ছোট্ট মতিন । শহরের অলিতে গলিতে নানা ভাঙা চূড়া আর বাজে জিনিস টুকিয়ে বেড়ায় সে । সবার কাছে যেগুলো ফেলনা আর অকাজের , মতিনের কাছে সেগুলো মণি মুক্তোর চেয়ে কোন অংশে কম নয় । কেননা এগুলো বেচেই তার পেটের আহার জোটে । কাজেই সকাল সন্ধ্যা সে ঘুরে বেড়ায় , হাজির হয় এ ডাস্টবিন থেকে ও ডাস্টবিনে । যদি কিছু পাওয়া যায় এ আশায় ।
তার বয়সী শিশুরা যেখানে হেসে খেলে মহানন্দে দিন কাটায় আর মানুষ হওয়ার জন্য পাঠশালে যায় , মতিনের মত ছেলেরা সেখানে রাস্তায় রাস্তায় পায়চারি করে শিকারি বাঁজের মত কাগজ আর ভাঙা চূড়া জিনিস টুকায় । তাদের আনন্দ তখনই হয় , যখন তারা পেট ভরে খেতে পায় । সে মরিচ , পেয়াজ আর নুন ভাত হলেই হল ; নবাবের মত পোলাউ , কোর্মা , আর কালিয়া কুফতা চাইনা তাদের ।
মতিন টোকাই । তবে একটি দলের হয়ে কাজ করতে হয় তাকে । দলে তারা দশ জনের মত ছোট ছোট ছেলে মেয়ে । কারো বয়সই এগার-বারোর উপরে নয় । তাদেরকে লিডিং করে কানা হাশেম । এলাকার দাদা বলে পরিচিত সে । মতিনরাও দাদা বলে ডাকে তাকে । তাকে নিয়মিত মাশোহারা দিয়েই টোকাইগিরি করতে হয় তাদের । নয়তো কঠিন শাস্তির মুখোমুখী হতে হয় । মতিনরাও নিরুপায় । তাই দাদার হুকুম মতই চলে তারা । ফলে দাদার হুকুমে মাঝে মাঝে ছোট খাট অপরাধও করতে হয় তাদের ।
মতিনরা আজ সকাল সকাল কাজে বেরুবে । দাদার হুকুম , আজ নাকি পাশের ঐ বড় মাঠটায় কিসের জনসভা আছে । ওখানে বোমা ফেলতে হবে তাদের । মাঝে মাঝেই একাজ করতে হয় মতিনদের । এতে কানা হাশেম মোটা অঙ্কের টাকা হাতে পায় , আর মতিনেরা পায় কিছু ভাল খাবার । কিন্তু এর জন্য যে তাদের বিরাট কোন ক্ষতি হতে পারে , এমন কি মৃত্যূও ! তাও জানে তারা ! তবুও পেটের তাগিদে এ পথে পা বাড়ায় মতিনেরা । যাই হোক , বেলা ১০ টা । ইতিমধ্যে জনসভা লোকে লোকারণ্য । বক্তৃতা রাখছেন একজন অপরিচিত লোক । তবে লোকটার কথায় মায়া আছে । সবাই মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনছে তাঁর কথা । মতিনরাও ভুলে গেল তাদের কাজের কথা । অন্যদের মত লোকটার কথা শুনে তাদের চোখ থেকেও বয়ে চলল , জলের ফোয়ারা । লোকটার কথায় এতই বাস্তবতা আর অসহায় মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে যে , রাস্তার লোকগুলো পর্যন্ত গন্তব্য ভুলে থমকে দাঁড়িয়েছে ! দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা দেয়ার পর জনসভা শেষ হল । যে যার মত চলে গেল নিজ নিজ ঠিকানায় । কিন্তু মতিনরা তখনো থোম ধরে বসে আছে । নজর তাদের জমিনের দিকে । কাজেই লক্ষ করে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন বক্তৃতা দানকারী লোকটি । বললেন , -তোমরা কারা বাবা ? এখানে এভাবে বসে আছ ? এবার উপরে দিকে তাকিয়ে মুখ খুলল মতিন , -আমরা টোকাই ! লোকটি মতিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন , -এখানে বসে আছ যে , তোমাদের কাজের ক্ষতি হচ্ছেনা ? মতিন নিচু গলায় জবাব দিল , -আমরা আসলে এসেছিলাম মিটিংয়ে বোমা ফেলতে । কিন্তু আপনার কথা শুনে কিযে হল ! কিছুই বুঝলামনা ! কথাগুলো বলার পর মতিনসহ সবাই ভয় পাচ্ছিল । বোধ হয় পুলিশে দিয়ে দিবে তাদের । একটু দূরে আবার একটা পুলিশ জিপ দেখা যাচ্ছে । কাজেই মনে মনে ক্কুল হুয়াল্লাহ ধ্বনি উঠে গেল তাদের । কিন্তু আশ্চর্য হল এই দেখে যে , লোকটি বিন্দুমাত্রও ক্ষেপে যায় নি ! বরং আরো মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন , -কেন এ কাজ কর তোমরা ? -দাদার হুকুম । না করলে খাবারতো জুটবেইনা বরং পেতে হবে অসহ্য শাস্তির সীমাহীন যন্ত্রণা ! একটু সাহস করে অনর্গল কথাগুলো বলে গেল মতিন । বাকিরা তার মুখের দিকে চেয়ে রইল । এসময় আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না লোকটি । শুধু বললেন , -আমি যদি তোমাদেরকে আমার সাথে নিয়ে যাই , তাহলে যাবে তোমরা ? এসময় কেউ একজন বলে উঠল , -পেট ভরে খেতে দিবেন ? লোকটি হাসি মুখে উত্তর করলেন , -শুধু খেতে নয় , সব কিছু পাবে তোমরা । জামা-কাপড় , পড়া-শোনা সব ! এসময় মতিন বলে উঠল , -নিশ্চয়ই যাব ! লোকটি তখন সবার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিয়ে গেলেন নিজের সাথে ।
মতিন এখন অনেক বড় হয়েছে । পড়া-শোনা বিদ্যা বুদ্ধি কিছুরই কমতি নেই তার । শুধু বেঁচে নেই সেই লোকটি , যিনি মতিনদের মত অনাথ রাস্তার টোকাইদেরকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন পরম স্নেহে । জায়গা দিয়েছিলেন নিজের হাতে গড়া শিশু নিকেতনে । আজ মতিনরা পড়া-লেখা শিখে মানুষের মত মানুষ হয়েছে । তার বন্ধুরা এখন কাজ করছে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ফার্মে । পাচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা বেতন । কিন্তু মতিন কাজে যোগ দেয়নি । লোকটির মৃত্যুর পর সেই এখন হাল ধরেছে শিশু নিকেতনটির । এখানে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অনাথ শিশু বিনামূল্যে থাকা খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে । গ্রহণ করছে শিক্ষা ও অন্যান্য সুবিধাগুলো । আর এর অর্থের যোগান দিচ্ছে তার সাথে পালিত হওয়া সেইসব বন্ধুরা ।
মতিনের এখন একটাই লক্ষ , এদেশ থেকে অভাব অনটন আর দরিদ্রতাকে চিরদিনের মত ঝেঁটিয়ে বিদায় করা । তার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে ও । করছে নানান গবেষণা ।