অ্যাডাম গ্রান্ট এর গিভ এন্ড টেক

দেয়া নেওয়া শব্দ দুটো আমাদের বেশ পরিচিত। আমরা প্রতিনিয়ত এই দেয়া নেয়ার হিসেব কষতে থাকি।কিন্তু যদি বলি যে এত হিসেব করার কোন প্রয়োজন নেই, এর বেশ সহজ কটা সূত্র আছে! এই সূত্র গুলি নিয়েই বই লিখেছেন তরুণ মনস্তাত্ত্বিক অ্যাডাম গ্রান্ট। গিভ অ্যান্ড টেইক।

প্রচলিত ধারণামতে খুব সফল মানুষদের মধ্যে তিনটি গুণ দেখা যায় আকাংখা, যোগ্যতা ও সুযোগ। কিন্তু অ্যাডামের মতে আর ও একটি প্রয়োজনীয় উপাদান থাকে যা অবহেলিত। সেটি হচ্ছে মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।

এব্যাপারে আলোকপাত করলে দেখা যায় যে পৃথিবীতে তিন ধরনের মানুষ দেখা যায়।
টেকার : যারা যতটা দেয় তার চেয়ে নেয় বেশি।তারা বিশ্বাস করে পৃথিবী শুধুই প্রতিযোগিতামূলক। সফল হতে গেলে নিজেদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। সব কৃতিত্ব একা নিতে হবে। তবে তারা শুধুই যে নেতিবাচক তা কিন্তু নয়, তারা শুধু অন্যের উপর নিজের ভাল টা বিশ্বাস করতে পারেনা।

গিভার: কর্মক্ষেত্রে এরা প্রায় দুর্লভ প্রজাতি। এদের মনোযোগ থাকে অন্যদের কি দরকার তারউপর।

যদি কেউ টেকার হয় তো তিনি অন্যকে সাহায্য করেন নিজের লাভলোকসান মেপে। অন্যদিকে যদি গিভাররা লাভ খুজবেন, তবে নিজের নয়, যাকে সাহায্য করছেন তার।অনেক সময় নিজেকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। মার্গারেট ক্লার্কের গবেষণায় দেখা গেছে কাছের মানুষদের জন্য বেশিরভাগ মানুষ গিভারের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এই সম্পর্ক বেশ জটিল পর্যায়ে। খুব কম সংখ্যক মানুষই কর্মক্ষেত্রে গিভারের ভূমিকা পালন করে। অনেকেই তখন তৃতীয় পন্থা অবলম্বন করেন। ম্যাচার্স। এরা ব্যাস্ত থাকে দেনাপাওনার ভারসাম্য বজায় রাখতে। যদি কেউ ম্যাচার হন তো তিনি বিশ্বাস করবেন, ইট মারলে পাটকেল টি ক্ষেতে হবে। তাদের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয় সুবিধা আদান প্রদানের বিনিময়ে।

পেশাগতভাবে এই তিন পদ্ধতির নিজস্ব সুবিধা অসুবিধা আছে।কিন্তু একটি অন্য দুটির চেয়ে ব্যয়বহুল প্রমাণিত হয়। গবেষনায় দেখা গেছে গিভাররা সফলতার
সিড়িতে সবার নিচে থাকে। বিশাল পরিসরে গুরুত্বপূর্ন পেশাগুলিতে গিভাররা প্রতিকূল অবস্থায় থাকে। তারা বাকিদের সঙ্গতিসম্পন্ন করতে গিয়ে নিজেদের সফলতা জলাঞ্জলি দেয়।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সফলতার সিড়ির উপরেও থাকে গিভাররাই। তাহলে আমরা কর্মক্ষেত্রে দেয়ার স্বভাব কে সীমাবদ্ধ করার প্রবণতা দেখতে পাই কেন?

টেকাররা প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের প্রিয়পাত্র হতে চায় এবং তাদের আকাঙ্খা পূরনে তারা প্রসংশা ও মোহনীয়তার আশ্রয় নেয়।
এবং তারা প্রথম সাক্ষাতেই বেশ উজ্জ্বল প্রভাব ফেলে।

একদল জার্মান মনোবিজ্ঞানী দেখা গেছে অপরিচিতরা তাদেরই বেশি পছন্দ করে যারা নিজেদের মধ্যে একধরনের অহংবোধ লালন করে এবং অন্যদের শোষণ ও কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা রাখে । এই জন্যই স্যামুয়েল জনসন বোধ হয় লিখেছেন ” একজন মানুষের সত্যিকার মানদণ্ড হচ্ছে তার ব্যবহার ঐসব মানুষদের সাথে যারা তার কোন কাজে আসবেনা।” সাবেক এ্যাপল কর্মকর্তা ও সিলিকন ভ্যালি কিংবদন্তি গাই কাওয়াসাকি এর মতে কোন মানুষের সাথে দেখা হলে সে যাই হোকনা কেন প্রথম চিন্তা হওয়া উচিৎ ‘ কিভাবে আমি এই মানুষটিকে সাহায্য করতে পারি?’

বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ব্রায়ান লিটল এর মতে গিভাররা pronoia তে ভোগেন। pronoia হলো ভ্রান্ত বিশ্বাস, যে অন্য্রা তোমার পেছনে ভাল ভাল কথা বলছে আর সর্বদা তোমার ভাল চিন্তা করছে। এটি paranoia এর বিপরীত।

গ্রান্টের মতে নেটওয়ার্ক হওয়া উচিৎ এমন এক ট গাড়ি যা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, নাকি এমন কিছু যা আমরা শুধু নিজেদের জন্য রেখে দিবো। আর গিভাররা সব সময় দলগত সার্থ আগে দেখে। সহকর্মীদের সাহায্য করতে হলে নিজের প্রসঙ্গ থেকে সরে আসতে হবে। জন মেয়ারের মতে প্রশ্ন করতে হবে আকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে সে এমন অবস্তায় কি অনুভব করছে।
আবার গিভাররা যখন উপদেশ চায় তখন তাদের মাথায় এটা মোটেও থাকেনা যে তারা নিজেদেএ দুর্বলতা প্রকাশ করছে। তারা প্রকৃত পক্ষেই নিজেদের উন্নতি করতে ব্যাস্ত। ম্যাচাররা অন্যদিকে নিজেদের নিবৃত করে এই ভেবে পাছে তাদের বিনিময়ে কিছু দিতে হবে।

তবে গিভারদের মধ্যে ভেদাভেদ আছে, একদল এক্কেবারে উপরে আরেকদল মহাতলে। এরা হলো যথাক্রমে অন্যরকম গিভার আর নিঃসার্থ গিভার। সফল গিভাররা অন্যদের প্রতি যত্নশীল ও সাহায্যকারী হলেও তাদের নিজেদের লক্ষ্য ও আকাংখা থাকে।
তবে মানুষ তখনি কোন কাজে যত্নশীল হয় যখব দেখে যে তাদের কাজ ফলপ্রসূ হচ্ছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে মানুষ রা দেয় বেশি তাদের আয় ও বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে দেয়ার স্বভাব মানুষ কে সুখী করে, অনুপ্রাণিত করে আর ও বেশি পরিশ্রমী হওয়ার এবং আর ও বেশি আয় করার।
এই জন্যই গিভাররা সহজে কাজে অবসন্নতা যার ইংরেজি নাম burnout এর শিকার হননা। দেয়ার মাধ্যমে তারা একধরনের সংকল্প ও সুখের আশ্রয় পায় যার পথ ম্যাচার বা টেকার রা পায়না।
অন্যরকম গিভার চাকুরীজীবিরা টেকসই অবদান রাখেন বেশি, নি:সার্থ গিভার, টেকার বা ম্যাচারদের তুলনায়।
বিদ্রুপাত্মক হলেও সত্যি, নিজেদের আকাঙ্খার প্রতি সচেতন থাকায় অন্যরকম গিভারদের শক্তি সঞ্চিত থাকে, যার কারনে তারা নি:সার্থ গিভারদের তুলনায় বেশি দিতে পারে। এটাই অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী হার্বাট সিমন পর্যবেক্ষণ করেছেন।
“The intelligent altruists, though less altruistic than the unintelligent altruists, will be fitter than both unintelligent altruists and selfish individual.”

এটা সত্যি কখনো কখনো গিভাররা টেকারদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু অন্যসব প্ররিস্থিতিতে গিভাররা তাদের দাক্ষিণ্য ফিরে আসতে দেখে, এমন কি তা বাড়তেও দেখে। তবে এখানে বলতে হয় কখনো ভাল কাজ না ভোলা এবং আকস্মিক ত্রুটি মাফ করে দেওয়ার নীতি কার্যকর বেশি।
গিভাররা সাধারণত নিজেদের আকাঙ্খাকে গুরুত্ব দিতে কুন্ঠাবোধ করে তবে এই অসুবিধা ও নিমিষেই মিটে যায় যখন গিভাররা উঁচু লক্ষ্য ঠিক করে এবং তার পেছনে লেগে থাকে। তাদের জন্য এটা আর ও সহজ হয় যখন তারা অন্যকারো পক্ষ হয়ে কাজ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে সে সব দলে মানুষ রা সুখী যেখানে নিজস্বতা ও একইসাথে একাত্বতা প্রকাশ করা যায়। এই গুলো সেই জায়গা যা মানুষ মুল্যায়ন করে বেশি।

স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক সিয়ালভিনি গবেষণায় দেখতে পান যে সেই সব জায়গায় দান বেশি পাওয়া যায় যেখনে লেখা থাকে ‘ একটি কড়িও সাহায্য করবে।’ যেখানে মানুষ অন্যদের দিতে দেখে সেখানে মানুষের দান করার সহজাত প্রক্রিয়া তৈরি হয়।এই জন্য ফ্রিসাইকেলের মত সংগঠন গুলি এত জনপ্রিয়।
চার্লস ডারউইন এর মতে যে গোষ্ঠীর লোকেরা গিভারদের মত আচরণ করে এবং সর্বদা ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকে তারাই শেষ পর্যন্ত অন্য গোষ্ঠীর উপর বিজয় লাভ করে এবং এটা হয় একটি প্রাকৃতিক নির্বাচন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ইএম ফস্টার বলেন ” আমি কিভাবে জানবো আমি কে যতক্ষণ না আমি দেখছি আমি কি করেছি”।

সফল গিভারদের ব্যাপারে এটাই আকর্ষণীয় যে তারা সিড়ির উপরে থাকে অন্য কাউকে না নামিয়ে। এবং তাদের পরিসর এমনভাবে বৃদ্ধি করে যাতে অন্যরাও লাভবান হয়। ওয়েনি এবং সেরিল বেকার মন্তব্য করেন যে পারস্পরিকতার ঝলক তৈরির জন্য দরকার অন্যদের সাহায্য করার সাথে সাথে অনুরোধের সূত্র তৈরি করা।

যদিও এ্যাডাম গ্রান্ট তার নিজের গিভার অভিজ্ঞতায় বলেছেন তার ব্যর্থতার কথা, কিন্তু আমার মতে স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ না জিতলেও জীবনের দৌড়ে গ্রান্ট পিছিয়ে নেই মোটেও। মাত্র ২৮ বছর বয়সে একাডেমিক ট্রেনিয়র প্রাপ্ত এই মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়সী ট্রেনিয়র প্রাপ্ত প্রফেসর। গিভ অ্যান্ড টেইক এর বড় প্রমাণ বোধ হয় উনি নিজেই।