দেখতে বসেছি একটা সিনেমা, অথচ দেখলাম দুটো! ব্যাপারটা অদ্ভুত, তাই না! এমনটা অবশ্যই সম্ভব, যদি সেটা হয় মালায়ালাম সিনেমা। তারা সিনেমা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে প্রতিনিয়তই। তারা যেন সিনেমার নিয়ম সব ভেঙেচুরে নতুন করে নিয়ম তৈরি করবে বলে ঠিক করেছে। তাদের প্রত্যেক সিনেমাতেই থাকে চমক, থাকে নতুনত্ব। তেমনই একটা নতুন চমক অর্থ্যাৎ সিনেমা নিয়েই এই লেখাটা।
আসলে যখন এই লেখাটা যখন লিখতে বসি, তখনও রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। যে সিনেমা নিয়ে বলছি, তা হলো সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘Jana Gana Mana’ (নামটা অবশ্য তাদের জাতীয় সঙ্গীত থেকে ধারা করে নেয়া)। শারিস মোহাম্মদের লেখা, ডিজো জোসে এন্থনি’র পরিচালনায় নির্মাণ হয়ে গেলো চমৎকার একটা লিগ্যাল ড্রামা জনরার সিনেমা। উইকিপিডিয়াতে যদিও লিগ্যাল ড্রামা বলা হয়েছে, আপনি যখন দেখতে বসবেন তখন দেখবেন পলিটিক্যাল-লিগ্যাল-সাসপেন্স-থ্রিলার-কোর্ট ড্রামা জনরার একটা সিনেমা। এতোগুলো জনরা কীভাবে একত্রে করা সম্ভব হলো তা সিনেমা না দেখলে বুঝতে পারবেন না।
এই সিনেমা এতো তাড়াতাড়ি দেখা হতো না। কিছুদিন আগে সিনেমাপ্রেমী এক আপু ফেসবুকে একটা সিনেমা বিষয়ক গ্রুপে পোস্ট করেছিলো যে, এই সিনেমার টিজার এবং ট্রেইলারের সাথে নাকি সিনেমার কোনো সম্পর্ক নাই। একটু অবাক হলাম বিষয়টা জেনে। তারপর প্রথমে টিজার এবং ট্রেইলার দেখলাম। সিনেমাটা আসলে কী নিয়ে তা বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম পলিটিক্যাল থ্রিলার বা কপ থ্রিলার কিছু একটা হবে হয়তো। এরপর শুরু করলাম সিনেমা দেখা। আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকতে থাকলাম গল্পের। ভালোই গল্প ফাঁদা হলো। অসম্ভব সুন্দর অভিনয়, দারুণ সিনেমাটোগ্রাফি, সাথে চমৎকার গল্প। টিজার-ট্রেইলারের সাথে গল্পের কোনো মিল আসলে আছে কী নেই, তা আর মাথায় এলো না। সব মিলিয়ে অনবদ্য গল্প দাঁড়ালো, যা যা করা উচিত বলে মনে হচ্ছে তা-ই করা হচ্ছে সিনেমায়। কেমন জানি খাপে-খাপ হয়ে যাচ্ছে! তাও ভালো। অন্তত অখাদ্য খাচ্ছি না।
অভিনয় দক্ষতা আর গল্পের কারণে আপনার চোখ সরবে না স্ক্রিন থেকে। এসিপি সজ্জন কুমারের চরিত্রে সুরাজ ভেঞ্জারামুডু এবং সেইসাথে বাকি যারা যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাদের নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নাই। দীর্ঘ এক ঘন্টা সতেরো মিনিট আপনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবেন পর্দায় আর আশা করবেন সব যেন ঠিকঠাকভাবে শেষ হয়।
এরপর শুরু হবে কোর্ট ড্রামা। উদয় হবেন পৃথ্বিরাজ সুকুমারান এডভোকেট অরবিন্দ স্বামীনাথনের চরিত্রে। কিন্তু আপনার কেমন জানি লাগবে। পছন্দের নায়ক, এসেছেন সিনেমার শেষদিকে। তা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যার পক্ষ নিচ্ছেন বা সবাই যার পক্ষে, তিনি কেনো তার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে কিন্তু আসামীদের পক্ষে। সেই আসামীরা আবার কোর্টে উপস্থিত নাই।
নাহ, আপনি যেটা ভাবছেন তা না। এরপর গল্পের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যায়, তা কিন্তু না। যেটা হয়, তা হলো- গল্প একের পর এক মোড় ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যে গিয়ে থামে, তা ভাবতে ভাবতে আপনি দুইটা দিন অনায়াসে পার করে দিতে পারবেন। ব্যাপারটা অনেকটা রুবিক্স কিউবের মতো- একপাশ মিলিয়ে নিয়ে যেই না খুশিতে লাফাবেন, তখনি অন্যপাশ মেলাতে গিয়ে আবার এলোমেলো হয়ে যাবে সব।
এভাবে চলতে চলতে সিনেমাটা যেখানে থেমেছে সেখানেই কি থামার কথা? তা বোধহয় না। কারণ, ইতিমধ্যে এটার সিক্যুয়েল নির্মাণের ঘোষণা চলে এসেছে। সিক্যুয়েলে যে কী থাকবে, সেটাই এখন আমার জন্য ভাবনার বিষয়। এ ধরনের সিনেমার সিক্যুয়েল সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। আর মালায়ালাম সিনেমা বলে আগে থেকে অনুমানও করতে পারছি না।
সিনেমার গল্পটা নিয়ে আর কিছু বলার নাই আমার। দুইটা কারণে বলার নাই। প্রথমত, বললে অনেক কিছু বলা হয়ে যাবে। তারপর দেখতে বসে আমাকে গালাগাল দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বললেও বুঝবেন না। বুঝতে হলে আগে সিনেমা দেখতে হবে, তারপর সেটা নিয়ে আড্ডায় বা আলোচনায় বসা যায় আপনার সাথে। তখন জমবে বেশ।
দক্ষিণ ভারতের বর্তমান সময়ের সিনেমাগুলোতে গল্প খুবই সাদামাটা হলেও তাদের উপস্থাপন দারুণ হচ্ছে। মানে হলো, গল্প জমজমাট না হলেও সিনেমা মোটেও খারাপ লাগছে না দেখতে। এর কারণ হয়তো তাদের সিনেমাটোগ্রাফি আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য। তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্রত্যেকটা আলাদা আর হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। সেদিক থেকে বলতে গেলে তো এটা নিখুঁত একটা স্ক্রিপ্ট বলা যায়, সেইসাথে সুন্দর উপস্থাপন এবং পরিবেশন, আর সাবলীল অভিনয় তো আছেই। আর তার সাথে যখন এইরকম অনবদ্য ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যুক্ত হয়, তখন দেখতে বসে আপনি প্রবল এক ঘোরের মধ্যেই সিনেমাটা শেষ করবেন। ঘোর লাগা কিছুতেই কাটতে চাইবে না। তার সাথে যুক্ত হবে আরো একগাদা প্রশ্ন, সত্য কী? ন্যায় কী? আর বাস্তবতা কী?
আশা করি এই সিনেমার কারো অভিনয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে না। সুতরাং, আলাদা করে আর নাম না বলি। তবে আরেকটা জিনিস নিয়ে বলতে চাই, তা হলো গান। আমি সিনেমা দেখার আগে যখন টিজারে গানটার দিকে নজর গেলো, তখন আবার সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম-
হৃদয়ের ব্যথা
তুমি হৃদয়ে থেকো
একা একা
আছো কেনো
মিলিয়ে লেখো
ইতিহাস কোনো
হে শোনো
হে শোনো…
শুনেই গায়ের লোম দাড়িয়ে গেলো। সিনেমাতে আরো দুটো বাংলা লাইন শোনা গেলো, তাও গানের-
নাহি নাহি ভয়
সত্যের হবে জয়।
যেহেতু আমি বাঙালি, সেহেতু মালায়ালাম সিনেমায় বাংলা গান শুনে ভালো লাগাটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও বেড়েছে। তবে তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এবং সিনেমাটা দেখতে এই কারণটা খুবই সামান্য। অবশ্যই সিনেমাটা আপনার দেখা উচিত। ভালো লাগবে আশা করি, আপনি যে জনরার সিনেমাপ্রেমীই হোন না কেন।
পৃথ্বিরাজ সুকুমারান, মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অসাধারণ এক অভিনেতা, বোধহয় জন্মেছেন থ্রিলার সিনেমার জন্যই। তার প্রায় সব থ্রিলার-ই আমার ভালো লেগেছে। তবে ’জন গণ মন’-এর মতো করে মনে নানান প্রশ্নের উদয় হয়েছিলো তার গতবছর মুক্তি পাওয়া ’কুরুথি’ সিনেমাটা দেখে। সেটাও একাধারে পলিটিক্যাল-একশন-রিলিজিয়াস-সাসপেন্স থ্রিলার মিশ্রিত। যদিও ধর্মের বিষয় নিয়ে কেউ বলেছে কিনা জানা নেই। তবে সবকিছু মিলিয়ে কাছাকাছি ধরনের ভিন্ন গল্পের সিনেমা। এটা নিয়েও অনেক ভাবনার উদয় হবে মনে, প্রশ্ন জাগবে নানান বিষয় নিয়ে।
এছাড়াও ২০১৯ সালে ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স’ সিনেমাটা বেশ সাড়া ফেলেছিলো। সুরাজ ভেঞ্জারামুডু ও পৃথ্বিরাজ সুকুমারানের জুটিটা মানুষ খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলো তখন।
আমি আসলে ধারণা দিতে চাচ্ছিলাম তাদের অভিনয়, তাদের চিত্রনাট্য পছন্দের বিষয়ে। যদিও বলাটা বোকামি। কারণ, যারা মালায়ালাম চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা আরো ভালো জানেন এ সম্পর্কে।
যাদের রেটিং দরকার, তাদের জানিয়ে রাখি- ‘জন গণ মন’ সিনেমা আইএমডিবি’র রেটিং অনুযায়ী ১০-এ ৮.৪, ভোট দিয়েছেন সাত হাজার জনেরও অধিক।
সবশেষে দুইটা বিষয় ক্লিয়ার করে দিই। এক হচ্ছে, এটার টিজার এবং ট্রেইলারের প্রায় অংশই সিনেমায় আছে। ট্রেইলারের পুরো অংশটা সিনেমাতে নেই। হয়তো সিক্যুয়েলের জন্য রাখা জিনিসটা। এটা নিশ্চিতভাবে জানি না। আর দুই হচ্ছে, এটার দৈর্ঘ্য দুই ঘন্টা একচল্লিশ মিনিট। অর্থ্যাৎ প্রায় তিন ঘন্টা। যদিও বিরক্ত হবেন না, তবুও জানিয়ে রাখলাম।
যেই সিনেমা আমার চিন্তার জগতকে নাড়া দেয়, আমাকে আবার নতুন করে ভাবতে শেখায়, সেটাই আমার কাছে সিনেমা। এই কাজগুলো সব জনরাতেই সম্ভব, যদি সেভাবে বানাতে পারে। আর ঠিক এই কারণে আমার এই সিনেমাটা এতো ভালো লেগেছে।
আপনিও বসে পড়ুন দেখতে। আর হ্যাঁ, যাতে বুঝতে সমস্যা না হয় তার জন্য সাবটাইটেল নিয়ে বসবেন।