ইরা, ঘুম এবং অন্যান্য

কেউ কেউ অল্প কিছুতেই বেশ খুশি হয়ে যায় আবার কাউকে খুশি করতে ঘাম ছুটে যায়। খুশির মতো রাগ ও যেন স্রোতস্বিনী.. কখন আসে আর কখন যায় তার হদিস পাওয়া যায় না। তেমনি ইরার আজ তার বাবার উপর বড্ড রাগ। কারণ ছাড়ায় রাগ বলে একটা খটমটে বেপারে যেন আটকা পরে গেছে ইরার দিনকাল। হুঠহাট রাগে সব কিছু ভেঙে ফেলার ইচ্ছা দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সবের মূলে রয়েছে এই ঘুম….আর অতিরিক্ত চিন্তা….
ঘুমের সাথে মন মেজাজের যে এতো দৃঢ় সম্পর্ক থাকতে পারে তা কখনো ভাবেনি ইরা। আপাতদৃষ্টিতে শুধু মাত্র বাবার ঘুমের প্রতি হিংসা ই ইরার রাগের একমাত্র কারণ…নিরীহ একটা কারণ… কিন্তু ইরার মন চাইছে বাড়ির সব থালা বাসন কংক্রিটের মেঝেতে একটার পর একটা ফেলে…
সবাই বলে রাগের সময় ১০০থেকে ১ পর্যন্ত গুণলে বা জোরে জোরে শ্বাস নিলে রাগ কমে যায়। এ দিকে ইরা ১০ বার ওভাবে গুণেও রাগ কমাতে পারছে না।
বাবা, ও বাবা!
-উম্ম
আর কতো ঘুমাবে? এই ভরসন্ধ্যায় কেউ ঘুমায় বুঝি?
-কি?
বাবা! ওঠো! আমার হোমওয়ার্কে হেল্প করো। কাল যে অনেক হোমওয়ার্ক!
-কি হোমওয়ার্ক…কবে লাগবে?
মা চেঁচেমেঁচি শুনে ঘরে ঢুকে ডেকে নিয়ে গেল ইরাকে। তার হোমওয়ার্কে সাহায্য করল। পড়াল। তবুও ঘুম ভাঙে না ইরার বাবার।
রোজকার মতো আজও মাঝরাতে ইরা ডাকছে বাবাকে-
“বাবা, আর কত ঘুমাবে? ওঠো। আমার ঘুম আসছে না। বাবা…..” কত ডাকল, কত বার…কিন্তু ইরা কোন সাড়া ই পেল না লোকটার।

এদিকে ইরার ঘুম আসছে না। বাথরুমে গিয়ে গোসল করল সে এই মাঝরাতে, তবুও মাথা ঠান্ডা হয় না।

——

রাতের দেবতা নিক্সের ছেলে ঘুমের দেবতা হিপনোস তার পাতালগৃহ থেকে বিতারিত হয়েছেন কেবল। তেমন বড় কিছুই না শুধু জিউস কে দুবার চক্রান্ত করে ঘুম পারিয়েছিলেন,তাতেই দেবতাদের রাজার ক্রোধে আজ গৃহচ্যুত হিপনোস। এ দিকে হেরার বুদ্ধিতেই যে শেষবার জিউসকে ঘুম পাড়াতে গিয়েছিলেন তা আর বিশ্বাস করাতেই পারলেন না কাউকে। হিপনোস নিজেও জানেন ট্রয়ের যুদ্ধে জিউস কে ঘুমিয়ে রাখা তার অপরাধ ই হয়েছে। তাই বলে এতোটুকু অপরাধের এতোবড় শাস্তি?কেনো কেনো কেনো? যার পরশে মানব সম্প্রদায় এককালে আরামে ঘুমাতো, যার ছেলেদের কারণে সুন্দর সুন্দর স্বপ্নের জাল বুনত সে হিপনোস আজ তার সমস্ত ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারাচ্ছে। পরিণত হচ্ছে এক সাধারণ মানুষে। আর একই সাথে মানুষের ঘুম চক্র নষ্ট হচ্ছে, ঘুমের মাধ্যমে ক্লান্তি দূর হওয়ার বদলে যেন ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পরছে…. দিকে দিকে শুধুই হাহাকার।

——

সকাল হতে আর বেশি দেরি নেই তবুও ইরা ঘুমাতে পারছে না, দিনে করা প্রতিটি কাজ এখন দানব আকার ধারণ করে ইরার চিন্তার জগৎকে ছিন্নভিন্ন করছে। অথচ বারো বছরের এক কিশোরীর এতো চিন্তা এতো অপরাধবোধ থাকার কথা নয়। রাতের পর রাত জেগে কাটাবার কথা নয়। দিনরাত মনমরা হয়ে জন্মজন্মান্তরের ভুল চিন্তা করার কথা নয়। বারো বছর বয়সটা উচ্ছ্বাসের বয়স,আনন্দের বয়স, হেসে খেলে ভুল করার বয়স। কিন্তু ইরার সাথে কোনভাবেই বৈশিষ্ট্য গুলো মেলে না। ইরা বাবামায়ের একমাত্র মেয়ে। একমাত্র মেয়েরা একটু রাগী জেদি আর অভিমানী ই হয়ে থাকে সাধারণত। তাই প্রথমদিকে বেপারটায় গা করেন নি ইলিয়াস সাহেব।

কিন্তু এই যে অতিরিক্ত রাগ, অতিরিক্ত চিন্তা…ঘুম না হওয়া…. অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া এসব তো স্বাভাবিক না। আর তাই বার বার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখিয়েও কাজ না হওয়ায় ভাল হওয়ার আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছেন তিনি। যে ডাক্তার ই দেখানো হয় তিনি ই সব শুনে একগাদা ঔষুধ লিখে দেন। যেনো মুড়ি মুড়কির মতো ঔষুধ খেলেই মনের রোগ সেরে যায়।

——
দেবী হেরার প্রস্তাবে জিউসের মতো শক্তিশালী কাউকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের শক্তিমত্তার পরীক্ষা করার লোভ….. বড়ই কঠিন লোভ হিপনোসের জন্য। আর শাস্তিও হাতে হাতেই পেলেন হিপনোস… একদম lethe নদীতে দুবার গোসল…. এ নদীর পানিতে হাত দিলেও জীবনের একটা অংশ ভুলে যায় সবাই… সেখানে ডুব দিয়ে হিপনোস তার কর্মক্ষমতা স্মৃতি সবই প্রায় হারিয়ে ফেলল। এদিকে হিপনোসের ঘুম পাড়ানোর শক্তি চলে যাওয়ায় মানুষ এর অবস্থা বেশ খারাপ হতে লাগল। এসময় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এলেন প্রমিথিউস। তিনি সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষের বন্ধু। মানুষকে প্রথম আগুন জ্বালানো শেখানো থেকে আরো অনেক কিছুতেই রয়েছে তার অবদান। তিনিই জিউসকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হিপনোসের শাস্তি কমানোর ব্যবস্থা করলেন। জুড়ে দিলেন একটি বিচিত্র শর্ত, বললেন, হিপনোস একবারে তার শক্তি হারাবে না। বরং ধাপে ধাপে শক্তি হারিয়ে মানুষের কাতারে চলে যাবে। আর শক্তি হারানোর সাথে সাথে মানুষ ও ভুলে যাবে তাকে। যদি কখনো এমন এমন একজন মানুষ যার দীর্ঘদিন ঘুম হয় না হিপনোসকে মনে প্রাণে ঘুমের জন্য ডাকে তবেই তার শক্তি ফিরে পাবে হিপনোস।

—–

আজকাল ইরার কিছুই ভাল লাগে না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা ক্লাসের পড়া সবই যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। তার প্রিয় বিষয় মিথলজি ও আজকাল ভাল লাগে না। বার বার হিপনোসকে নিয়ে নানা আর্টিকেল পড়ে,নানাভাবে ঘুমের দেবতার কার্যপদ্ধতি জানার চেষ্টা করে। অনেক আর্টিকেল পড়ে যখন ইরা হিপনোসের শাস্তি সম্পর্কে জানতে পারে তখন বেশ মুষড়ে পরে। তার মনে হতে থাকে আসলেই হিপনোসের শক্তি শেষের পথে। কিন্তু মিথলজি তো মিথলজিই। আজকের ডাক্তার আঙ্কেলকে অবশ্য বেশ পছন্দ হয়েছে ইরার। ইরা ভাবতে থাকে,”আহা!কি সুন্দর করে যে কথা বলেন তিনি! আর কত কথায় না বলেন। তিনিও বোধহয় মিথলজির ভক্ত। কি যেন বললেন শেষে! ওহ হ্যাঁ মনে পরেছে, হিপনোস অভিশপ্ত হলেও বার বার ঘুম পাড়াতে চান কাউকে। ঘুম ছাড়া মানুষের সাময়িক বিশ্রামের কোনো সুযোগ ই নেই যে। এই যে আমরা এখন সারারাত জেগে থাকি সারাদিন ঘুমাই এর কারণ তো তার অনুপস্থিতি ই। যতই প্রযুক্তির দোষ দেই না কেন ঘুম চক্রের এই অবনতির কারণ হিপনোসের ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ায়!”
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই একসময় আসলেই ঘুমের দ্বারপ্রান্তে এসে গেল ইরা। তখন ই হঠাৎ কি মনে করে হিপনোস এর কাছে খুব করে ঘুম চাইল…. আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে গেল ইরা…ঘুমের ঠিক আগ মুহুর্তে ইরার মনে হল যেন কেউ কপালে জাদুর পরশ বুলালো আর দূর হয়ে গেল তার সমস্ত দুশ্চিন্তা…সমস্ত ভয়।

—-

প্রমিথিউস এর প্রস্তাব বেশ মনোঃপুত হল জিউসের। আবারো হিপনোসের শক্তি ফিরিয়ে দেওয়া হোক,তারপর ধীরে ধীরে কেড়ে নেওয়া হবে তার সমস্ত শক্তি….. ফিরে পেয়ে আবার হারানোর যন্ত্রণা ভোগ করবে এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে? আস্তে আস্তে পৃথিবীর মানুষ ভুল যাবে হিপনোসের কথা আর সে দেবতা থেকে চলে যাবে মানুষের কাতারে। আর যেখানে সে আগেই হারিয়ে যাবে স্মৃতির অতলে সেখানে নতুন করে কারো তাকে ডাকার প্রশ্ন ই ওঠে না। কিন্তু জিউস বুঝতেও পারেনি প্রমিথিউস এতো বুদ্ধিমান হবে যে তার খুশির সুযোগে হিপনোসের জন্য শাপে বর ধরণের শর্ত জুড়ে দিবে।

——

রাত ৩ টা
ঘুম ভাঙল হিপনোসের…. কেউ তাকে মন থেকে ডাকছে…..হ্যাঁ তিনি করতেই পারেন এই মেয়েটাকে সাহায্য। প্রমিথিউসের শর্ত ও তো এটায় ছিল, কোন একজন মানুষ যার অনেক দিন ঘুম হয় না, যার ঘুমের প্রতি রয়েছে তীব্র আকর্ষণ এমন কেউ ডাকলেই তো আস্তে আস্তে তিনি ফিরে পাবেন নিজের ক্ষমতা আবার ও তার গুহায় আরামে বসবাস করতে পারবেন। হ্যাঁ তিনি সাহায্য করবেন ইরাকে।

ডাক্তার প্রশান্ত সেন চ্যাম্বার থেকে বের হলেন বেশ খুশি মনেই। তারপর বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে আজকের ছোট্ট রোগীটির কথা ভাবতে লাগলেন, আদৌ কি তিনি মেয়েটার মনে হিপনোসেরকথা চুপি চুপি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন? না কি এ চেষ্টাও বৃথা গেল তার। আর কতকাল তাকে এভাবে মানসিক ডাক্তার সেজে যে থাকতে হবে ,কে জানে?
এসব ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টিতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন প্রশান্ত সেন ওরফে প্রমিথিউস।


ইরা এখন ভালভাবে ঘুমাতে পারে। হিপনোস কি তবে সত্যিই তাকে সাহায্য করল? না কি এ সব ই নতুন ডাক্তার টার ঔষুধের প্রভাব? কে জানে? তবে অনেক দিন পর ইরা আজ খুব খুশি….