নতুন বউ এর এমন মাঝরাতের চিৎকার খুবই লজ্জাজনক ঘটনা হলেও মজুমদার বাড়িতে এটা আজ নতুন কিছু না। গুনে গুনে রাত ১২.১ মিনিটে ৭দিনের বাসি পানি দিয়ে গোসল করানো তাদের রীতি। হোক সেটা মার্চে বা ডিসেম্বরে। নতুন বউ কতটা শক্ত পোক্ত সেটারই প্রথম পরীক্ষা বলা চলে।
অথচ মধু দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরে এসেছিল। বাবা মারা যাবার পর চাচার দয়াতেই তাদের মা মেয়ের দিনানিপাত। স্কুলের গণ্ডিটাও পাড় করতে পারেনি। বড় সংসার দেখে চাচা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। জামাই যে কেমন কি করে সেটাও জিজ্ঞেস করার সাহস নেই তাদের।
সালেহা বেগম একবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” মিয়া ভাই তা পাত্র কি করে? ”
একধমকেই থামিয়ে দিয়ে শফিক বলে উঠলো, আপনার মেয়েকে তো হাত পা বাইন্ধা নদীতে ফেলাই দিবার পারি না। বড় সংসারেই বিয়া দিতাছি। সমস্যা নাই শুধু পাত্রের আগে একটা বউ ছিল। রোগাইন্না মাইয়া বিয়ের কিছু দিন পরই অক্কা পেয়েছে। বেটা ছেলের এমন দুই একটা সমস্যা কোন সমস্যাই না। তাছাড়া আপনার মেয়েরে যে ওরা মাগনা নিতেই রাজি এই আপনার ভাগ্য।
নিজেই নিজেকে শান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পান না সালেহা বেগম। খুব আশা ছিল ভালো একটা ছেলের কাছে মেয়েকে দিবেন। যেই মধুর মেধাকে দাম দিবে। লেখাপড়ায় খুব ভালো মধু। সুযোগ না হলেও পড়াটা মন দিয়ে পড়তো। বরাবরই ক্লাসে প্রথম সে। ইচ্ছা বড় হয়ে উকিল হবে। মার কষ্ট গোচাবে। কিন্তু কথায় আছে না শুটকির আবার সুগন্ধ। অন্যের সংসারে আর কত দিন। চাচির কাজ করতে করতে বেলা যায় মা মেয়ের। রাতে খাবার পর সব কাজ শেষে কিছু সময় পায় লেখাপড়ার জন্য। তারপরও লাইট জ্বালানোরও উপায় থাকে না, চাচি খুব চিল্লাচিল্লি করে। সব কিছু কপালের লিখন ভেবে মধুও রাজি হয়ে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে গা শিউরে উঠলো তবে সেটা শীতের জন্য। এবাড়িতে আসার পর পরই রেণু( মজুমদার বাড়ির বড় বউ) সাবধান করে দিয়েছিল মধুকে। যাইহোক সে যেন মুখে টু শব্দটাও না করে। তাহলে প্রথম দিনই লোকে নতুন বউ নিয়ে আকথা কুকথা বলবে। রাতে খাবারের সময় মুন্নাফ(বর) কে একবার দেখার সুযোগ হয়েছিল মধুর। বয়স কম করে হলেও ৪০ কালো লম্বা গোছের একটা লোক। ভয়ংকর মুখের মানচিত্র। ঠাট্টা সম্পর্কের আত্মীয়রা হাসি তামাশা করছে, এর মাঝে মুন্নাফ ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে হনহন করে বাইরে বের হয়ে গেল।
মধুর মন আরো খারাপ হয়ে গেল। প্রথম পরীক্ষার জন্য গোসলখানায় নেয়া হলো মধুকে। সবার হাতে বড় বড় কলসি ভর্তি পানি। এই শীতের শুরুতেই মাঝরাতে গোসলের কথা শোনেই মধুর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এক মগ পানি দিতেই মধুর কাপাকাপি দেখে সবাই হাসতে লাগলো। আর বড় মামি তো বলেই উঠলো এমন কাচাকুমলা বউ জীবনেও দেখিনি এই বউ এই সংসারে ঠিকতি পারবে না। আমার মত পোষ মাসে বিয়া হইলে এই তো দেখি প্রথম দিনেই খাটিয়ায় উঠতো।
এই কথা শোনে মধুর ঠাণ্ডা শরীর মনে হয় আগুন হয়ে উঠলো। কিন্তু সেই আগুন জ্বলার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন আরো বেশি ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিল। এভাবে কত কলসি পানি যে ঢালা হলো সেটা মধুর মনে নেই শুধু মনে পড়ছে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে কেউ যেন নাক গলা টিপে ধরে আছে, ফুসফুস টাকে চাবিয়ে খাচ্ছে।
বিকট কাশির শব্দ শোনে মধু চোখ খোললো মধু,বাম হাতটায় কেমন যেন ব্যথার জন্য অনুভূতি হচ্ছে ওর। ভালো করে তাকাতেই দেখলো হাতে স্যালাইনের সুই গাথা।
ওকে চোখ মেলতে দেখেই সালেহা বেগম (মধুর মা) শোকর গোজার করে উঠলেন। মুখে বললেন, যাক অবশেষে তাহলে জ্ঞান ফিরলো।
টানা তিন দিন পর নাকি চোখ খুলেছে মধু। পাত্র পক্ষকে বলতে গিয়েও বলা হয়নি মধুর নিউমোনিয়ার প্রকট সমস্যা আছে। ছোট বেলায় একবার মরতে মরতে বেচে গেছে। ডাক্তার এসে খুব হুমড়ি তুমড়ি করে গেছে। এমন কুসংস্কারের জন্য। খালেদ মজুমদারের ( মধুর শ্বশুর) আতে ঘাঁ লেগেছে। তাদের বাড়ির রীতিনীতি নিয়ে বাইরের একজন যাতা বলার সুযোগ পেয়েছে বলে। এরজন্য মধুকে আসামী বানানো হয়েছে। জানিয়ে দিয়ে গেছে, এই বউকে আর নেয়া যাবে না। এমন নরম বউ দিয়ে তাদের চলবে না।
আসছে পৌষ মাসের ১২তারিখ মুন্নাফের আবার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।