এথেনার অভিশাপে সৃষ্টি হল পৃথিবীর প্রথম মাকড়শা

এথেনা হলেন গ্রীক জ্ঞানের দেবী।যুদ্ধ কৌশল, শিল্প ও কারিগরির দেবী।এতো জ্ঞানী হওয়ার সাথে সাথে তিনি বেশ অহংকারীও ছিলেন। তাকে কেউ না মানলে বা তার সাথে লাগতে গেলে তার ফল হত ভয়ঙ্কর।আর এইরকম ই এক ঘটনায় আরকনি নামক এক কুমারী মেয়ে পরিণত হয় পৃথিবীর প্রথম মাকড়শায়।

আরাকনি ছিলেন লিডিয়ার রাজকুমারী।তার পিতার কাছ থেকে সে শিখেছিল বুনন কৌশল।বুনন কাজে সে এতোটায় দক্ষ ছিল যে সবাই ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বুনন দেখত।তার এই শিল্প দেখতে দূর দূরান্ত থেকে সবাই ছুটে আসত।বাদ যেত না জলপরীরাও।আরাকনি তার আঙুলের ছোঁয়ায় জীবন্ত করে তুলতো তার সব শিল্প কর্মকে।তার আঙুলে যেন জাদু ছিল।সে জাদুর ছোঁয়ায় সব উল যেন স্বাচ্ছন্দ্যে সুতায় পরিণত হত। সুতাগুলো যেন তার স্পর্শ পেতে অধীর হয়ে থাকত।তার হাতের সূচের আঘাতেও যেন সুতাগুলোর ছিল পরম সুখ।সকলেই আরাকনির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল।দর্শক বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল আরাকনির অহংকার।

তখনকার যুগে বিশ্বাস করা হত এ ধরণের গুণগুলো দেব দেবীদের তরফ থেকে প্রদত্ত।আর তাই সবাই ভাবত আরাকনির এই বুননের গুণ এসেছে সরাসরি এথেনার কাছ থেকে।কিন্তু আরাকনি তার অহংকারে অন্ধ হয়ে এ কথা অস্বীকার করে বসল।

একদিন এক ব্যক্তি তাকে বলল,” আমার তোমার বুনন দেখে মনে হয় স্বয়ং এথেনা যেন তোমায় বুনন শিখিয়েছেন।তুমি বোধহয় তার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষার্থী।তোমার উপর তার কৃপাদৃষ্টি সবসময় বজায় থাকুক মা।”
কিন্তু আত্মঅহমিকায় অন্ধ আরাকনি নিজের শিল্পের উৎসকেই অস্বীকার করে বসল।সে বলল, আমি কখনো এথেনার কাছ থেকে কিছু শিখিনি। এ আমার দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রম এবং সাধনার ফল।এতে কোনো দেবীর অবদান নেই।আর আমার এই হাত থাকতে কারো কৃপা দৃষ্টির ও দরকার নেই।তুমি বরং এক কাজ করো, তুমি তোমার এথেনাকে গিয়ে বলো আমার সাথে একদিন বুননের প্রতিযোগিতা করতে।আমিও দেখি কার বুনন দক্ষতা বেশি! যদি আমি হেরে যাই তবে আমি অবশ্যই এথেনাকে ক্ষতিপূরণ দেব।”
আরাকনির এই উদ্ধতভরা বাক্য এথেনার কানেও গেল।মনে মনে ফুঁসে উঠলেন দেবী।কিন্তু তিনি ছিলেন কৌশলের দেবী।তাই ভাবলেন কৌশলেই মর্ত্যের এই অজ্ঞান রমণীকে শাস্তি দিবেন তিনি।যেমন ভাবা তেমন কাজ।

এবার এথেনা এক বৃদ্ধার বেশ ধরে হাজির হয়ে গেলেন আরাকনির বাড়ি। সেদিন ও আরাকনির বুনন দেখতে জমেছিল লোকের আসর।সে আপনমনে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।এর মাঝে বৃদ্ধাবেশী এথেনা আরাকনিকে তার ভুল শোধরানোর সুযোগ দিয়ে বললেন, শুনেছি তুমি না কি স্বর্গের দেবতাদের প্রতিযোগিতায় আহবান করছো? আমার কথা মেনে নাও আর এই অহংকার ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করো। আমার দিকে দেখো আমার মাথার চুল তো এমনি এমনি সাদা হয়নি মা।আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,দেবতাদের সাথে শত্রুতা করলে ফল কখনো ভাল হয় না।আমি বলি কি? তুমি যেমন নশ্বর তেমন নশ্বর দের সাথেই প্রতিযোগিতা করো। আর জ্ঞানের দেবীর কাছে ক্ষমা চাও।তিনি অনেক দয়ালু।তোমাকে হয়ত তোমার উদ্ধতের জন্য মাফ করে দেবেন।আশা করি তুমি এই বৃদ্ধার উপদেশকে অবহেলা করবে না।” আরাকনি এতোক্ষণ তার কাজ করছিল।
এবার সে বোনা থামিয়ে বলল,” বুড়ি মা আপনার বয়সের সম্মান করে কিছু বলছি না বলে আপনি দেখি যা নয় তাই বলে যাচ্ছেন।আমি সেদিন ভুল করে তার সাথে প্রতিযোগিতা করতে চাই নি।বরং ভেবে চিন্তেই বলেছি। আর আমি সেটাই বলেছি যেটা আমার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা।আমি এথেনার সাথে বুনন প্রতিযোগিতা করতে চাই এবং জিততে চাই।আর আপনার এসব উপদেশ অন্য কাউকে দিলেই ভাল হয়।আমার সময় নষ্ট করবেন না।চলে যান এখান থেকে।আর আপনার দেবীর যদি নিজের বুনন দক্ষতায় এতোই বিশ্বাস থাকে তবে আসুক নেমে সে! দেখাক তার দক্ষতা!আমিও দেখাব আমার দক্ষতা।হয়ে যাক পরীক্ষা!”

এসব শুনে বৃদ্ধা বললেন, তথাস্তু! আর তারপর বৃদ্ধা রূপী এথেনা তার স্বরূপে ফিরে এলেন।তার রূপের আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠল।আর সেখানে উপস্থিত সবাই ভক্তিতে লুটিয়ে পরল তার পায়ে।সবাই দেবীর স্তূতি গাইতে শুরু করল।শুধু আরাকনি একা মাথা উঁচু করে বসেছিল।শুধু তার গাল গুলো সব রক্তশূন্য হয়ে উঠেছিল।কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।আত্ন অহমিকায় অন্ধ আরাকনি তখন কাজে লেগে পরল।এথেনা ও একই সাথে কাজে লেগে পরলেন।
দুজনের হাত যেন বিদ্যুৎ গতিতে কাজ করছিল।প্রতিযোগিতার আনন্দ তাদের শ্রমের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল।এথেনা আঁকতে থাকলেন দেবতাদের নানা গৌরবময় গাঁথা।আঁকলেন বারোজন অলিম্পিয়ান দেবতাকে, আঁকলেন ত্রিশূল হাতে সমুদ্রদেবতা কে, তার পিতা দেবরাজ জিউসকে আঁকলেন স্বর্গের সভায় সকল দেবতার মধ্যিখানে।স্বমহিমায় উজ্জ্বল তিনি সেখানে।চারকোণায় আঁকলেন বিদ্রোহী পথভষ্ট নশ্বর মানবের বিদ্রোহ আর দেবতাদের শাস্তির গল্প।আরো কত কিছুই না আঁকলেন জ্ঞানের দেবী।তার হাতের মাকু যেন সাগরে ঢেউ তুলছিল।সুতার ভাঁজে ভাঁজে যেন ছড়াচ্ছিল স্বর্গীয় আলো।চারদিকে ছড়িয়ে পরল এক স্বর্গীয় সুখ।

অপরদিকে আরাকনি বেছে নিল সম্পূর্ণ বিপরীত একটি বিষয়। সে তার বুননে ফুটিয়ে তুলতে চাইল দেবতাদের কদর্য রূপ।সে দেবতাদের আঁকল মাতাল অবস্থায়। তাঁদের ক্ষমতার অপব্যবহার করার মূহুর্তগুলো ফুটে উঠল তার বুননে।সে আঁকল জিউস কিভাবে লেডাকে বোকা বানিয়েছিল, কিভাবে লেডাকে ধর্ষণ করেছিলেন জিউস।আঁকল ষাঁড় রূপী জিউস আর ইউরোপার কাহিনী।কিভাবে জিউস ইউরোপাকে তার পিঠে উঠিয়ে সাগর পাড়ি দিলেন,কিভাবে ইউরোপা ষাঁড়ের পিঠে তার বন্ধুদের খুঁজছিলেন।তার মনের ভাব যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল আরকনির হাতের ছোঁয়ায়।কাপড়ে আঁকা দেবতা,ষাঁড় ইউরোপা সবই যেন জীবন্ত।দর্শকরা যেন ইউরোপার কষ্ট নিজেরা অনুভব করতে লাগলেন।

এথেনাও আরাকনির বুনন দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।তার নিখুঁত বুনন শৈলী তার মনে আনন্দের জন্ম দিয়েছিল।একই সাথে দেবতাদের এই অপমানে তার মন ক্রোধে ভরে উঠল।তার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগল।তাই তিনি তার হাতে থাকা মাকু দিয়ে আরাকনির ক্যানভাস চিড়ে দিলেন।আর তাকে অপমান করলেন।এরপর আরকনিকে লজ্জা দিতে সেই ক্যানভাস চেপে ধরলেন আরাকনির মাথায়। আরাকনি নিজের এই অপমান সহ্য না করতে পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করল।

কিন্তু এই দৃশ্য দেবীর মনে দয়ার জন্ম দিল।তিনি বললেন, ” বেঁচে ওঠো, অহংকারী নারী।আর তোমার অপরাধের শাস্তিস্বরূপ এভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় বেঁচে থাকো।আর তোমার বংশধরেরাও এভাবেই ঝুলে থাকবে এটায় দেবতাদের অপমান করার শাস্তি।”
এটা বলেই দেবী আরাকনির গায়ে এক বিশেষ রস ছিটিয়ে দিলেন।আর সাথে সাথে আরাকনির মাথার সব চুল ঝরে গেল, তার নাক কান ও হারিয়ে গেল চুলের সাথে।আর তার মাথা ছোট হতে হতে সবচেয়ে ছোট আকৃতির মাথায় পরিণত হয়ে গেল।তার সব আঙুল গুলো পায়ে পরিণত হয়ে গেল আর তার পেটের চারপাশে জুড় গেল।আর সে এখনো এই পা গুলো দিয়ে বুননের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
আর এভাবেই গ্রীক পুরাণ মতে সৃষ্টি হল পৃথিবীর প্রথম মাকড়শার।আর এভাবেই প্রাচীনকালে গ্রীকরা মাকড়শার জাল বোনার দক্ষতার একটি মনঃপুত ব্যাখ্যা দাঁড় করায়।

আরাকনির এই গল্প আমরা খুঁজে পাই আধুনিক সাহিত্যের পরতে পরতে।তাকে আমরা বিভিন্ন ফ্যান্টাসি গল্পের পাতায় প্রায়শই উপস্থিত হতে দেখি।উদাহরণ হিসেবে “হারকিউলিসঃ দ্য লিজেন্ডারি জার্নিস” বইয়ে তাকে অর্ধেক মানবী এবং অর্ধেক মাকড়শারূপী দানব রূপে দেখতে পাই। বিখ্যাত ফ্যান্টাসি সিরিজ “পার্সি জ্যাকসন” এবং “হিরোস অফ অলিম্পাসে”ও আরাকনির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।এথেনার সন্তান হওয়ায় এনাবেথ ও আরাকনিকে ভয় পেত।”দ্য স্পাইডার গডেস” নামক একটি উপন্যাসে আরাকনি ছিল প্রধান চরিত্র।”ক্লাস অফ দ্যা টাইটানস” উপন্যাসে আরাকনি একটি বড় মাকড়শা রূপে ক্রোনাসের সাথে ডিল করে।সে হিরোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বদলে আবারো মানুষ হওয়ার সুযোগ চেয়েছিল।কিন্তু ক্রোনাস তার ওয়াদা ভঙ্গ করে। পরবর্তীতে এথেনা তাকে মানুষ বানিয়ে দেয় এবং তার অধীনে বুননের কাজে লাগিয়ে দেয়।এরকমই আরো নানা গল্প উপন্যাসে বার বার এসেছে আরাকনির নাম।