অল্প বয়সেই আজিজের বাপ-মা মরিয়া গেল। বুড়াে নানা আজিজকে আনিয়া তাঁহার বাড়িতে রাখিলেন। কিন্তু তাহার মতাে দুষ্ট ছেলেকে সামাল দিবেন কতদিন? আজ এটা নষ্ট করে- কাল ওটা বাজারে বিক্রি করিয়া মেঠাই খায়। অনেক ধকম-ধামক মারপিট করিয়াও।
আজিজকে ভালাে করা গেল না। পরিশেষে নানা তাহাকে বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিলেন।
দশ বারাে বৎসর পরে একদিন অনেক টাকা-পয়সা লইয়া আজিজ দেশে ফিরিয়া আসিল। আসিয়া শহরে একটি বাড়ি কিনিয়া ফেলিল। তারপর নানা-নানীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিল। তাহার হাতে আঙটি, ঘড়ি, পরনে দামী কাপড়। নানা-নানী তাে দেখিয়া অবাক!
নানা জিজ্ঞাসা করিলেন, “হ্যারে আজিজ! বিদেশে যাইয়া তুই এত টাকা-পয়সা কামাই করিলি কি করিয়া ?”
আজিজ উত্তর করিল, “নানা। ওসব জিজ্ঞাসা করিবেন না। টাকা- পয়সা উপার্জন করিয়াছি হেনতেন করিয়া।”
নানা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আরে নাতী! বল না হেনতেন কাকে বলে?”
আজিজ বলিল, “সে কথা আর একদিন বলিব নানা। আজ থাক।”
আজিজ চলিয়া গেল। কিন্তু নানার মনে কেবলই জাগে, হেনতেন কাকে বলে?
আচ্ছা, নাতীর মতাে হেনতেন করিয়া নানা নিজের অবস্থা আরও ভালাে করিতে পারে না? ভাবিয়া ভাবিয়া নানার আর ঘুম হয় না।
সেদিন আজিজকে নানা ডাকিয়া আনিলেন ; বড় লােক নাতীর জন্য নানী অনেক পিঠা-পায়েস করিয়াছেন। নানা নাতী দুইজনে বসিয়া খাইতেছেন, নানা তখন কথাটা পাড়িলেন,
“হ্যারে আজিজ! সেদিন না বলিয়াছিলি হেনতেন কাকে বলে অন্য সময় বলবি?
আজ তােকে কিছুতেই ছাড়িব না।/হেনতেন কাকে বলে তােকে বলিতেই হইবে!
একটা পিঠা চিবাইতে চিবাইতে আজিজ বলিল, “নানা? আজ ওকথা থাক। পরে একদিন বলিব।”
নানী বলিলেন, “আর একদিন কেন নাতী? তােমার নানা যখন জানিতে চান, আজই বল না কেন, ভাই? হেনতেন কাকে বলে আমারও জানিবার ইচ্ছা।”
আজিজ বলিল, “আচ্ছা নানী! হেনতেন কাকে বলে আমি শুধু মুখেই বলিব না। আপনাদিগকে দেখাইয়া দিব। আমাকে শুধু এক মাসের সময় দিন।”
একট কি ভাবিয়া আজিজ আবার বলিল, “নানা! একটা কথা! নানী তাে সারা জীবন আপনার সংসারে খাটিয়া খাটিয়া শরীর ক্ষয় করিয়া ফেলিলেন। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে নানীকে আমার শহরের বাড়িতে কিছুদিন রাখিয়া সবকিছু দেখাইয়া আনি।”
এ কথা শুনিয়া নানী নাতীর উপর খুব খুশী হইলেন। নানার মুখের দিকে তিনি চাহিয়া রহিলেন, নানা কি জবাব দেন।
নানা বলিলেন, “সে তাে ভালাে কথা ভাই! আমার তাে আর কোনাে আত্মীয়-স্বজন নাই, যেখানে যাইয়া তােমার নানী দুইদিন বিশ্রাম করিয়া আসিবে। তুমি বড়লােক নাতী, লইয়া যাও তােমার নানীকে। কয়েক দিন শহরের যা কিছু দেখিয়া আসুক।”
নানীকে সঙ্গে লইয়া আজিজ তাহার শহরের বাসায় আসিল। নানার বাড়ি হইতে। শহর পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে।
কিছুদিন পরে শহর হইতে আসিয়া আজিজ কাঁদ কাঁদ হইয়া নানাকে বলিল, “নানা! দুঃখের কথা আর বলিব কি! একদিনের কলেরা হইয়াই নানী মরিয়া গিয়াছেন। আপনাকে যে খবর দির তাহারও সময় পাইলাম না। ডাক্তার-কবিরাজের বাড়ি ঘুরিয়াই শরীর কাহিল করিয়া ফেলিলাম।”
নানা কিছুদিন বউ-এর জন্য খুব কাঁদিলেন। তারপর ঘর-সংসারের কাজে মন দিলেন। | আজিজ শহরের বাড়িতে যাইয়া তার নানীকে বলিল, “নানী। দুঃখের কথা কি বলিব! বসন্ত রােগ হইয়া একদিনেই নানা মরিয়া গিয়াছেন।”
শুনিয়া নানী ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, “ওরে আজিজ! শীগগীর আমাকে বাড়িতে রাখিয়া আয়।” আজিজ আরও কাঁদ কাঁদ হইয়া বলিল, “নানী! আপনাদের গ্রামে আরও দুই তিন জনের বসন্ত হইয়াছে। সেখানে গেলেই আপনাকে বসন্ত রােগে ধরিবে। কিছুতেই আমি আপনাকে সেখানে লইয়া যাইতে পারিব না।”
চার পাঁচ দিন কাঁদিয়া কাটিয়া নানী আবার আগের মতােই খাওয়া-দাওয়া করিতে লাগিলেন।
কিছুদিন পরে আজিজ আসিয়া তাহার নানার সঙ্গে দেখা করিয়া বলিল, “নানা! আর কতদিন একলা সংসার সামলাইবেন ? এই বুড়াে বয়সে কে দেয় আপনার ভাত-পানি, আর কে লয় আপনার খবরাখবর ?” কয়েকদিন হাত পুড়াইয়া রান্না করিয়া খাইয়া নানা অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছেন।
নাতীর কথায় একেবারে গলিয়া গেলেন, “তাই তাে রে ভাই! এই বুড়াে বয়সে ঘর সংসারের কাজ করিতে করিতে একেবারে। নাজেহাল হইয়া পড়িয়াছি।”,
উনি সুযােগ বুঝিয়া আজিজ বলিল, “নানা! আমার বাসার ধারে একেবারে নানীর মতাে দেখিতে একটি বিধবা মেয়ে আছে। নানীর মতাে বয়সী। বলেন তাে তার সঙ্গে আপনার বিবাহের জোগাড় করিতে পারি।”
নানা বলিলেন, “নারে ভাই, এই বুড়াে বয়সে কাকে আনিয়া দিবি, জানি না, চিনি না, আমার ঘর-সংসার নাস্তানাবুদ করিয়া ফেলিবে।”
আজিজ বলিল, “নানা! ওসব চিন্তা করিবেন না। আমার বাসার কাছে বলিয়া সর্বদা মেয়েটিকে দেখিতে পাই। তার চাল-চলন একেবারে নানীর মতাে। আপনি দেখিলে বুঝিতে পারিবেন না মেয়েটি নানী ছাড়া অপর কেহ।”
নানা তখন বলিলেন, “আচ্ছা তাের যদি ইচ্ছা হয় তবে বিবাহের বন্দোবস্ত কর।”
আজিজ বলিল, “নানা! খালি হাতে তাে বিবাহ হয় না। কনে পক্ষ। আবার শরীফ ঘর। অন্ততঃ হাজার টাকা না হইলে এই বিবাহের কাজে নামা যায় না।”
নানা গণিয়া গণিয়া নাতীর হাতে হাজার টাকার নােট দিলেন।
বাসায় আসিয়া আজিজ তাহার নানীকে বলিল, “নানী। এইভাবে বিধবা হইয়া আপনি আর কতদিন থাকিবেন? আমাকে তাে জানেনই। আমার মতিগতির কোনাে ঠিক নাই। যা টাকা-পয়সা আছে ফুরাইলে আবার বিদেশ চলিয়া যাইব। তখন আপনার কি উপায় হইবে ?”
নানী একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, “তাই তাে রে ভাই! আমার ভবিষ্যৎ ভাবিয়া কুল-কিনারা পাই না।”
আজিজ বলিল, “অমুক গ্রামে একজন বুড়াে লােক দেখিয়াছি। একেবারে নানার মতাে দেখিতে। অবস্থা বেশ ভালাে। অল্পদিন হইল তাহার বউ মরিয়াছে। আপনি যদি বলেন, তাহার সঙ্গে আপনার বিবাহের বন্দোবস্ত করিতে পারি।”
শুনিয়া নানী ক্ষেপিয়া উঠিলেন, “আরে হতভাগা! আমার কি এখন। বিয়ার বয়স আছে?”
আজিজ বলিল, “সেই বুড়াে লােকটারও কি বিয়ার বয়স আছে? তবে দিনে দিনে আপনি যখন আরও কমজোর হইয়া পড়িবেন তখন। আপনার দেখাশুনা করিবে কে নানী! আপনি তাে আমার কথায়। বিশ্বাস করিবেন না- সেই লােকটার চলন-বলন, হাবভাব, গায়ের রং একেবারে নানার মতাে। প্রথমে দেখিলে তাহাকে অপর লােক বলিয়া চিনিতেই পারিবেন না।”
নানী বলিলেন, “তাের নানার মতাে যদি দেখিতে হয়, তবে কর বিয়ার জোগাড়।”
শুভদিনে শুভক্ষণে নানা বিবাহের পােশাক পরিয়া পালকিতে চড়িয়া কয়েকজন বরযাত্রী সঙ্গে লইয়া নাতীর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাজী-বন্দুক ফুটাইয়া নাতী বুড়াে নওসাকে ঘরে আনিয়া বসাইল।
শা-নজরের সময় নানা নানীকে চিনিতে পারিলেন। নানীও নানাকে চিনিতে পারিলেন। দুইজনে দুইজনকে পাইয়া ভারি খুশী। তবুও নানা আজিজকে ডাকিয়া ধমকাইয়া বলিলেন, “ওরে। লক্ষ্মীছাড়া! এই তাের কীর্তি!”
হাসিতে হাসিতে আজিজ আসিয়া নানাকে বলিল,
“নানা, হেনতেন। কাকে বলে জানিতে চাহিয়াছিলেন। তাই হেনতেন কাকে বলে আপনাদিগকে হাতে-কলমে দেখাইয়া দিলাম।”