ভয়ের জ্যামিতি বড় অদ্ভুত।
কোনো সূত্রই মানেনা।
নিজেকেই প্রশ্ন করুননা,কী দেখলে আপনি ভয় পেতে পারেন?
গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল আপনার।কামরাতে আপনি একা।পুরো বাড়ি ফাঁকা।কেউ নেই।বাইরে জোছনার রাত।তরল সোনার মত জোছনা।হঠাত দেখলেন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভয়াল এক মূর্তি।চোখ দুটো বড় বড়।চোখের পলক পড়ছেনা।যেখানে নাক থাকার কথা,নেই।দাঁতগুলো সব বড় বড়।মুখটা যেন আধখোলা দেশলাই।ভয় পাবেন আপনি?
অথবা খাটের নীচে কী যেন নড়াচড়া করছে।উঁকি দিলেন।দেখলেন আপনার বন্ধু শুয়ে আছে সেখানে।যে গত বছর নদীতে ডুবে মারা গেছে ভয় পাবেন?
ছাদের উপর কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে অনেকক্ষন ধরে।উঠে গেলেন দেখতে,কী দেখলে ভয় পেতে পারেন আপনি?
১।কিংকং ২। এলিয়েন ৩। নরকংকাল ৪।বড় বড় কতগুলো কালো মাকড়সা।
সঠিক উত্তর কোনটা?
বিজ্ঞানীদের মতে সবগুলোই।
দেখা গেছে মানুষ এবং পশুপাখিদের অনুভূতিগুলো প্রায় একই ধরনের কাজ করে,যখন তারা ভয় পায়।
মানুষের ক্ষেত্রে দেখা গেছে,সে তার পরিচিত পরিবেশ থেকে কিছুক্ষনের জন্য বিচ্ছিন্ন হলেও ভীষনভাবে ভয় পেতে পারে।
ভরা মাছের বাজারে মাছ দাম দস্তুর করার সময় যদি আপনি দেখেন মাছওয়ালার মুখে তিনটে চোখ,আপনি ভয় পেতে পারেন।একই রকম ভয় পেতে পারেন যদি দেখেন আপনার স্ত্রী গভীর রাতে বসে রান্নাঘরে কাঁচা মাছ খাচ্ছে!
পুকুরের ঠান্ডা পানিতে নেমেছেন গোসল করার জন্য।ডুব দিতেই দেখলেন এক মৎস কন্যা।যেরকম ভয় পাবেন ততটুকু ভয় পাবেন সবুজ রং এর এক জলজ প্রাণীকে দেখলে।যেটার অক্টোপাসের মত বড় বড় শুঁড় আছে!
খুব সাধারন জিনিসেও মানুষ ভয় পায়।এডগার অ্যালান পো’র সেই গল্পের কথা মনে নেই?একটুকরো আলোর সাহায্যে ভয় দেখিয়ে একটা খুন করা হয়েছিল।পড়েননি?
আমার প্রথম ভয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছিল এক কবরস্থানে।
অনেকগুলো বছর আগে আমি প্রশান্ত মহাসাগরের একটা দ্বীপে ছিলাম।সেটা ছিল আমার স্বেচ্ছা দীপান্তর।অনেকেইহয়ত জানেন এই ব্যাপারটা।
সান এন্টোনিও নামে একটা গ্রামে থাকতাম।চমৎকার জায়গা।সমূদ্রের পাশেই।নারকেল গাছে ঠাসা জঙ্গলের নীচেই আমাদের টিনের বাড়িটা।তো,কথা সেটা না।কথা হচ্ছে ছুটির এক রাতে সুসুদি গ্রামে যাচ্ছিলাম।কিছু বন্ধু থাকে সেখানে।রাত ঠিক দশটা এলাকাটা বেশ নিঝুম তারচেয়ে বড় কথা একটা বিশাল কবরস্থান পার হয়ে ওদের বাড়িতে যেতে হয়।কী ভয়াল!যে ভুলটা সবাই করে,অর্থাৎ রাস্তা সংক্ষিপ্ত করার জন্য সোজা কবরস্থানের মাঝখান দিয়েই হাঁটা ধরলাম আমি।কারণ ঘুরে গেলে অনেক সময় লাগবে।কবরস্থান নিয়ে ভয় কাজ করেনা আমার ভেতর,কারণ ওখানে যারা শুয়ে আছে তারা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা।যারা দুই পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর বুকে তারাই আমার বেশি ক্ষতি করতে পারবে!
কবরস্থান বেশ পরিষ্কার।লম্বা কিছু লোহার পিলারের উপর লাইট জ্বলছে।সংখ্যায় খুব কম তারপরও বেশ ফুটফুটে চারদিকটা।মাঝখানে রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি।দুইপাশে সাড়ি সাড়ি সিমেন্টে বাঁধানো কবর।সবগুলোর উপরে সিমেন্টের অথবা কাঠের ক্রুশ।সাদা রঙের। অনেকগুলো কবরের উপর লম্বা কাঁচের গ্লাসের ভেতর রাখা লাল রঙের মোমবাতি জ্বলছে।এরকম একটা মোম টানা পাঁচদিন ধরে জ্বলে।আমি জানি।ঝড়ের রাতেও সহজে নেভে না।
ঠিক যখন কবরের মাঝমাঝি এলাম,তখন মনে হল,আমি একা নই।কবরের ভেতর শুয়ে থাকা লোকগুলোর কথা বলছিনা।কিছু একটা আছে।জীবন্ত।আমারঅনুভূতিগুলো তাই বলছে।
এমন সময় আচমকা দূরে কোথাও ডেকে উঠল এক গাদা কুকুর।লম্বা,টানা,একঘেয়ে সুরে।।ব্যাপারটাসত্যিই কাকতালীয়।তবে আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন আপনি,মাঝে মাঝে কুকুরের এই একটানা ভয়ার্ত ডাকটা সত্যিই ভয়ংকর।এবং সে সময় যদি আপনি কোনো কবরস্থানের মাঝ বরাবর থাকেন,সোনায় সোহাগা হয় ব্যাপারটা।
নিজের অজান্তেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। খামোকাই মাইকেল জ্যাকসনের ‘থ্রিলার’ ভিডিও অ্যালবামটার কথা মনে পড়ে গেল।প্রায় শেষ প্রান্তে এসেছি,এমন সময় জিনিসটা দেখতে পেলাম।
‘জিনিসটা’ বললাম এজন্য যে,এটাকে মানুষ বলতে পারছিনা।কবরস্থানের শেষমাথায় কাঠের বেঞ্চি পাতা।সেখানেই বসে আছে লোকটা।শুধু ধড়টা আছে।মাথা মুন্ডু নেই!চাঁদেরে আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাছি।
আতংকের একটা শীতল লাভা মেরুদন্ডের উপর দিয়ে বয়ে গেল।অসম্ভব এক দৃশ্য!ভয়াল।
ঝেড়ে উল্টোদিকে দৌড় দেব কিনা ভাবছি।আরো ভয়ের ব্যাপার মুন্ডুহীন প্রেতের বাম হাতে একটা মদের বোতল।আমাকে ভয়ের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেল পরের ঘটনাগুলো।ধীরে ধীরে মদের বোতলটা নিয়ে হাতটা উপরে উঠল এবং একই সাথে ধীরে ধীরে মুন্ডুহীন প্রেতটার ধড়ের উপর মাথা গজাল।পরম তৃপ্তির সাথে গব গব করে কয়েক ঢোক পানীয় গিলল সদ্য গজিয়ে ওঠা মাথাটা।তারপর আবার অদৃশ্য হয়ে গেল!
পৃথিবীর সবচাইতে পৈশাচিক দৃশ্য!
ভাবুন তো একবার।একুশ বছরের এক তরুন দাঁড়িয়ে আছে এক নির্জন কবরস্থানে।তার চোখের সামনে ঘটছে ব্যাখ্যার অতীত কিছু ঘটনা।যা শুধু অলৌকিকই নয়,পৈশাচিকও বটে!
সম্ভবত নিজের অজান্তেই কোনো শব্দ করে ফেলেছিলাম।ঝট করে বেঞ্চের উপর বসা থেকে উঠে দাঁড়াল জিনিসটা।আবার মুন্ডু গজিয়েছে।আমাকে দেখে ভয়াল এক চিৎকার করে উঠল।চিৎকারের জন্য কুকুরগুলোর কান্না পর্যন্ত থেমে গেল।
ম্যারাথন দৌড় দেবার আগেও থেমে গেলাম।কারণ অপার্থিব পিশাচটা আমাকে ভয় দেখানোর জন্য চিৎকার দেয়নি ও নিজেই ভয় পেয়েছে!
দ্রুত দুই এক কদম হেঁটে গেলাম সামনে।হাত দুটো সারেন্ডারের ভঙ্গিতে উপরে তুলে নরম গলায় জানতে চাইলাম,তুমি ঠিক আছো,বন্ধু?
চাঁদের আলো এবার সরাসরি পড়েছে বোতলওয়ালা প্রেতটার মুখে।কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব এল,ওহ জিসাস,তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ,ম্যান।
ভুতের মুখে জেসাসের নাম শুনে ভাল লাগল।আরো ভাল লাগল লোকটার চেহারা দেখে।একেবারে বুড়ো।আমাকে দেখে বেশ ভয় পেয়েছে।থর থর করে কাঁপছে।
মরমী বন্ধুর মত পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।জানতে পারলাম বুড়োর বউ মারা গেছে গত তিনদিন আগে।বেঞ্চির একটু দূরে প্রথম কবরটাই ওর বউয়ের।দীর্ঘ চল্লিশ বছর এক সাথে ছিল ওরা সুখে দুঃখে।এখন মাটির তলায় কাঠের বাক্সের ভেতর শুয়ে আছে ওর হৃদয় হরনকারিণী মেয়েটা।
কিছুই ভাল লাগছিল না বুড়ো।তাই সন্ধ্যা বেলাতে এসে বসে আছে এই বেঞ্চিটাতে।বোতলটা ছিল সঙ্গী।মাতাল হয়ে যাবার পর একটু তন্দ্রা মত এসেছিল।তাতেই মাথাটা ঝুঁকে চিবুকটা এসে ঠেকেছিল বুকের উপর।ঠিক সেই সময় আমি আসছিলাম পেছন থেকে।কাজেই আমি দেখেছিলাম একটা মুন্ডু ছাড়া শরীর।হঠাৎ তন্দ্রাটা টুটে যেতেই বুড়ো নতুন করে কয়েক ঢোক মদিরা গলায় ঢেলেছিল বউয়ের দুঃখে।সেই সময় আমি দেখেছিলাম অলৌকিক দৃশ্য!পিশাচটার মুন্ডু গজিয়েছে।
একইভাবে মদ গেলার পর আবার মাথাটা ঝুঁকে চিবুকটা নেমে এসেছিল বুকের উপর আর আমি ভেবেছিলাম অদৃশ্য হয়ে গেছে মুন্ডুটা।
কী বীভৎস!
বুড়ো ভয় পেয়েছে অন্য কারণে।হঠাৎ করেই তার মনে হয়েছে ভয়াল কী যেন একটা তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।,বউয়ের শোক ছাপিয়ে তার মনে হয়েছে এই কবরস্থানেই অনেক প্রাচীন স্প্যানিশ জলদস্যুদের কবর দেয়া হয়েছিল।ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল তাদের।কথাটা মনে হতেই ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে।আর পেছন ফিরে তাকাতেই সে দেখেছে জ্যান্ত এক আতঙ্ক এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে।সেই আতংকের অন্য নাম-মিলন গাঙ্গুলী!চাঁদেরআলোতে আমাকে যে কেমন দেখায় সেটা তো আমিই ভাল করে জানি!
সমবেদনা জানাতে গিয়ে কবরস্থানের বেঞ্চিতে বসে কয়েক ঢোক মদিরা গিলে বিদায় নিলাম বুড়োর কাছ থেকে।
ভাল থেকো তুমি ,বুড়ো মিয়া!
ভয়ের জ্যামিতি
Loading books...