আমাদের গ্রামের নাম খুশিপুর। নিজের গ্রাম কে সবাই সুন্দর,ভাল বলে। সে দিক থেকে নয়,আমাদের গ্রাম আসলেই অনেক সুন্দর। গ্রমের একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা,অন্যপাশে বিশাল রেল-লাইন। গ্রামের মাঝ দিয়ে শুয়ে আছে আকা-বাকা মেঠো পথ। দিনের পুরোটা সময় কাটে ক্রিকেট ,ফুটবল আর নদীতে ডুবিয়ে। এ ছাড়াও প্রতিদিনের রুঠিনে আরেকটা ভাল কাজ আছে। তাহলো সব বন্ধুর মিলে গাছ থেকে গাছে ঘুরে ফল কুড়িয়ে বেড়ানো। তা অবশ্য নিজেদের গাছ থেকে না। আম,জাম,কাঠাল,লিচু,পেয়ারা ইত্যাদি চুরি করতে গিয়ে বাড়িতে পৌছাবার আগেই নালিশ চলে যায় বাড়িতে। মাঝে-মাঝেই খেতে হয় আব্বা-আম্মার বকুনি। কি ভাবছেন গল্পটা হয়তো আমার কিংবা আমার গ্রামকে নিয়ে যদিও শিরোনামটা ভিন্ন।
জি হ্যা-আপনাদের সকলের ধারণা ই ভূল। মাফ করবেন এতক্ষন আজাইরা পেচাল পারার জন্য।
আচ্ছা কৃপন মানুষ আপনাদের কাছে কেমন লাগে?
হয়তো ভাল লাগতেও পারে আবার নাও লাগতে পারে। কিন্ত আমার কাছে একদম ভাল লাগে না।
তবে এ গুণটায় একেবারে ভরপুর আমাদের লেকো চাচা থুক্কো সেলিম চাচা। সেলিম চাচা মানুষ হিসাবে যদিও অনেক ভাল । বয়সটা ৪০ কিংবা ৪৫ এর ঘরে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে,এলাকার উন্নয়নে বিভিন্ন কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করে।
আরে ভূল বুঝেছেন,টাকা দিয়ে কোন সাহায্য ই করে না মাঝে-মাঝে কোথাও যাওয়া লাগলে,একটু কাজ লাগলে। তবে তিনি কাজ করার চেয়ে করতে দেখিয়ে দিতে বেশি পছন্দ করে। কৃপণ হওয়া ছাড়াও চাচার আরেকটা দোষ আছে। তিনি কেন যেন বাচ্চা কাচ্চাদের একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। গ্রামের সকল পুলাপান ই যেন তা শ্ত্রু। তা কেন একটু পরে ই বুঝতে পারবেন। অবশ্য সহ্য না করতে পারা পিছনে আমাদেরও যথেষ্ট অবদান আছে। সুযোগ পেলে আমরাও জ্বালাতন করতে ছাড়িনা।
সেলিম, মানে আমাদের লেকো চাচা তাঁর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁর বাবাও এলাকার অনেক ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তবে শেষ বয়সে অসুখে পরে কিছু সম্পত্তি কমিয়ে গেছেন। তবে তাতে কিছু হয়নি এখনও অঢেল আছে। পৈতৃকসূত্রে সেলিম চাচা সে সম্পত্তির মালিক হন। কেমন জানি কাকতালীয় হলেও সত্য যে লেকো চাচা আরে থুক্কু সেলিম চাচার ও এক ছেলে। তাঁর নাম আরিফ। একটু আবুল টাইপের তাই আমরা সবাই তাকে গামা আরিফ বলে ডাকি। বয়সে আমাদের থেকে দুই-এক বছরের বড় হবে। সে ও বাবার মতো ই কিপটে। ও ভূলে ই গিয়েছিলাম সেলিম চাচার অন্য আরেকটা গুণ আছে তা হলো যে কাজটা করতে ১০ টাকা লাগে তিনি সে কাজটা ৭ টাকায় করার চেষ্টা করেন। আর না পারলে নিজেই কাজটা করার চেষ্টা করলেন। অনেকের কাছে অজানা হলেও সত্য গ্রামের হাটবাজার একটু সকালে বসে। তো ওই দিন সকালবেলা বাজারে যাচ্ছি একটু সামনে গিয়ে দেখলাম গ্রমের বড় তেতুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে লেকো চাচা। সালাম দিলাম,তবে উত্তর নিল কিনা জানিনা কারন আমার মনে হয় তিনি আমাকে দেখেও দেখেননি। তবে পাত্তা না দেওয়ার পিছনে আরেকটা কারণ আছে। সে এক কেলোর কীর্তি। কি সে কেলোর কীর্তি কি আবার স্মরণ করব?আচ্ছা আপনাদের মন যেহেতু চাইছে তাহলে স্মরন করা ই যাক। গত জুম্মার দিন সকাল বেলা সাইকেল করে বাজারে যাচ্ছিলাম,আমাদের বাড়ি থেকে বের হলেই রাস্তা। রাস্তাটার পাশেই বড় একটা পুকুর। যেহেতু বর্ষার দিন পুকুর পানিতে টুইটুম্বুর। রাস্তায় উঠতেই সামনে দেখলাম মস্ত এক ট্রাক। সত্য বলতে সাইকেল আমি তেমন ভাল পাড়ি না তাও আবার এক ভাঙ্গারী টাইপের সাইকেল। ট্রাক দেখে সাইকেল আস্তে চালাচ্ছি,সামনেই দেখি লেকো চাচা। রাস্তাটা এতই সরু ছিল যে পুকুরের পাশে গিয়ে ট্রাক একপাশে আর লেকোচাচা পুকুরের পাশ দিয়ে আসছে। ভয়ে আমার হাত পা কাপতে শুরু করল সাইকেল ও কাপছিল। কিছু বুঝে উঠার আগের লেকো চাচা মারলেন পানিতে ঝাঁপ। আর আমাকে সে কি গালি। আসলে সাইকেল লেগে যাওয়ার ভয়ে —। ওই দিন বিকেল বেলা জগাদের মাঠে খেলতে গেলাম,জগা আসলে আমাদের এক বন্ধুর নাম-ভালো নাম জসিম। ক্রিকেট আমার প্রিয় খেলা,এ খেলায় করিনা কোন হেলা। সবার সাথে অনেকটা যুদ্বের মধ্য দিয়েই অপেনিং এ আমি। সবাই প্রায়ই নিশ্চিত ছিল যে প্রথম বলেই আমি——। হ্যা সত্যিই ভাবছেন; সবার মন রাখতে গিয়ে প্রথম বলেই আউট। তবুও বাঙালির পরিচয় রক্ষার্থে একটু কথা-কাটাকাটি করে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কে আর শুনে । মাঠের বাইরে বসে ভাবছিলাম আমার পরে যে নামবে সে যেন প্রথম বলেই আউট হয়। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আতিক এর ছক্কা আর বল লেকো চাচার চালে। বল টিনের চালে পরে শব্দ হওয়ার আগেই লেকো চাচার শব্দ শোনা যায়। মুহূর্তে সবাই উধাও যেন কেও এখানে ছিল ই না। আমি মাঠের পাশের তাল গাছটার আড়ালে,মাঠে কেউ নেই। লক্ষ্য করে দেখলাম মাঠের এক কোণে পরে আছে আমার নীল জুতা-জুড়া। বল হাতে সেলিম চাচা মাঠে আর ভদ্র ভাষায় সে কি গালি। আমার তো মনে হয় লেকো চাচা উও পেতে ছিলেন কোন সময় আমাদের বলটা যাবে আর সে তাঁর গালি আর উপদেশ এর মেশিন চালু করবেন। ফিরে ই যাচ্ছিলেন,কিভাবে চোখ পড়ল আমার জুতা জুড়ার দিকে। তখনই ভেবে নিয়েছিলাম ঊনিশতম বলটার সাথে আমার জুতা জুড়াও গেল। আমার চিন্তা আবার মিথ্যা হয় কিভাবে,খাপে খাপ-জরিনার বাপ। এবারের জুতা-জোড়া ও লেকো চাচার চুলায়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখলাম ঘরের সবাই নিস্তব্দ। প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম এটা ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থা। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে না ঢুকতেই বাবার ডাক পড়ল। আস্তে-আস্তে গিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াতেই দেখি বাবা রেগে লাল হাতে বাশের মস্ত এক খাপড়া,কিছু বুঝে উঠবার আগেই মারলেন একটা। আরেকটা মারার আগেই দাদি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর বাবাকে নানান কথা বলতে লাগলেন।
বাবা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন আমিও রাগ করে জগাদের আমতলায় বসেছিলাম,একটু পরে নিবু-নিবু হারিকেন হাতে মা আর দাদি এলেন। তখন জানতে পারলাম লেকো চাচার নালিশে ই বাবা এত রেগেছেন। যাইহোক তাঁরপর কেটে গেল অনেক দিন। ওই মাঠে আর খেলতে ও যাই না। সেবার ইদের দশ দিন আগে স্কুল বন্ধ দেয়। ইদের আগের রাত যাকে গ্রামে মূলত সবাই চান রাইত বলে ডাকে্। সব বন্ধুরা মিলে ওই রাতে গঞ্জ থেকে পটকা বাজি কিনে আনলাম। ও আরেক কথা ভূলে ই গিয়েছিলাম চলুন পরিচয় করা যাক গুগলির সাথে। আরে নাহ—গুগলি হলো সেলিম চাচার ষাড়ের নাম। দেখতে বাঘের মতো মনকাড়া লাল। প্রথম পটকাটা ফোটাতেই যেন আনন্দের শুরু কিন্তু ভাবতেও পারিনি যে আনন্দটা বেশিক্ষণ এর নয়। গ্রামের মোড় থেকে পটকা ফোটাতে-ফোটাতে গ্রামের ভিতরে আসছিলাম। কে জানত যে লেকো চাচার বাড়ির সামনে ফোটানো দুটি পটকা-বাজি ই আমাদের আজকের আনন্দের শেষ। পটকা দুটো ফুটতেই লেকো চাচা্র গোয়াল ঘর থেকে গুগলি তেড়ে আমাদের দিকে। সবাই ভয়ে এক দৌড়। একটু পরেই গ্রামের অর্ধেক মানুষ লেকো চাচার বাড়িতে। গুগলি নাকি হারিয়ে গেছে,আশেপাশেরক সকল গ্রামে খোজা হয়েছে কোথাও পওয়া যায়নি। নিশ্চিত ছিলাম এবার কাল সকালে দড়বার জমবে আর বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবেন। তখনই বাড়িতে গিয়ে কাথার নিচে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ভয়ে পা চলছিল না। এমন সময় বাবা ডাকলেন চল তোর সেলিম চাচার গরুটা পাওয়া গেল কি না দেখে আসি।
চললাম বাবার সাথে সেলিম চাচার বাড়ি আর মনে-মনে ভাবছিলাম আজ বাড়ি থেকে বেড়োতেই হবে। গিয়ে দেখি সেলিম চাচা দুয়ারে বসা আর লোকজনের সাথে বলছে আমার কপালের দোষ গুগলিটা কয়েক দিন ধরেই পাগলামি করছিল কেন যে আমি ছিড়া দড়িটা দিয়ে বাধতে গিয়েছিলাম। চাচার কথা শুনে যেন কলিজায় পানি এলো। ইদের নামাজ শেষে লেকো চাচা আমাদেরকে পাচশত টাকা দিয়ে বললেন যা তোরা মজা কিনিস আর বল কিনে মাঠে খেলতে যাইস। আমিতো পুরাই থ! কেমনে কী যে লেকো চাচা আমাদের সহ্য ই করতে পারতেন না সে আজ,–সবাই বলাবলি করছিল লেকো চাচার মগজ গেল নাকি??সেদিন সবাই ঠিক করলাম বিকেলে খেলার পর গুগলিকে খুজতে বেড়োব।
একটু পরে দেখলাম সেলিম চাচার বাড়িতে বহু লোকের ভিড় এগিয়ে গিয়ে দেখি গুগলি ফিরে এসেছ।
সেলিম চাচা আর আগের মত নেই । আমাদের সকলকে অনেক স্নেহ করেন। বিকেল বেলা আমরা মাঠে খেলার সময় মাঠের কোনে বসে গুগলিকে ঘাস খাওয়ান এবং আমাদের খেলা দেখেন……।