তিরোমণের কাহিনী

বহু যুগ আগের কথা। যখন পৃথিবীর বুকে মানুষ ও অমানুষের মাঝে সীমারেখা ছিল অস্পষ্ট, তখনকার ঘটনা। সেই অতীত কালে ছিল এক রহস্যময় দেশ – মিথেরোহাবন। এই দেশের অস্তিত্ব ছিল দৃশ্য ও অদৃশ্যের মাঝামাঝি, যেখানে বাস করত অসংখ্য প্রেত ও ভূত।
মিথেরোহাবনের রাজা ছিলেন ভয়ংকর ছায়ানাথ। তাঁর শাসনে প্রেতরা মানুষের জগতে ঘুরে বেড়াত, আর নিরীহ মানুষদের ধরে এনে প্রেতে পরিণত করত। এভাবেই তারা বাড়াতো তাদের সংখ্যা ও শক্তি।
মানুষের দেশে ছিল এক সাহসী যুবক, নাম তার তিরোমণ। সে ছিল একজন কুশলী শিকারি ও যোদ্ধা। একদিন গভীর জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে তিরোমণ হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত কুয়াশার মধ্যে পড়ে গেল। সেই কুয়াশা ছিল আসলে মিথেরোহাবনের প্রবেশদ্বার।
কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর তিরোমণ নিজেকে দেখতে পেল এক অচেনা জগতে। চারদিকে ছিল বিশাল বিশাল গাছ, যার পাতাগুলো ছিল কালো। আকাশে ছিল লাল রঙের চাঁদ। বাতাসে ভেসে আসছিল করুণ আর্তনাদ।
তিরোমণ বুঝতে পারল, সে এখন মিথেরোহাবনে। তার সাহস ও বুদ্ধি এখন পরীক্ষার মুখে। কীভাবে সে এই ভয়ঙ্কর জগৎ থেকে পালাবে? কীভাবে সে নিজেকে রক্ষা করবে প্রেতদের কবল থেকে?
হঠাৎ করেই একদল প্রেত তাকে ঘিরে ফেলল। তাদের নেতা চিৎকার করে বলল, “ওরে মানব! তোকে এখন আমাদের মতো হতে হবে। তোর আত্মা হবে আমাদের সম্পদ!”
তিরোমণ তার ধনুক তুলে নিল। কিন্তু সে জানত, সাধারণ অস্ত্র দিয়ে প্রেতদের কিছুই করা যাবে না। তাকে চাই কৌশল আর বুদ্ধি।
সে চিৎকার করে বলল, “হে প্রেতরাজ! আমি এসেছি তোমাদের রাজা ছায়ানাথের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে। আমাকে তার কাছে নিয়ে চলো!”
প্রেতদের নেতা একটু থমকে গেল। সে ভাবল, যদি এই মানুষটি সত্যিই কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে এসে থাকে, তাহলে তাকে হত্যা করলে রাজার রোষে পড়তে হবে।
“ঠিক আছে,” সে বলল, “চল, তোকে রাজার কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু সাবধান! যদি মিথ্যা বলে থাকিস, তাহলে তোর পরিণতি হবে ভয়ংকর!”
এভাবেই তিরোমণ প্রথম বিপদ থেকে রক্ষা পেল। কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছে আরও বড় বিপদ – স্বয়ং প্রেতরাজ ছায়ানাথ।

প্রেতদের দল তিরোমণকে নিয়ে চলল মিথেরোহাবনের রাজপ্রাসাদের দিকে। পথে যেতে যেতে তিরোমণ দেখল, এই অদ্ভুত দেশের প্রতিটি কোণায় রয়েছে অলৌকিকতার ছাপ। গাছের ডালে ডালে ঝুলছে আলোকময় ফল, যা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে নীলাভ আলো। মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে সবুজ বাষ্প, যা শ্বাস নিলে মনে হয় যেন শরীর হালকা হয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে তারা পৌঁছালো রাজপ্রাসাদে। প্রাসাদটি ছিল বিশাল এক কালো পাথরের স্তূপ, যার গায়ে জ্বলজ্বল করছিল হাজারো ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু। প্রাসাদের দ্বারে দাঁড়িয়ে ছিল দুই বিশালাকায় প্রহরী, যাদের শরীর থেকে ঝরে পড়ছিল অবিরাম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
তিরোমণকে নিয়ে প্রেতদল ঢুকে পড়ল রাজসভায়। সেখানে বিশাল এক সিংহাসনে বসে ছিলেন স্বয়ং ছায়ানাথ। তাঁর মাথায় ছিল একটি মুকুট, যা তৈরি করা হয়েছিল যেন অন্ধকার দিয়ে। তাঁর চোখ দুটি ছিল গভীর কুয়ো যেন, যার মধ্যে তাকালে মনে হয় সব আলো হারিয়ে যাচ্ছে।
ছায়ানাথ গর্জন করে বললেন, “কে এই মর্ত্যবাসী? কেন সে এসেছে আমার রাজ্যে?”
তিরোমণ সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল। সে বলল, “হে মহারাজ! আমি এসেছি আপনাকে একটি সতর্কবাণী দিতে। মানুষের জগতে এক মহাযোদ্ধার জন্ম হয়েছে, যার নাম আলোকধর। সে শীঘ্রই আসবে আপনার রাজ্য ধ্বংস করতে।”
ছায়ানাথের চোখে ফুটে উঠল উদ্বেগ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী প্রমাণ আছে তোমার কথার?”
তিরোমণ উত্তর দিল, “মহারাজ, আমি নিজে দেখেছি তাকে। তার হাতে রয়েছে এক অদ্ভুত তলোয়ার, যা থেকে নির্গত হয় এমন আলো যা আপনাদের ধ্বংস করতে পারে। সে বলেছে, তিন দিনের মধ্যে সে আসবে মিথেরোহাবন আক্রমণ করতে।”
ছায়ানাথ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি তাঁর মন্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ বিষয়ে কী করা যায় বলো!”
মন্ত্রীরা পরামর্শ করতে লাগলেন। এই সুযোগে তিরোমণ বলল, “মহারাজ, আমি জানি কীভাবে আলোকধরকে পরাজিত করা যায়। যদি আপনি আমাকে কিছু সময় দেন, আমি আপনাকে সেই পদ্ধতি শেখাতে পারি।”
ছায়ানাথ কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “ঠিক আছে। তোমাকে তিন দিন সময় দেওয়া হল। এই সময়ের মধ্যে তুমি আমাদের সেই কৌশল শেখাবে। কিন্তু সাবধান! যদি তুমি প্রতারণা করো, তাহলে তোমার আত্মা চিরকাল এই রাজ্যে বন্দি থাকবে।”
এভাবে তিরোমণ পেল কিছু সময়। কিন্তু এখন তার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ – কীভাবে সে এই সময়কে কাজে লাগিয়ে পালিয়ে যাবে মিথেরোহাবন থেকে?

তিরোমণকে রাখা হল প্রাসাদের একটি কক্ষে। সেখানে তাকে পাহারা দিত দুজন প্রেত। কিন্তু তিরোমণের মন ছিল চঞ্চল। সে জানত, এই তিন দিনের মধ্যেই তাকে পালাতে হবে, নইলে তার আত্মা চিরকালের জন্য আটকে যাবে এই ভয়ঙ্কর রাজ্যে।
প্রথম দিন, তিরোমণ ছায়ানাথকে বলল, “মহারাজ, আলোকধরকে পরাস্ত করার প্রথম পদ্ধতি হল শক্তি সঞ্চয়। আপনার সৈন্যদের প্রতিদিন সকালে সূর্যোদয়ের সময় একটি বিশেষ মন্ত্র জপ করতে হবে।”
ছায়ানাথ জিজ্ঞেস করলেন, “কী সেই মন্ত্র?”
তিরোমণ উত্তর দিল, “মন্ত্রটি হল – ‘অন্ধকারের শক্তি, আমাকে বল দাও। আলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস দাও।’ এই মন্ত্র জপ করলে আপনার সৈন্যরা অজেয় হয়ে উঠবে।”
ছায়ানাথ সন্তুষ্ট হয়ে নিজের সৈন্যদের সেই মন্ত্র জপ করার নির্দেশ দিলেন।
দ্বিতীয় দিন, তিরোমণ বলল, “মহারাজ, দ্বিতীয় পদ্ধতি হল একটি বিশেষ অস্ত্র তৈরি করা। এই অস্ত্র বানাতে লাগবে হাজার বছরের পুরনো একটি গাছের ছাল, একটি কালো হাতির দাঁত, এবং একটি অন্ধ পাখির পালক।”
ছায়ানাথ তৎক্ষণাৎ তার সৈন্যদের পাঠালেন সেই জিনিসগুলি সংগ্রহ করতে। তিরোমণ জানত, এই কাজে অনেক সময় লেগে যাবে।
তৃতীয় দিন এল। তিরোমণ জানত, আজই তার শেষ সুযোগ। সে ছায়ানাথকে বলল, “মহারাজ, আজ আমি আপনাকে শেখাব কীভাবে আলোকধরের তলোয়ারের শক্তি নষ্ট করা যায়। কিন্তু এর জন্য আমাদের যেতে হবে মিথেরোহাবনের সীমানায়।”
ছায়ানাথ সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”
তিরোমণ উত্তর দিল, “কারণ, সেখানে রয়েছে এক বিশেষ পাথর, যা স্পর্শ করলে যে কোনো অস্ত্রের শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। আমরা সেই পাথর নিয়ে এসে আলোকধরের তলোয়ার স্পর্শ করাব।”
ছায়ানাথ রাজি হলেন। তিনি নিজে, তিরোমণ, এবং কয়েকজন প্রেত সৈন্য নিয়ে রওনা দিলেন মিথেরোহাবনের সীমানার দিকে।
যখন তারা সীমানায় পৌঁছালেন, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। তিরোমণ দেখল, সামনেই রয়েছে সেই কুয়াশা, যার মধ্য দিয়ে সে এই রাজ্যে প্রবেশ করেছিল।
হঠাৎ তিরোমণ চিৎকার করে উঠল, “দেখুন! ওই যে আলোকধর আসছে!”
সবাই তাকাল সেদিকে। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। এই সুযোগে তিরোমণ দ্রুত ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল কুয়াশার মধ্যে।
ছায়ানাথ বুঝতে পারলেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তিনি গর্জন করে উঠলেন, “ধর! ধর ওকে!”
কিন্তু ততক্ষণে তিরোমণ কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে ফিরে এসেছে মানুষের জগতে।
এভাবেই তিরোমণ নিজের বুদ্ধি ও কৌশল দিয়ে নিজেকে উদ্ধার করল মিথেরোহাবন থেকে। সে ফিরে এসে সবাইকে সতর্ক করে দিল প্রেতদের বিষয়ে। সেদিন থেকে মানুষেরা সাবধান হয়ে চলাফেরা করত, যাতে আর কেউ প্রেতদের হাতে বন্দি না হয়।
আর মিথেরোহাবনের প্রেতরা? তারা আজও অপেক্ষা করছে আলোকধরের আগমনের। কিন্তু তারা জানে না যে, প্রতিটি সাহসী ও বুদ্ধিমান মানুষই এক একজন আলোকধর, যারা সত্য ও ন্যায়ের আলো ছড়িয়ে অন্ধকারকে দূর করে।

যে বইগুলো কিনতে পারেন ডিস্কাউন্ট রেটে থেকে:

Loading books...