ক্রেডিট কার্ডের আদ্যোপান্ত

যুগে যুগে মানব সভ্যতায় কত কিছুই না যুক্ত হয়েছে নতুনভাবে৷ সভ্যতার ক্রমবিকাশ মানুষকে করে তুলেছে সভ্য, জীবনকে করেছে সহজ। মানব সভ্যতায় টাকার ইতিহাস টা অত্যন্ত পুরোনো। বিনিময় প্রথার যুগ থেকে কাগজের টাকার এই প্রত্যাবর্তনে যোগ হয়েছে অনেক নতুনত্ব। আর প্রযুক্তির এই যুগে কাগজের টাকাও ধীরে ধীরে হচ্ছে ফ্যাঁকাসে। আধুনিক সভ্যতায় যোগ হয়েছে টাকায় নতুনত্ব। ফিজিক্যাল টাকা থেকে তা হয়েছে অনলাইন কারেন্সি। ক্রমবর্ধমান পৃথিবীতে এখন আর পকেটে টাকা না থাকলেও মানুষ নির্বিঘ্নে করতে পারছে কেনাকাটা। কিংবা যেকোন লেনদেন করতে পারছে খুব সহজেই। প্রয়োজন শুধু একটা প্লাস্টিকের কার্ড। যা ব্যবহার করে যেকোন জায়গায় প্রয়োজন মেটানো সম্ভব টাকার।

আর এই কাজটাকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে ক্রেডিট কার্ড। মানুষের এখন মানিব্যাগে কাড়ি কাড়ি টাকা রাখার প্রয়োজন নেই। সেখানে শুধু একটি ক্রেডিট কার্ড থাকলেই সে নিবারন করতে পারছে যেকোন প্রয়োজন। আর ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে আপনার জানার প্রয়োজনীয়তা থেকেই আমাদের আজকের আয়োজন। আজ আমরা জানবো ক্রেডিট কার্ড কি, এর উৎপত্তি এবং এর সুবিধা অসুবিধা সহ আরো অনেক কিছুই।

শুরুতেই জানবো ক্রেডিট কার্ড আসলে কি?

ক্রেডিট কার্ড হচ্ছে এক ধরনের আয়তাকার একটি কার্ড, যা কোন ব্যাংক অথবা অর্থনৈতিক লেনদেনের কোন প্রতিষ্ঠান দ্বারা ইস্যু করা হয়। যা ব্যবহার করে আপনি বিভিন্ন পন্য কেনাকাটা অথবা সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। যেকোন প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি, যারা ক্রেডিট কার্ড লেনদেন গ্রহণ করে, সেখানে এই কার্ড ব্যবহার করে আপনি আপনার পছন্দসই সেবা পেতে পারেন।

ক্রেডিট কার্ড টা হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম, যার মাধ্যমে আপনি যেকোন ব্যাংক অথবা অর্থনৈতিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করতে পারবেন নিজের ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়ীক কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। এবং নির্দিষ্ট সময় পর এই ধার করা অর্থটি আবারো কার্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানকে আপনার ফিরিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ধার্য করা মুনাফা কিংবা অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ, যেমন বিলম্ব ফি, সহ আপনাকে পরিশোধ করতে হবে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে আপনি যেকোন এটিএম বুথ থেকেও টাকা ক্যাশ করার সুযোগ পাবেন।

একজন ব্যক্তির সক্ষমতা অনুযায়ী ক্রেডিট কার্ড আপনাকে টাকা ব্যবহারের একটা নির্দিষ্ট লিমিট দিয়ে দেয়। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আপনি কত টাকা ব্যবহার করতে পারবেন, তার একটা সীমানা নির্ধারণ করা থাকে ক্রেডিট কার্ডে। এটা হয়তো আপনার আয়ের উপর নির্ভর করে কিংবা আপনার সক্ষমতার উপর নির্ভর করে দেওয়া হবে। আর এই সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়াটাকেই বলা হয়, “ক্রেডিট লিমিট”

তাহলে এই “ক্রেডিট লিমিট” টি কেমন হয়ে থাকে?

ধরা যাক আপনার মাসিক বেতন ৫০ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে আপনি এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারবেন এমন সীমানা নির্ধারণ করা থাকবে আপনার ক্রেডিট কার্ডে। তবে এই অংকটি নির্ভর করছে সেবাপ্রদান কারী প্রতিষ্ঠানের উপর। কারন নানান ব্যাংকের নানান নিয়মকানুন থাকতেই পারে৷

তবে ক্রেডিট কার্ডের সবথেকে বড় প্রশ্নটি হলো, আপনি ক্রেডিট কার্ডের জন্যে উপযুক্ত ব্যক্তি হবেন কিনা। সাধারণত মাসিক আয়ের উপর ভিত্তি করে কিংবা প্রতিষ্ঠিত কোন ব্যবসায়িক ব্যক্তিকেই দেওয়া হয় এই ক্রেডিট কার্ডটি। অর্থাৎ, খরচ অনুযায়ী সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে টাকাটা ফেরত দিতে পারছেন কিনা, প্রতিষ্ঠান সেটিই দেখবে। প্রতিষ্ঠান যখন নিশ্চিত হয়ে যাবে, এই পরিমাণ অর্থ ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা এবং যোগ্যতা দুটোই আপনি রাখেন, তবেই প্রতিষ্ঠান আপনাকে ক্রেডিট কার্ডের উপযোগী বলে মনে করবে।

ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার পর আপনার করনীয় কি?

ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার ধাপটা নাহয় খুব দৌড়ঝাপের মধ্য দিয়ে আপনি শেষ করলেন, কিন্তু এই ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার পরের ধাপগুলো কেমন! সাধারণত ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার পর আপনি এই কার্ডটি আপনার যেকোন কেনাকাটা কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে পারবেন।

ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার পর আপনি সারা মাসে আপনার ক্রেডিট কার্ড লিমিট অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন, তার হিসেব সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যাংকের কাছে সংরক্ষিত থাকবে। তারপর মাস শেষে ব্যাংক তার একটি হিসেব করে বিল আকারে আপনার দৃষ্টিগোচর করবে। সেই হিসেব দেখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপনাকে সেই পরিমাণ অর্থ ব্যাংককে পরিশোধ করা লাগবে। এই সময়টি ব্যাংকের নিজস্ব নিয়মকানুন অনুযায়ী হয়৷ তবে সাধারণত যেকোন ব্যাংক আপনাকে এই টাকাটি পরিশোধের জন্যে ১০-১৫ দিন সময় দিয়ে থাকবে।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ করার পর ব্যাংক আপনাকে পরবর্তী মাসে ব্যবহারের জন্যে ক্রেডিট লিমিট দিয়ে দিবে। অর্থাৎ কোন এক মাসে আপনি যদি ৫০ হাজার টাকা লিমিটের একটি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করেন, এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করে দেন, তাহলে পরবর্তী মাসের জন্যে আবারো আপনার ক্রেডিট কার্ডে ৫০ হাজার টাকার লিমিট দিয়ে দেওয়া হবে।

ক্রেডিট কার্ড অফলাইন কিংবা অনলাইন দুই ধরনেরই হতে পারে। তবে আপনি যদি দেশের বাহিরেও আপনার ক্রেডিট কার্ডটি ব্যবহার করে সেবা নিতে চান, তাহলে আপনার অবশ্যই একটি পাসপোর্ট থাকা লাগবে। কারন আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্যে পাসপোর্ট একটি গুরত্বপূর্ণ সম্পদ। পাসপোর্ট ব্যাতিত আপনি আপনার ক্রেডিট কার্ড লিমিট ব্যবহার করতে পারবেন না।

বৈদেশিক ব্যবহারের জন্যে কিভাবে ক্রেডিট কার্ডকে উপযোগী করে তোলা যায়?

আপনার যদি একটি আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট থাকে, তাহলে সেটি ব্যবহার করে আপনি খুব সহজেই আপনার ক্রেডিট কার্ডটিকে আন্তর্জাতিক ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে পারবেন। আপনি আপনার ক্রেডিট কার্ড লিমিটের একটি অংশ বৈদেশিক কারেন্সিতে রুপান্তর করতে পারবেন, যাতে করে দেশের বাহিরে গিয়েও আপনি সেই কারেন্সিতে ক্রেডিট কার্ডটি ব্যবহার করতে পারেন।

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে আপনি আন্তর্জাতিক অনলাইন কেনাকাটা কর‍তে পারবেন কিনা?

অবশ্যই পারবেন। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে আপনি খুব সহজেই আন্তর্জাতিক যেসব অনলাইন প্লাটফর্মগুলো আছে, সেখান থেকে কেনাকাটা কিংবা পেমেন্ট করতে পারবেন। যেমন, গুগল প্লে-স্টোরে যেকোন গেম অথবা এপ্স কেনা, যেকোন আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইট থেকে কেনাকাটা করা, ফেইসবুক বুস্ট অথবা গুগল এডসে খরচ করা ইত্যাদি অনেক কাজেই আপনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন।

ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়ার পর এবার আমরা কথা বলবো ক্রেডিট কার্ডের উৎপত্তি নিয়ে।

কোথা থেকে এলো আমাদের আজকের এই ক্রেডিট কার্ড?

কার্ডের মাধ্যমে সেবাগ্রহণের রুপকল্পটার সর্বপ্রথম শুরু করেন এডওয়ার্ড বেল্যামি। ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত তার ইউটোপিয়ান উপন্যাস “Looking Backword”- এ মোট ১১ বার তিনি ক্রেডিট কার্ড শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে ক্রেডিট কার্ডের যাত্রাটা শুরু হয় মূলত ১৯২৮ সালের দিকে। তৎকালীন সময়ে বর্তমানের ক্রেডিট কার্ডের আদলে প্রচলন শুরু হয় চারগা প্লেট নামে এক আয়তাকার ধাতব পাতের। এই ‘চারগা প্লেট’ টি বড় বড় ব্যবসায়ী এবং তাদের বিশ্বস্ত ক্রেতাদের দেওয়া হতো। এরপর ১৯৩৪ সালে আমেরিকান এয়ার লাইন্স এবং এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন তাদের টিকিট ক্রয়বিক্রয় সহজলভ্য করতে চালু করে “Buy Now & Pay Late” সুবিধার। যা পৃথিবীবাসীর কাছে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় ট্রাভেল কার্ডের।

তারপর ১৯৫০ সালে ডাইনার্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল এর দুই প্রতিষ্ঠাতা রালফ্লাইডার এবং ফ্রাঙ্ক ম্যাকনামারা পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসেন “চার্জ কার্ড” নামক একটি সুবিধা যার মাধ্যমে অর্থ পরিশোধের কাজ করা হতো। এরপর ১৯৫৮ সালে ব্যাংক অব আমেরিকা “BankAmericard” নামে একটি মডার্ন ক্রেডিট কার্ড বের করে, যাকে টেক্কা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাজারে আসে “Master Charge” নামে নতুন আরেকটি অর্থ লেনদেনের কার্ড। “BankAmericard” কার্ডের নাম পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে এসে করা হয় “Visa”।

আশির দশকে ক্রেডিট কার্ডে প্রথম ম্যাগনেটিক স্ট্রিপের ব্যবহার শুরু হয় এবং নব্বই দশকে কার্ডে ইএমবি চিপ টেকনোলজি যোগ করা হয়। আর এর পরের সময়গুলো সবারই জানা। কালের বিবর্তনে ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের আজকের ক্রেডিট কার্ড এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

আধুনিক বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত প্রযুক্তিরই উদ্ভাবন হয়েছে তার সব-কটিরই রয়েছে সুবিধা অসুবিধা। ক্রেডিট কার্ডের ফলে মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটাই সহজ হয়েছে। এবার জানবো ক্রেডিট কার্ডের সুবিধাগুলো।

ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা সমূহঃ

ক্রেডিট কার্ড মানুষের হাতে আসার পর মানুষের কেনাকাটা হয়ে গিয়েছে অনেক সাবলীল। দিন যত যাচ্ছে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সংখ্যাটাও ততই বাড়ছে। মানুষ এখন খুব সহজেই যেকোন জায়গা হতে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারছে। হাতে নগদ অর্থ না থাকলে ক্রেডিট কার্ড কাজ করে যাদুর মত। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা গুলো হলোঃ

১. সহজেই ক্রেডিট এক্সেস করাঃ

ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো খুব সহজেই ক্রেডিট এক্সেস করা। ক্রেডিট কার্ডটা এমনভাবে কাজ করে, যাতে করে আপনার কাছে নগদ অর্থ থাকুক বা না থাকুক, আপনি এই কার্ডের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করতে পারবেন এবং আপনার খরচ হিসেবে তা পরবর্তীতে শোধ করতে পারবেন। এতে আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে ঠিক ওই সময়ে কোন টাকা কাটবেনা, এবং প্রতিবার কার্ড ব্যবহারের কারনে আপনার ব্যাংক একাউন্টে গচ্ছিত অর্থ থেকেও কোন পরিমাণ অর্থ কর্তন করা হবেনা।

২. দ্রুত লেনদেনঃ

ক্রেডিট কার্ডের অন্যতম প্রধান একটি সুবিধা হলো দ্রুত লেনদেন করা। কোন ক্রেতা যদি হঠাৎ করেই মনস্থির করে নেন, কোন একটি পণ্য তার প্রয়োজন, কিন্তু সে হিসেবে তার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই, তাহলে তিনি চটজলদি এই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্যটি ক্রয় করে ফেলতে পারবেন। এবং ব্যবহৃত অর্থ তিনি পরবর্তীতে শোধ করে দিতে পারেন। এছাড়াও নগদ অর্থ প্রয়োজন হলেও তিনি এটিএম বুথ থেকেও টাকা উত্তোলন করতে পারেন।

৩. লোন সুবিধাঃ

কোন কোন ব্যাংক কোন রকম মুনাফা ছাড়া কিংবা নির্দিষ্ট পরিমাণ কিছু মুনাফায় কার্ডধারীকে লোন সুবিধা দিয়ে থাকে। যা অত্যন্ত সুবিধাজনক। বিশেষ করে হঠাৎ করেই যাদের লোনের প্রয়োজন হয়। ক্রেডিট কার্ড আপনাকে এই সুবিধাটা প্রদান করে থাকে।

৪. ইএমআই সুবিধাঃ

কোন ব্যক্তি যদি বড় অংকের কোন পণ্য কিনতে যান, এবং তার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত না থাকে, তাহলে তিনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কিস্তিতে পণ্যটি কিনতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি এই কার্ড ব্যবহার করে মাসিক কিস্তিতে যেকোন পণ্য কিনতে পারেন। তারপর ধীরে ধীরে সেই পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে পারেন।

৫. ইনসেনটিভ এবং অফার সুবিধাঃ

কিছু কিছু ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে আপনাকে বিভিন্ন অফার প্রদান করে থাকে। প্রতিবার কার্ড ব্যবহার করার কারনে আপনাকে কিছু পয়েন্ট দেওয়া হবে, যা ব্যবহার করে আপনি কেনাকাটা করতে পারবেন অথবা আপনার ক্রেডিট কার্ডের বকেয়াও পরিশোধ করতে পারবেন। এমনকি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটায় অনেক প্রতিষ্ঠানও আপনাকে ছাড় দিবে। যার মাধ্যমে আপনি নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিসকাউন্ট পেতে পারেন।

৬. অধিকতর নিরাপত্তাঃ

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে আপনার টাকা হারানো, চুরি কিংবা অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়গুলো মাথায় না রাখলেও চলে। যদি ক্রেডিট কার্ড হারিয়ে যায়, তাহলে ওই ক্রেডিট কার্ড হারানোর অভিযোগ করলে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের দ্বায়ভার আপনার উপর বর্তাবে না। আর ক্রেডিট কার্ডে অন্যান্য নিরাপত্তা সিস্টেমগুলো মানায় কোন চোর কিংবা প্রতারক আপনার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারবেনা।

৭. পরিবর্তনযোগ্যঃ

ক্রেডিট কার্ডটি পরিবর্তনযোগ্য। অর্থাৎ আপনি যে অফারের ক্রেডিট কার্ডটি নিচ্ছেন, আপনি চাইলেই সেটি পরিবর্তন করে অন্য অফারের যেকোন ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করতে পারেন।

৮. ক্রেডিট লাইন তৈরির সুযোগঃ

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে আপনি একটি ক্রেডিট লাইন তৈরি করার সুযোগ পাবেন। এটা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ কারন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে আপনার খরচের প্রত্যেকটা রেকর্ডই ব্যাংক সংরক্ষণ করে রাখে। অনেক লোন নেওয়ার ক্ষেত্রেই ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেডিট কার্ড রেকর্ড দেখে, এবং সেই হিসেবে লোন দেয়।

এতো বললাম ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধাগুলো। কিন্তু মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ চিন্তা করেই তো আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করবেন, কি করবেন না। প্রযুক্তির উন্নয়ন যেমন মানুষকে অনেক সুবিধা এনে দিয়েছে, তেমনি তার অসুবিধাও রয়েছে।

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের অসুবিধাঃ

১. নূন্যতম বকেয়ার ফাঁদঃ

ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বিলের শীর্ষে ব্যাংক যে অংকটি প্রদর্শন করে এটি সাধারণত নূন্যতম বকেয়ার এমাউন্টটি থাকে৷ বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই এটা মনে করেন যে, এই এমাউন্টটাই তার মোট বকেয়া এবং এটাই তাকে পরিশোধ করা লাগবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা একটা সর্বনিম্ন এমাউন্ট, যেটা পরবর্তীতে আবারো ক্রেডিট সুবিধা পাওয়ার জন্যে কোম্পানীকে দিতে হবে।

এই সমস্যাটা ব্যবহারকারীর উপর সাইকোলজিক্যালি কাজ করে। ব্যবহারকারী মনে করেন তার বকেয়ার পরিমাণ কম, এবং তিনি ইচ্ছেমতো খরচ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার সমস্ত টাকার পাশাপাশি ব্যাংককে সেই পরিমাণ মুনাফাও প্রদান করা লাগে।

২. লুকোনো খরচঃ

শুরুর দিকে ক্রেডিট কার্ডকে সহজ এবং সাবলীল মনে হলেও এতে কিছু হিডেন চার্জ রয়েছে, যা আপনার সামগ্রিক ব্যয়কে বাড়িয়ে দিতে পারে। ক্রেডিট কার্ডের বেশকিছু ফি এবং ট্যাক্স থাকে, যেমন বিলম্ব ফি, জয়েনিং ফি, নবায়ন ফি, প্রসেসিং ফি ইত্যাদি। এছাড়াও কার্ড পেমেন্ট কোন কারনে মিস হয়ে গেলে আপনাকে জরিমানা গুনতে হবে এবং বার বার বিলম্ব পেমেন্ট করলে আপনার ক্রেডিট লিমিটও কমে যেতে পারে। যা আপনার ক্রেডিট স্কোর এবং ভবিষ্যতের ক্রেডিট ব্যবহারের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. কার্ডের অত্যধিক ব্যবহারঃ

যেহেতু ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে ঠিক সেসময়ে টাকা কর্তন করা হচ্ছেনা, সেহেতু আপনি অনেক বেশি ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন। যা আপনার অজান্তেই আপনার ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। কারন আপনি চাইলেই যেকোন সময় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করতে পারছেন। এটা আপনার খরচ এমন পর্যায়ে বাড়িয়ে দিতে পারে, যা আপনি পরিশোধ করতে পারছেন না। আর তার পাশাপাশি সেই হিসেবে ব্যাংককে তো মুনাফা আপনার দেওয়াই লাগবে।

৪. উচ্চ মুনাফার হারঃ

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি আপনি আপনার কার্ডের বকেয়া পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে আপনার বকেয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং সে অনুযায়ী আপনাকে অনেক বেশি ইন্টারেস্ট প্রদান করা লাগবে। ক্রেডিট কার্ডে ইন্টারেস্ট রেট মোটামুটি বেশি। মাসিক গড়ে ৩%, যা বছরে ৩৬%।

৫. ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতিঃ

খুব সাধারণ না হলেও আপনি ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির শিকার হতে পারেন। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাহায্যে একটি কার্ড ক্লোন করা এবং গোপনীয় তথ্যে অ্যাক্সেস লাভ করতে পারা সম্ভব, যার মাধ্যমে অন্য কোন ব্যক্তি আপনার কার্ড ব্যবহার করতে পারে। তাই সন্দেহজনক যেকোন কেনাকাটা লক্ষ্য করলে তা যত দ্রুত সম্ভব ব্যাংক কে জানানো প্রয়োজন। জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হলে ব্যাংক কার্ডটির চার্জ বন্ধ করে দেয়, এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কেনাকাটার জন্যে আপনাকে কোন অর্থ পরিশোধ করতে হবেনা।

ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা অসুবিধা জানার পর যে জিনিসটা একজন ব্যবহারকারী সবথেকে বেশি অনুভব করেন তা হলো কিভাবে ক্রেডিট কার্ড সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়।

সঠিকভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের নিয়মঃ

অতিরিক্ত ব্যবহারে ঋণের বোঝা মাথায় না নিয়ে সহজ সাবলীলভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের জন্যে নিম্নোক্ত টিপসগুলো অনুসরণ করুন-

১. প্রথমেই কার্ডে থাকা লেখাগুলো ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে। যাতে করে কার্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান হতে কার্ড ব্যবহারে যেসমস্ত শর্ত এবং চার্জ দেওয়া হয়েছে তা সম্পর্কে আপনি অবগত থাকেন।

২. আপনার আয় যতটুকু, ঠিক ততটুকুই কার্ড ব্যবহারের চেষ্টা করবেন। অতিরিক্ত ব্যবহার এড়িয়ে চললে সহজ ও সাবলীলভাবে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারবেন।

৩. দৈনন্দিন ছোট ছোট কাজে কার্ড ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। যাতে করে আপনি কতটুকু অর্থ ব্যয় করছেন, তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকে।

৪. কিছুদিন পর পর ক্রেডিট লিমিট চেক করুন এবং যখন দেখবেন আপনার ক্রেডিট লিমিটের ৪০% এর উপর আপনি ব্যবহার করে ফেলেছেন, সেক্ষেত্রে হিসেব করে কার্ড ব্যবহার করুন।

৫. বড় বড় অর্থের কোন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ইএমআই সুবিধা ব্যবহারের চেষ্টা করুন।

৬. সব সময় আপনার ক্রেডিট লিমিট অন্তত ৪০% রাখার চেষ্টা করুন, যাতে করে জরুরি কোন কাজে আপনি আপনার ক্রেডিট কার্ডটি ব্যবহার করতে পারেন।

৭. কেনাকাটার জন্যে পরিকল্পনা করুন এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করুন। অপরিকল্পিত কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার পরিহার করুন।

৮. অতিরিক্ত সুদ থেকে বাঁচতে প্রতি মাসে আপনার ক্রেডিট কার্ডের পুরো বকেয়া পরিশোধ করুন।

৯. কখনো কার্ড পেমেন্ট মিস না করার চেষ্টা করবেন। এতে করে অতিরিক্ত সুদ থেকে বেঁচে যাবেন এবং আপনার ক্রেডিট কার্ডটি সুরক্ষিত থাকবে।

১০. যদি দেখেন ইতিমধ্যেই আপনি অতিরিক্ত অনেক ব্যয় করে ফেলেছেন, ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করুন। তারা হয়তো আপনার অবস্থা বিবেচনা করে একটি নির্দিষ্ট সুদ হারে বকেয়া পরিশোধের সুযোগ দেবে।

শেষকথাঃ

প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগে আমাদের জীবন যাপন যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি আমাদের নিরাপত্তাকেও ফেলেছে হুমকির মুখে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত যেকোন প্রযুক্তিরই রয়েছের ভালোর পাশাপাশি কিছু খারাপ দিক। আর এই দুইয়ে মিলেই সমন্বয় করার মাধ্যমে আমাদের নিজেদের কাজগুলো সম্পন্ন করা লাগে। আগামী বিশ্বে নগদ অর্থ যে আর থাকবেনা, তা বোঝার জন্যে রকেট সাইন্স জানার প্রয়োজন নেই। ফিজিক্যাল মুদ্রা থেকে ইতিমধ্যেই অর্থ অনলাইন মুদ্রায় রুপান্তরিত শুরু হয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির সাহায্যে এখন কোটি কোটি টাকা আপনি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করতে পারবেন। আর তাই বলাই যায়, ভবিষ্যত পৃথিবীতে ক্রেডিট কার্ডেরও সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, যখন হাতে হাতে ক্রেডিট কার্ড শোভা পাবে। ক্রেডিট কার্ডের সম্ভাব্য হুমকিগুলো জেনে সচেতনভাবে কার্ড ব্যবহার করাই আপনাকে দিতে পারে সাবলীল অর্থ লেনদেনের নিশ্চয়তা।

অনবরত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহঃ

১. আমার ক্রেডিট কার্ড লিমিটের কতটুকু ব্যবহার করা উচিত?

উত্তরঃ আপনি নিয়মিত আপনার ক্রেডিট লিমিট চেক করতে পারেন। তবে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে চাইলে এবং খুব বেশি ব্যয় করে অতিরিক্ত সুদের হাত থেকে বাঁচতে চাইলে চেষ্টা করবেন যেনো ক্রেডিট কার্ডের লিমিট ৪০% এর নিচে না নামে।

২. ক্রেডিট কার্ড কি কোন ধরনের নিরাপত্তা বা ইন্সুরেন্স প্রদান করে?

উত্তরঃ ক্রেডিট কার্ড ইন্সুরেন্স হিসেবে আপনাকে কিছু অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রদান করবে, যাতে করে আপনার কার্ড যদি হারিয়ে যায়, বা সেই কার্ড থেকে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত কেনাকাটা হয়, অথবা কার্ড নষ্ট হয়ে গেলে আপনি সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।

৩. ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে আমার লোন নেওয়া উচিত নাকি ইএমআই সুবিধা নেওয়া উচিত?

উত্তরঃ ব্যক্তিগত লোন থেকেও ইএমআই অনেক সহজ এবং সাশ্রয়ী। ইএমআই ব্যবহার করে আপনি যেকোন দামী পণ্য, যেমন টেলিভিশন, ফ্রিজ অথবা বাইকসহ আরো অনেক কিছু কিনতে পারবেন।

৪. আমার ক্রেডিট কার্ডের নূন্যতম যে বকেয়া পরিমাণ দেওয়া, সেই পরিমাণ অর্থই আমি পরিশোধ করতে পারবো কিনা?

উত্তরঃ বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই মনে করেন যে নূন্যতম যে এমাউন্টটি ক্রেডিট কার্ড বিলের উপরে দেওয়া থাকে, তা তার মোট বকেয়ার পরিমাণ। যেখানে প্রকৃতপক্ষে এটি সর্বনিম্ন একটা এমাউন্ট, যা আপনাকে পরিশোধ করতে হবে পরবর্তী সুবিধা পাওয়ার জন্যে। মাস শেষে আপনার ব্যয় হিসেবেই আপনার বকেয়া পরিশোধ করা লাগবে।

৫. আমি কি আমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে এটিএম থেকে নগদ টাকা তুলতে পারি? এতে অতিরিক্ত চার্জ লাগবে কিনা?

উত্তরঃ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে আপনি এটিএম বুথ থেকেও টাকা তুলতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী আপনাকে ২-৩% অতিরিক্ত চার্জ দেওয়া লাগতে পারে।