অপরাধ ও মনস্তত্ব

বেশ ক’বছর আগে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একটা রেইপ কেস নিয়ে পড়ছিলাম। সেই কেস পড়তে গিয়ে দেখলাম বেশিরভাগ মানুষই অপরাধী ধরা পড়ার পর তাকে অপরাধী হিসেবে মেনে নিতে নারাজ! মনে আছে আমার ই পরিচিত দু একজন বলছিল তারা এমন চোয়াল ভাঙা, রুগ্ন, লিকলিকে গড়নের কাউকে অপরাধী হিসেবে মেনে নিতেই পারছে না। পুরো দেশবাসীর প্রতিক্রিয়া ও তখন এমন ই ছিল— ভিলেন মানেই বিশালাকার দেহের কেউ হবে এমন ই তাদের ধারণা। কেসটি নিয়ে পড়তে পড়তে সিজার লমব্রসোর ক্রিমিনোলজি বইয়ের কথা মনে পড়লো। লমব্রসো বলেছিলেন, যাদের চোয়াল অত্যন্ত শক্ত বা যাদের হাড়ের গঠন শক্ত, মজবুত বা দাঁত একটু ভিন্ন ধরনের তারা উগ্র প্রকৃতির হয় এবং অপরাধ সংগঠনের প্রবণতা তাদের মধ্যে বেশি থাকে। সে যাই হোক—সিজার লমব্রসোর এই তত্ত্ব যেটি কিনা বলতে চায় যে মানুষ জন্মগতভাবেই অপরাধপ্রবণ – এটি খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায় নি।

অপরাধঃ

নির্দিষ্ট কোন রাষ্ট্র বা অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রণীত আইনের পরিপন্থী কার্যকলাপই অপরাধ হিসেবে পরিগনিত হয়।এই অপরাধ ও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন। এক দেশে যেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, অন্য দেশে তা আবার অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। মানুষের অপরাধে জড়িয়ে পড়বার কারন অনুসন্ধানে, বহু শতাব্দী ধরে, গবেষকরা অপরাধ বিষয়ক বিভিন্ন তত্ত্বের বিচার-বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। অপরাধের পেছনে বেশ কিছু প্রভাবক কাজ করলেও মনোবিজ্ঞানীরা এর সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আজ তাই শুধু অপরাধের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ থিওরি ও অপরাধঃ

অপরাধের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো পর্যালোচনা করতে গেলে প্রধান তিনটি সাইকোলজিক্যাল তত্ত্বের উপর আলোকপাত করতে হয় : (১) সাইকোডায়নামিক থিওরি (২) বিহেভিয়ারেল থিওরি ও (৩) কগনিটিভ থিওরি

সাইকোডায়নামিক থিওরি:
সাইকোডায়নামিক থিওরি এই ধারণার উপর কেন্দ্রীভূত যে একজন ব্যক্তির শৈশবকালের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তার অপরাধ করার জন্য বা তার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে। শৈশবে একটি শিশুর বেড়ে ওঠা তার পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলে। কোন মানুষ ই আদতে ক্রিমিনাল বা অপরাধী হয়ে জন্মায় না, বরং তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থাই তাকে একজন অপরাধী করে তোলে। তবে হ্যাঁ, অপরাধী হয়ে ওঠতে যে নির্দিষ্ট কোন বয়স আছে তা কিন্তু নয়। আশপাশের জুভেনাইল ক্রাইম নিউজগুলো তাই বলে। “World’s Youngest serial killer” শিরোনামে একটি নিউজ দেখছিলাম, দেখে চোখ ছানাবড়া হওয়ার অবস্থা ; বিশ্বের সবচেয়ে ছোট খুনীর বয়স মাত্র ৮ বছর। বলছিলাম অমরজিত সাডার কথা; যার জন্ম ১৯৮৮ সালে ভারতের বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম মুশাহারিতে। অমরজিতের জীবন ঘাঁটলে দেখা যায়, সে গুনে গুনে হত্যা করেছে তিনটি; যার মধ্যে প্রত্যকের বয়স ই ৬ বছরের নিচে। মুশাহারি গ্রামের ছোট শিশু খুশবু নিখোঁজ হওয়ার নেপথ্যের কারন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর সব তথ্য। ছোট অমরজিত নিজে পুলিশ স্টেশনে বসে একের পর এক লোমহর্ষক খুনের বর্ণনা দিতে থাকে; তাও অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে। অমরজিত তার প্রতিবেশী খুশবু ছাড়াও খুন করে নিজের পরিবারের আরো দুই ছোট সদস্যকে। এই সবগুলো খুনের ক্ষেত্রে একটা কমন বিষয়; এদের সবাইকেই সে খুনের আগে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। অমরজিতের স্বীকারোক্তির পরে, অনেক মনোবিজ্ঞানীই এর কারণ অনুসন্ধান শুরু করেন। মাত্র ৮ বছরের শিশু, যাঁর বাড়িতে না আছে টিভি, না আছে কোন ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড — সে কি করে একজন সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠলো তা জানা জরুরি ছিল। জানা যায়, অমরজিত এক হতদরিদ্র পরিবারে সদস্য; যে কিনা খুব ছোট থেকেই তার পরিবারকে নির্যাতিত হতে দেখে এসেছে। অসুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠা, দরিদ্রতা ও সামাজিক নিপীড়ন- তাকে বানিয়ে তোলে বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী সিরিয়াল কিলার৷
সাইকোডায়নামিক থিওরির মূলে যেতে হলে ফ্রয়েডের ঈড, ঈগো এবং সুপারইগো নিয়ে আলোচনা জরুরি। কিন্তু, সেই বিশদ আলোচনা এখানে করা সম্ভব নয়। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে- ইড (ব্যক্তিগত চাওয়া বা গোপন ইচ্ছে) হচ্ছে আমাদের ইচ্ছেগুলো যা আমরা পূরণ করতে চাই ; কিন্তু আমাদের সুপারইগো(বিবেক) আমাদের বিবেকের দরজায় কড়া নেড়ে জানান দেয় যে সব কিছু তুমি চাইলেই পেতে পারো না।আর ইগো হচ্ছে এই দুই অবস্থার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী সত্তা। আমাদের চাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যকার অস্থিরতা দূর করে (স্বপ্নে ইচ্ছেগুলো পূরন হতে দিয়ে) ভারসাম্য অবস্থা বজায় রাখে। এই ইড, ইগো এবং সুপারইগোর ভিতরের এই ভারসাম্য না থাকলে তখনই জন্ম নেয় হতাশা আর অস্থিরতার যা পরবর্তীতে বিদ্বেষমূলক আচরণে রূপ নেয়। ফ্রয়েডের মতে, আমরা প্রায়শই আমাদের নানা ইচ্ছে শুধুমাত্র সুপারইগো কে প্রাধান্য দিয়ে দমিয়ে ফেলি; আর এই অবচেতন মনের চাওয়াগুলোই একসময় ভয়ংকর রুপ নেয়। অরবিন্দ আদিগার লেখা ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ আমার খুবই পছন্দের একটি বই, এটি নিয়ে কিছুদিন আগে মুভিও নির্মিত হয়েছে। গল্পের প্রোটাগনিস্ট বলরাম হালওয়াই বড় হয়েছে চরম দরিদ্রতায়। বড় হয়ে সে তার কর্তার সম্পত্তি পাবার আশা করে; কিন্তু তার বিবেক তাকে সেটা করার অনুমতি দেয় না। দিনের পর দিন তার দরিদ্রতা, ধনী হবার বাসনা, মালিক বা কর্তার দুর্ব্যবহার তাকে বানিয়ে ফেলে ভয়ংকর এক খুনী।

বিহেভিয়ারেল থিওরি:
বান্দুরার থিওরি অনুযায়ী, মানুষ তার আশপাশের পরিবেশ দ্বারা ও সরাসরি প্রভাবিত হয়। বিহেভিয়ারেল থিওরি মূলত বলে যে এটি একটি লার্নিং এক্সপেরিয়েন্স। অপরাধী তার চারপাশের অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অপরাধ পরিচালনা করে। এ কারনেই স্কুল-কলেজে ভালো কাজের জন্য পুরষ্কার ও মন্দ কাজের জ্ন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়। শুধুমাত্র শাস্তি হচ্ছে না বলে সমাজে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, ইভ টিজিং, হত্যাসহ নানা অপরাধ বেড়ে চলেছে। পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা আমাদের যা শেখায় তাই আমরা শিখি। রিচার্ড রাইট এর লেখা “ন্যাটিভ সান” এর প্রোটাগনিস্ট বিগার থমাস শেতাঙ্গদের দ্বারা বর্ণবাদ, মানসিক নির্যাতন ও শ্রেণিবৈষম্যের শিকার হতে হতে একসময় একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে হত্যা করে বসে।

কগনিটিভ থিওরি:
কগনেটিভ থিওরি মূলত একজন ব্যক্তির মানসিক প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে। প্রত্যেক মানুষের ই চিন্তার জগত আলাদা; একটি বিষয় একেক জন একেকভাবে দেখতে পারে। কগনিটিভ থিওরিতে মূলত একজন ক্রিমিনালের মানসিক প্রক্রিয়া, চিন্তার জগত, পারিপার্শ্বিকতার প্রতি রিয়েকশান বা প্রতিক্রিয়া -এসব নিয়ে স্টাডি করা হয়। একজন ক্রিমিনালের বড় কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধ নিয়ে ঘাঁটতে গিয়ে প্রায়শই দেখা যায় তার ছোট খাটো ক্রিমিনাল হিস্ট্রি থাকে। তাদের সবার মধ্যেই হুট করে ডিসিশান নেয়া, দ্রুত রেগে যাওয়া, মিথ্যা বলা এ ধরনের ব্যবহার দেখা যায়। আর এ সব ব্যবহার ই মূলত মানুষ তার শৈশব থেকে আস্তে আস্তে শিখতে থাকে। মানে এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং শৈশব থেকে কগনেটিভ স্টেইজ পর্যন্ত একজন ব্যক্তি যা শিখে তাই তার ব্যক্তিত্ব কে একটা শেইপ দেয়। কগনেটিভ থিওরি অনুযায়ী, নৈতিক শিক্ষা একটি শিশু খুব ছোট বেলা থেকেই শিখে এবং কৈশোরে সে সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী তা ব্যবহার করতে শেখে। যে শিশু ছোট থেকেই দাম্পত্য কলহ দেখে বড় হয়েছে বা তার মাকে নির্যাতিত হতে দেখেছে। বড় হয়ে সে যে কোন ধরনের সম্পর্ককে ঘৃনা করতে পারে কিংবা সেও তার পার্টনারকে একইভাবে নির্যাতন করতে পারে। তবে বড় হতে হতে তাঁর চিন্তা জগতে পরিবর্তন আসতেও পারে।
এই সাইকোলজিক্যাল থিওরিগুলো ক্রমাগতই নানা বিচার-বিশ্লেষণ ও সংশোধনের মধ্য দিয়ে গেছে, তবু ক্রিমিনোলজিতে এটি খুব মজবুত একটা ভিত্তি প্রদান করে। এই থিওরিগুলোর উপর দাঁড়িয়ে এটুকু বলা যায়, কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না; বরং হয়ে ওঠে অপরাধী।