেঁদে উঠলো মনে হয়! নাহ দীর্ঘ পথের যাত্রায় হয়তো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এসব নিছক মনে ভুল। ঘন জঙ্গল আর অন্ধকার পথে হাঁকিয়ে চলেছে গাড়িটা। বনের ভেতর কয়েকজন লোক আগুনের সামেন জোড় হয়ে আছে। গাছপালার ফাঁকফেকর দিয়ে পিনপিনে আলো দূর থেকে গোল গোল আকৃতি নিয়ে ভাসছে। নিশাচর পাখিগুলো ডাকাডাকি করলেও গাড়ির খটখটে শব্দের কাছে তা একেবারে ক্ষীনকায়। হেডলাইটের আলোয় সামনের পথ এতোটা স্পষ্ট না দেখা গেলেও কিছুটা পরিস্কার। রাস্তার পাশে পাথরের একটা বোর্ড আছে। তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা বলিগাঁও ২ কিঃমিঃ। তার পাশে হলুদ রঙের বোর্ডে কি যেন সতর্কতা দেখানো হয়েছে। পুরোটা পড়ার আগেই স্বজোড়ে ব্রেক কষলো মজিবর। গাড়ির সামনে বয়োবৃদ্ধ একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা লাঠি। কি অদ্ভুত ব্যপার। একটু হলেই তো লোকটা চাপা পরতো। আসিফের চোখে চোখ পরতেই বৃদ্ধ খিলখিল হাসি দিয়ে বললো,মিথ্যা, সব মিথ্যা। এখানের মিথ্যেরা অনেক ভয়ংকর। মিথ্যা… সব মিথ্যা। মজিবর গাড়ি থেকে নেমে তাকে তাড়িয়ে আবার গাড়ি ছুটাতে শুরু করলো। রাত বোধহয় অনেক হয়েছে। অন্ধকারে ঘড়ির কাঁটা ঠিক দেখা গেলো না। মোবাইলে ভালো চার্জও নেই। নয়তো ফ্ল্যাস অন করে দেখা যেতো।

বলিগাঁও থেকে বাঁ দিকের ইট বিছানো পথ ধরে এগুচ্ছে গাড়িটা। এবড়োখেবড়ো রাস্তার দুই পাশে কিছু সুপারি গাছের সাড়ি। গোড়ার অংশ ভালোভাবে দেখা গেলেও উপরের দিকটা কুয়াশায় ঢাকা। শিরশিরে একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। তবে আশ্চর্য হলেও সত্যি, এতো কুয়াশা থাকার পরও কেন জানি শরীরে শীতের ছিটাফোঁটাও অনুভব হচ্ছে না। বরং বড্ড গরম লাগছে । মাথাও শরীর কেমন ভাড়ী হয়ে আসছে।
অনেকটা সময় ধরে পথ চলতে চলতে হঠাৎ স্টার্ট বন্ধ হতেই বোধগম্য হলো চলে এসেছি। বিশাল একটা এরিয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। অনেকটা আগেকার জমিদার বাড়ির মতো। দোতলা থেকে নিচে নেমেছে বেশ চওড়া সিঁড়ি। বড় বড় দরজা আর জানালা। বাড়ির এক পাশে মন্দিরও আছে দেখছি। আশেপাশের বড় বড় গাছগুলো ছায়ার মতো লাগছে। আচমকা একটা তেল বাতি নিয়ে হাজির হলো মজিবর। চলুন ওপরে যাইতে হইবো। সে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দোতলায় এসে একটা রুম দেখিয়ে বললো, এইহানেই থাকবেন। হাত মুখ ধুয়ে আহেন আর আমি দেখি কিছু ব্যবস্থা করন যায় কিনা। আসিফ লজ্জায় হুট করে বলেই ফেললো, না না এসবের আর দরকার নেই । আমি ব্যাগের মধ্যে করে কিছু খাবার এনেছি তাতেই রাত চলে যাবে। অনেক রাত হয়েছে। আপনি বরং ঘুমিয়ে পড়লে ভালো হয়। বুড়ো মানুষ কতটা পথ খেটেছেন। মজিবর খিটখিটে হাসির ঢেউ তুলে বললো, আমি রাইতে ঘুমাই না। চোক্ষে ঘুম আহে না। আপনে ঘুমান। মজিবর চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে দিলো আসিফ। পেছনের জানালা দিয়ে তরতর করে বাতাস এসে ঘর ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। দক্ষিনের জানালাটা বন্ধ করে দিলো,শেষ রাতে ঠান্ডা লাগতে পারে বলে। মুহূর্তে নিরব নিস্তব্ধতা নেমে এলো। বিছানাটা এক রাশ ঘুমের বায়না করেছে। ক্লান্ত শরীর আর ধকল নিতে চায় না। নিশাচর জেগে আছে আর আসিফ তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

ভোরের আলো ফুটিফুটি করছে। রাতের আধাঁর শেষে পৃথিবীতে দিন নেমে এলো। সূর্যের আলোকচ্ছটায় চকমক করছে নদীটা। পাখিরা নিদ্রা ছেড়েছে বহু আগেই। সবুজ ঘাসগুলো শিশির কণা মাথায় তুলে অপেক্ষা করছে কখন সূর্য উঠবে। আবছা কুয়াশার ভোর। তেজহীন রক্তমাখা সূর্যটা ধরনীর বুকে সদ্য প্রসব হলো। আসিফ গভীর ঘুমে গলাব্দি ঢুকবে আছে। এমন সময় দরজায় তীব্র খটখট শব্দে লাফিয়ে উঠে সে। নিজের ঘর হলে কখনোই এমনটি হতো না। আসিফের মা নিজ হাতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলতেন,আসিফ উঠে পর। বেলা হয়েছে আফিস যাবি না?কিন্তু এখানে এমন আশা করা নিছক বোকামি। আড়মোড়া ভেঙে দ্রুত বাছানা ছাড়তে হলো। ফোনের স্কিন দেখতে দেখতে দরজা খুলে দিলো আসিফ। গতরাতে বিদ্যুৎ যতটা সময় ছিলো তাতে ফোনের অর্ধেক চার্জ সম্পন্ন হয়েছে। মজিবর ঘরে প্রবেশ করতেই বললো, কাল রাতে আপনের ঘুম কেমন হইছে?জী ভালো,ছোট করে উত্তর দিলো সে। মনে হয় আপনে মিথ্যা বলতাছেন। রাতে ঘুম হইলে তো চক্ষু লাল হওনের কথা না। আসিফ কৃত্রিম একটা হাসি দিয়ে বলল,না ঘুম হয়েছে তবে একটু কম। তাই হয়তো লাল হয়ে আছে। আচ্ছা ব্যপার না আপনি নাস্তা রেডি করুন আমি একটু বের হবো। স্যারের জমিটা দেখে মাপ ঝোপের একটা ব্যপার আছে। কাগজ,কলম একটা লম্বা ফিতা আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার মেনু দেখে তার চোখ কপালে উঠার মতো। লাল শরবত, মাংসের কিমা আর চর্বির পরটা। শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে মুখে দিলো। ঢক করে এক ঢোক গিলে মনে হয় মহাবিপদে পরে গেলো সে। বমিবমি ভাব হচ্ছে। কেমন যেন আঠালো আর নোনতা একটা স্বাদ। পরটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তা চর্বি দিয়ে ভাজা। মনে সংকোচ নিয়েই মাংসের কিমা আর পরোটায় শেষ হলো নাস্তার পর্ব। মজিবর বললো আপনে শরবত খান না? আসিফ চমকে উঠে বললো হ্যাঁ খাই তো। তবে এটা কেমন যেন নোনতা লাগছে। পাহাড়ি ফলের শরবত তো, মনে হয় এইজন্যই এমন লাগতাছে বলেই এক চুমুকে ঢকঢক করে খেয়ে নিল,মজিবর। লোকটা বড্ড অদ্ভুত। হুট করে কখন চলে যায়, আসে কিছু বুঝাই যায় না। ঘন গোঁফ-দাড়ি আর মাথায় ঝাকড়া চুল। কন্ঠে বেশ বয়সের ঢং আছে। দৃষ্টিতে রহস্য মাখা। চোখের দিকে তাকাতেই আসিফের নজরে এলো এক জোড়া নীল রঙের চোখ। সাধারণত গল্প উপন্যাস ও মুভিতে ভ্যাম্পায়ারদের চোখ এমন হয়। কিন্তু সে এমনটা নাও হতে পারে। অনেকের বংশগতও হয়। বিশেষত বিদেশী সাদা চামড়ার মানুষের চোখ নীল থাকে। আসিফ বলল,এখানে আপনি কতদিন যাবত আছেন আর আপনার পরিবার কেও নেই?শব্দ না হলেও মুখে অনেকটা হাসি হাসি ভাব ছিলো। আসিফের কথা শুনে আচমকা বিদ্যুৎ খেলে গেলো তার মধ্যে। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো মুখে। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, সে এক ইতিহাস। তখন এই চ্যাটার্জী বাড়ির ভরপুর যৌবন ছিলো। টেহা পয়সার কোন অভাব ছিলো না। গেদা থেকে শুরু করে থুরথুরে বুড়ো, যে কেও হাত পাতলে রবিতাভ ও তার বাবা হরিতাভ কাওরেই খালি হাতে যাইতে দিতেন না। তারা শিব দেবতার পূজা করতো। কিন্তু সাদু সন্ন্যাসী দেখতে পারতো না। এ কথা বলতেই কেমন অস্বভাবিক আচর করতে লাগলো মজিবর। মেজেতে পরে গেলো সে। চোখ,মুখ লাল হয়ে এলো। কিছুটা স্বস্তিহীন ভাব। চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো আসিফ। পরিস্থিতি সামলে নেয়ার জন্য কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো, আচ্ছা আমাদের তো সেই জমিটা দেখতে যাওয়ার কথা। চলুন তাহলে এখনই বেড়িয়ে পরি। আসিফ কিছুটা ভয় পেয়েছিল তখন। ভয় পাওয়রই কথা। হুট করে কেও যদি এমন অদ্ভুত আচরণ করে,তাহলে যে কারো হৃদপিণ্ড আঁতকে উঠবে। মজিবর স্বাভাবিক হতেই উঠে দাঁড়ালো। হেলেদুলে ঘর থেকে বাহিরে চলে গেছে । আসিফ নিজের কাজে মন দিলো। এতোক্ষনে নিচে নেমে গেছে মজিবর। সেই গাড়িটা আজ দেখা গেল না। আকাশ বেশ স্বচ্ছ। এখন কি ঋতু চলছে এক মিনিট ভেবেও মনে পরলো না। তবে কুয়াশার কথা মনে করে ধরে নিলো শীতকাল। কিন্তু শীতকালে আকাশ এতো ঝকঝকে তকতকে থাকে না। তাহলে হয়তো শীত আসার পূর্বাস বহন করে এমন কোন কাল। মজিবর একটা ছাতা হাতে আসিফ কে ডাকতে লাগলো। দ্রুতনিচে নেমে এলো সে। একফালি হাসি হেসে বললো,চলুন যাওয়া যাক।

যে বইগুলো কিনতে পারেন ডিস্কাউন্ট রেটে থেকে:

Loading books...
Exit mobile version