লা ফিনালিসমোঃ ইতালি বনাম আর্জেন্টিনা; ইউরোপ বনাম লাতিন আমেরিকা

ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বে কোন মহাদেশ সেরা? এই দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। বিশ্বের সব মহাদেশেই ফুটবল জনপ্রিয় খেলা হলেও লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো ফুটবলের সৌন্দর্য ও সাফল্যে সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে এগিয়ে কে? এই প্রশ্নের আপাতকালীন সমাধানের চেষ্টা করেছে উয়েফা ও কনমেবল। ইউরো চ্যাম্পিয়ন ও কোপা আমারিকা চ্যাম্পিয়নের মধ্যে বসছে ফাইনালের ফাইনাল । যে ফাইনালকে ইতালিয়ানরা আদর করে ডাকছে ”লা ফিনালিসমো”। ফুটবলের রাজধানী লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে বসছে ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার লড়াই। জুনের পয়লা দিনের প্রথম প্রহরে লিওনেল মেসি ও লিওনার্দো বনুচ্চিরা মুখোমুখি হবেন চ্যাম্পিয়নের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশায়।

কেন এই আয়োজন?

ফুটবল মানেই বিনোদন। কিন্তু ফুটবল কি শুধুই বিনোদন? ফুটবল মানে এখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার লেনদেন। নতুন নতুন আসর আর নতুন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রতিটা ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থাই চাচ্ছে মোটা অংকের টাকা কামাই করতে। বড় আসরগুলোর দিকেই সংস্থাগুলোর বেশি আগ্রহ। আর এজন্যই ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা চারবছরের বদলে দুই বছর পর পর বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা ভাবছে। ফিফার সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে উয়েফা ও কনমেবল পাল্টা আয়োজন হিসেবে ফিনালিসমো আয়োজন করছে।

ইউরোপ ও লাতিনের ফুটবল সামর্থ্য নিয়ে আগেও দ্বন্দ্ব হয়েছে। ফিনালিসমো’র মত ম্যাচ আয়োজনের কথাও বলাবলিও হয়েছে । বিশ কয়েকবার আয়োজন ছোট পরিসরে। কিন্তু সে সব কথা হালে পানি পায় নি। অবশেষে ফাইনালিস্টদের ফাইনাল দেখবে ফুটবল বিশ্ব। এর মাধ্যমে রথ দেখাও হবে কলা বিক্রিও হবে। দর্শক যেমন উপভোগ করবে ফুটবলের ধ্রুপদী লড়াই তেমনি ম্যাচ শেষে উয়েফা ও কনমেবলের একাউন্টে জমা হবে মোটা একাউন্টের টাকা।

আসলেই কি শ্রেষ্ঠত্ব ধরা দেবে?

গেল বছরের ১১ জুলাই ভোর রাতে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের ঘরের মাঠ মারাকানা স্টেডিয়ামে নেইমার-ভিনিসিয়ুসদের হতাশ করে ”একটি বড় শিরোপা” জেতে লিওনেল মেসি-আনহেল ডি মারিয়ারা। ঠিক একই দিনে মধ্যরাতে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে টাইব্রেকারে পরাজিত করে বনুচ্চি-কয়েল্লিনিরা। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকা শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে দুই দল এখন নামবে অলিখিত এক বিশ্বসেরা দল হওয়ার দৌড়ে। ফিফা আয়োজিত বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে বিশ্বের সবগুলো মহাদেশের দল। সেই আসরেই মূলত বিশ্বের সেরা দল নির্বাচিত হয়। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বাইরের কোন দেশ এখনো বিশ্বকাপ জিততে পারে নি। সে দিক দিয়ে লাতিন ও ইউরোপের সেরা দুই দলের লড়াইকে বিশ্বের অন্যতম সেরা লড়াই হিসেব দেখাতে চাচ্ছে উয়েফা ও কনমেবল। তাদের সেই প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হয়, সময়ই তা বলে দিবে।

বেদনায় নীল ইতালি

দুঃখের গায়ে লাল জামা বেদনার গায়ে নীল। বেদনার রং যদি নীল হয় হবে সেটা ইতালি ক্ষেত্রেই মনে হয় সবচেয়ে বেশি খাঁটি। ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালি যেন মাঠে নামবে বেদনার প্রতিবিম্ব হয়ে। এই বেদনার আগুনে তারা পুড়ছে ২০১৮ সাল থেকে। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে বাদ পড়ে যেদিন তারা রাশিয়া যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেছিল সেদিন থেকেই যেন ইতালিয়ান ফুটবলের এক দুঃখ যাত্রা শুরু। অভিজ্ঞ কোচ রবার্তো মানচিনি আজ্জুরিদের দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন ইতালি জেগে উঠবে। জেগে উঠার পথে হাটছিলও ইতালিয়ানরা। রাশিয়া বিশ্বকাপের হতাশা ভুলে আরও একটি বড় আসর শুরু করেছিল। ২০২০ সালের ইউরো কাপ অনুষ্ঠিত হলো ২০২১ সালে। পুরা আসরে অপরাজিত থেকে শিরোপা ঘরে নিল ইতালিয়ানরা। ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে ইউরো কাপ হোম থেকে রোমে নিয়ে গিয়েছিল জিয়ানলুইজি ডোন্নারাম্মারা। কিন্তু আবার খেই হারিয়ে ফেলেছে তাঁরা। টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার লজ্জা তাদের ঘাড়ে। কাতার বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার কষ্টে নীল হয়ে ফিনালোমিসা খেলতে নামবে লোকাতেল্লি-বেরাল্লিরা।

 

অবশেষে একটি মেজর শিরোপা………

৩৭ বছর কাটলো…..আর কত অপেক্ষা করতে হবে একটি মেজর ট্রফির জন্য !! গেল বছরের জুলাই মাসের আগেও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মনে মনে ভাসতো এই কথা । তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে- কামরূপ কামাখ্যা পাড় হয়ে আর্জেন্টিনাকে একটি মেজর ট্রফি উপহার দিয়েছেন লিওনেল মেসি, আনহেল ডি মারিয়ারা। ২০১৫ আর ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা ফাইনালে দুঃখ, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে পরাজিত হওয়ার দুঃখ তাদের তাড়া করে বেড়িয়েছে অনেক দিন। সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা ঘরে তুরে ম্যারাডোনা- বাতিস্ততার উত্তসূরীরা। ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনালে আনহেল ডি মারিয়ার “চিপ” ১৯৮৭ সালের পর কোপা আমেরিকা ঘরে তুলতে সাহায্য করে লিওনেল স্কোলোনির শিষ্যদের।

দুজনে মিলেছি একেলা……

গত একদশক জুড়ে দুই দলই দুঃখ ও হতাশার চর্চা করেছে। দু দলকেই সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন দুজন কাণ্ডারি। একজন কোচিংয়ে অপেক্ষাকৃত নবীন কিন্তু অন্যজন অভিজ্ঞতা ও সাফল্যে প্রবীণ। ইতালির দুঃসহ অবস্থা থেকে উদ্ধারের দায়িত্ব পান ম্যানচেস্টার সিটি, ইন্টার মিলানের সাবেক কোচ রাবার্তো মানচিনি। তাঁর ছোঁয়ায় বদলে গিয়েছিল আজ্জুরিরা। কিন্তু বদলাইয়াও বদলাইল না ইতালি…..

আর্জেন্টিনা দলটির অবশ্য এত বাজে অবস্থা ছিল না। তবে তারা তিনটি ফাইনাল খেলেও শিরোপা ছুঁয়ে দেখার ভাগ্য করতে পারে নি। সেই করুণ অবস্থা থেকে আর্জেন্টাইনদের উদ্ধার করেন লিওনেল স্কলোনি। ৪৪ বছর বয়সী স্কালানির সাথে রসায়নটা যেন ভালই জমে গিয়েছিল লিওনেল মেসি, রবার্তো মার্তিনেজ, আনহেল ডি মারিয়দের। স্কলানি যেন তাদেরকে দিয়ে তুলির শেষ স্পর্শ দিলেন। কারণ ফাইনাল তারা আগেও খেলেছে কিন্তু দিন শেষে শিরোপা গেছে অন্যের ঘরে। স্কলোনিও মেসি-ডি মারিয়াদের নিয়ে ফাইনাল খেলেছেন। এবার আর শিরোপা অন্যের ঘরে যায় নি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের মাটিতে তাদের হারিয়ে একটা শিরোপার স্বাদ উপহার দিয়েছেন পুরো বিশ্বের আর্জেন্টিনা সমর্থকদের।

 

আবারও বেকায়দায় ইতালি……

ইতালির অধিনায়ক ও রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী জর্জিও কিয়েল্লিন্নি এই ম্যাচের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলবেন। ইউরো জয়ী দলের জন্য দুঃসংবাদ আছে আরও বেশ কয়েকটি। মধ্যমাঠের খেলোয়াড় ফেদারিকো কিয়েসা ও দলটির মূল স্ট্রাইকার চিরো ইমমোবিলে আহত থাকায় মূল দলের বাইরে রয়েছেন। এছাড়াও বেরার্দি ও রাফায়েল তালাই ও খেলতে পারবেন না। ফিনালিসমোর পরেই নেশন্স লীগের গুরুত্বপূর্ণ বেশকয়েকটি ম্যাচ রয়েছে মানচিনি শিষ্যদের । এজন্য এ ম্যাচটিকে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ইতালির রেকর্ডও খুব একটা ভালো না। মেসিদের বিপক্ষে তাই আন্ডাডগ হয়ে মাঠে নামবে আজ্জুরিরা।

ফুরফুরে আর্জেন্টিনা…….

ফুরফুরে মেজাজে আছে আর্জেন্টিনা। দলে নেই কোন ইনজুরি শঙ্কা । ইন্টার মিলান স্ট্রাইকার লাউতারো মার্তিনেজ আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। লিওনেল মেসি, আনহেল ডি মারিয় আর লাউতারো মার্তিনেজকে নিয়ে শক্তিশালী আক্রমণভাগ রসায়ন কষছেন স্কলোনি। মধ্যমাঠের ডি পল আর রক্ষণ ভাগের রোমেরো-ওটামেন্ডিরা যেন শানে ধাঁর দিয়ে আছেন। আর গোলকিপার ইমানুয়েল মার্তিনেজও লিওনেল মেসির জন্য জীবন দিয়ে দিতেও প্রস্তুত। টানা দুই বছর পরাজয়ের তেতো স্বাদ পায়নি আর্জেন্টাইনরা। ৩৭ম্যাচ ধরে অপরাজিত তাঁরা। ইতালির বিপক্ষেও তাদের পরাজয়ের নজীর নেই। তবে একটি স্মৃতি তাদের মনে ভয় জাগানিয়া। লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে কখনো জয়ের মুখ দেখে নি ম্যারাডোন-মেসির আর্জেন্টিনা।