জিউসের প্রেম ও সিগনাস ও বৃষ তারকামন্ডলীর সৃষ্টি

দীর্ঘ দশবছর যুদ্ধের পর জয় হলো অলিম্পিয়ানদের। এবার এলো রাজত্ব ভাগ করার পালা। জিউস নিলেন আকাশ, পোসাইডন সমুদ্র এবং হেডিস নিলেন পাতালপুরি। আর অলিম্পাস পর্বত হল একটি নিরপেক্ষ জায়গা,যেখানে দেবসভা অনুষ্ঠিত হয়। অলিম্পাস ছিল না ঝড় তুফান বা বৃষ্টি। এর উপর দিয়ে দিনরাত চলত অবিরাম গ্রীষ্মের লীলাখেলা। দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ আর সোনালী আলোর মেলা। অলিম্পাসের প্রাসাদের হলগুলো সব সোনালী বর্ণের,যেখানে প্রায়শই সকল দেবতাকে ভোজসভায় নিমন্ত্রিত জানানো হত। এই ভোজসভাগুলোতেই বিশ্বপরিচালনার সকল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে মনে করা হত। গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হল দেবতাদের মানবীয় বিভিন্ন দূর্বলতা। তারাও মানুষের মতোই হিংসা বিদ্বেষ অনুভব করে,ঝগড়া করে,হতাশ হয়,একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও করে। এই অলিম্পাসেই বসবাস আমাদের গল্পের মূল চরিত্র জিউসের।
জিউস নামটি ইন্দো ইউরোপীয় যার অর্থ উজ্জ্বল আকাশ। আবার প্রাচীনকালে জিউস শব্দ দ্বারা বুঝানো হতঃ “জীবন্ত”,”ফুটন্ত”,”সেচ” এবং “যার মধ্যে সবকিছু বিদ্যমান”। জিউস যখন জন্মান তখন তিনি একটানা ৭ দিন হেসেছিলেন,তাই ৭ সংখ্যাটি গ্রিক পুরাণে পবিত্র। জিউস এর পূজার সবচেয়ে প্রাচীন চিহ্নগুলো স্বভাবতই পাওয়া যায় ক্রিট দ্বীপে। এগুলোর মধ্যেঃল্যাব্রিস নামক একটি ডাবল কুঠার অন্যতম। যার ছিল সৃষ্টিশীল ও ধ্বংসাত্মক শক্তি, এ কুঠার একই সাথে জীবন দান ও নাশ করতে পারত। এছাড়া জিউসের ষাঁড়রূপ অবতারের চিত্রও পাওয়া যায় এখানে।
অলিম্পাসে জিউসের মূর্তির জীবন্ত মুখ অনেকের ই বিস্ময়ের কারণ হয়েছিল। এ মূর্তির পাদদেশের পুকুরের পানির উপর তেল ঢেলে আলো প্রতিফলিত করা হয়েছিল। দেবতার মুখ থেকে তখন উজ্জ্বলতা ও চোখ থেকে বিদ্যুৎ নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। একবার তো সম্রাট ক্যালিগুলা জিউসের বিশাল মূর্তির প্রশংসা শুনে তা রোমে স্থানান্তরের জন্য তার কর্মীদের অলিম্পিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু কর্মীরা স্থানান্তরের জন্য যেই না মূর্তিতে আঘাত করেছে অমনি অট্টহাসি দিয়ে ওঠেন জিউস। এতে সবাই ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।
মূলত অলিম্পিয়ায় ছিল জিউসের প্রধান মন্দির।

জিউস যখন তার বোন হেরাকে দেখেন তখন তার প্রেমে পরে যান। কিন্তু হেরাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন,এর কারণ ছিল মেয়েদের প্রতি জিউসের অবজ্ঞা এবং খারাপ ব্যবহার। এ ঘটনায় জিউসের মনে হেরাকে পাওয়ার জন্য জেদ চেপে যায়। একদিন জিউস একটি কোকিলের ছদ্মবেশে হেরার বাসস্থানে আসে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর এবং মুমূর্ষু এক পাখি দেখে হেরা পাখিটিকে কোলে করে কক্ষে আনেন এবং তার পরিচর্যা করতে লাগেন। এসময় কোকিলবেশী জিউস স্বরুপে ফিরে আসে এবং হেরাকে ধর্ষণ করে। এ লজ্জা ঢাকতে হেরা জিউসের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে সম্মতি জানান। হেরা ই ছিলেন জিউসের প্রথম এবং বৈধ স্ত্রী। তাদের বাসর রাত ৩০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এর আগে জিউস মেটিসের সাথে মিলিত হন মেটিস ছিল জ্ঞান এবং বুদ্ধির দেবী,মেটিসকে গ্রাস করেন জিউস, এ মিলনে অ্যাথেনার জন্ম হয়। এরপর জিউস স্বর্গীয় আইন ও ন্যায়ের ভবিষ্যৎবক্তা দেবী থেমিসকে ও বিয়ে করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। অনেকে আবার এ সম্পর্ককে বিয়ের নাম দিতে নারাজ। যাই হোক,এ মিলনে তার ঔরসজাত কন্যাদের বলা হয় ওরেস। তারা মানুষ এবং দেবতাদের জীবনের শৃঙখলা ও নিয়মানুবর্তীতা রক্ষা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। জিউস হেরার সাথে বার বার বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। বার বার বিভিন্ন দেবী এবং নশ্বর মানবের সাথে মিলনে সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রাণীর রূপধরে নারীদের প্রলুব্ধ করতেন এবং মিলিত হতেন। এমনই কিছু উপকথা আমরা আজকে জানব।
লিডা ছিলেন রাজা থেস্তিয়াসের কন্যা। তাঁর স্বামীর নাম ছিল তাইন্দারেউস যিনি আবার ছিলেন স্পার্টার রাজা। লিডা দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন। স্বভাবতই জিউসের দৃষ্টি লিডার উপর পরে এবং তিনি তাকে পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এ দিকে হেরা কখনোই জিউসের অন্য কোনো নারীর প্রতি আসক্তি সহ্য করতে পারতেন না। যেভাবেই হোক সেই নারী বা দেবী জিউসপত্নী হেরার আক্রোশের স্বীকার হতো। আর তাই জিউস অনেক চিন্তা করে ঠিক করলেন তিনি এক রাজহাঁসের রূপ নিয়ে লিডার কাছে যাবেন। একদিন একটি রাজহাঁস ঈগলের ভয়ে পালাতে গিয়ে লিডার বাহুতে এসে পরে। লিডা সেই রাজহাঁসকে আশ্রয় দিতে গেলে রাজহাঁস তথা জিউস স্বরূপে ফিরে আসেন এবং লিডাকে ধর্ষণ করেন। সেই একই রাতে লিডা তাইন্দারেউসের সাথেও মিলিত হন। ফলে লিডা দুটি ডিম প্রসব করেন। লিডার এ ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে রচিত হয়েছে সনেট, কবিতা ও চিত্রকর্ম। আর এমনই একটি সনেট হল, লিডা ও রাজহাঁস যার রচয়িতা ছিলেন উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস।

Leda and the Swan

BY WILLIAM BUTLER YEATS

A sudden blow: the great wings beating still

Above the staggering girl, her thighs caressed

By the dark webs, her nape caught in his bill,

He holds her helpless breast upon his breast.

How can those terrified vague fingers push

The feathered glory from her loosening thighs?

And how can body, laid in that white rush,

But feel the strange heart beating where it lies?

A shudder in the loins engenders there

The broken wall, the burning roof and tower

And Agamemnon dead.

Being so caught up,

So mastered by the brute blood of the air,

Did she put on his knowledge with his power

Before the indifferent beak could let her drop?

যাইহোক, দুইটি ডিম থেকে মোট চারটি সন্তানের জন্ম দেন লিডাঃ হেলেন ও ক্লাইমেনেস্ত্রা এবং ক্যাস্টর ও পোলাক্স। এই চারজনের মধ্যে কে যে কার সন্তান তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অন্য এক উৎসের মতে, জিউস হেলেনের মা নেমেসিসের সাথে মিলিত হন এবং হেলেনকে একটি ডিম রূপে প্রসব করেন। ডিমটি একটি রাখাল কুড়িয়ে পেয়ে লিডাকে দেয় এবং লিডা তা সিন্দুকে রেখে ফোটায়। হেলেনকে লিডা নিজের সন্তান হিসেবেই গ্রহণ করে। জিউস তার এই অবতারকে স্মরণীয় করে রাখতে সিগনাস(Κύκνος) নামক একটি তারকা মন্ডলী সৃষ্টি করেছেন।

জিউস একবার ওশেনিড ইউরিনোমাস এর সাথে মিলত হয়ে ৩ কন্যার জন্ম দেন এদের একত্রে বলা হয় চ্যারিস। এরা হলেন-
• আগ্লায়া ( উজ্জ্বল)
• ইউফ্রোসিন(ভাল চিন্তা)
• ফলিয়া(প্রস্ফুটিত)
এই তিন বোন নতুন জীবনের আনন্দদায়ক, অনন্ত যৌবনা সূচনার মূর্ত প্রতীক। জিউসের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিশ্বে এ তিন বোনের গুরুত্ব অপরিসীম।

জিউস সর্বদায় সুন্দরীদের প্রতি আকর্ষিত হতেন,সে সুন্দরী দেবী হোক বা নশ্বর মানবী তাতে তাঁর তেমন কিছু যায় আসত না। এমনই এক কাহিনি জিউস ও ইউরোপার।
ইউরোপা ছিলেন ফিনিসিয়ার রাজা এজিনর ও রাণী টেলেফাসা এর কন্যা। তিনভাই ক্যাডমাস, সিলিক্স, ফিনিক্স এবং বাবা মায়ের চোখের মনি ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী ইউরোপা। ফিনিসিয়াবাসীরাও ইউরোপাকে চোখে হারাত। ইউরোপার অপার্থিব সৌন্দর্যে ছেলে বুড়ো সকলেই মুগ্ধ ছিলেন। তার ব্যবহার ও ছিল খুব মিষ্টি। সবার আদর যত্ন এবং প্রশ্রয়ে ভালই দিন কাটছিল ইউরোপার। কিন্তু হঠাৎ করেই ইউরোপার খুশিতে কেউ যেন নজর লাগাল। প্রায়শই রাতে একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগল সে। সে দেখল, এশিয়া ও ফিনিসিয়ার যোদ্ধাদের পোশাক পরা দুই নারী তাকে নিয়ে যুদ্ধ করছে। তারা নিজেদের মহাদেশ দাবি করছে। একসময় এশীয়যোদ্ধা বলল,”আমি তোমার চাইতে সম্পদশালী,শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী। তোমার মতো নামহীন,শ্রীহীন কারো কোনো অধিকার নেই ইউরোপার উপির। ইউরোপা শুধুই আমার।”
অন্য যোদ্ধা এ শুনে বলল,”আমি নামহীন,শ্রীসম্পদহীন,আর তাই ইউরোপাকে আমার ই দরকার বেশি। ইউরোপা হবে আমার অলঙ্কার। দেখবে,জিউস আমাকে দান করবেন ইউরোপাকে।” যুদ্ধে দ্বিতীয় নারীর বিজয়ের মাধ্যমে স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। প্রথমদিন আমলে না নিলেও একই স্বপ্ন কয়েকবার দেখায় বেশ চিন্তিত হয়ে পরে সে। ভেবে ভেবেও এর সুরাহা করতে পারে না আবার বাড়িতে কাউকে বলতেও পারছিল না। বাড়ির লোকজন সর্বদায় তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন,নতুন করে তাদের দুশ্চিন্তা আর বাড়াতে চাইত না বুদ্ধিমতী ইউরোপা। ওদিকে ইরোসের তীরে জিউস প্রেমে পরে গেলেন ইউরোপার। জিউস তাই হেরাকে ফাঁকি দিতে একটি সাদা ষাঁড়ের রূপ ধরে মর্ত্যে এলেন। ইউরোপা রোজকার মতো সেদিন ও সঙ্গীনীদের সাথে বনের ধারে ফুল তুলতে এসেছিল। জিউস তখনই সাগর পেরিয়ে ঢুকলেন বনের মধ্যে। ষাঁড়টি ছিল বেশ আদুরে,তাই ভয় পাওয়ার বদল সবাই একে একে ষাঁড়ের পিঠে চেপে ঘুরতে লাগল। ইউরোপার পালা এলে সেও নিশ্চিন্ত মনে ষাঁড়ের পিঠে চেপে বসল। কিন্তু ইউরোপা পিঠে উঠতেই ষাঁড় সাগর তীরের দিকে এক ভোঁ দৌড় লাগাল। প্রথমে ইউরোপা ও তার সাথীরা এটাকে মজার খেলা ভাবলেও যখন ষাঁড়টি সাগরের পানি দেখে না থেমে এগিয়ে যেতে লাগল তখন সবার টনক নড়ল। ধাওয়া করতে লাগল তারা ষাঁড়কে। কিন্তু ততক্ষণে ষাঁড় তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে প্রায় মাঝসমুদ্রে চলে গেছে। এদিকে সমুদ্রে নামা দেখে ইউরোপা ও ঘাবড়ে যায়। সে একবার ভাবে উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপ ই দেবে সে। এসময় হঠাৎ ষাঁড়টি মানুষের গলায় ইউরোপাকে শান্ত হতে বলল। ষাঁড় গিয়ে থামল ক্রিট দ্বীপে। সেখানে জিউস তাঁর স্বরূপে ফিরে এলেন এবং ইউরোপার সাথে কিছুদিন কাটিয়ে অলিম্পাসে ফিরে গেলেন। জিউস ও ইউরোপার তিন ছেলে হয়,মিনোস, র‍্যাডাম্যান্থস এবং সারপেডন। জিউস তার ষাঁড়ের রূপকে স্মরণীয় করে রাখতে বৃষ তারকামন্ডলী বানিয়ে দেন। ইউরোপার তিন ছেলেকে মৃত্যুর পর পাতালের তিন বিচারক করে দেন। জিউস ইউরোপাকে চারটি বিশেষ উপহার ও দেনঃ
• হেফাস্টাস নির্মিত কন্ঠহার
• ট্যালোস নামক ব্রোঞ্জনির্মিত প্রহরী,
• ল্যেল্যাপ্স নামক কুকুর
• একটি বর্শা যা কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয় না।
ইউরোপার নামের সাথে মিল রেখে ক্রিটের নতুন নাম রাখেন ইউরোপ। আর এভাবেই ইউরোপের নামকরণ করা হয়।
জিউস সম্পর্কে আরো অনেক অজানা কাহিনী আমরা জানব পরের পর্বে।