আফ্রোডাইটকে নিয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ যে ঘটনা তা সম্ভবত পিগমালিয়ন এবং গালাটিয়ার প্রেম কাহিনি। প্রাচীন গ্রীসের সাইপ্রাস নামক দ্বীপে পিগমালিয়ন নামে এক প্রতিভাশালী ভাস্কর ছিলেন যিনি ঘন্টার পর ঘন্টা হাতির দাঁতের উপর ভাস্কর্য খোদাই এর কাজে নিমগ্ন থাকতেন। তিনি তাঁর কাজকে এতোটায় ভালবাসতেন যে কাজ ই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান এবং ভাললাগা। আফ্রোডাইট ছিলেন সাইপ্রাসের রক্ষাকর্তা।কিন্তু সাইপ্রাসের মেয়েরা তাকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানাতে ব্যর্থ হলে তিনি সব মেয়েদের প্রেমবিহীন পতিতালয়ের জীবন কাটানোর অভিশাপ দিলেন। এ কারণেই মূলত পিগমালিয়নের নারীদের প্রতি বিতৃষ্ণা ছিল। তো পিগমালিয়ন একবার একখন্ড হাতির দাঁতের উপর একটি সুন্দরী তরুণীর মূর্তি তৈরি করতে শুরু করেন।তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত খোদাইয়ের কাজ চালান যতক্ষণ না মূর্তিটি তৈরি হয়।তিনি এতোটায় নিখুঁতভাবে কাজটা সম্পন্ন করেছিলেন যে মূর্তিটিকে দেখলে জীবন্ত মানুষ মনে হচ্ছিল। নারীবিদ্বেষী পিগমালিয়ন তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রেমে পরে গেলেন। অথচ কামের প্রতি ঘৃণা থেকে পিগমালিয়ন কখনো বিয়ে করবেন না বলেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তরুণীর মূর্তিটিকে তিনি সুন্দর পোষাক,অলঙ্কার পরিয়ে দিতেন এবং উজ্জ্বল পাথর, ছোট ছোট পাখি, নানান রঙের ফুল এবং তখনকার সময়ে তরুণীরা যা যা পছন্দ করত তা দিয়ে অনেক আদর করে সাজাতেন। এই মূর্তির নাম রেখেছিলেন গালাটিয়া যার অর্থ সুপ্ত ভালবাসা। পিগমালিয়ন বার বার তাঁর সৃষ্টিকে ছুঁয়ে দেখতেন, চুমু খেতেন, নিজের প্রেমিকার মতো আদর যত্নে রাখতেন আর ভাবতেন,”আহা! কত সুন্দরী আমার গালাটিয়া,একে যদি আমার স্ত্রী হিসেবে পেতাম, মূর্তি না হয়ে সে যদি রক্ত মাংসের মানুষ হত!”
মাঝে মাঝে তো তিনি গালাটিয়াকে রক্ত মাংসের মানুষ ভেবে ভুল ও করতেন।
একদিন পিগমালিয়ন দেবী আফ্রোডাইট এর উৎসবে তাঁর মন্দিরে গিয়ে গালাটিয়ার আদলে কাউকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানান। তাঁর অন্তরের আবেগ এতোই তীব্র ছিল যে তা দেবীর কান পর্যন্ত পৌঁছায়, এবং তিনি তাঁর ভক্তের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে পিগমালিয়নের বাড়ি যান মূর্তিটি দেখতে। সাথে সাথে ভাস্করের এতো আবেগপ্রবণ প্রার্থনার কারণ জানতেও তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মূর্তিটি স্বচক্ষে দেখে দেবী ভাবতে বাধ্য হন যে এ মূর্তি ঠিক তারই আদলে তৈরি হয়েছে।মূর্তির নিঁখুত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী তৎক্ষণাৎ মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
পিগমালিয়ন বাড়ি ফিরে অভ্যাস মতো গালাটিয়াকে চুমু খেতে গেলে উষ্ণতা অনুভব করেন এবং বুঝতে পারেন গালাটিয়া আসলেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এতে ভাস্কর অনেক বেশি আনন্দিত হয়ে ওঠেন। দুজনেই তখন দেবীর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ধন্যবাদ জানান এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। এ বিয়েতে তাঁরা আফ্রোদিতিকে বিশেষ অতিথি হিসেবে দাওয়াত দিলেন এবং সারাজীবন দেবীর পূজা, স্তুতি গাওয়া সহ নানা আচার পালন করেন। বিনিময়ে দেবী তাদের দীর্ঘায়ু ও সুখী দাম্পত্য জীবনের আশীর্বাদ দেন।
এই দম্পতির একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে হয়। ছেলের নামে সাইপ্রাসের নাম রাখা হয় পাফোস।
এছাড়া গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী ইউরোপ সৃষ্টি এবং বৃষ তারকামন্ডলী সৃষ্টির পেছনের উপকথাতেও রয়েছে আফ্রোডাইট এবং তার সন্তান ইরোসের গৌণ প্রভাব। এজিনর কন্যা ইউরোপা ছিলেন অপার্থিব সুন্দরী,তাকে দেখলে মনে হয় যেন কোনো পরী বা দেবী পথ ভুলে স্বর্গের বদল মর্ত্যে নেমে এসেছেন। আফ্রোডাইটের প্ররোচনায় তাঁর পুত্র ইরোস জিউসের দিকে ভালবাসার তীর ছুঁড়ে দেন। এ তীরের কারণে এজিনরের মেয়ের প্রেমে পরে যান জিউস। তাই একদিন স্বর্গরাজ জিউস একটি সুন্দর ষাঁড়ের রূপ ধরে ইউরোপার সামনে আসেন এবং ইউরোপা তার পিঠে উঠলে তাকে নিয়ে সমুদ্রের দিকে দৌড় দেন। এসময় ইউরোপার অন্য সঙ্গীনীরা এটাকে ষাঁড়ের খেলা বলেই মনে করেছিল। জিউস ইউরোপাকে নিয়ে তাঁর জন্মস্থান ক্রিট দ্বীপে যান এবং সেখানে তাঁর ৩টি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যারা মৃত্যুর পর পাতালের ৩ বিচারকে পরিণত হন। এছাড়া ইউরোপাকে দেওয়া কথা অনুযায়ী জিউস ক্রিটের নাম রাখেন ইউরোপ।এবং জিউসের এর ষাঁড়ের রূপ ধরার ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে বৃষ তারকামণ্ডলী সৃষ্টি করেন।
আফ্রোডাইট বেশ প্রতিশোধপরায়ণও ছিলেন। তাঁর এই প্রতিশোধপরায়নতার এক বলি হিপ্পোলিটাস। হিপ্পোলিটাস প্রথমে আফ্রোডাইটের সম্প্রদায় ভুক্ত হলেও পরবর্তীতে তিনি দেবী আর্টেমিস এর ভক্তে পরিবর্তিত হন। এ ঘটনায় আফ্রোডাইট প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠেন। প্রতিশোধ উন্মত্ত দেবী হিপ্পোলিটাসের সৎ মা ফ্রায়েডাকে হিপ্পোলিটাসের প্রেমে পরতে প্ররোচিত করেছিলেন। ফ্রায়েডা প্রত্যাখিত হলে তার স্বামী এবং হিপ্পোলিটাসের বাবা থিসিউস এর উদ্দেশ্যে একটি নোট রাখে যেখানে উল্লেখ ছিল হিপ্পোলিটাস তার সৎ মাকে ধর্ষণ করেছে। এতে থিসিউস ক্ষিপ্ত হন এবং হিপ্পোলিটাসকে তার কৃতকর্মের স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে বলেন। হিপ্পোলিটাস তার প্রতি ফ্রায়েডা এর ভালবাসার উল্লেখ করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেননি। থিসিউস তাই প্রকৃত সত্য না জেনেই হিপ্পোলিটাস কে অভিশাপ দেন।ফলে নিজের রথের ঘোড়াকে ভয় পাওয়ার ফলে রথ উলটে মারা যান হিপ্পোলিটাস।আসলে কিন্তু আফ্রোডাইটের পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম। তিনি চেয়ে ছিলেন মা ছেলের এ প্রেম থিসিউসের সামনে প্রকাশিত করতে। কিন্তু হিপ্পোলিটাস তা হতে দেন নি।
মনোবিজ্ঞানে কোনো প্রতিষ্ঠিত ধারণার সাথে নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোকে ব্যাখ্যা করার একটি উপায় রয়েছে যা কম্পলেক্স নামে পরিচিত। এই কম্পলেক্সগুলো প্রায়শই একজন ব্যক্তির আচরণ বা বৈশিষ্ট্যকে কোনো পৌরাণিক কাহিনির চরিত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে। আফ্রোডাইটের ও নিজস্ব কম্পলেক্স রয়েছে। যা আফ্রোডাইট কম্পলেক্স নামে পরিচিত।এ কম্পলেক্সে আক্রান্ত মহিলা বিশ্বাস করে যে সে একজন পুরুষের সাথে সম্পর্ক না রাখলে কখনোই সুখি হতে পারবে না,ভাল থাকতে পারবে না। এই কম্পলেক্সে আক্রান্তরা তাদের সাথে দেখা হওয়া প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে তাদের আদর্শ সঙ্গীর খোঁজ করতে থাকে, এছাড়া তারা অবিবাহিত থাকার ধারণায় সর্বদায় আতঙ্কিত থাকেন। তারা সর্বদাই একজন সঙ্গী চান,সঙ্গীটি ভাল বা খারাপ যা ই হোক না কেন। যদি শেষপর্যন্ত আদর্শ মানুষ বা সঙ্গী খুঁজে না পায় তাহলে তারা বেশ হতাশাজনক অবস্থায় যান,তাদের মধ্যে নিম্ন আত্নসম্মানবোধ, দীর্ঘস্থায়ী বদমেজাজ ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা যায়।
হেডিস কর্তৃক পার্সেফোনের অপহরণের ঘটনায় ও হাত ছিল আফ্রোডাইট ও তাঁর পুত্র ইরোসের।কারণ হিসেবে বলা হয়, ডিমিটার পার্সেফোনকে অলিম্পাস থেকে দূরে রাখায় তিনি বেশ ক্ষুদ্ধ ছিলেন তাই ইরোস যখন ভালবাসার তীর নিক্ষেপ করছিলেন তখন বাধা দেওয়ার বদল সাহায্য ই করেন আফ্রোডাইট।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি দেবতা ও নশ্বরদের মধ্যে আফ্রোডাইট এর বেশ কিছু প্রেমিক ছিল যার মধ্যে অ্যারেস তাঁর বেশ প্রিয় ছিলেন। অ্যারেস এর সাথে মিলনে এ দেবীর ৬টি সন্তান জন্ম নেয় যারা হলেনঃঅ্যানটেরোস, ডেইমোস, ইরোস, ফোবোস, হারমোনিয়া এবং হোমার।এছাড়া ডায়োনিসের সাথে ২টি সন্তান; হাইমেনিয়াস ও প্রিয়াপাস এবং হার্মিসের সাথে ৩টি; হামাফ্রোডাইট, পেইট এবং টাইচে নামক সন্তান ছিল তাঁর।সমুদ্রের দেবতা পোসেইডনের সাথে ও তাঁর সন্তান ছিল বলে জানা যায়।
কামনার দেবী তাঁর প্রিয় পুত্র অ্যানিয়াসের জন্য সবসময় চিন্তিত থাকতেন এবং তার সুরক্ষার ব্যবস্থায় ব্যস্ত থাকতেন। অ্যানিয়াস ট্রয়ের যুদ্ধে একজন সৈনিক ছিল। ট্রয়ের যুদ্ধের পরোক্ষ কারণ অবশ্য দেবী আফ্রোডাইট নিজেই। যা হোক,ডায়োমেডিস যখন অ্যানিয়াসকে হত্যা করতে যাচ্ছিল তখন আফ্রোডাইট নিজে আহত হয়েও পুত্রকে সময়মতো উদ্ধার করেন।
অবশ্য আহত হওয়ায় অ্যানিয়াসকে ফেলেই দিয়েছিলেন দেবী কিন্তু অ্যাপোলো অ্যানিয়াসকে রক্ষা করে একটি মেঘ দ্বারা। পরবর্তীতে অ্যাপোলো ই অ্যানিয়াসের সেবা শুশ্রুষা এর জন্য তাকে ট্রয়ের এক পবিত্র স্থানে রেখে আসেন, যেখানে আফ্রোডাইট অ্যানিয়াসের সেবা করেন।
ট্রয়ের যুদ্ধে দেবী প্যারিসকে বার বার সাহায্য করেন।একবার তো ম্যানিওলাসের হাত থেকে বাঁচাতে প্যারিসকে মেঘের আবরণে আবৃত করে ট্রয়ের সুরক্ষিত এলাকায় নিয়ে আসেন।
দেবীকে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মে নগ্ন রূপে দেখানো হয়।তার সৌন্দর্য বার বার মুগ্ধ করেছে কবি সাহিত্যিক ও ভাস্কর দের। এন্টিওকের আলেক্সজান্ডার নামক এক ভাস্কর আফ্রোডাইটের আদলে নির্মাণ করেন তার বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘ভেনাস ডে মিলো‘ যা আফ্রোডাইটের সবচেয়ে বিখ্যাত মূর্তি। জন কীটস, টেনিসন, শেক্সপিয়র কেউই এ দেবীকে নিয়ে লেখার সুযোগ ছাড়েননি।হোমারের বর্ণনায়ও এ দেবীর রোমান সংস্করণ তথা ভেনাসের রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। শেক্সপিয়র লিখেছিলেন অ্যাডোনিস ও আফ্রোডাইটের প্রেম নিয়ে।চিত্রকর্মেও বার বার উঠে এসেছে আফ্রোডাইটের সৌন্দর্য তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম হল স্যান্ড্রো বত্তিচেলির ‘বার্থ অফ ভেনাস‘ যা ১৪৮৬ সালে আঁকা হয়।
কামনা ও লালসার দেবীঃ আফ্রোডাইট – শেষ পর্ব
Loading books...