সে ১৯১৩ সালের কথা। ক্লান্ত নজরুল কুন্ডলী পাঁকিয়ে শুয়ে আছে সিঁড়ির নিচে। রুটির দোকানে আটা-ময়দা মাখতে মাখতে সে হয়রান। আসানসোলে মোহাম্মদ আহাদ বখশের বেকারী ও রুটির দোকানে তার মাসিক মাইনে মাত্র ১ টাকা। মাইনে দিবে আর খেতে দিবে কিন্তু থাকার যায়গা নেই। এমন শর্তে চাকুরি নিয়েছে ছোট্ট নজরুল। জীবন তখন তাকে চরম শিক্ষা দিচ্ছে। অভাব আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে একের পর এক চাকুরি বদল করছেন। বেঁচে থাকতে হবে, ভারতবাসীকে উপহার দিতে হবে বিদ্রোহের জয়গান। এজন্যই হয়ত অদম্য নজরুল হার মানে নি।
তিনতলা ভবনের সিঁড়ির নিচে প্রায়ই শুয়ে থাকে একটি বালক। শুয়ে নিথর হয়ে ঘুমায়। ব্যাপারটি লক্ষ্য করলেন ভবনের দোতলায় বাস করা দারোগা কাজী রফিজ উল্লাহ। দারোগা সহেব একদিন বালকের সাথে কথা বললেন। গান আর লেখাপড়ায় আগ্রহী ছোট্ট বালক নজরুলের কথায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন দারোগা রফিজ। রুটির দোকান থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে এনে নিজ গৃহে কাজ দিলেন। ১৯১৩ সালের শেষ কয়েক মাস নজরুল দারোগার বাসায় কাজ করেন।
লেখাপড়ার প্রতি অদম্য অগ্রহ্য ছিল নজরুলের। দারোগা সাহেবকে বারবার নিজের পড়ালেখার বিষয়টি বলে সে। নজরুলের পীড়াপীড়ীতে দারোগা কাজী রফিজ উল্লাহ তাকে নতুন করে স্কুলে ভর্তি করাতে সম্মত হলেন। তবে কোলকাতায় নয়। নজরুলকে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত হলো দারোগা সাহেবের নিজ এলাকা ত্রিশালের কাজীর শিমলা গ্রামে। ১৯১৪ সালের জুন মাসে ভাগ্য নজরুলকে অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিয়ে আসলো পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে।
নজরুল যে বাড়িতে থাকতো !!!
সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজ উল্লার সরকারী চাকুরি। সরকারী চাকুরি মানেই ঘন ঘন বদলি। আজ বাংলায় তো কাল বিহারে, পরশু আসামে। স্ত্রী শামসুন্নেসা খানমকে নিয়ে তিনি সবসময় দৌড়-ঝাপের মধ্যে থাকেন। এর মাঝে নজরুলকে আসানসোলের কোন স্কুলে ভর্তি করে দিলে নজরুলের লেখাপড়া আবার বন্ধ হওয়ার আশংকা থেকে যায়। এজন্য দারোগা সাহেব চিঠি লিখলেন তাঁর ভাই কাজী সাখাওয়াত উল্লাহকে। নজরুলের থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ার সকল বন্দোবস্ত হয়ে গেল। ট্রেন ভাড়া দিয়ে নজরুলকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ত্রিশালের কাজীর শিমলা গ্রামে। ১৯১৪ সালের ১৪ জুন কাজীর শিমলা গ্রামে পা রাখলেন দুখু মিয়া। কাজী রফিজউল্লাহর গৃহে তিনি ৩ মাস বাস করেন। ছায়া-সুনিবিড়,শান্ত-সুশীতল গ্রাম কাজীর শিমলা। যে গ্রামে যেন এখনো নজরুলের পদচিহ্ন লেগে আছে।
দারোগা সাহেবের বংশধরেরা এখানো সেখানে বাস করেন। তবে বেঁচে নেই নজরুলের আশ্রয়দাতা কাজী রফিজ উল্লাহ সাহেবের কোন ছেলেমেয়ে। রফিজ উল্লাহ সাহেব মারা যান আসামে। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে। তাঁর নাতি-নাতনিদের অনেকে ময়মনসিংহ শহরে আর বেশ কয়েকজন ঢাকাতে বসবাস করেন। বাড়িটির পূর্ব পাশে রয়েছে একটি পুকুর। দুরন্ত নজরুল এই পুকুরে অসংখ্যবার সাঁতরেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পুকুরের একপাশে নজরুল যে ঘরটিতে থাকতেন তা আর এখন নেই। কাজীর শিমলাতে নজরুলের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল স্মৃতি সংরক্ষণ প্রকল্প। নজরুলের নানান বয়েসের ছবি এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সংরক্ষণাগারে গেলে দেখা যাবে কবির ব্যবহার করা একটি খাট।
নজরুল যে স্কুলে লেখাপড়া করতো
জুন মাসেই কাজী নজরুলকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো দাড়িরামপুর ইংলিশ হাই স্কুলে। সপ্তম শ্রেণীতে। ফ্রি- স্টুডেন্টশিপে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল সে। নজরুল মেধাবী ছিল কিন্তু ক্লাশে অন্যমনস্ক থাকত। তাকে কোন প্রশ্ন করা হলে সে হকচকিয়ে যেত। পুনরায় তাকে প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা হলে তবেই সে উত্তর দিতে পারত। স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “দুই বিঘা জমি” ও “পুরাতন ভৃত্য” কবিতা আবৃত্তি করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল নজরুল। সপ্তম শ্রেণী থেকে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেই অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিল নজরুল। তবে অষ্টম শ্রেনীতে দরিরামপুরে আর পড়া হয় নি নজরুলের।
বার্ষিক পরীক্ষায় বাংলা খাতায় রচনার বদলে একটি কবিতা লিখেছিলেন নজরুল ইসলাম। এজন্য স্কুলের এক শিক্ষক বেত দিয়ে খুব পিটিয়েছিলেন নজরুলকে। পরীক্ষার ঐ খাতাসহ নজরুল ইসলাম স্কুলের হেডমাস্টারের রুমে গিয়ে অভিযোগের সুরে বললেন-
”স্যার, আমি তো রচনাটাই লিখেছি, তবে কবিতায় এই যা। এর মধ্যে দোষের কি হলো?”
হেডমাস্টার এই অভিযোগের কোন সৎ সমাধান দিতে পারেন নি। হেডমাস্টারের কক্ষ থেকে অভিযোগ দিয়ে নজরুল বের হওয়ার পর ঐ শিক্ষক আরেক দফা পিটুনি দেন নজরুলকে। সেই রাতেই ত্রিশাল ছাড়ে নজরুল। শিক্ষকের বেত্রাঘাতের দাগ তখনো তাঁর পিঠে।
কাজী নজরুলের স্মৃতি বিজরিত সেই স্কুল এখন সরকারী নজরুল একাডেমিতে পরিণত হয়েছে। স্কুলের একপাশে নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল বেদী। স্কুলের যে যে কক্ষে নজরুল লেখাপড়া করতেন সেখানেই নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতি ফলক। নজরুলের ভালোবাসায় সিক্ত এই স্কুল। প্রতি বছল নজরুলের জন্মদিনে ঘটা করে আয়োজন করা হয় নজরুল জয়ন্তী।