একজন ধর্মগুরুর কথায় প্রভাবিত হয়ে ১৯৭০ এর দশকে একসাথে প্রায় ৯০০ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। এটা পৃথিবীর কোনো কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রান্তের ঘটনা নয়। এ ঘটনা ঘটেছে সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত আমেরিকায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরা দুই একজনের বক্তব্য ছাড়া এ ঘটনার আসল কারণ আমরা কেউই জানি না৷ শিক্ষিত এক গুচ্ছ লোক কারো কথায় সায়ানাইড খেয়ে নিতে পারে তা আসলেও ভাববার বিষয়।
আজ থেকে প্রায় চারদশক আগে ১৯৭৮ সালে এমনই এক ঘটনা ঘটান জিম জোন্স। জিম জোন্সের জন্ম আমেরিকার ইন্ডিয়ানার এক দরিদ্র পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত জোন্স ছিলেন অদ্ভুত স্বভাবের অধিকারী। ছোটবেলায় তিনি যখন বন্ধুদের সাথে খেলতেন তখন তাদের উদ্দেশ্যে কথা বলতে ভালবাসতেন। পশুপাখিদের উপর অদ্ভুত সব পরীক্ষা চালাতেন, তারপর তাদের হত্যা করে শেষকৃত্যের আয়োজন ও করতেন। একবার তো তার বন্ধুদের এক ঘরে বন্দী করে নিজের বক্তব্য শুনিয়েছিলেন এই ব্যক্তি। শোনা যায় জিমের আদর্শ না কি ছিলেন এডলাফ হিটলার। বড় হতে হতে তিনি ধর্মের দিকে মন দেন। একইসাথে বর্ণবাদের প্রতি তার ছিল কঠোর ঘৃণা। একসময় তিনি খ্রিস্টানধর্মের সাথে কম্যুনিজম এবং স্যোশালিজমের সংমিশ্রণে এক নতুন ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ১৯৫৫ সালের দিকে তিনি ইন্ডিয়ানায় পিপলস টেম্পল প্রতিষ্ঠা করেন। তার নতুন ধরণের মতবাদ, বর্ণবাদের প্রতি ঘৃণা, সমাজে সমতা বিধানের চেষ্টা তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে খুব দ্রুত সময়েই নিজের অনুসারী কিছু লোক জুটিয়ে ফেলেন তিনি। এই অনুসারীরা বেশিরভাগই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দক্ষ এবং পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। তারা সামাজিক বৈষম্যবিরোধী একদল মানুষ ছিলেন যারা মানুষের সেবা করতে চেয়েছিলেন। তারা দেখে জিমের মাধ্যমে এ কাজটি সহজেই করা সম্ভব। ফলে তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
তার বয়স যখন ৩৫ এর মতো তখন ১৯৬৫ সালে তিনি তার অনুসারীদের ইন্ডিয়ানা থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে বসবাসের নির্দেশ দেন। আসলে ১৯৬০ সালের দিকে এক আর্টিকেলে পৃথিবীর এমন নয়টি জায়গার তালিকা প্রকাশিত হয় যে জায়গাগুলো নিউক্লিয়ার বোমার আঘাতেও থাকবে সুরক্ষিত। এই তালিকায় ক্যালিফোর্নিয়ার নাম ও ছিল। জোন্স এমনকি ১৫ জুলাই ১৯৬৭ সালে একটি নিউক্লিয়ার হামলা হওয়ার ভবিষ্যৎ বাণীও করেন। অবশ্য তিনি প্রায় সারাজীবনই আমেরিকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। নিউক্লিয়ার হামলায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়া ও তার এই শঙ্কাগুলোর একটি। তার এই ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায় ৭০ জন অনুসারী ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করে।
জিম জোন্সের জীবনের দিকে ভাল করে তাকালে দেখা যায়, জোন্স ফাদার ডিভাইন নামের এক ধর্মগুরুর অনুসারী ছিলেন। ১৮৮০র দশকে জন্মানো এই ধর্মগুরু ও কিন্তু বর্ণবাদ বিরোধী মতবাদের অনুসারী ছিলেন। তার অনুসারীরা তাকে এমনকি গড হিসেবেও দেখত। পিপলস টেম্পলেও কিন্তু আমরা সমতা, বর্ণবাদ বিরোধীতা বিভিন্ন বর্ণের মানুষদের আগমণ দেখতে পাই। ফাদার ডিভাইনের মৃত্যুর পর জোন্স নিজেকে ডিভাইনের পূনঃর্জন্ম হিসেবেও দাবী করেন। তবে ডিভাইনের স্ত্রী জোন্সকে এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়েই বের করে দেয়। জোন্স কিন্তু এতোকিছুর পরেও নিজেকে নবী বা মসীহা হিসবেই ভাবতে থাকেন। তিনি দাবী করেন তিনি না কি ক্যান্সার সারিয়ে তুলতে পারেন। আদৌ কেউ রোগমুক্ত হয়েছিল কিনা তা কিন্তু আজ ও জানা যায় নি। তবে তিনি ধীরে ধীরে খ্রিস্ট ধর্ম থেকে দূরে যেতে থাকেন।
জিম জোন্স তার অনুসারীদের নীপিড়িত নিগ্রহিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলেন। মূলত সমাজের বঞ্চিত গোষ্ঠীকে মুল ধারায় আনার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়নই ছিল তার লক্ষ্য। নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পক্ষে সবসময় সোচ্চার থাকায় ১৯৭০ এর দিকে জিম জোন্স ও তার পিপল’স টেম্পল অ্যাঞ্জেলা ডেভিস এবং হার্ভি মিল্ক এর মতো বামপন্থী নেতা এবং ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো বিপ্লবী কৃষ্ণাঙ্গ গেরিলা সংগঠনের সুদৃষ্টি লাভ করতে সক্ষম হয়। বিপুল সংখ্যক আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক পিপল’স টেম্পলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে বিপুল সংখ্যক আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক পিপল’স টেম্পলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
তবে জিম জোন্স কিন্তু কখনোই আমেরিকায় তার নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। এজন্যই তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে আমেরিকা ত্যাগ করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। খুঁজতে থাকেন নিরাপদ ভূখন্ড। অবশেষে গায়ানার এক গহীন জঙ্গলের পরিত্যক্ত বিশাল একটি এলাকা পছন্দ হয় জোন্সের। ১৯৭৭ সালে তিনি ও তার অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দল বেঁধে রওনা হন গায়ানার উদ্দেশে। সেখানে তারা পিপল’স টেম্পলের নতুন চার্চ স্থপন করেন। জিম জোন্সের প্রতিষ্ঠিত এই নতুন শহরটির নামই হল জোন্সটাউন।
শুরু থেকেই কিন্তু সেখানে বিপদের চিহ্ন গুলো দেখা যাচ্ছিল। এই চার্চের নিয়ম গুলো ছিল অত্যন্ত কঠিন। অনুসারীদের সবাইকেই বাধ্যতামূলকভাবে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করতে হত। শুধু তাই নয় তাদের সারাজীবনের সঞ্চিত ধনসম্পদ দিয়ে নির্মিত হচ্ছিল এই ইউফোরিক নগরী। পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ছিল এই চার্চের আরেকটি অমানবিক নিয়ম। এমনকি জিম তার অনুসারীদের সন্তানদের ও গায়ানাতেই বন্দী করে রাখতে চেয়েছিল। তার কোনো ভক্ত যেন পিপস টেম্পল থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে এজন্য জিম তাদের দিয়ে দিয়ে স্ট্যাম্প পেপারে সই করিয়ে নিত৷ এই স্ট্যাম্পে লেখা থাকত অনুসারীরা নিজেরা তাদের সন্তানদের ধর্ষণ করেছে।
জোন্সটাউনের বাসিন্দারা যখন নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নতুন শহর নির্মাণের কাজ করত তখন তাদের শোনানো হত জিমের বিভিন্ন বাণী। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাদের বাধ্যতামূলকভাবে শুনতে হত জিমের ভাষণ। জিম নিজের একটা আর্মিও তৈরি করে ফেলেছিল সে সময়। নাম দিয়েছিল রেড ব্রিগেড। গায়ানার সরকার চাইলে শুরুতেই জিমের এই নতুন নগর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধুলিসাৎ করতে পারত। কিন্তু তারা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এমন কিছুই করেনি।
জোন্সটাউনের অধিবাসীরা শুরুর দিকে তাদের বাবা মা, আত্মীয় পরিজনদের নিয়মিত চিঠি লিখত। কিন্তু আস্তে আস্তে চিঠির পরিমাণ কমতে থাকে। একই সাথে চিঠির ভাষায় ও আসে পরিবর্তন। এসব দেখে আত্মীয় স্বজনরা সরকারের কাছে ধর্ণা দেয়। তারা জোন্সটাউনে আসলে কি ঘটছে তা খতিয়ে দেখতে অনুরোধ জানায়। এরই মধ্যে ইউএস এর এক দম্পতি তাদের সন্তানের কাস্টেডির কেস জিতে যায়। ফলে জিম বেশ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরে। জোন্সটাউনে নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্প বসানো হয়, রাতের বেলা নিয়ম করে চলে পাহারা। এরই মাঝে জোন্স বাসিন্দাদের নিয়ে গণ আত্মহত্যার প্র্যাক্টিস করতে থাকে। এমন রাত গুলোকে সেসময় হোয়াইট নাইট বলে ডাকা হত।
অবস্থা বেগতিক দেখে সবার পরিবারের তরফ থেকে ক্যালফোর্নিয়ার কংগ্রেসম্যান লিও রায়ান কিছু সাংবাদিক ও কর্মকর্তাদের নিয়ে জোন্সটাউন পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন।
১৪ নভেম্বর, ১৯৭৮ সালে কংগ্রেসম্যান রায়ান ও তার দল গায়ানার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অবশেষে ১৭ নভেম্বর তারা জোন্সটাউনে এসে পৌঁছান। জিম তার অনুসারীদের নিয়ে এক সভার আয়োজন করেন। তবে ১৮ নভেম্বর জিমের এক ভক্ত কংগ্রেসম্যান রায়ানকে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা করলে রায়ান এই সফর শেষ করে আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এসময় জোন্সটাউনের কিছু বাসিন্দাও রায়ানের সাথে ঘরে ফিরে যেতে চান। অন্যরা অবশ্য জোন্সটাউনেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কংগ্রেসম্যান রায়ান সবাইকে নিয়ে একসাথে দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তারা তাই অন্য একটি প্লেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দুইটি প্লেনে করে স্বদেশে ফেরার জন্য তারা যখন এয়ারপোর্টে বসে ছিলেন তখন সেখানে একটি পুরোনো আমলের ট্রাক এসে হাজির হয়। সেই ট্রাক থেকে বেরিয়ে আসে একদল সশস্ত্র মানুষ। তারা রায়ানসহ তার পুরো দলের প্রতি গুলি বর্ষণ করে। কংগ্রেসম্যান রায়ানের মৃত্যু নিশ্চিত করতে বার বার তার মৃত শরীরের দিকেও গুলি বর্ষণ করে দলটি। মৃত্যুর আগে রায়ানের সাথে থাকা ফটোগ্রাফাররা কিছু ছবি তোলেন ও ভিডিও করেন। বেঁচে যাওয়া মানুষেরা আশেপাশের জঙ্গলে পালিয়ে যায়।
এদিকে জোন্সটাউনে জিম জোন্স সবাইকে হোয়াইট নাইট এক্সিকিউট করতে বলে। কেউ কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত করলে জিম তাদের জানায় কংগ্রেসম্যান রায়ান খুন হয়েছে। ফলে তাদের আর বাঁচার কোনো উপায় নেই। তাই আত্মহত্যায় একমাত্র পথ। সবার হাতে তুলে দেওয়া হয় সায়ানাইড মেশানো জুস। শেষে অনেককে সায়ানাইড ভর্তি সিরিঞ্জ ও ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে জোন্স টাউনে থাকা ৩০০এর মতো বাচ্চাকে এই জুস খাওয়ানো হয়। এই বাচ্চাদের কান্না রেকর্ড হয়েছিল সেখানে থাকা বিভিন্ন টেপ রেকর্ডারে। কত ভয়ানক সে শব্দ!
পরের দিন গায়ানার আর্মি সেখানে পৌঁছে। তারা জোন্সের আর্মির তরফ থেকে আক্রমণের আশা করেছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা অবাক হয়ে যায়। জোন্সটাউন জুড়ে ছিল দারুণ নিরবতা। আস্তে আস্তে আর্মি শহরে প্রবেশ করে। তারা দেখে পুরো শহর জুড়ে পরে আছে লাশ। সেদিন কিছু লোক জঙ্গলে পালিয়ে বেঁচেছিল। জিম কিন্তু মৃত্যুর জন্য অন্য এক পথ বেছেছিল। সে বন্দুকের গুলিতে নিজের জীবন শেষ করে।