জিউস ও প্যান্ডোরার বাক্সঃ
প্রমিথিউসের এমন ধোঁকাবাজির পর জিউস ভাবলেন এবার তিনি এক মানবী তৈরি করবেন। কেননা প্রমিথিউস মানবজাতির জন্য বার বার কেন জিউসের বিপক্ষে যান তা জানতে চেয়েছিলেন তিনি।জিউস এবার পুত্র হেফাস্টাসকে আদেশ দিলেন মাটি দিয়ে কোমল একটি নারীমূর্তি বানাতে যা দেখতে হবে খুবই আকর্ষণীয়া। হেফাস্টাস জিউসের নির্দেশ পেয়েই বানিয়ে ফেললেন এক অনিন্দ্য সুন্দর নারী মূর্তি। এরপর এই মূর্তিতে প্রাণ সঞ্চার করলেন জিউস।আর নাম রাখলেন প্যান্ডোরা। যার অর্থ সবার জন্য উপহার। এই প্যান্ডোরার মধ্যে জিউস একটি গুণকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন আর তা হল কৌতুহল। প্যান্ডোরার বাক্স অবশ্য প্যান্ডোরার চেয়েও বেশি পরিচিত। যাইহোক, জিউস এবার এপিমিথিউস কে প্রস্তাব দিলেন প্যান্ডোরাকে বিয়ে করার জন্য। এপিমিথিউস আগেই প্যান্ডোরার সৌন্দর্যের কথা শুনেছিল।তাই কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেল। কেননা কাজ করার পর ভাবাই ছিল এপিমিথিউসের কাজ।বেশ ধুম ধাম করেই এপিমিথিউস আর প্যান্ডোরার বিয়ে সম্পন্ন হল। এপিমিথিউস জিউসের থেকে কিছুই নেন নি। কিন্তু জিউস প্যান্ডোরাকে একটি বাক্স উপহার দেন।এই বাক্সের উপরে লেখা ছিল “এটি কখনো খুলো না“
মজার বেপার এই নির্দেশনা দেওয়া বাক্সের চাবি কিন্তু প্যান্ডোরার হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছিল। প্যান্ডোরা তার কৌতুহলের কারণে বার বার বাক্স খুলে দেখতে চাচ্ছিল। কিন্তু নির্দেশনা পড়ে আর এগোচ্ছিল না। একদিন প্যান্ডোরার কৌতুহল তার বিবেককে হার মানাল। আর প্যান্ডোরা বাক্সটি খুলে ফেলল। আর সাথে সাথেই বাক্সটি থেকে ভয়ঙ্কর সব অশুভ শক্তি বের হতে লাগল।তা দেখে প্যান্ডোরা ভয়ে পিছিয়ে গেল।এগুলো ছিল সকল খারাপ গুণ যেমন ইর্ষা, ব্যাধি, জরা,শোক ইত্যাদি।এরপর প্যান্ডোরা ঝটপট এসে বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে দিল।কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এই সব অশুভ শক্তি ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে।মানুষের নির্মল আনন্দময় জীবন হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। এসময় এপিমিথিউস বাড়ি ফিরে দেখেন প্যান্ডোরা বাক্সটি ধরে কাঁদছে। সব শুনে তিনি বাক্সটি খুললেন আর তখন বাক্সতে থাকা শেষ জিনিসটাও বেরিয়ে গেল। আর এটি ছিল আশা।
মানুষ শত দুঃখকষ্টেও এই আশার জোরেই বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে।
এভাবেই জিউস প্যান্ডোরার মাধ্যমে সারা মানবজাতি এবং প্রমিথিউসকে শাস্তি দিলেন।
অ্যাথেনার জন্ম উপাখ্যানঃ
জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনার জন্ম বেশ চমকপ্রদ।আমরা জানি যে টাইটান সমুদ্রদেবতা ওসেনাস এবং টেথিসের এক কন্যার নাম ছিল মেটিস। এই মেটিস এক হিসেবে জিউসের বোন ছিলেন একইসাথে তিনি ছিলেন জিউসের প্রথম প্রেম।মেটিস জ্ঞানের দেবী তাই স্বভাবতই তিনি ছিলেন বুদ্ধিমত্তায় অনন্যা। আর জিউস যখন তাকে প্রেমের প্রস্ট্যাব দেয় তখন তিনি তার ভবিষ্যৎ জেনে গিয়েছিলেন! কি সেই ভবিষ্যৎ তা আমরা একটু পরেই জানব।যাইহোক ভবিষ্যৎ জানায় তিনি জিউসের প্রস্তাবে প্রথমদিকে সাড়া দিচ্ছিলেন না। কিন্তু জিউস ও ছিলেন নাছোড় বান্দা। সুন্দরী,বুদ্ধিমতী মেটিসকে তার চাই ই চাই।তাই তিনি বিভিন্ন বেশ ধারণ করে মেটিসকে রাজি করাতে চেষ্টা করলেন।জিউসের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত মেটিস সাড়া দেন।এই খুশির সময়ে জিউসের কাছে একটি খারাপ খবর আসে।খবরটা আসে একটা ভবিষ্যৎ বাণীরূপে। মেটিসের সাথে জিউসের মিলনে প্রথমে একটি কন্যা সন্তান জন্মাবে যে বুদ্ধিতে জিউসের সমান হবে।যদি তারা এরপরেও একসাথে থাকে তবে এরপর তাদের একটা পুত্র সন্তান হবে।এই পুত্র সন্তান শক্তিতে তার বাবার চেয়ে বড় হবে আর জিউসকে হঠিয়ে সিংহাসনে বসবে।
জিউস যে মেটিসকে পাওয়ার জন্য এতো ছটফট করছিলেন সেই মেটিসের সাথে আনন্দময় সময় কাটানোর বদলে ভীষণ চিন্তায় দিন কাটাতে লাগলেন। এরপর অনেক ভেবে তিনি ঠিক করলেন, ক্রোনাস যেভাবে জিউসের ভাইবোনদের একে একে গিলে ফেলেছিল ঠিক একইভাবে জিউস ও মেটিসকে গিলে খাবেন।
কিন্তু মেটিস তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আগেই জানত।তাই সে সবসময় খুব সতর্ক থাকত।জিউসের সামনে কোনো মতেই অন্যমনস্ক হত না।এদিকে জিউস ও মেটিসকে গিলে ফেলার জন্য সদা তৎপর।এই যখন অবস্থা তখন একদিন জিউস মেটিসের কাছে গেলেন এবং দেখলেন সে সুতার কাজ করছে তথা কাপড় বানাচ্ছে আর একটা হেলমেট তৈরি করে পাশে রেখেছে।এসব দেখে জিউস জিজ্ঞেস করলেন,কি মেটিস! কার জন্য এসব বানানো হচ্ছে? প্রশ্ন শুনে মেটিস কিছুটা অমনোযোগী হয়ে পরেন।এবার জিউস সুযোগ বুঝে সাথে সাথেই মেটিস কে গিলে ফেলল।
মেটিস তখন জিউসের পেটের ভিতরে বসেই কাপড় বুনতে লাগলেন।এ শব্দে জিউসের মাথা ব্যথা ধরে গেল। এরকমই একদিন জিউস টাইট্রান নদীর তীরে ঘুরতে গিয়েছিলেন।একটু হাঁটতেই জিউসের মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা করতে লাগল।আর এসময় স্বর্গের দেবদূত হার্মিস সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন।জিউসকে গোঙাতে দেখে জিউসের কাছে আসতেই জিউস তাকে কুড়াল এনে তার মাথায় কোপ দিতে বললেন।হার্মিস এবার একটুও দেরি না করে জিউসের মাথা এক কোপে দুভাগ করে ফেললেন। হার্মিস কিন্তু জিউসের ই এক পুত্র।জিউস ও মায়ার মিলনে এক পর্বতের গুহায় জন্ম হয় হার্মিসের। যাইহোক তখনই জিউসের মাথা থেকে বের হয়ে এলেন যুদ্ধ সাজে সজ্জিত এক সুদরী নারী।আসলে জিউস যখন মেটিসকে গিলে ফেলেছিলেন তখন মেটিস ছিলেন অন্তঃস্বত্তা ।আর তার এই সন্তানের জন্যই সে পোশাক তৈরি করছিল। এরপর জিউস ওই মেয়ের নাম রাখেন অ্যাথেনা।মজার বেপার হল যে অ্যাথেনাকে জন্মাতেই দিতে চাচ্ছিলেন না সে অ্যাথেনা একটু ব্যথা পেলেই ক্রোধিত হয়ে যেতেন জিউস। এরকমই একটি ঘটনায় প্রাণ যায় নদীদেবতা টাইট্রানের কন্যা পালাসের।
জিউসের ঢাল এবং পালাস –অ্যাথেনাঃ
পালাস ও অ্যাথেনা খুব ভাল বন্ধু ছিল।তারা একসাথে খেলাধুলা করত।একদিন তাদের মধ্যে ছোট একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যায় আর পালাস অ্যাথেনাকে মারতে হাত উঠায়।প্রিয় মেয়ের এই দশা দেখে জিউস খুব রেগে যান এবং একটি ঢাল পাঠিয়ে মেয়েকে রক্ষা করেন।এদিকে স্বর্গ থেকে ঢাল নেমে আসা দেখে পালাস ওখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরেন।সুযোগ বুঝে অ্যাথেনা এবার পালাসকে মারতে মারতে মেরেই ফেলে। নিজের সাথীকে মেরে ফেলার পর অ্যাথেনা খুব অনুতপ্ত হয় এবং পালাসের আদলে পালাডিয়াম নামে একটি কাঠের মূর্তি তৈরি করেন।এই মূর্তিটি ট্রোজান যুদ্ধের সময় ট্রয়ে ছিল। আর ট্রয়ের পতন হয় এই যুদ্ধে।স্বভাবতই এই মূর্তিটিকে অশুভ ভাবত সবাই।
জিউস ও অলিম্পিক গেমসঃ
খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে সর্বপ্রথম অলিম্পাস পর্বতের পাদদেশে অলিম্পিক গেমস শুরু হয়।এ নিয়ে তিনটি মতবাদ চালু আছে।কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ক্রোনাসের সাথে জিউসের যুদ্ধ জয়ের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে জিউসের সম্মানে সর্বপ্রথম চালু করা হয় এই অলিম্পিক গেমস।এটি ছিল তখনকার রাজাদের জন্য মান সম্মানের লড়াই। অনেকের মতে, টিট্রিয়ানদের সাথে যুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখতেই উদ্ভব হয় এই অলিম্পিক গেমস এর।প্রথম অলিম্পিক গেমস এ না কি জিউস নিজে অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিলেন।
আবার অনেকের মতে, হারকিউলিকস যখন তার ১২টি কাজ সম্পন্ন করে এবং অজিয়াসের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের জন্য তাকে বধ করে তার রাজ্য দখল করে তখন এজন্য পিতা জিউসের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে তিনি প্রথম এ খেলার প্রবর্তন করেন।
যাইহোক অলিম্পিক গেমস এ প্রতিযোগীতা শুরুর আগে জিউসের মন্দিরে সূর্যরশ্মির সাহায্যে জ্বালানো আগুনে হাত রেখে শপথ নিতে হত।আর এর মাধ্যমে প্রতিযোগী ঘোষণা করত সে বিগত দশমাস যথারীতি অনুশীলন করেছে এবং কোনো অসুদপায় অবলম্বন করবে না। এসময় একটি পশু বলি দেওয়া হত দেবরাজের উদ্দেশ্যে।
অনেক ঐতিহাসিক বলে থাকেন, এই মৃত পশুর রক্ত ছুঁয়ে এমন শপথ নিত প্রতিযোগীরা।
অনেকের মতে, প্রথম অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় নাকি দেবতারা বিচারক হিসেবে ছিলেন।
গ্রীক পুরাণের প্রায় সব উপাখ্যানেই জিউসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সমস্ত দেবদেবীর জীবনেই তিনি কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রেখেছেন।