শীতকাল,জানালার শিক গলে কুয়াশা এসে ঢুকছে। গত এক সপ্তাহ ধরে শীত ঝেপে নেমেছে। সন্ধ্যার পর কেও বাইরে বের হয় না। সালেহ শেখ শুয়ে আছেন বিছানায়। তার গায়ে পাতলা কম্বল দেয়া। পুরো শরীর অবশ তাই শরীরে শীতের আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু নাক ,চোখের পাপড়ি দিয়ে ঠিকই টের পাওয়া যায় শীতের প্রকটতা কত বেশি। সালেহ শেখের বাসার আশেপাশে তেমন কোনো ঘড়বাড়ি নেই। সবচেয়ে কাছে করিমের বাড়ি। করিমের বউ ছেলে প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়, তার কয়েকদিন পরে বাচ্চাটাও মারা যায়। সালেহ শেখের বাসায় করিম সারাদিন থাকে, প্রায় সময় রাতেও থেকে যায়। কিন্তু আজ নিজের বাড়ি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। সালেহ শেখ করিমকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আজ এইহানে থাকবা না?”
করিম হেসে উত্তর দিলো,
“না, একটু বাড়িত যামু। একটা কাম আছে। সব কইরা দিয়া যাইতাসি। ভোর বেলা আইসা পরুম।”
করিম বেরিয়ে পড়লো।
তাড়াহুড়ার কারণে করিম জানালা বন্ধ করতে ভুলে গেছে। এই তীব্র শীত সালেহ শেখকে সারা রাত সহ্য করতে হবে। চার পাশ একদম স্তব্ধ, একটা টু শব্দও নেই। বাড়ির পিছনে বন-জঙ্গল, রাত হলেই নানা পশু পাখি, পোকার ডাক শোনা যায় কিন্তু এই অসহ্যকর শীতের দাপটে তারাও আজ নিশ্চুপ। সালেহ শেখের ইচ্ছে করছে, উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আসতে, মাথার পাশের টেবিলে রাখা হারিকেন টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আগুনের তেজ বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব?
রইজুদ্দিনের কথা বারবার মনে পরছে। মানুষ একা থাকলে নানান কিছু নিয়ে ভাবে। বেশি ভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে। রইজউদ্দীন গত পরশু মারা গেছেন। মারা যাওয়ার খবরটুকু পাওয়া গেছে কিন্তু শেষ দেখা আর হয় নি। হাটাচলা করতে পারে না এমন মানুষকে কোথাও নিয়ে যাওয়া খুব কষ্টের। এই কষ্টের কাজ কেও করতে চায় না।
সালেহ শেখের বয়স তখন সতেরো। শোনা গেছে, গ্রামে মিলিটারিরা এসেছে। ভয়ে কেও ঘর থেকে বের হচ্ছে না। গ্রামের সব ঘরে খবর পাঠানো হলো, ঘরের সকল পুরুষদের আছরের আযানের পর স্কুল মাঠে উপস্থিত থাকার জন্য। সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। না গেলে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। তখন সালেহ শেখের পাশের বাড়িতে রইজউদ্দিনদরা থাকত।
তাদের দুইজনের বাবা মিলে পরামর্শ করলেন,
“পোলাগোরে নেওনের দরকার নাই। ওরা ধান ক্ষেতের মইধ্যে পলায়া থাকবো। আর এমনেও কয়ডা প্রশ্ন কইরা ছাইড়া দিবো। ওগোরে নিয়া যাওনের দরকার নাই”
আছরের আযান পরলো। বাবারা বের হবার সাথে সাথেই সালেহ ও রইজউদ্দিন লুকিয়ে পরে ধান ক্ষেতের আড়ালে। তারা ধীরে ধীরে ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে স্কুল মাঠের দিকে আগাতে লাগল।
সবগুলো মানুষকে এক লাইনে দাঁড় করানো হলো । একটা লোক এসে সবার নাম বয়স লিখে নিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর খাকি জামা পরা একটা লোক এলো। তাকে দেখে আশে পাশের সব মিলিটারি স্যালুট দিলো। কোনো কথা বললেন না ,লাইনের এই মাথা থেকে ওই মাথা দুইবার হাঁটলেন। তারপর কয়েকজনের কাঁধে হাত রেখে চলে গেলেন। তাদের নিয়ে যাওয়া হলো নদীর পাড়ে। পাঁচ মিনিটে তাদের রক্তে লাল হয়ে গেলো নদীর পানি। দূর থেকে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখলো সালেহ ও রইজউদ্দীন। যাদের রক্ত ঐ নদীতে লাল করেছে তার মধ্যে তাদের দুইজনের বাবা ছিলো।
এর সপ্তাহ দুইয়েক পর গ্রামে মুক্তি বাহিনী এলো। খবর পেয়ে সবার প্রথম যে দুজন মানুষ গ্রাম থেকে তাদের কাছে গিয়েছিলেন তারা হলেন সালেহ শেখ আর রইজউদ্দিন। একসাথে কত মিলিটারি ,বেস ক্যাম্প উড়িয়ে দিয়েছে তারা এর হিসেব নেই। যুদ্ধের শেষের দিকে, আর মাত্র একটা অপারেশন বাকি। চারপাশে তখন জোরো গুঞ্জন, পাকিস্তানিরা যেকোনো সময় আত্মসমর্পন করে কাথা- কম্বল নিয়ে পালাবে। অপারেশনের নাম দেয়া হলো “অপারেশন লাস্ট। দুটোদল করা হলো। একদলে সালেহ শেখ, অন্য দলে রইজউদ্দীন। সালেহ শেখের দলে তিনজন এবং রইজউদ্দীনের দলে চারজন সদস্য। পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প বানানো হয়েছে। দুটো দলের কাজ আলাদা আলাদা। সালেহ শেখের দলের দ্বায়িত্ব মিলিটারিদের মনোযোগ তাদের দিকে নেয়া। যখনই মিলিটারিরা ওইদিকে খেয়াল করবে ঠিক তখনই রইজউদ্দীনের দল ঝাপিয়ে পরবে তাদের উপর।
মিলিটারি ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। রাইজউদ্দীনের দল লুকিয়ে আছে ঝোপের আড়ালে। সালেহ শেখের দল জয় বাংলা বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে নদীতে ঝাপ দিবে৷ মিলিটারিদের মনোযোগ চলে আসবে এই দিকে আর ঠিক তখনই রইজউদ্দীনের ঝাপিয়ে পরবে। সালেহ শেখ ইশারা দেয়ার সাথে সাথেই তিনজন জয় বাংলা বলে উঠল। বলেই দৌড় দিলো নদী দিকে। মিলিটারিরা শব্দ শুনে বন্দুক তাক করে এগিয়ে এলো। ফাকা গুলি ছুড়তে শুরু করল। সালেহ শেখ যখন নদীর ঠিক কাছাকাছি তখন মিলিটারিদের একটা বুলেট এসে লাগে সালেহ শেখের পিঠে। নদীর পাড়েই পরে গেলেন তিনি। পিছন থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। কিচ্ছুক্ষণ পর গুলির শব্দ থেমে গেলো। আকাশ কাঁপিয়ে একদম মানুষের উল্লাসধ্বনি ” জয় বাংলা”। সালেহ শেখ কোনো ব্যাথা অনুভব করতে পারছেন না। তার সারা শরীর জুড়ে স্বাধীনতার ফুল। তার মনে হলো, মরে গেলেও ক্ষতি নেই। দেশের জন্য জীবন দেয়াটাই অনেক বড় ব্যপার। নিজেকে এক নিমিষেই স্বার্থক মনে হয়। সালেহ শেখের খুব ঘুম পাচ্ছে। তিনি অতল ঘুমে তলিয়ে গেলেন। যখন ঘুম ভাঙল তখন তিনি সদর হাসপাতালের একটা বিছানায় শোয়া। চোখ মেলেই দেখলেন রইজউদ্দীন দাড়িয়ে। হাসি মুখে বলল,
“কিরে সালেহ, ঘুম ভাঙল তোর। দেশ তো স্বাধীন হয়া গেসে রে। এখন থেইক্কা এই দেশের নাম বাংলাদেশ। আমরা দেশ স্বধীন করসে রে দোস্ত।”
এই কথা বলতে বলতে চোখে পানি এসে পরল রইজুদ্দীনের। গুলি এসে লেগেছে সালেহ শেখের মেরুদন্ডতে। হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছেন না। প্রায় ছয় মাস হাসপাতালে পরে থাকতে হয়েছে। এই ছয়মাস প্রতিটা মুহুর্তে সাথে ছিলেন রইজউদ্দীন। এই অবশ শরীর নিয়েই বেঁচে আছেন তিনি।
এইসব ভাবতে ভাবতে সালেহ শেখের চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগলো। হঠাৎ জানালার দিকে চোখ যেতেই দেখলেন রইজউদ্দীন দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, “অনেক তো হলো এইবার চল।যাবি আমার লগে?”
সালেহ চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে বলতে লাগলেন, “যাবো যাবো।” ঠিক কিছুক্ষণ পর সব চুপ। হারিকেনের মৃদু আলো এসে পরেছে শত ভাঁজ পরেছে নিথর মুখটার উপর।
কুয়াশাগুলো চাদরের মতো করে জড় হয়েছে শরীরের উপর। যেনো সাদা শ্বতপাথরের চাদর গায়ে শুয়ে আছেন।