প্রাক ইসলামি আরব এবং ইসলামের অভ্যুদয়

ইসলামের আগমনের পূর্বে, ষষ্ঠ শতকের কোনো এক সময়।

বৃষ্টি শূন্য মরুর বুকে দাঁড়িয়ে আছে একটি চারকোণা ঘর। নাম কাবা। চারপাশে দূরে কিছু পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে স্বগর্বে। ভেতরে রাখা আছে আরব পেনিনসুলার সকল দেবদেবীর মূর্তি। সংখ্যায় তা প্রায় ৩৬০টি। প্রতিবছর আরবের প্রতিটি প্রান্ত থেকে মানুষজন জমা হয় এখানে। পূজা করে তাদের দেবদেবীদের। চুমু খায় মূর্তিতে। মেলাও বসে এসময়। ধূসর মরু রঙিন হয়ে ওঠে। একসময় মেলা ভেঙে যায় সবাই ফিরে যায় যে যার ঘরে। শুরু হয় যুদ্ধ, মারামারি হানাহানি। যেখানে নারীরা শুধুই খেলনা। আইন বলতে কোনো কিছুর দেখা মেলে না সে সমাজে। আইনহীনতায় যেন সবচেয়ে বড় আইন। রক্তপাত হানাহানি আর অন্ধকার এই এলাকায় আলোর প্রতীক হয়ে জন্ম নেয় ইসলাম। কেমন ছিল প্রাক ইসলামি আরব? ইসলামের আগমন কতটা বদলেছে তাকে?
ইসলামের আগমনের আগের সময়টাকে বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ। এসময়ের আরবরা জুয়া খেলত, মদ পান করত, জন্মের সাথে সাথেই মেয়ে শিশুকে মেরে ফেলত, যুদ্ধে লিপ্ত হইত নিজেদের আনন্দের জন্য। নিতান্তই বর্বর এবং পথভ্রষ্ট্র একটি জাতি ছিল তারা। আরবরা শতাব্দীর পর শতাব্দী, প্রজন্মের পর প্রজন্ম কোনো প্রকার সরকার ছাড়াই অতিবাহিত করেছে। তাদের দলনেতা ছিল গোত্র প্রধানরা। এসময় আরব সম্প্রদায় মূলত তিনটি শাখায় বিভক্ত ছিল-
১. আরবে বায়িদাহ: এরা হলো মূলত সে সমস্ত জাতি যারা এ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যেমন: আ’দ, সামূদ,হাযূর ইত্যাদি।
২. আরবে আরিবা: এদেরকে ক্বাহত্বানী আরব বলা হয়। তারা ইয়াশজুব বিন ইয়া‘রুব বিন ক্বাহত্বানের বংশোদ্ভূত। এই আরবদের প্রকৃত আবাসস্থল ছিল ইয়ামেনে। এই গোত্রের ছিল বহু শাখা। এর মধ্যে পরবর্তীকালে হিমইয়ার বিন সাবা ও কাহলান বিন সাবা নামক দুটি গোত্রই সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। বনী সাবা’র আরো এগারটি বা চৌদ্দটি গোত্র ছিল যাদেরকে সাবিউন বলা হতো।
৩. আরবে মুস্তা’রিবা : এরা হচ্ছেন ঐ আরব সম্প্রদায় যারা ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধারা থেকে আগত। এদেরকে আদনানী আরব বলা হয়।
এই গোত্রগুলোকে কেউ একীভূত করতে পারেনি। আরবরা তখন নিজের পরিবারকে খুব ভালবাসত। একমাত্র গোত্রপ্রধানদের কথা মেনে চলত। আর গোত্রপ্রধানরাও তাদের রক্ষার জন্য যেকোনো ধরনের কাজ করতে পারত। এসময় কোনো আইন ছিল না। রক্তের বদলে রক্ত, খুনের বদলে খুন এটায় ছিল সেখানকার নীতি। কোনো অপরাধের জন্য ক্ষমা মিলবে না কি শাস্তি তা নির্ধারিত হত মানুষটি কতটা শক্তিশালী, কত সহযোগী আছে তার এসবের উপর ভিত্তি করে। আর যেহুতু না ছিল কোনো আইন, আর না ছিল পুলিশ বা আর্মি তাই তখনকার মানুষ আরো বেশি গোত্র নির্ভর ছিল। গোত্রে গোত্রে চলত বিরতিহীন যুদ্ধ। যুদ্ধ তাদের জন্য ছিল একধরনের বিপজ্জনক খেলা, বিনোদনের উৎস। তাই কোনো কারণ থাক বা না থাক, লাভ হোক বা না হোক তারা নিরন্তর যুদ্ধ করত। যুদ্ধ তাদের জন্য গৌরবের কাজ, তাদের দক্ষতা দেখানোর মাধ্যম। অহংকার, প্রতিশোধপরায়নতা ও নিষ্ঠুরতা ছিল এ সমাজের প্রধান চালিকা শক্তি।

এসময় আরবদের মধ্যে ইহুদিরা ছিল সবচেয়ে উন্নত জাতি। তারা ছিল সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে ভাল ব্যবসায়ী, সবচেয়ে ভাল কৃষক। তারাই আরবের সবচেয়ে উর্বর ভূমি হিজাজের অধিকাংশ জমির মালিক ছিল। তৎকালীন আরবের সবচেয়ে উন্নত অংশ মক্কা ও মদিনাও ছিল এই হিজাজেরই অংশ। মক্কার বেশিরভাগ মানুষ এসময় ব্যবসা করত। বাণিজ্য কাফেলাগুলো ছুটে যেত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তারা শীতকালে যেত ইয়েমেনে আর গরমকালে সিরিয়ায়। এসময়টায় পশুর মতো মানুষ বিক্রি হত বাজারে। নারী পুরুষ বা শিশু সে বৃদ্ধ হোক বা যুবক সবাইকেই নিলামে তোলা হত। দাসদের প্রতি করা হত অমানবিক অত্যাচার। যার যত টাকা সে তত প্রভাবশালী। তাদের টাকার মূল উৎস ছিল সুদের ব্যবসা। তারা ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিত। এই সিস্টেম টা এমন ছিল যে তা ধনীদের আরো ধনী আর গরীবদের আরো গরীব বানাতো।
আরবে চলত পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা। এখানে মেয়েদের ব্যবহার করা হত সেক্স টয়ের মতো।তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না। একজন পুরুষ যতজন ইচ্ছা মহিলাকে বিয়ে করতে পারত। আর পিতার মৃত্যুর পর পুত্র নিজের মা ছাড়া পিতার অন্য সব স্ত্রীর স্বামী বনে যেত। মেয়েদের মনে করা হত বোঝা। যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর যদি শত্রু গোত্রের কেউ মেয়েদের অধিকার পেয়ে যায় এই ভয়ে জন্মের পর পরই কন্যা সন্তানকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হত। এমনকি সমাজের চাপে অনেকসময় নিজের কন্যাকে পুঁতে ফেলত অনেক পিতা। মেয়েরা পতিতাবৃত্তি করে নিজের জীবন চালাত। পতিতাবৃত্তির জন্য তারা নিজেদের বাড়িতে ঝুলাত পতাকা। এসব মেয়েদের ডাকা হত লেডিস অফ ফ্লাগ নামে।


মদ্যপান ছিল আরবের সবচেয়ে পরিচিত প্রথা। মদ খেয়ে জুয়া খেলত তারা। বাজি রাখত সর্বস্ব। মিশরের সায়িদ কুতুব ( Sayyid Qutb) তার মাইলস্টোন বইয়ে বলেছেন, এসময় ৪ ধরণের বিয়ে প্রচলিত ছিল। প্রথম ধরণের বিয়ে ছিল বর্তমান সময়ের বিয়ের মতোই। দ্বিতীয় ধরণের বিয়ের নাম ছিল নিকাহ আল ইস্তিবা। এ ধরণের বিয়ের জন্য বিবাহিত মহিলাদের অন্য পুরুষের কাছে পাঠানো হত। ঋতুস্রাব শেষ হওয়ার পর অপেক্ষা করা হত। যদি মেয়েটি গর্ভবতী না হয় তাহলে তার স্বামীই অন্য পুরুষের কাছে নিয়ে যেত। পুরুষটির পছন্দ হলে সে মহিলার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করত। এরফলে জন্ম নেওয়া সন্তানকে পবিত্র এবং অভিজাত মনে করা হত। অবশ্য গর্ভবতী হওয়ার পর স্বামী তার স্ত্রীর কাছে যেতে পারত। তৃতীয় ধরণের বিয়েতে এক নারী ১০ জনের কম পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করত। এরপর সন্তান জন্মদানের পর সব পুরুষকে একসাথে তার ঘরে ডাকত। এরপর মহিলাটি যার নাম নিত সন্তানটি তার বলেই বিবেচিত হত। আর চতুর্থ ধরণের বিয়ে হত মূলত পতিতার সাথে। একসাথে অসংখ্য পুরুষ তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করত। পরে একজন বিশেষজ্ঞকে ডেকে বাচ্চার বাবা নির্ধারণ করা হত। এসময় এমনকি দুই সহোদরা বোনকেও একসাথে বিয়ে করত। দাসীদের সাথে যৌন সঙ্গম ছিল খুবই স্বাভাবিক বেপার।
আরবরা পড়াশুনায় তেমন একটা আগ্রহী ছিল না। খুব কম সংখ্যক আরবই পড়তে এবং লিখতে পারত। খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মধ্যে সামান্য জ্ঞান চর্চার আগ্রহ দেখা যেত। তবে পড়াশুনা না জানলেও তারা খুব ভাল কবিতা লিখতে পারত। কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলত তাদের সমাজ সংস্কৃতি এবং জীবনের গল্প। সে কবিতাগুলো হত খুবই শ্রুতিমধুর। এমনকি যখন গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ হত তখন অনেকসময় কবিরা নিজেদের গোত্রের পক্ষ থেকে কবিতা শুনাত। কবিদের লড়াই চলত। সে লড়াই দেখতে ভীড় জমাত সকলে। কবিরা তাদের কবিতায় শুনাত নিজের প্রিয়তমাকে হারানোর গল্প, কখনো তাদের উটের বর্ণনা দিয়ে লিখত কবিতা। এসময় কবিতায় ছিল আরব সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

আইয়ামে জাহেলিয়ার এই সময়ে আরবে নানা ধরণের ধর্ম প্রচলিত ছিল। যেমন-
মূর্তিপূজক বা পলিথেইস্ট: আরবের বেশিরভাগ মানুষ ছিল মূর্তিপূজক। প্রায় প্রতিটি গোত্রই আলাদা আলাদা দেবদেবীর পূজা করত। কেউ পূজা করত সিরিয়ানদের চন্দ্রদেবতা হোবালের, কেউবা গ্রীক দেবী আফ্রোদিতিকে মানত আরাধ্য। কেউ পূজা করত জিসাস বা ইসা (আ) এর, কেউবা তার মাতা মেরি বা মরিয়ম (আ) এর। এসব মূর্তিই তারা রাখত কাবা শরীফে। হযরত ইব্রাহীম (আ) এবং তার পুত্র ইসমাইল (আ) যে কাবাঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন আল্লাহর নির্দেশে সে কাবাঘরে আরবরা মূর্তি পূজা করত।
অনেকে ছিল নাস্তিক। যারা বিশ্বাস করত এই পৃথিবী চিরন্তন। পৃথিবী নিজে নিজেই তৈরি হয়েছে এর কোনো স্রস্টা নেই।
ছিল জিনদিকস, যারা বিশ্বাস করত পৃথিবীতে দুই জন দেবতা আছেন। একজন ভাল আর অন্যজন খারাপ। তারা কোনো এক প্রান্তে নিজেদের মধ্যে নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছেন।
ছিল তারাদের পূজারি sabines, আরো ছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান।
এছাড়াও খুব ছোট একটা দল ছিল যারা মূর্তি বা চাঁদ তারার পূজা করত না। ইব্রাহীম (আ) এর দেখানো পথে চলত। এই দলটি থেকেই জন্ম হয় মোহাম্মদ (সা) এর।

এসময় আরবে ছিল অসংখ্য পুরোহিত এবং শ্যামন। মনে করা হত এরা ইশ্বরের সাথে সরাসরি কথা বলতে পারে। তারা কোনো এক দেবতার কাছ থেকে উত্তরের আশায় শূন্যে তীর ছুঁড়তো। তীর যেদিকে পরতো সে অনুযায়ী পুরোহিতরা প্রশ্নের উত্তর জানাতো। অনুষ্ঠিত হত উকাজ মেলা। সে মেলায় কবিতা শুনাতো কবিরা। যার কবিতা সবচেয়ে ভাল হত সে কবিতা সোনার কালিতে লিখে টাঙিয়ে দেওয়া হত কাবাঘরের দরজায়। একে ডাকা হত মুআল্লাক্বা বলে।
আরবের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত ভেদ করে সকালের সূর্যের মতো আগমন ঘটে ইসলামের। মহানবী (সা) এক নতুন ধরণের জীবনব্যবস্থার প্রচলন করেন। ইসলামের ছায়াতলে বন্ধ হয়ে যায় গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ। একীভূত হতে থাকে আরব। মেয়েরা পায় তাদের অধিকার, সম্মান । এসময় নারীরা স্বাধীনভাবে কাকে বিয়ে করতে চায়, কখন বিয়ে করতে চায় সে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। কাবা ঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয় সমস্ত মূর্তি। ইসলামের আগমনে আরবের রূপই পালটে যায়। দূর্ধর্ষ বর্বর জাতিটি হয়ে ওঠে সভ্য সুন্দর।