সের্হিও আগুয়েরোর এক গোলে ম্যানচেস্টার সিটির ভাগ্য কিভাবে বদলে গেল

সের্হিও আগুয়েরোর এক গোলে ম্যানচেস্টার সিটির ভাগ্য কিভাবে বদলে গেল?

একটি গোলের শুরু যেভাবে…….

একটি গোল; একটি ক্লাবের ভাগ্য বদল! বিষয়টি ভাবতে গেলে যে কেউ অবাক হওয়ার কথা। ২০০৮ সালে দুবাইয়ের আবুধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ ম্যানচেস্টার সিটির মালিকানা কিনে নেওয়ার পর ক্লাবটিকে দ্রুত বদলে ফেলতে শুরু করে। সাফল্য খরায় ভুগতে থাকা দলটিকে তাঁরা ইংল্যান্ডের অন্যতম সফল দলে পরিণত করার মন্ত্র নেয়। তাদের সেই লক্ষকে আরো সহজ করে দেন এক তরুণ আর্জেন্টাইন। আতলেতিকো মাদ্রিদ থেকে কেনা সেই আর্জেন্টাইনই তরুণ যার নাম সের্হিও আগুয়েরো; তাঁর এক অবিস্মরণীয় এক গোলে সিটিকে লিগ জিততে শেখান। আর সেখান থেকেই ক্লাবটির পথচলা আরো সহজ হয়ে যায় । ক্লাবটি ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অনেক নামীদামী খেলোয়াড়দের দলে ভিড়িয়ে ইংল্যান্ডের অভিজাত ক্লাবের সমগোত্রীয় হওয়া দৌড়ে তাল মিলাতে শুরু করে।

এই দিনই সেই দিন…..

২০১২ সালের ১৩ মে। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরের ইতিহাদ স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছে প্রিমিয়ার লিগের দুই ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি ও কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স । ইংল্যান্ডের অপর প্রান্ত সান্দারল্যান্ডের মাঠে মুখোমুখি হয়েছে প্রিমিয়ার লিগের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও সান্দারল্যান্ড। এদিন ২০১১-১২ মৌসুমের শেষ দিন । মাঠে নেমেছে প্রিমিয়ার লিগের ৩২টি দল। কিন্তু সবার নজর দুটি ম্যাচের দিকে। ম্যানচেস্টারের দুই ক্লাবই যে লিগ শিরোপা প্রত্যাশী। ৩৭ ম্যাচে শেষে দুই দলেরই সমান ৮৬ পয়েন্ট। কিন্তু গোল ব্যবধানে এগিয়ে আছে সিটি। শেষ ম্যাচে জয় পেলে সমান পয়েন্ট হলেও গোল ব্যবধানে শিরোপা উঠবে রবার্তো মানচিনির ম্যানচেস্টার সিটির হাতে। ভিনসেন্ট কোম্পানি, পাবলো জাবালেতা, সামির নাসরি, ডেভিড সিলভাদের যে আর তর সইছে না। ৯০ মিনিটের অপেক্ষো। একটি জয় যে নীল জার্সি পরিহিত নাবিকদের খুব দরকার। কারণ ১৯৬৮ সালে পর যে শিরোপা সিটির খেলোয়াড় আর সমর্থকেরা স্পর্শ করতে পারেন নি। সেদিন কেমন ছিল সেই ম্যাচ দুটি?

ম্যাচের ২০ মিনিট…….
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-সান্দারল্যান্ড ম্যাচের ২০ মিনিটের মাথায় ওয়েন রুনির গোলে এগিয়ে যায় ইউনাইটেড। শুরুতেই প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা ইউনাইটেডের দিকে ঝুঁকে গেল।

ম্যাচের ৩৯ মিনিট…….
ম্যানচেস্টার সিটির ডিফেন্ডার পাবলো জাবালেতার গোলে ১-০ গোলে এগিয়ে যায় সিটি। গোল ব্যবধানে ইউনাইটেডের চেয়ে এগিয়ে থাকার কারণে লিগ জেতার সম্ভাবনা চলে যায় সিটির দিকে।

ম্যাচের ৪৮ মিনিট………
কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের খেলোয়াড় জিবরির সিসে সিটির বিপক্ষে গোল কর বসেন। ম্যাচে ১-১ গোলে সমতা । শিরোপা আবার ইউনাইটেডে দিকে ঝুঁকে পরে। সিটির ম্যাচ যদি ড্র হয় তবে ২ পয়েন্ট ব্যবধানে লিগ জিতবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

ম্যাচের ৬৬ মিনিট…….
ইতিমধ্যে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের খেলোয়াড় জো বার্টন লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়েছেন। কিন্তু কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স বড় অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে। ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে করে ফেলেছে আরো এক গোল। ম্যাচে তখন ২-১ গোলে পিছিয়ে ম্যানচেস্টার সিটি। তার মানে সিটি হেরে যাচ্ছে। ৩ পয়েন্ট ব্যবধানে লিগ জিততে চলছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

ম্যাচের ৯০+২ মিনিট…..
ম্যাচের নির্ধারিত সময় শেষ। কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স ২-১ গোলে এগিয়ে। তারমানে তারা ম্যাচ জিততে চলছে। জয়ী হয়ে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের খেলোয়াড়েরা যখন আনন্দ উৎসব করার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক তখনি ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে সমতাসূচক গোল করেন সিটির বসনিয়ান স্ট্রাইকার এডিন জেকো। ম্যাচ তখন ২-২ গোলে সমতা। লিগ শিরোপা তখনো ইউনাইটেডে দিকে । কারণ সিটি- কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের ম্যাচ ড্র হলেও লিগ ২ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে লিগ জিতবে ইউনাইটেড।

ম্যাচের ৯০+৫ মিনিট……
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সান্দারল্যান্ডের বিপক্ষে জয় লাভ করেছে। তারা ধরে নিয়েছে সিটিকে পেছনে ফেলে লিগ জিতে নিয়েছে তারা। সংবাদ ম্যাধ্যমের অনলাইন সংস্করণগুলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ২০১১-১২ মৌসুমের লিগ জয়ী দল হিসেবে ঘোষণা করছে। কিন্তু সিটির ম্যাচ যে তখনো শেষ হয় নি। ফুটবল বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ম্যাচের ৯৫ মিনিটে সিটির হয়ে তৃতীয় ও জয়সূচক গোলটি করেন সের্হিও আগুয়েরো। ইউনাইটেডের উৎসবকে কান্নায় পরিণত করে ৪৪ বছর পর লিগ শিরোপা জয়ের আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন সিটিজেনরা। খেলোয়াড় ও দর্শকদের আনন্দ এতটাই বাঁধভাঙ্গা ছিল যে, ম্যাচ শেষে গ্যালারি থেকে দর্শকেরা মাঠে ঢুকে খেলোয়াড়দের সাথে জয় উৎস মেতে উঠেন।

কিংবদন্তি কিভাবে সেই দিনকে স্মরণ করছেন……

১০ বছর পরও সিটি সেই গোল, দিন ও জয়টিকে স্মরণ করছে এবং ক্লাবটির স্টেডিয়ামের সামনে সের্হিও আগুয়েরোর একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেছে। ম্যানচেস্টার সিটিতে ১০ বছর সাফল্যের সাথে খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে গত মৌসুমে বার্সেলোনায় পাড়ি জমিয়েছিলেন আগুয়েরো। কিন্তু হার্টের সমস্যা দেখা দেওয়ার পর খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি ঘটে। তার মনের এক কোনে একটি আফসোস এখনো রয়ে গেছে। তিনি চেয়েছিলেন সিটির জার্সি গায়ে ইউরোপ সেরার তকমা লাগাবেন। সেই আশা অপূরণ রেখেই সিটিকে বিদায় জানাতে হয়। তবে নিজের করা সেই গোল ও জয় এখনো তার অন্তরে সতেজ। সিটির স্টেডিয়ামের সামনে তার ভাস্কর্য উন্মুক্ত করতে এসে আবেগ আপ্লুত আগুয়েরো বলেন –

”সত্যি কথা বলতে, এটি সত্যি আমার জীবনের সুন্দর একটি মুহূর্ত। সিটিতে ১০ বছরে আমি অনেক শিরোপা জিতেছি এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছি। কিউপিআরের বিপক্ষে করা গোল এখনো আমাকে নস্টালজিক করে তুলে।”

সেই জয়ের পর কি হলো?

সেই শুরু…। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি ম্যানচেস্টার সিটিকে। একটি লিগ শিরোপা তাদের খুব দরকার ছিল। খেলোয়াড়দের মনে আত্মবিশ্বাস আনতে, ইউরোপে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে; লিগ শিরোপা তাদের দারুণ ভাবে সহায়তা করে। সের্হিও আগুয়োরের সেই গোলই সিটিকে নতুন করে লিগ জয়ী হতে শেখায়। ইংল্যান্ডের ফুটবলে এক নতুন রাজার আগমন ঘটে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইয়ের দুই ফুটবলপ্রেমী মনসুর বিন নাহিয়ান ও খালদুন আল মোবারক ম্যানচেস্টার সিটিকে ইউরোপের সেরা ক্লাবদের একটি গড়ার উদ্দেশ্যে প্রতিভাবান ও তারকা খেলোয়াড়দের দলে ভেড়াতে থাকেন। দলে আসতে থাকেন সেরা কোচ। তবে সিটির উত্থানে ইতালিয়ান কোচ রবার্তো মানচিনির অবদানও কম নয়। তার সাহস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা খালদুন আল মোবারকের চিন্তার সাথে মিলে যায়। প্রিমিয়ার লিগের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবগুলো থেকে খেলোয়াড় সই করাতে থাকেন মানচিনি ও খালদুন আল মোবারক।পরের মৌসুমে লিগ শিরোপা জিতেতে না পারলেও ইতিমধ্যে আরো ৪ বার লিগ শিরোপা ঘরে তুলেছে ম্যানচেস্টার সিটি। পেপ গার্দিওয়ালার মত কোচ এসেছেন সিটির ডাগ আউটে। তিনি সিটিকে নিয়ে চলেছেন সাফল্যের অন্য উচ্চতায়। তার হাত ধরে চলতি মৌসুমে আরো একটি লিগ শিরোপা জয়ের পথে সিটিজেনরা।

তবে তাঁদের কাছে ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাবান শিরোপা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এখনো অধরাই রয়ে গেছে । বারবার সেমিফাইনালের কোটা থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে সিটিজেনদের।একবার ফাইনাল খেলেও স্বদেশী চেলসির কাছে পরাজিত হয়ে নিরাশ হয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। সেখানেও হয়ত একজন সের্হিও আগুয়েরো দরকার, যে একবার সিটিজেনদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে শেখাবেন। তারপর একের পর এক চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাও সিটির শোকেসে আসতে থাকবে।

তোমার হলো শুরু আমার হলো সাড়া…..

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তখন ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের অন্যতম সেরা ক্লাব। সেই মৌসুমে তাঁরা প্রিমিয়ার লিগের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নও ছিল। সান্দারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের পর তাঁরা ধরে নিয়েছিল তাঁরা ব্যাক টু ব্যাক লিগ শিরোপা জিততে যাচ্ছে। কিন্তু আগুরোর গোলের মাধ্যমে তা আর হয় নি। কিন্তু পরের মৌসুমে অবশ্য তাঁরা লিগ শিরোপা জিতেছিল।……সেই শেষ। ইউনাইটেডের কোচ হিসেবে ২০১২-১৩ মৌসুমে স্যার এলেক্স ফার্গুসন অবসর নিলে ইংল্যান্ড ও ইউরোপে ইউনাইটেডের দিন শেষ হয়ে আসে। এরপর সিটি যেখানে ৪ বার লিগ শিরোপা জিতছে ও আরো একটি জয়ের পথে সেখানে ইউনেইটেড এক হালি কোচ বদলেও নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। ম্যানচেস্টারের রাজা এখন সিটিজেনরা।ম্যানচেস্টারের একপ্রান্তে যখন শিরোপা উৎসব হয় তখন অন্য প্রান্তে নেমে আসে হাহাকার।আর এই উৎসব আর হাহাকারে, একজন আগুয়েরোর শেষ সময়ের গোল অনেক কিছু বহন করে।