জিউস আরো অনেকের প্রতিই আকর্ষিত ছিলেন। তাদের পাওয়ার জন্য যেকোনো পন্থা বেছে নিতে তার বাঁধত না। আর এমনই কিছু সম্পর্কের কথা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
ডিমিটার ছিলেন শস্য এবং উর্বরতার দেবী এবং জিউসের বোন। ডিমিটারের সৌন্দর্য ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর। আর এ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন জিউস। বোনকে প্রস্তাব দেন শারীরিক সম্পর্কের। ডিমিটার তাতে স্বভাবতই রাজি হন নি। এরপর জিউস এক ফন্দি আঁটলেন। সাপ বেশে মিলিত হন মতান্তরে ধর্ষণ করেন ডিমিটারকে। এ মিলন থেকে জন্ম হয় পার্সেফোনের। মায়ের মতোই অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। পার্সেফোন সম্পর্কে জ্যোতিষশাস্ত্রের টাইটান দেবতা অ্যাট্রিয়াস ২টি ভবিষ্যৎ বাণী করেনঃ
১.তার সতীত্ব হঠাৎ করে গোপনে চুরি করা হবে এবং
২.তার ভবিষ্যৎের স্বামী তাকে অপহরণ করবে।
এ ভবিষ্যৎবাণী শুনে ডিমিটার বেশি ভীত এবং চিন্তিত হয়ে পরলেন এবং মেয়েকে ইতালির সিসিলিতে অবস্থিত এক গুহায় গোপনে লুকিয়ে রাখলেন। পার্সেফোন গুহার গভীর অংশে বড় হতে থাকলেন। গুহার মুখে থাকত ভয়াল এবং বিশালদর্শন ড্রাগন। তাই ডিমিটার বেশ নিশ্চিন্তেই কৃষি দেবীর দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন। এ অবস্থায় একদিন কামনা ও লালসার গ্রীক দেবী আফ্রোদিতি এবং তার পুত্র ইরোস ভাবলেন তাদের শক্তি সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করার ক্ষেত্রে পার্সেফোনের চেয়ে ভাল বলির পাঁঠা আর কেউ হতে পারে না। কারণ পার্সেফোনকে সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল,ইরোস তার ভালবাসার তীর দিয়ে সব দেবতাকেই পার্সেফোনের প্রেমে ফেলতে পারেন। আর যেমন ভাবা তেমন কাজ। তীরের প্রভাবে সকলেই পার্সেফোনের প্রতি আকৃষ্ট হন,সকলেই পার্সেফোনকে বিয়ে করার জন্য ডিমিটারের কাছে মেয়ের জন্য নানা ধরণের উপহার পাঠাতে লাগলেন। কিন্তু কোনো প্রস্তাবেই মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হলেন না মা ডিমিটার । এদিকে ইরোসের তীরের প্রভাব থেকে বাদ যাননি স্বয়ং দেবরাজ এবং পার্সেফোনের পিতা জিউস। পার্সেফোনের রূপের কারণেই হোক বা ইরোসের তীরের কারণেই হোক,জিউস পার্সেফোনকে কামনা করতে লাগলেন। কিন্তু হেরার ভয়ে তিনি সরাসরি পার্সেফোনের কাছে যেতেও পারছিলেন না। কিন্তু একদিন হেরা একটা কাজে অলিম্পাসের বাইরে যাওয়ায় সুযোগ এসে গেল জিউসের হাতে। তিনি নিজেকে একটি ড্রাগনে পরিণত করলেন এবং পার্সেফোনের গুহামুখের ড্রাগনদের ঘুম পাড়িয়ে গুহায় প্রবেশ করলেন। গুহায় তখন পার্সেফোন ফুল নিয়ে খেলা করছিলেন। এসময় জিউস পার্সেফোনকে প্রলুব্ধ করেন এবং পার্সেফোনের সাথে মিলিত হয়। অর্থাৎ প্রথম ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়ে গেল। তাদের এই মিলন থেকে এক শিশুর জন্ম হয় যার নাম জাগ্রিয়াস। জাগ্রিয়াসের জন্মের পর জিউস তাকে অলিম্পাসে নিয়ে গিয়ে তার সিংহাসনে বসান। জন্মসূত্রেই জিউসপুত্র পেয়েছিল বজ্র নিক্ষেপ করার ক্ষমতা। এছাড়াও জিউসের আরো অনেক গুণই তার মধ্যে দেখা যেত। হেরা তার স্বভাব অনুযায়ী ই জাগ্রিয়াসকে ঘৃণা করতে লাগলেন। তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। এ কাজে তিনি ব্যবহার করলেন কিছু টাইটান কে। টাইটান রা শিশু জাগ্রিয়াসকে কিছু খেলনা দেখিয়ে বলল,” হে বালক! যদি তুমি এ খেলনা গুলো নিতে চাও তাহলে বজ্র তৈরির ক্ষমতা আমাদের দিয়ে দাও। ” জাগ্রিয়াস কিছু না ভেবেই টাইটানদের হাতে তার ক্ষমতা তুলে দিলেন। আর তারপর শক্তিহীন শিশুটিকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে তারা। শুধু তার ছোট্ট হৃদয়টায় টিকে ছিল।
এ ঘটনায় জিউস অত্যন্ত ক্রোধিত হন এবং হৃদয়টি কুড়িয়ে নিজের কাছে রাখেন।
এর কিছুদিন পর দেবরাজ জিউস আবারো মর্ত্যের এক নারীর রূপে মুগ্ধ হন। এ নারী আর কেউ না রাজা ক্যাডমাসের কন্যা সেমেলে। অনেকে বলেন,সেমেলে জিউসের জন্য একটি ষাঁড় বলি দেওয়ায় সেমেলের প্রতি আকৃষ্ট হন জিউস। এবার দেবরাজ নিজেকে এক রূপবান যুবকে পরিণত করে সেমেলেকে তার প্রেমে পরতে বাধ্য করেন। নিয়মিত মিলনে অচিরেই সেমেলে গর্ভবতী হয়ে পরেন। হেরা সর্বদায় জিউসের এ ধরণের প্রেমিকাকে নিজের শত্রু মনে করতেন এবং তাদের ক্ষতি করার জন্য উঠে পরে লাগতেন। এ ঘটনায় হেরা খুব ক্রুদ্ধ হন এবং সেমেলেকে শায়েস্তা করার ফন্দি আঁটেন। জিউস পত্নী হেরা সেমেলের কাছে বৃদ্ধা প্রতিবেশী রূপে হাজির হন। এবং আস্তে আস্তে নিজেকে সেমেলের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বন্ধু হিসেবে পরিণত করেন। হেরা কিন্তু আস্তে আস্তে সেমেলের মনে সন্দেহের বীজ বুনে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হেরা সেমেলের মনে জিউসের দেবত্ব নিয়ে সন্দেহ ঢোকান এবং বলেন,”মা! তুমি এক কাজ করো, তোমার প্রেমিককে তোমার সামনে স্বরূপে আবির্ভূত হতে বলো। তাহলেই বোঝা যাবে সে মানুষ না কি দেবতা। ” সেমেলে হেরার কথায় প্রভাবিত হয়ে একদিন রাতে দেবরাজের কাছে আবদার করেন যে তিনি তাঁকে পূর্ণরূপে দেখতে চান। জিউস বেশ ভালভাবেই জানতেন কোনো নশ্বর মানুষ দেবতার পূর্ণরূপ দর্শন করলে তাকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে যায়। তার তিনি এ কাজ থেকে সেমেলেকে বিরত করার চেষ্টা করলেও সেমেলে তাঁর জেদ বজায় রাখেন। ফলে জিউস দেবতারূপে আবির্ভূত হন এবং সেমেলে তাঁর তাপে ভস্ম হয়ে যান। এসময় জিউস সেমেলের গর্ভ থেকে শিশুটিকে বের করে নেন এবং জিউসের ইচ্ছায় শিশুটি পূর্ণরূপে জন্ম লাভ করে।
এ শিশুটির নাম ডায়োনিসাস। তিনি ছিলেন মদ উৎসব ও আনন্দের দেবতা।
অন্য কিছু সংস্করণ অনুযায়ী, সেমেলে হেরার প্ররোচনায় জিউসের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জানান এবং এতে জিউস ক্রুদ্ধ হয়ে সেমেলেকে ভস্ম করে দেন। এ সময় হার্মেস সেমেলের ভ্রূণটিকে রক্ষা করেন এবং জিউসের উরুতে স্থাপন করেন। তিনমাস পর,জিউসের উরুভেদ করে জন্ম হয় সেমেলির পুত্র ডায়োনিসাস। আর জাগ্রিয়াসের হৃদয় তখনো জিউসের কাছে থাকায় অনেকে পার্সেফোনের সাথে ডায়োনিসাস এর একটি বাঁকানো সম্পর্কের কথা চিন্তা করেন।
লেটো ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ টাইটান। জিউসকে ভালবেসেছিলেন তিনি। তাদের মিলনে লেটো গর্ভবতী হন। এতে হেরা স্বভাবতই ক্রুদ্ধ হন এবং লেটোকে অভিশাপ দেন,”সূর্যের আলো যতদূর পর্যন্ত প্রতিফলিত হয় ততদূর পর্যন্ত কোনো স্থানে সন্তান প্রসব করতে পারবি না তুই!” যখন লেটোর প্রসব বেদনা উঠল তখন প্রসবের জন্য কোনো জায়গা খুঁজে পেলেন না তিনি। তাঁর এ হাহাকারে জিউসের ও কষ্ট হতে লাগল। তিনি তাঁর ভাই এবং সমুদ্রদেবতা পোসাইডন এর কাছে সাহায্য চাইলেন। জিউসের অনুরোধে ঢেউ দিয়ে ঢেকে দিলেন ডেলোস দ্বীপকে। এ জলের নিচে সন্তান প্রসব করলেন লেটো। জমজ সন্তানের মধ্যে প্রথম জন্মাল আর্টেমিস যিনি হলেন চন্দ্রদেবী, এবং আর্টেমিস তার ভাই অ্যাপোলোর জন্মের সময় ধাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
স্মৃতির টাইটান দেবীর নাম হল নেমোসিন। জিউস নেমোসিনের উপর আকৃষ্ট হন এবং একজন রাখালের বেশে তাঁকে প্রলুব্ধ করে সন্তান জন্ম দেন। এ সময় নেমোসিনের সাথে ৯ রাত কাটান বলে তাদের মিলনে ৯টি মিউজেস তৈরি হয়। এঁরা মূলত সৃষ্টিশীল মানুষের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেন। মিউজেসদের প্রতীক,পোশাক ছিল আলাদা।
তাঁরা হলেনঃ
• কবিতার মিউজ ক্যালাইওপি
• ইতিহাসের মিউজ ক্লিয়ো
• সঙ্গীতের মিউজ বংশীবাদক ইউটারপ
• প্রেমের কবিতার মিউজ এরাটো
• ট্রাজেডির মুখোস পরিহিত ট্রাজেডির মিউজ মেলপোমেন
• পলিহিমনিয়াকে বলা হয় ধর্মীয় কবিতার মিউজ
• নাচের মিউজ হলেন টারপসিচোর
• মুখোশপরিহিত কৌতুকের মিউজ থেলিয়া
• এস্ট্রোনমির মিউ ইউরেনিয়া।
আলকেমিনি ছিলেন রাজা ইলেক্ট্রিয়নের কন্যা। তিনি অনেক লম্বা এবং জ্ঞানী ও সুন্দরী ছিলেন। অনেকে তার চেহারা এবং কালো চোখকে আফ্রোদিতির সাথে তুলনা করত। অ্যাম্ফিট্রিয়ন ভুলবশত ইলেক্ট্রিয়নকে মেরে ফেলেন এবং আলকেমিনি অ্যাম্ফিট্রিয়নের পেছন পেছন থিবসে আসেন। সেখানেই তার অ্যাম্ফেট্রিয়নের সাথে বিয়ে হয়,এই শর্তে যে অ্যাম্ফিট্রিয়ন তার ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিবে। যাই হোক,অ্যাম্ফিট্রিয়ন একসময় থিবস ছেড়ে টাফিয়ান এবং টেলেবিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যান। এদিকে আলকেমিনির উপর দীর্ঘদিন ধরেই নজর ছিল জিউসের। তিনি একদিন অ্যাম্ফিট্রিয়নের ছদ্মবেশ নিয়ে মহলে আসেন এবং সবাইকে অভিযানে তার জয়ের বেপারে বলেন। এবং আল্কেমিনির সাথে মিলিত হন। বলা হয় জিউস সূর্যদেবতা হেলিওস কে তিনদিন উঠতে মানা করেছিলেন। এর ফলে একরাত ৩রাতের সমান দীর্ঘ হয়েছিল এবং জিউস আল্কেমিনিকে সম্ভোগ শেষে অলিম্পাসে ফিরে যান। এরপরের দিন আসল অ্যাম্ফিট্রিয়ন ফিরে আসলে আলকেমিনি হতবাক হয়ে যান এবং সব ঘটনা স্বামীকে জানান। জিউস আল্কেমিনির এ মিলনে জন্ম হয় গ্রীক বীর হারকিউলিকস এর।
হারকিউলিকস এর জন্মের আগেই জিউস অলিম্পাসে তার সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে, এই বালক একদিন তার পাশে রাজত্ব করবে। এতে হেরা রেগে যান এবং হারকিউলিকসের শত্রুতে পরিণত হন।
এরপরের পর্বে আমরা জানব জিউস এবং আইও এর অমর প্রেম গাঁথা সহ আরো অনেক কিছু নিয়ে।