রবার্ট চেসব্রো এবং তিমির তেল

আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত পণ্যের মধ্যে এমন কিছু পণ্য আছে যা বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং জাত, পাত, লিঙ্গভেদে ব্যবহৃত। সেই সকল পণ্যর মধ্য থেকে কিছু পণ্যের ইতিহাস জানলে আপনি চমকে যাবেন।

গল্পটা রবার্ট চেসব্রোর। গল্পটার সূচনা হয় হতাশা থেকে। পৃথিবী জুড়ে সব থেকে বেশি হতাশার কারণ কি হতে পারে? আপনি ঠিকই ভাবছেন।

রবার্ট চেসব্রো তার চাকরি হারিয়ে ফেলেছে। চেসব্রো একজন রসায়নবিদ ছিলেন এবং তার কাজ ছিল স্পার্ম তিমির তেল থেকে কেরোসিন পরিষ্কার করা। কিন্তু পেনসিলভানিয়ার টিটাসভিলে তেল আবিষ্কৃত হলে তার চাকরি শেষ হয়ে যায়। তিনি তাঁর বেকারত্বকে দুর্বলতা হিসেবে কখনই বেছে নেন নি। বরং তিনি  মাটি থেকে বেরিয়ে আসা কালো জিনিস থেকে কী ধরণের নতুন পণ্য তৈরি করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করতে টাইটাসভিলে ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন।

১৮৫৯ সালে, টিটাসভিলের তেলক্ষেত্রে থাকাকালীন, চেসব্রো কিছু আকর্ষণীয় আবিষ্কার করেছিলেন। সেখানকার তেল শ্রমিকরা তাদের কাটা ও পোড়া সারানোর জন্য একটি পদার্থ ব্যবহার করতেন। এটি একটি অবশিষ্টাংশ যা রড মোম নামক তেল রিগ পাম্প থেকে সরানো হয়েছিল। রড মোম শ্রমিকদের জন্য একটি উপদ্রব ছিল কারণ এটি তাদের সরঞ্জামগুলিকে ত্রুটিযুক্ত করেছিল।

চেসব্রো একটি সুযোগ দেখে কালো, মোমযুক্ত পদার্থ সংগ্রহ করতে শুরু করে। তিনি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে ফিরে আসেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পদার্থটিকে পরিশোধন করার ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, রড মোম থেকে পাতলা, হালকা তেল পাতানোর মাধ্যমে, তিনি একটি হালকা রঙের জেল তৈরি করতে পারেন এবং তিনি ১৮৬৫ সালে প্রক্রিয়াটির প্রকাশ করেছিলেন।

চেসব্রো তাঁর পণ্যের পরিশোধন নিখুঁত করতে আরও দশ বছর কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন। তিনি নিউইয়র্কে থেকে নিজের দেহে ক্ষত সৃষ্টি করে এই পণ্যটি ব্যবহার করে প্রদর্শন করতে শুরু করেন।
১৮৭০ সাল নাগাদ, চেসব্রো তার প্রথম কারখানা খুলেন। এবং ১৮৭২ সালে, তিনি তার পণ্যটির নাম দেন ভ্যাসলিন।  নামটি জলের জন্য জার্মান শব্দ, ওয়াসার এবং তেলের জন্য গ্রীক শব্দ, ওলিওনের মিশ্রণ ছিল, যার বৈজ্ঞানিক-শব্দপূর্ণ সমাপ্তিতে পরিবর্তন হয়েছে – “ine “।  দুই বছর পরে, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বিক্রি করা শুরু হয়।

ভ্যাসলিনের উৎপাদন অবশেষে নিউ জার্সির পার্থ অ্যামবয় এবং কানাডা, ইউরোপ এবং আফ্রিকার কারখানায় স্থানান্তরিত হয়। চেসব্রো ১৯০৮ সাল পর্যন্ত কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলেন। ১৯৫৫ সালে, চেজব্রো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি  পন্ডের এক্সট্র্যাক্ট কোম্পানির সাথে একীভূত হয়ে চেসব্রো-পন্ডস, ইনকর্পোরেটেড হয়ে ওঠেন।

১৯৬৯ সালে, ভ্যাসলিনের বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা একটি হালকা, অ-চর্বিযুক্ত ময়শ্চারাইজিং লোশনে ভ্যাসলিনে পেট্রোলিয়াম জেলির উচ্চতর ময়শ্চারাইজেশন সরবরাহ করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারে। আজ, ভ্যাসলিনে হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ হ্যান্ড এবং বডি লোশন ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে একটি।

রবার্ট চেজব্রো-এর মতোই, ভ্যাসলিন  ব্র্যান্ডটি ত্বকের প্রতি আবেগ এবং কৌতূহল দ্বারা অনুপ্রাণিত। ত্বক প্রকৃতির একটি জটিল এবং অলৌকিক সৃষ্টি। আমাদের ত্বক আশ্চর্যজনক:

এটি একটি প্রধান সংবেদনশীল অঙ্গ যার প্রতি বর্গফুটে ৩২,৫০০টি সংবেদী কোষ এবং ৩২ ফুট স্নায়ু রয়েছে।

এটি আমাদের প্রতিকূল জলবায়ু এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

এটি আমাদের হিটিং এবং কুলিং সিস্টেম যা আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

এটি নড়াচড়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য নরম এবং নমনীয় কিন্তু ভাঙ্গা বা ছিঁড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট শক্ত।

এটি জলরোধী তবে জল নির্গত করতে পারে।

যাই হোক না কেন, আমাদের ত্বক আমাদের দেহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ভ্যাসলিন ১৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ত্বকের জন্য উপকারী হিসেবেই প্রমাণিত এবং জনপ্রিয় । ১৯৮৭ সালে, এই কোম্পানিটি ইউনিলিভার দ্বারা কেনা হয়।

পেট্রোলিয়াম জেলি হল হাইড্রোকার্বনের মিশ্রণ এবং এটি যখন তরলে উত্তপ্ত হয় তখনই এটি দাহ্য। এর জল-প্রতিরোধক বৈশিষ্ট্যগুলি এটিকে যা রাখা হয়েছে (যেমন ফাটা ঠোঁট, কাটা বা পোড়া) সিল করার পাশাপাশি আর্দ্রতা বজায় রাখতে এটিকে খুব কার্যকর করে তোলে। জেলি যত সাদা হবে, এটি তত বেশি পরিমার্জিত হবে। হোয়াইট পেট্রোলাটামের পরে ইউএসপি হল ইউনাইটেড স্টেটস ফার্মাকোপিয়া, ওষুধের তথ্য এবং মানগুলির একটি সংকলন, এবং ১০০% পদার্থকে দেওয়া গ্রেড নির্দেশ করে।

 ভ্যাসলিন তৈরির এই গল্পে তেল শ্রমিকরা যে পদার্থটি ব্যবহার করতো এবং যা দিয়েই মূলত ভ্যাসলিন তৈরি করা হয় তা হলো  স্পার্ম তিমির তেল।

 পৃথিবীতে প্রায়  ৮৯ প্রজাতির তিমি রয়েছে। যার মধ্য থেকে স্পার্ম তিমি অন্যতম। স্পার্ম হোয়েল বা স্পার্ম তিমি, দাঁতওয়ালা তিমি প্রজাতির মধ্যে সবচে বড় প্রজাতি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Physeter macrocephalus. লম্বায় প্রায় ৬০ ফিটের মতো এই প্রানির মস্তিষ্কও ওজনে অন্যান্য প্রানির তুলনায় সবচে বেশি। যা প্রায় ৯ কিলোগ্রামের কাছাকাছি।

কালচে ধূসর রঙের স্পার্ম তিমির দেহ অন্যান্য তিমির মতো মসৃণ নয় বরং অনেকটা কুঁচকানো ভাব লক্ষ্য করা যায়। এদের মাথা অনেকটা আয়তাকার এবং দৈর্ঘ্যে তা দেহের তিন ভাগের এক ভাগ। দাঁতওয়ালা তিমি হলেও স্পার্ম হোয়েলদের কেবল নিচের চোয়ালে দাঁত থাকে। অন্যান্য তিমির নাসারন্ধ্র মাথার ঠিক উপরের দিকে থাকলেও স্পার্ম হোয়েলের নাসারন্ধ্র বা blowhole থাকে মাথার সামনের দিকে এবং আকৃতি হয় অনেকটা S এর মতো বা কখনো মানুষের দুই ঠোঁটের মতো।

দেখতে কিম্ভূতকিমাকার স্পার্ম হোয়েল আরো একদিক দিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে আর তা হলো এরা সবচে গভীরে (প্রায় ৩০০০ মিটার পর্যন্ত) খাদ্যের উদ্দেশ্য যেতে পারে। গবেষণা বলে, এরা প্রায় দুই ঘন্টার মতো নিশ্বাস ধরে রাখতে সক্ষম!

খাবার হিসেবে এদের প্রাধান তালিকায় থাকে বিশাল আকৃতির স্কুইড, অক্টোপাস এবং বিভিন্ন প্রকারের বড় মাছ। অ্যাণ্টারটিকা থেকে আর্কটিক সব মহাসাগরেই এরা বিচরণ করতে পারে। এরা প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

আমরা অনেকেই হয়তো এই ধরণের তিমির নাম কখনো শুনি নি। এইবার আমরা এই নামের বিবরণ জানবো।

১৮-১৯ শতকের দিকে যখন তিমি শিকারের প্রকোপ ভয়ংকর ছিল, তখন ইংল্যান্ডের কিছু তিমি শিকারিরা মৃত স্পার্ম তিমির দেহ থেকে একটি ব্যাপারটি আবিষ্কার করে। স্পার্ম তিমির মাথার বেশির ভাগ অংশ জুড়ে স্পারমাসেটি (Spermaceti) নামক একটি অঙ্গ বিদ্যমান। এটি এক ধরণের সাদা মোমের মতো আংশিক তরল পদার্থ উৎপন্ন করে থাকে। যা প্রায় আয়তনে ২০০০ লিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। একে Sperm oil ও বলা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এই spermaceti শব্দ থেকেই এই প্রজাতির সাধারণ নামকরণ হয় sperm whale।

তবে এই  স্পারমাসেটি নামক অঙ্গের কাজ কি তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। এই বিষয়ে দুইটি ধারণা পাওয়া যায়। হতে পারে তিমিদের ভাসিয়ে  রাখা বা সর্বোচ্চ গভীরে যেতে পারার ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করে এই অঙ্গটি। আবার তিমির শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখতে পারে স্পারমাসেটি নামক অঙ্গটি। তবে এই ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে স্পার্ম তিমিকে অন্যান্য তিমি থেকে আলাদা প্রমাণ করে থাকে ৷

পৃথিবীর বিস্ময়কর আবিষ্কার গুলোর মধ্যে পেট্রলিয়াম জেলি যা ভ্যাসলিন নামে পরিচিত তা একটি। অজানায় হাত ছড়িয়ে অনেক সময় ভালো কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব তা রবার্ট চেসব্রোর গল্প থেকেই বোঝা যায়।