জিউসের আবির্ভাব ও বিশ্বসৃষ্টির রহস্য

প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ বিশ্বসৃষ্টির রহস্যকে নানা ঢঙে বর্ণনা করতে চেয়েছে। সবারই রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প। এক্ষেত্রে বাদ যায়নি গ্রীকরাও। গ্রীকপুরাণে মহাবিশ্ব সৃষ্টির একটি চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। হেসিওড নামক একজন কবি গ্রিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘থিওগনি’ নামক কবিতায় সৃষ্টি রহস্যের একটি ব্যাখ্যা দেন। তার মতে,সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে ক্যাওস থেকে। ক্যাওস ছিল অবয়বহীন অপরিসীম শূন্যতা, মূলত এটি হল সৃষ্টি ও শূন্যতার মধ্যে দ্বিধা, এই ধারণাটি অবশ্য কিছুটা শূন্যতা থেকে সবকিছু শুরুর মতোই ছিল। ক্যাওস থেকে আকস্মিক ভাবেই সৃষ্টি হয় গায়া বা ধরিত্রী মাতা সহ ৫ টি শক্তি,তারা হল- টারটারাস বা পাতাল, এরিবাস অর্থাৎ পাতালপুরীর অন্ধকার এক কথায় মৃত্যুর আবাসস্থল, নিক্স অথবা রাত, এরোস বা ভালবাসা । গায়া নিজেই আরো তিনটি বস্তুর জন্ম দিল।

এগুলো হলঃ
• ইউরেনাস বা আকাশ।
• পাহাড়-পর্বত
• পন্টাস বা সমুদ্র

প্রাচীনকালে অবশ্য পৃথীবীকে ধারণা করা হত গোলাকার বা চাকতি হিসেবে যাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে পন্টাস। কোনো মানুষ পৃথিবীর কিনারে পৌঁছালেই সে মারা যেত।
এছাড়া যখন ভালবাসার জন্ম হল তখন সে তার আলো দিয়ে নির্মূল করল সমস্থ অন্ধকার। তখন এরিবাস আর নিক্স মিলিত হয়ে জন্ম দিল ইথার বা স্বর্গীয় আলো এবং দিন বা দিবালোক।
মজার বেপার হল পরবর্তীতে গায়া আবার বিয়ে করে ইউরেনাস বা আকাশকে। তাদের মিলনে জন্ম নেয় অনেকগুলো সন্তান। প্রথম জন্ম নেওয়া সন্তানরা ছিল ৫০ টি মাথা ও ১০০টি হাত বিশিষ্ট দানব, যাদের ডাকা হত হেকাটনকেরিস বলে।
এদের ও আবার নাম ছিলঃ
• কটাস
• ব্রায়ারিয়াস
• জাইজিস

এরপর জন্মায় ৩জন সাইক্লপস। সাইক্লপস নামকরণের কারণ ছিল এদের মাথা বরাবর একটি বড় সর্বদা বনবন করা ঘূর্ণয়মান চোখ।
এরা হলেনঃ
• ব্রন্টেস বা বজ্র
• স্টেরোপস বা বিদ্যুতের ঝলকানি
• আর্জেস বা ঝলসানো আলো।

এই তিন জনই পরবর্তীতে তৈরি করে জিউসের অস্ত্র।
এরপর জন্ম নেয় উন্নত এবং দেবতাসুলভ টাইটানরা। টাইটান ছিলেন ১২ জন, যাদের ৬জন ছেলে এবং ৬ জন মেয়ে। এরা হলেন-
• ওশিয়ানাস- সমুদ্রদেব
• টেথিস- সমুদ্রদেবের পত্নী
• হাইপেরিয়ন- সূর্য
• থিয়া-সূর্যদেবের স্ত্রী
• থেমিস- স্বর্গীয় আইন কানুনের দেবী
• নিমোসিনি- স্মৃতিদেবী
• কোয়েস-প্রশ্নোত্তর তথা বুদ্ধির দেবতা
• ফিবি- কোয়েসের স্ত্রী
• আয়াপেটাস-মৃত্যুদেবতা
• ক্রিয়াস-স্বর্গীয় নক্ষত্রপুঞ্জের দেবতা
• রিয়া- ক্রোনাসের স্ত্রী এবং ধরিত্রীর দেবী।
• ক্রোনাস- পৃথিবী ও স্বর্গের দেবতা।

ধরিত্রীকে স্ত্রীরূপে দেখানো হত, বাবা ইউরেনাস এবং মা গায়ার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ক্রোনাস ছিল সবচেয়ে তেজস্বী। ইউরেনাস কিন্তু সন্তানদের সাথে পিতৃসুলভ আচরণ করতেন না। পিতা এবং সন্তানদের মধ্যে ছিল ঘৃণার সম্পর্ক। ইউরেনাস সন্তানদের এতোটায় ঘৃণা করতেন যে তাদের জন্মের সাথে সাথেই তাদের মা গায়ার পেটে ঠুসে দিতেন। এহেন নিষ্ঠুরতায় গায়া দেবী ভীষণ বিরক্ত হয়ে ওঠেন। আবার অন্য সংস্করণে বলা হয়, ইউরেনাস তার সন্তানদের টারটারাস তথা পাতালে বন্দী করে রাখত। যাইহোক গায়া তার এবং তার সন্তানদের প্রতি হওয়া অবিচার মানতে পারছিলেন না। তাই তিনি তার সন্তানদের পিতার বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়াতে উৎসাহ দেন। কিন্তু ক্রোনাস ছাড়া কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায় না। গায়া তাই ক্রোনাসকে একটি হীরের তৈরি কাস্ত্ব দিলেন। এরপর রাতে যখন ইউরেনাস গায়ার সাথে মিলিত হল এবং অবসাদে ঘুমিয়ে পরল তখন ক্রোনাস সেই হীরের কাস্তে দিয়ে পিতার লিঙ্গ কেটে নিল। এ সময় ইউরেনাস ক্রোনাস কে অভিশাপ দিলেন যে,”আমাকে যেমন আমার আপন ঔরসজাত সন্তানের হাতে প্রাণত্যাগ করতে হল তেমনি তোমাকেও নিজের সন্তানের হাতেই জীবন দিতে হবে। কর্মফল অবশ্যই ভোগ করবে তুমি। ”
ইউরেনাসের রক্ত থেকে জন্ম নিল এরিনিজ রা যারা দেখতে বেশ বীভৎস এবং তাদের কাজ হল স্বর্গে থেকে পাপীদের বিচার করা।
এছাড়া লিঙ্গ সমুদ্রে ফেলার আগে ইউরেনাসের ৩ ফোঁটা রক্ত গিয়ে পড়ল পৃথিবীর বুকে, যা থেকে জন্ম নিল-
• চকচকে বর্ম ও বর্শাধারী দৈত্যকুল
• তিন প্রতিশোধদেবী তথা ইরিনিস। যারা মাতৃপিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে সদা তৎপর।
• সবচেয়ে নিরীহ ও নরমসরম গোছের বনদেবী বা নিম্ফ।

এদিকে ইউরেনাস এর লিঙ্গ সমুদ্রে ভেসে থাকা ফেনার সাথে মিশে তৈরি হল কামনা ও ভালবাসার দেবী আফ্রোডাইট।
ইউরেনাসের মৃত্যুর পর ক্রোনাস হয়ে উঠলেন স্বর্গ মর্ত্যের একচ্ছত্র অধিপতি। ক্রোনাস বিয়েও করলেন নিজের সুন্দরী বোন রিয়াকে। এতোকিছুর মাঝেও ক্রোনাস কিন্তু এক মুহুর্তের জন্য ও পিতার অভিশাপের কথা ভুল্লেন না। তাই যখনই ক্রোনাসের কোনো সন্তান জন্মাত তখন ই তাদের গিলে ফেলতেন তিনি। এভাবে তার ৫ সন্তানকে গিলে ফেললেন, এঁরা হলেন-
• বিয়ে ও সন্তান জন্মদানের দেবী হেরা
• পাতালের রাজা হেডিস
• সমুদ্রদেবতা পোসাইডন
• উনুনের দেবী হেস্টিয়া এবং
• শস্য ও ফসলের দেবী ডিমিটার।

রিয়া নিজের সন্তানদের প্রতি এ নিষ্ঠুরতা কোনো ভাবেই সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই তিনি যখন ষষ্ঠবারের মতো গর্ভধারণ করলেন তখন এক ফন্দি আঁটলেন। এ ষষ্ঠ সন্তানের নাম ই জিউস। জিউসের জন্ম হয় এক অন্ধকারময় মধ্যরাত্রিতে,আর্কেডিয়ার লাইসেয়াম পর্বতে। জন্মের পর জিউসকে নেডা নদীতে গোসল করানো হয়। এবং ক্রোনাস জিউসকে নিতে আসলে সন্তানের বদলে একটি পাথর কে কাপড়ে মুড়িয়ে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন রিয়া। আর নিজের সদ্য জন্মানো সন্তানকে পাঠালেন ক্রিট দ্বীপে। আর ক্রোনাস ও সন্তান ভেবে পাথর গিলে নিশ্চিন্তে থাকলেন।
ক্রিট দ্বীপে ছোট্ট জিউসকে রাখা হয়েছিল আইডা পর্বতের একটি গুহায়। জিউসের দেখভালের দায়িত্ব পরে দুই বোন অ্যাড্রাস্টেইয়া এবং আইও এর উপর। তাদের পিতা মেলিসাস ছিলেন ক্রিট দ্বীপের একজন দলপতি। আইও এবং অ্যাড্রাস্টেইয়া একটি পৌরাণিক ছাগলের দুধ এবং বন থেকে সংগ্রহীত মধু জিউসকে খাওয়াতেন। এ ছাগলের নাম ছিল এ্যামালথিয়া। এসময় এ্যামালথিয়ার একটি শাবক ও দুধ পান করত যার নাম ছিল প্যান। জিউস প্যানকে দুধভাই হিসেবে বেশ ভালবাসতেন। প্যান পরবর্তীতে পরিবেশের দেবতা বা বনের দেবতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ল্যাটিন কবি হাইগিনাস এর মতে- জিউস ঈগা নামক ধাত্রীর দুধ পান করেন।
অনেকের মতে, ঈগা ছিলেন জিউসের একজন সেবিকা। আবার অন্য অনেকে ধারণা করেন জিউসের প্রতিপালনে সাইনোসুরা নামক একধরণের পরী সাহায্য করেছিলেন। এছাড়া কিউরেটাসদের উপর ভার ছিল জিউসকে রক্ষা করার। শিশু জিউস যখন কান্না করতেন তখন কিউরেটাসরা তাদের তলোয়ারে জোরে জোরে আঘাত করতেন,যাতে কান্নার শব্দ চাপা পরে যেত।

ধীরে ধীরে ক্রিট দ্বীপে বড় হয়ে উঠতে থাকেন জিউস। একদিন ঘটনাক্রমে ক্রিট দ্বীপে এসে উপস্থিত হলেন ক্রোনাস। এসে তিনি জিউস সম্পর্কে জানতে পারলেন। অন্য অনেকের মতে,জিউসের কথা জেনেই ক্রিট দ্বীপে এসেছিলেন তিনি।
জিউস আপাতদৃষ্টিতে তাঁর পিতার সাথে দেখা করার জন্য এক উৎসবের আয়োজন করলেন। তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ক্রোনাসকে বিশেষ এক ধরণের ঔষুধ খাওয়ানো যাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন এবং তাঁর গিলে ফেলা পাঁচ সন্তানকে উগ্রে দিতে বাধ্য হন। পরিকল্পনামাফিক,জিউস মদের সাথে ঔষুধ মিশিয়ে ক্রোনাসকে খাওয়ালেন,যাতে ৫ সন্তানের সাথে সাথে শেষোক্ত পাথরটিও উগ্রে দিলেন ক্রোনাস। এইসন্তানরা সকলেই পূর্ণ যুবক -যুবতী রূপে আবির্ভূত হল। সাথে সাথেই জিউস তাদের নিয়ে অলিম্পাস পর্বতে পালিয়ে গেল। এদিকে ক্রোনাস সুস্থ হওয়ার আগেই জিউস নিজেকে দেবরাজ ঘোষণা করেন।
জিউস ও তার ভাইবোনদের বলা হত অলিম্পিয়ান। ক্রোনাস সুস্থ হয়ে উঠলে অলিম্পিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে শুরু হয়ে যায় অলিম্পিয়ান ও টাইটানদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

এসময় জিউসের সাহায্যে এগিয়ে আসেন রিয়া। তিনি ক্রোনাসকে পরাজিত করার সকল কৌশল শিখিয়ে দেন জিউসকে। এছাড়া সাইক্লোপসদের সাথে ক্রোনাসের বিশ্বাসঘাতকতার কথাও জানান তিনি। আসলে ইউরেনাসকে উৎখাতের সময় সাইক্লোপসরা ক্রোনাসকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু অকৃতজ্ঞ ক্রোনাস তাদের পুনরায় টারটারাসে নিক্ষেপ করেন। এ ভুলের ই সুযোগ নেন জিউস এবং তিন সাইক্লোপসকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেন তার দন্ড, যা থেকে ঘন ঘন মেঘ সৃষ্টি ও বিদ্যুৎ বর্ষণ করছিলেন তিনি। এরপর ক্রোনাস অলিম্পাসের সমান উচ্চতার একটি পাহাড় তৈরির নির্দেশ দেন তাঁর সৈনিকদের। সৈন্যরা নিকটবর্তী পেলিওন নামক পাহাড়ে পাথর জড়ো করে অলিম্পাসের সমান উচ্চতায় নিয়ে আসে। কিন্তু এ সময় টারটারাস থেকে মুক্ত সাইক্লোপসরা ভূমিকম্পের সৃষ্টি করল যাতে পেলিওন পর্বত ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর জিউসের বজ্রের আঘাতে ক্রোনাস এবং তাঁর সৈন্যরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হল। এ যুদ্ধে জয়লাভের পর ক্রোনাস সহ তার সকল সহযোগীকে টারটারাসে বন্দী করলেন জিউস। গ্রীকরা বিশ্বাস করে,টারটারাসে বন্দী এসব টাইটান যখন বের হয়ে আসার চেষ্টা করে তখন পৃথিবীতে ভূমিকম্প বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের আগমন ঘটে। এ যুদ্ধে এয়াপিটাস এবং তার দুই সন্তান প্রমিথিউস ও এটলাস অংশ না নেওয়ায় তাদের বন্দী করেননি জিউস। যদিও পরবর্তীতে এটলাসের কাঁধে সমস্ত বিশ্বের ভার বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সে আরেক গল্প।
জিউসকে নিয়ে আরো নানা মজার মজার তথ্য এবং গল্প আমরা জানব পরের পর্বগুলোতে।