দরিরামপুরঃ যে মাটি ভালোবাসায় ভেজা – ২

নজরুল যে বাড়িতে লজিং বা জায়গীর থাকতো।

দারোগা বাড়ি থেকে দরিরামপুর হাই স্কুলের দূরত্ব ছিল প্রায় ৫ মাইল। জল কাঁদায় ৫ মাইল হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে যেত নজরুল। নজরুলের এই দুর্ভোগ লাঘবের জন্য নতুন করে জায়গীরদার জোগার হয়। স্কুল থেকে মাইলে খানেক দূরে নামা পাড়া গ্রাম। নামা পাড়ার সুহৃদ বিচুতিয়া ব্যাপারি নজরুলকে নিজ বাড়িতে রেখে লেখাপড়া ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। নজরুল ছিলেন গানের পাগল। কাজী বাড়ির রক্ষণশীল পরিবেশে নজরুল নাকি হাপিয়ে উঠেছিল। ব্যাপারি বাড়ি এসে সে আবার প্রাণ ফিরে পায়। ব্যাপারি বাড়ি থেকে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া, গান করা আর বাঁশি বাজানোতে আর কোন বাধাঁ রইল না। নামা পাড়া গ্রামটি  বিল পরিবেষ্টিত । বিলের অপরুপ প্রকৃতিক রুপ তাকে বিমোহিত করে তুলতো। 

সেই বাড়িতেও নজরুল স্মুতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। গড়ে উঠেছে সুরম্য ভবন। আর সেখানেও রাখা হয়েছে নজরুলের বিভন্ন সময়ের ছবি। নজরুল পাঠাগার, মিলনায়তন ও বই বিক্রয় কেন্দ্র। বিচুতিয়া ব্যাপারির বংশধরেরা বাস করছেন নজরুল জাদুঘরের পাশেই।  নজরুল এখানে যে ঘরটিতে থাকতেন তার আদলে নির্মাণ করা হয়েছে একটি ঘর। এর আঙিনায়ও বিশাল পুকুর। লাজুক আর নরম স্বভাবের নজরুল ব্যাপারি বাড়িতে হাঁসি, খুশি আর প্রাণ-চাঞ্চল্যে দিন কাটিয়েছেন, সেটা অনুমান করা যায়।

সেই শুকনি বিলই এখন বিশ্ববিদ্যালয়।

দরিরামপুর হাই স্কুলের পশ্চিমে সুতিয়া নদী। সুতিয়া নদী পার হয়েই শুকনি বিল। শুকনি বিলের প্রায় মাঝামাঝি ছিল একটি বট গাছ। এই বটগাছের তলাই জমে উঠত কবির গানের আসর। বটের ছায়ায় বসে নজরুল বিশ্রাম নিতেন। বাঁশি বাজাতেন। গান করতেন। বিলে কাজ করা কৃষক-শ্রমিকের মধ্যমণিতে  পরিনত হয়েছিলেন তিঁনি। তাঁর গান আর বাঁশি শুনতে প্রায়ই জড়ো হতেন কৃষক-মুটে-মজুররা। সেই বটগাছটি ঘিরেও নানা জনশ্রতি রয়েছে। ঠিক একই যায়গায় এখনো রয়েছে  একটি বটগাছ। অনেকে বলেন, এটিই সেই বটগাছ  যেখানে নজরুল বিশ্রাম করতেন, গান করতেন, বাঁশি বাজাতেন। আবার অনেকে বলেন, এখন যে গাছটি রয়েছে সেটি মূলত বটগাছ নয় । এটি একটি অশ্বত্থ গাছ।  সেই গাছ নিয়ে যত বিতর্ক থাক ,স্থান নিয়ে বিতর্ক নেই। সেই বটগাছের পাশেই গড়ে উঠেছে নজরুলের নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয়।

নজরুল স্মৃতি বিজরিত সেই বটগাছের পাশেই  প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৫ সালের ১লা মার্চ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করে। দিন দিন এর অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে।


অগ্নিগীরি ও ত্রিশাল 

ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়

যাইতে যাইতে খ্যাচ খ্যাচায়।

কাওয়ারা সব লইল পাছ,

প্যাঁচা গিয়া উঠল গাছ।

প্যাঁচার ভাইশতা কোলা ব্যাং।

কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং।

প্যাঁচা কয়, বাপ বারিত যাও

পাছ লইছে সব হাপের ছাও।

ইঁদুর জবাই কইর‌্যা খায়

বোছা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়।

 

নজরুল ত্রিশালকে কখনোই ভুলতে পারেন নি। তাঁর ত্রিশাল জীবনের আলখ্যে তিনি রচনা করেন ছোট গল্প “অগ্নিগীরি”।  শান্ত ও লাজুক স্বভাবের নজরুল ত্রিশালে কেমন ছিলেন? দরিরামপুর স্কলে সে লেখাপড়া করলেও তার গল্পটি নির্মান করেছেন বীররামপুর গ্রামকে কেন্দ্র করে। এই গল্পে তিনি নিজের যে চরিত্র দাড় করিয়েছেন তা অবশ্য চমকে উঠার মত। কষ্ট পাওয়ার মত। নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম তার লেখা নজরুল জীবনিতে তার কিছুটা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্ধে ,ত্রিশাল নজরুলের  জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়া যায়গার নাম। সেই আসাসোল, সেই দারোগা কাজী রফিজ উল্লাহর হাত ধরে ত্রিশাল আগমন আর এখানে থেকে তার লেখাপড়ার সুযোগ তাকে পরবর্তী জীবনে অনেক কিছু ‍দিয়েছে। 

যে মাটি ভালোবাসায় ভেজা।

১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে  কবি কাজী নজরুলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহের কৃষক-শ্রমিক সম্মেলনে করা হয়েছিল তাকে অতিথি। নজরুলের খুব ইচ্ছা ছিল তিনি আবার ময়মনসিংহ আসবেন। অবার পা রাখবেন সেই কাজীর শিমলা, নামা পাড়া, দরিরামপুর। স্মৃতি হাতড়ে  খুঁড়ে বেরবেন সেই পুরনো দিনের কথা। কিন্তু শারিরীক অসুস্থতা তাতে বাঁধ সাথে । সশরীরে তিনি আর ময়মনসিংহ আসতে পারেন নি। তবে সেই সম্মেলনকে উদ্দেশ্য করে কষ্ঞ নগর বসে ময়মনসিংহবাসির উদ্দেশ্য একটি  প্রত্র রচনা করেন।

নজরুল ময়মনসিংহের প্রতি সবসময়ই নিজেকে ঋণী মনে করতেন। এখানে তাঁর বেশ কিছু ‍দিন কেটেছে, এখানে থেকে তিনি লেখাপড়া করেছেন সেই স্মৃতি তিনি কখনো ভুলেন নি। তবে ময়মনসিংহে আবার  আসার ইচ্ছা তাঁর ছিল। যদিও সেই ইচ্ছা আর তাঁর পূরণ হয় নি। তবে ময়মনসিংহের মাটি ও মানুষের ভালোবাসা তার গায়ে আমৃত্যু লেগে ছিল ।