কামনা ও লালসার দেবীঃ আফ্রোডাইট

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নিজেদের মনের সূক্ষ্ণ অনুভূতির যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। আর তাই মানুষের নিজস্ব অনুভূতির ব্যাখ্যা হিসেবে কোনো ঐশ্বরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ ই ছিল সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা। এই পটভূমিতে নারী ও পুরুষের প্রেমের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আবির্ভূত হন আফ্রোডাইট। তিনি ছিলেন সৌন্দর্য, কামনা এবং লালসার দেবী।বিশ্বাস করা হয় যে আফ্রোডাইট ছিলেন গ্রীসের সবচেয়ে সুন্দর দেবী।
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে তার অসংখ্য সমতুল্য থাকায় দেবীর রয়েছে একাধিক উৎস। গ্রীকদের মধ্যে তিনি আফ্রোডাইট, সুমেরীয় পুরাণে ইনানা, ফিনিশিয়ানে আস্টার্টে, ইট্রুস্কানে তুরান, অ্যাজটেকে জোচিকুয়েটজাল এবং রোমানে ভেনাস হিসেবে বেশ সুপরিচিত।

আফ্রোডাইট শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ “আফ্রোস(aphros)” থেকে। যার অর্থ সমুদ্র সফেন/ সাগরের ফেনা। তাই স্বভাবতই আফ্রোডাইট এর সাথে সমুদ্রের ফেনা বা সমুদ্রের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। সর্বাধিক পরিচিত সংস্করণগুলোতে বলা হয়েছে, যখন ক্রোনাস তার বাবা ইউরেনাসের কৃতকর্মের ফলাফল হিসেবে হীরার তৈরি কাস্তে দিয়ে তার যৌনাঙ্গ কেটে সমুদ্রে ফেলে দেয় তখন সেখানকার ফেনা থেকে জন্ম হয় আফ্রোডাইট এর। পাফোসের কাছের সমুদ্রের ফেনাতে এ ঘটনা ঘটে তাই দেবীর অনেক ভক্ত ই পাফোসকে তার তীর্থস্থান মনে করেন।
অন্য সংস্করণে, আফ্রোডাইটকে ইউরেনাসের নয় বরং ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন এমন বাচনিক দেবী ডিওনের কন্যা বলা হয়। বলা হয়ে থাকে তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েই জন্মগ্রহন করেছিলেন।
তার কিছু উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা হলঃ
১.নারী পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক(কামুকতা)
২.রিরংসা
৩.লিঙ্গ
৪.সৌন্দর্য
৫.উর্বরতা
৬.প্রজনন।

আফ্রোডাইট এর প্রধান প্রতীকগুলোর মধ্যে রয়েছে মর্টলস, গোলাপ,ঘুঘু,চড়ুই এবং রাজহাঁস।
প্রতিবছর গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় অনুষ্ঠিত হয় তার প্রধান উৎসব অ্যাফ্রোডিসিয়া। এছাড়া তিনি পতিতাদের পৃষ্ঠপোষক দেবী। আর এখান থেকেই গ্রিকো রোমান সংস্কৃতির “পবিত্র পতিতাবৃত্তি” ধারণাটি পরিচিতি লাভ করে। এথেন্স এবং করিন্থিয়ান্স উভয় শহরেই আফ্রোডাইট এর মন্দির ছিল। তবে করিন্থিয়ান্স আফ্রোডাইট এর শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে স্বীকৃত মন্দিরটি ছিল অ্যাক্রোকোরিন্থের শীর্ষে , যা খ্রিস্টপূর্ব 146 সালে রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের আগ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। আফ্রোডাইটের ধর্মের সাথে সমুদ্রের ওতোপ্রোতো সম্পর্ক রয়েছে,এ জন্য তাকে বিভিন্ন সমুদ্রের প্রাণীর সাথে চিত্রিত করা হয়।
আফ্রোডাইট প্রেমের দেবী হলেও এই প্রেম রোমান্টিকতার চেয়ে যৌন আকর্ষণের সাথেই বেশি জড়িত আর এ জন্যই তার ধর্মে কামুকতা একটি মূল উপাসান। তার উপাসনার উদ্দেশ্য নিয়ে মন্দিরগুলোতে বিভিন্ন যৌন ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করা হত। পরবর্তীতে গ্রিকরা নিজেদের সুবিধার জন্য এই ঐতিহ্যের অপব্যবহার শুরু করেছিল। “পতিতাদের” জন্য গ্রীক উচ্চারণ ছিল হাইরোডুলা, যার অর্থ একজন পবিত্র সেবক। মন্দিরগুলিকে পতিতাবৃত্তির স্থান হিসাবে ব্যবহার করার এই প্রথাটি মধ্যপ্রাচ্যের মতো বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃতিতেও চালু ছিল।

আফ্রোডাইট বেশ স্পর্শকাতর এবং আবেগী ধরণের দেবী ছিলেন। কামারদেবতা হেফাস্টাসকে বিয়ে করলেও বিভিন্ন দেবতা ও মানুষের সাথে মিলে বার বার প্রতারণা করেছেন তিনি।যদিও অলিম্পাসে এটা বেশ স্বাভাবিক রীতিই। আফ্রোডাইট এর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এ বিয়ে সম্পন্ন হয়, হেফাস্টাস ছিল খোঁড়া,কুৎসিত,কুঁজোওয়ালা এবং বদমেজাজী ধরণের। বিয়েটা হয় মূলত জিউসের পরিকল্পনায়, আফ্রোডাইটের সৌন্দর্যের কারণে দেবতাদের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ এড়াতে। পৌরাণিক কাহিনীর অন্য সংস্করণ অনুযায়ী,হেফাস্টাসের মা দেবী হেরা সন্তান কুৎসিত হওয়ায় তাকে দেবতাদের আবাসস্থল অলিম্পাস থেকে বহিষ্কার করেন। এ ঘটনার প্রতিশোধস্বরুপ উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন হেফাস্টাস তার জাদুকরী সিংহাসনে হেরাকে আটকে রাখে এবং মুক্তিপণ স্বরুপ আফ্রোডাইটকে বিয়ে করতে চান। হেরা এ শর্ত মেনে নেয় এবং কামারদেবতাকে খুশি করে। কিন্তু সৌন্দর্যের দেবী এতে বেশ অসন্তুষ্টই হন।

সৌন্দর্যের দেবী
সৌন্দর্যের দেবী

 

 

আফ্রোডাইট এবং অ্যাডোনিস

সৌন্দর্যের দেবীর ছিল অনেক প্রেমিক তাদের মধ্যে যুদ্ধ দেবতা অ্যারেস ছিলেন অন্যতম। হেফাস্টাস স্ত্রীর অবিশ্বস্ততা সম্পর্কে সূর্যদেবতা হেলিওসের মাধ্যমে জানতে পারেন তাই তিনি অ্যারেস এবং আফ্রোডাইটকে হাতেনাতে ধরে লজ্জা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন যা তাদের এতোটা বিব্রত করবে যে তারা আর একত্রিত হওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকবে। পরিকল্পনা মোতাবেক একটি অদৃশ্য জাল তৈরি করেন যে জাল এ বাধা পরলে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা মানুষ বা দেবতা কারোর ই ছিল না। হেফাস্টাস রাতে জাল বিছিয়ে চলে যান এবং পরদিন সূর্যোদয়ের সময় ফিরে এসে স্ত্রী এবং তার প্রেমিককে জালে বন্দী করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অ্যারেস ছিল খুবই ধূর্ত প্রকৃতির, তাই আবিষ্কৃত হওয়া এড়াতে বাড়ির দরজায় তার এক প্রহরী ইলেক্ট্রিয়নকে রেখেছিলেন যেন সে সূর্যোদয়ের মুহূর্তে অ্যারেসকে অবহিত করতে পারে।কিন্তু ইলেক্ট্রিয়ন ঘুমিয়ে পরায় অ্যারেস আফ্রোডাইটের সাথে যৌনমিলনরত অবস্থায় ধরা পরে যায়। এসময় হেফাস্টাস সমস্ত দেবতাদের ডেকে আনলে তারা আফ্রোডাইট এর নগ্ন সৌন্দর্য উপভোগ করেন এবং তার প্রশংসা করতে থাকেন একইসাথে তারা হেফাস্টাসকে নিয়ে নানারকম মজা করে।আর এভাবেই হেফাস্টাস অবিশ্বস্ত স্ত্রীকে লজ্জা দিতে গিয়ে নিজেই সকলের সামনে লজ্জায় পরে যান। অ্যারেস এবং আফ্রোডাইট প্রতিজ্ঞা করে তারা আর কখনো ঘনিষ্ঠ ভাবে কোথাও মিলিত হবে না।কিন্তু পরবর্তীতে তারা এ প্রতিজ্ঞা বার বার ভঙ্গ করেন। এদিকে ইলেক্ট্রিয়নের ঘুমের কারণে অ্যারেস এভাবে ধরা পরায় অ্যারেস তাকে মোরগ বানিয়ে দেয়,যেন সে কখনোই সূর্যোদয়ের ঘোষণা করতে ভুলে না যায়। আর এভাবেই গ্রীক পুরাণে মোরগের সকালে ডেকে ওঠার মতো ঘটনার ও ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়।
অ্যারেসের সাথে আফ্রোডাইটের বেশ কয়েকজন সন্তান হয় যাদের মধ্যে রোমান্টিক প্রেমের দেবতা ইরোস অন্যতম। বলা হয় ইরোস ভালবাসার তীর নিক্ষেপ করে মানুষকে প্রেমে পরতে বাধ্য করে।
এছাড়াও আফ্রোডাইট এর আরেকজন প্রেমিক ও ছিল যার নাম অ্যাডোনিস। অ্যাডোনিসের জন্মের বেপারেও আফ্রোডাইটের ভূমিকা ছিল।সাইপ্রাসের রাজা সিনিরাসের মেয়ে মিররা ছিলেন খুব সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী যুবতী।কিন্তু মিররার মা দাবী করতেন, মেয়েটি না কি আফ্রোডাইটের চেয়েও বেশি রূপবতী। এ ঘটনায় আফ্রোডাইট অনেক বেশি ক্রোধান্বিত হন এবং প্রতিশোধ নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর তার প্রতিশোধপরায়নতার জন্য তিনি মিররার মনে তার পিতার প্রতি লালসা সৃষ্টি করেন।মিররা পিতার কাছে প্রত্যাখ্যাত হলে পতিতার ছদ্মবেশ নেয় এবং পিতার সাথে মিলিত হয়। পরবর্তীতে এই মিলনের ফলে জন্ম নেয় অ্যাডোনিস। এদিকে সিনিরাস এ বেপারে জানতে পেরে ক্রোধিত হন এবং মেয়েকে মারতে উদ্যত হন,এসময় মেয়ে দেবতাদের কাছে বাঁচার জন্য সাহায্য চাইলে তাকে একটি গাছে পরিণত করা হয়। এদিকে সিনিরাস তার পরিবারের সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করে। মিররার এই শিশুটিরই নাম ছিল অ্যাডোনিস।আফ্রোডাইট শিশুটিকে দেখে সেখান থেকে বের করে আনার সিদ্ধান্ত নেন এবং পার্সেফোন ও হেডিস এর কাছে নিয়ে যান। এও বলেন যে অ্যাডোনিস বড় হলে তাকে নিয়ে যাবেন। অ্যাডোনিস বড় হলে বেশ সুদর্শন যুবকে পরিণত হন।পার্সেফোন তাকে নিজের কাছে রাখতে চাইলে আফ্রোডাইট ও পার্সেফোন এর মাঝে বিবাদ সৃষ্টি হয়। জিউস দ্বন্দ এড়াতে সিদ্ধান্ত নেন যে অ্যাডোনিস বছরের এক তৃতীয়াংশ আফ্রোডাইটের সাথে এক তৃতীয়াংশ পার্সেফোনের সাথে এবং বাকিটা নিজের ইচ্ছামতো যেকোনো দেবীর সাথে কাটাতে পারবে।
অ্যাডোনিস বছরের প্রথমভাগ আফ্রোডাইট এর সাথে, ২য় ভাগ পার্সেফোনের সাথে এবং ৩য় ভাগ আফ্রোডাইটের সাথে কাটাতে শুরু করেন। যা একইসাথে পার্সেফোন এবং অ্যারেসকে ক্রুদ্ধ করে। অ্যাডোনিসের ছিল শিকারের প্রতি অনেক টান, কিন্তু আফ্রোডাইট এই বেপারে তাকে সতর্ক করেন এই বলে যে, যে জন্তু ভয় পায় না তার সাথে কখনো লড়াই করতে যাবে না। কিন্তু এক অতিকায় শুয়োরকে দেখে অ্যাডোনিস প্রেমের দেবীর উপদেশ ভুলে ওই শুয়োরের সাথে যুদ্ধ করতে যায় এবং মারা যায়। এই দৈত্যাকার শুয়োর ছিল আসলে যুদ্ধদেবতা অ্যারেস।

আফ্রোডাইট তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেও সঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারায় সফল হতে পারেন নি। পরে অ্যাডোনিস আবারো আন্ডারওয়ার্ল্ডে ফিরে গেলে আফ্রোডাইট পার্সেফোনের সাথে দ্বন্দে জড়ালে জিউস হস্তক্ষেপ করেন এবং নতুন সিদ্ধান্ত হয় অ্যাডোনিস পার্সেফোনের কাছে বছরের ৬ মাস এবং আফ্রোডাইটের কাছে ৬মাস থাকবে। এ সিদ্ধান্ত আগের চেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত ছিল।
আফ্রোডাইটের গল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত গল্প ট্রোজান যুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে।
পেলিউস এবং থেটিসের বিয়েতে শুধুমাত্র অ্যারেসকে ছাড়া সমস্ত দেবতাকে দাওয়াত দেওয়া হয়। এ ঘটনায় এরিস ক্ষুব্ধ হন এবং লুকিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করে একটি সোনার আপেল দেবী আফ্রোডাইট, হেরা এবং এথেনার মাঝে ছুড়ে ফেলে দেন যাতে লেখা ছিল kallistēi যা দ্বারা সবচেয়ে সুন্দরের জন্য বুঝানো হয়।
আর এই আপেলের জন্য স্বভাবতই তাদের মধ্যে কার জন্য এই আপেল তা নিয়ে ঝগড়া লাগে এবং তা সমাধানের জন্য জিউসের কাছে যায় , এবং যে কাউকে বেছে নিতে বলে।জিউস তাদের প্যারিসের কাছে যেতে বলেন।

প্যারিসের সিদ্ধান্তের আগে তিন দেবীই তাকে বিভিন্ন পুরস্কারের লোভ দেখান এবং শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর মুকুট নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
হেরা তাকে বলেছিল,যদি সে তাকে বেছে নেয় তবে সে তাকে একটি অবিশ্বাস্য রাজ্য ;এশিয়া মাইনর দেবে। এথেনা তাকে সমস্ত জ্ঞান, খ্যাতি এবং গৌরব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল যা প্যারিস আকাঙ্ক্ষা করেছিল। কিন্তু আফ্রোডাইটই একমাত্র দেবী যিনি তার কানে ফিসফিস করে বলেছিলেন তার সত্যিকারের ইচ্ছা, তিনি তাকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নশ্বর নারী প্রদান করবেন। প্যারিস আফ্রোডাইটকে বেছে নিয়েছিল এবং তিনি তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তাকে হেলেন দিয়েছিলেন।এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে অন্য দুই দেবী প্যারিসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্বরূপ ট্রোজান যুদ্ধকে উস্কে দেন।
এছাড়াও আফ্রোডাইটকে নিয়ে নানা রকম গল্প প্রচলিত রয়েছে। যা সম্পর্কে আমরা পরে জানব।