বিষয়টা এমন;আপনি অনেক টাকা পয়সার মালিক, পাকা দালানে থাকেন, ধন-সম্পত্তির অভাব নেই, কাজের লোকেরও অভাব নেই; কিন্তু আপনি অসুখী! ইতালির অবস্থাটা হয়েছে ঠিক এরকম। ইতালির শোকেসে চারটি বিশ্বকাপ শিরোপা,৩টি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা এমনকি তারা বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়নও। অথচ টানা দ্বিতীয় বারের মত বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পরল রবার্তো বাজ্জিও, ফাবিও ক্যানভারোর উত্তরসূরীরা।বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ইউরোপ অঞ্চলের প্লে-অফে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল নর্থ মেসিডোনিয়ার কাছে ১-০ গোলে পরাজি হয়ে আবারও ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর থেকে বাদ পরে গেল ইউরোপ তথা বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি ইতালি।
এইতো সাত আট মাস আগের কথা। রবার্তো মানচিনি আজ্জুরিদের প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার নেওয়ার পর ইতালি দলটির পুরো খোলস পাল্টে ফেলেছিলেন। আর্ন্তজাতিক ফুটবলে টানা ৩৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার নজির গড়ে বিশ্ব ফুটবলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।ইউরো-২০২০ এ অপরাজিত থেকে শিরোপা ’হোম’ থেকে ‘রোমে’ নিয়ে গিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের ঘরের মাঠ ওয়েম্বিলিতে ইংলিশদের নাকের পানি আর চোখের পানি একত্রিত করে দিয়েছিলেন লিওনার্দো বুনচ্চি- ফেদরিকো কিয়েসারা। অথচ তাদেরকেই টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ না খেলার মত করুণ অভিজ্ঞতার সম্মুক্ষীণ হতে হল।
ইতালির সর্বনাশটা শুরু হয়েছিল মূলত ইউরোকাপের পর থেকেই।বিশ্বকাপ বাছাইয়েরে ইউরোপ অঞ্চলের গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোতে মোটেই কায়দা করতে পারছিলেন না ২০০৬ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইতালি। গ্রুপ পর্বের ৮ ম্যাচের ৪ জয় ও ৪ ড্র নিয়ে তারা গ্রুপ সি’র রানার্স হতে পেরেছিল। গ্রুপ সি চ্যাম্পিয়ন সুইজারল্যান্ডের সাথে তাঁদের টানা দুই ড্র তাদের ভুগিয়েছে বেশি। দুই ম্যাচেই একটি করে পেনাল্টি পেয়ছিল ইতালি। আর দুটি পেনাল্টিই মিস করেন ইতালির চেলসি মিডফিল্ডার জর্জিনহো।
গ্রুপ রানার্স-আপ হয়ে প্লে-অফ খেলা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।মরুর দেশ কাতারে অনুষ্ঠেয় আসন্ন বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ তখনো হাতছাড়া হয়নি মানচিনির শিষ্যদের। তবে প্লে-অফের সূচী দেখে অনেকেই ভড়কে গিয়েছিলেন। কারন ইউরোপের আরেক ফুটবল পরাশক্তি পর্তুগালকেও যে প্লে-ওফের পুলসিরাত পার হয়েই কাতারের টিকিট ধরতে হচ্ছে। প্লে-অফের প্রথম ধাপ পার হলেই মুখোমুখি হয়ে যাবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল আর লিওনার্দো বনুচ্চির ইতালি। তাবত ফুটবল বিশ্ব ধরে নিয়েছিল ইতালি ও পর্তুগাল খুব সহজেই যথাক্রমে উত্তর মেসিডোনিয়া ও তুরস্ককে খুব সহজেই কাবু করে প্লে-ওফের দ্বিতীয় ধাপে পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি হবে। সেই মহারণের অপেক্ষায় ছিল গোটা ফুটবল দুনিয়া।
মঞ্চ ঠিক ছিল। ইউরোপের একপ্রান্ত ইতালির পার্লেমোতে মুখোমুখি হয়েছিল চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও ইউরোপের পূঁচকে দেশ উত্তর মেসিডোনিয়া। অন্যদিকে পর্তুগালের পোর্ততে মুখোমুখি হয়েছিল সাবেক ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল ও তুরস্ক। ইতালির প্যাঁরিস সেন্ট জার্মেইর মিডফিল্ডার মার্কো ভেরাত্তির মন্ত্রমুগ্ধ বল পজেশন ও পাসিং ফুটবলে মেসিডেনিয়ান ফুটবলাররা ইতালিয়ানদের সাথে একদম পেরে উঠছিলেন না। ভেরাত্তি, জর্জিনহো ও বেরাল্লার মধ্যমাঠ নিয়ন্ত্রণে পুরো খেলাই যেন আজ্জুরিরা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলছিলেন। কিন্তু কাজের কাজটি কোন দলই করে করে উঠতে পারছিল না।
মেসিডোনিয়ার গোলমুখে মোট ৩২টি শট নেন ইতালিয়ান খেলোয়াড়রা । কিন্তু মেসিডোনিয়ার জাল খুঁজে পান নি চিরো ইমমোবিলে,লরেন্জ ইনসিনিয়েরা। ৬৬% বল নিজেদের পায়ে রেখে আর মুর্হুমুহূ আক্রমণ করেও গোল নামের সোনার হরিণের দেখা পায়নি ২০২০ ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি। উল্টো শেষ সময়ে ইতালির কফিনে পেরেক ঢুকে দেয় মেসিডোনিয়ান স্ট্রাইকার আলেকজান্দার ট্রাস্কোভস্কি। ইতালিয়ান ক্লাব এফসি পার্লেমোতো খেলা ট্রাস্কোভস্কি ইতালিয়ানদের বুকে ছুড়ি মেরে নিজেদের ঝুড়িতে জয়ের মালা তুলে নেন। মেসিডোনিয়ানরা ম্যাচ শেষে যখন গ্যালারির কাছে গিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করেন ঠিক তখনই ফিফা র্যাঙ্কিরের ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা ইতালির খেলোয়াড় ও স্টাফরা ম্যাচ শেষে গ্যালারিতে থাকা হতাশ ইতালিয়ান সমর্থকদের সামনে হাঁটু গেড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।ম্যাচ শেষে ইতালিয়ান অধিনায়ক জর্জিও কিয়েল্লিনি বলেন-
”খেলোয়াড়র ও সমর্থকদের জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। এই দলটি খুব ভালো খেলছিল ও যোগ্য দল হিসেবে ইউরোকাপ জিতেছে। এটি সত্যি দুঃখ ও লজ্জার বিষয় যে, দলটি টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপে যেতে পারছে না।
এটাই ফুটবল।যখন আপনি হারবেন, তখন আপনাকে চুপ থাকতে হবে।এছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।“
ইতালির বিশ্বকাপ ভাগ্য যেন কোন ভাবেই সুপ্রসন্ন হচ্ছে না। ২০০৬ বিশ্বকাপে জিনেদিন জিদানের ফ্রান্সকে পরাজিত করে শিরোপা ঘরে তোলার পর আর দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার ভাগ্যই হয়নি ইতালিয়ানদের। ২০১০ সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপ ও ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের প্রথম ধাপই পার হতে পারেনি তাঁরা। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিটই যোগার করতে পারে নি। চলতি বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কাতার বিশ্বকাপের টিকিটও তাদের কপালে জুটল না।কাগজে কলমে ১২ বছর ইতালির পতাকা উড়বে না বিশ্বকাপের মঞ্চে।
ইতালির পত্রিকাগুলো বিশ্বকাপ থেকে ইতালির বিদায়কে সহজভাবে নিতে পারছে। বড় হরফে প্রধান তিন পত্রিকা ‘গেজেত্তা দেলো স্পোর্ত’, ‘করিরো দেল স্পোর্ত’ ও টুট্টো স্পোর্ত’ এই বিদায়কে ‘বিপর্যয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। বড় বড় ফুটবল বিশ্লেষক ইতালির অতিত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বসে গেছেন। অনেকের মতে- ইতালির খেলোয়াড়েরা নিজেদের পরিচয় সংকটে ভুগছেন এবং দলটা পুরনো হয়ে গেছে।তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার অভাব ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা অত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগছেন। নিজ নিজ পজিশনে কোন খেলোয়াড়ই কাজের কাজ করতে পারছেন না। আক্রমণে লাৎসিও স্ট্রাইকার চিরো ইমমোবিলের পারফরমেন্স অধিকাংশ ইতালিয়ান সমর্থক যারপরনাই হতাশ।ইতালির রক্ষণভাগও তাদের সুনাম ধরে রাখতে পারে নি। কিন্তু তাই বলে এমন একটি দলের সাথে তারা পেরে উঠে নি যারা ফিফা র্যাঙ্কিয়ে সারা বিশ্বে ৬৭তম আর ইউরোপে ৪৭তম।
পার্লেমোর দুর্ঘটনা কবলিত রাত; ইতালির বর্তমান ফুটবলের দর্পণ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। যদিও বর্তমান ইউরোকাপ তাদের ব্যর্থতাকে অনেকটাই ঢেকে রাখবে। তবে ইউরো কাপ আর বিশ্বকাপ যোজন যোজন ফারাক। ইতালি স্কোয়াডের প্রতিটি খেলোয়াড়ই নিজ নিজ ভুল খোঁজে বের করছেন আর অনুতপ্ত হচ্ছেন। তবে সবার চেয়ে জর্জিনহোর পোড়ানিটাই হয়ত অনেক বেশি। গ্রুপ পর্বের দুটি ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া পেনাল্টির একটিকেও যদি তিনি গোলে পরিণত করতে পারতেন তবে হয়েত তার দলকে প্লে-অফেই আসতে হোত না। কারন ইতালিকে হারিয়ে সুইজারল্যান্ডই যে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সরাসরি কাতার যাওয়ার সুযোগ ছিনিয়ে নিয়েছে। যে সুযোগ ইতালি হাতছাড়া করেছে জর্জিনহোর পেনাল্টি মিসের মাধ্যমে।
ইতালির ফুটবল হর্তাকর্তারা এই বিপর্যয়ের পর ইতালিয়ন ফুটবলকে ঢেলে সাজাতে তৎপর হয়ে পরবেন। ২০১০ সালের পর থেকে কোন ইতালিয়ান ক্লাব ইউরোপে কোন শিরোপা জিততে পারে নি। হোসে মরিনহোর হাত ধরে ইন্টার মিলান জার্মাণ জায়ান্ট বায়ার্ণ মিউনিখকে হারিয়ে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিল। সেই শিরোপায় হয়ত এতদিনে ময়ল জমে গেছে। এরপর জুভেন্টাস দুইবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল খেললেও শিকে ছিড়তে পারে নি।
ইতালিয়ান ক্লাব কর্তৃপক্ষের উপর ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের খুব একটা কর্তৃত্ব নেই সেটা কয়েক দিন আগের ঘটনা থেকেই অনুধাবন করা যায়। নর্থ মেসিডোনিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপের প্লে-অফ ম্যাচের জন্য ইতালিয়ান জাতীয় দল যেন ভালো ভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে এজন্য সিরি- এ’র ৩১তম ম্যাচের সূচি বাতিল করতে বলেছিল তাঁরা। কিন্তু তাদের কথায় কর্ণপাত করার মত সময় দেখান নি সিরি-এ কর্তৃপক্ষ। যার ফলাফল কিন্তু ইতালিয়ান ফুটবল হাতেনাতে পেল। আর একটি ফুটবল বিশ্বকাপ যেন ঘরে বসে না দেখে মাঠে গিয়ে খেলতে পারে এমন সুযোগ তৈরি করার জন্য ইতালিয়ান ফুটবলকে অনেকটাই বদলাতে হবে। নয়ত ২০২৬ সালে অনুষ্ঠেয় কানাডা,যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো বিশ্বকাপেও আজ্জুরিদের খুঁজে পাওয়া যাবে না।তখন বিশ্বকাপে ইতালির অংশগ্রহণ অনেকটাই অনিয়মিত হয়ে যাবে আর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ইতালিয়ান সমর্থক মনের মাঝে কষ্ট জমিয়ে রেখে অন্য দলের খেলা উপভোগ করবে।