পলাশী প্রহসন অথবা বাংলার একটি কালো অধ্যায়

ইতিহাসের সাম্প্রতিক গবেষণা একের পর এক প্রমাণ হাজির করছে যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলার (১৭৩৩-১৭৫৭) চরিত্রের ওপর যেসব কলঙ্ক আরোপ করা হয়েছিল, তার বেশির ভাগই মিথ্যার সূক্ষ্মজালে জড়ানো। অতিরঞ্জিত ‘অন্ধকূপ’ হত্যার ঘটনা যে ডাহা মিথ্যা, তা প্রমাণ করা হয়েছে এখন থেকে প্রায় শত বছর আগে। অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানি ভবানীর বিধবা মেয়ে তারা সুন্দরীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল নবাব সিরাজের, এবং তাঁকে তিনি অপহরণ করতে চেয়েছিলেন, তার পেছনেও জোরালো যুক্তি পাওয়া যায়নি। অনেক ঐতিহাসিক এখন বলছেন, সিরাজের প্রতি রানি ভবানীর বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করানোর জন্যই এ রকমের একটি কাহিনি ফাঁদা হয়েছিল। এমনও প্রচার করা হয়েছিল যে তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেট চিরে তার সৌন্দর্য দেখতেন। এমন নিষ্ঠুর আচরণ যে সিরাজউদ্দৌলা করতে পারেন না, তার পক্ষেও যুক্তি হাজির করা হয়েছে। সিরাজ-গবেষকেরা এখন প্রায় জোরালো তথ্য-প্রমাণ হাজির করে বলছেন, নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ড্রেস রিহার্সাল হিসেবেই আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল এসব মিথ্যা প্রচার-প্রপাগান্ডার।

সিরাজ উদ দৌলা। ছবি সূত্রঃ Youtube

সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করার নেপথ্য কারণঃ

প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক, মুর্শিদাবাদ দরবারের প্রভাবশালী একটা বড় অংশ কেন শামিল হয়েছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে? কোন কারণে তারা হাত মিলিয়েছিল ইংরেজদের সঙ্গে?
এই প্রশ্নের জবাবে ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, বেপরোয়া ও দুঃসাহসী তরুণ সিরাজউদ্দৌলা নবাব হওয়ার পর তাঁর অমাত্যগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেন এবং কিসের জন্য তাদের এই শঙ্কা? একটু খুলেই বলা যাক। জগৎশেঠরা বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন একচেটিয়া ব্যবসার ফলে। তাঁরা ছিলেন টাঁকশালের একচ্ছত্র অধিকারী, পুরোনো মুদ্রাকে নতুন মুদ্রায় পরিবর্তন করার একচেটিয়া ব্যবসায়ী, বাট্টা নিয়ে অন্য জায়গায় মুদ্রা বিনিময় করার কারবারি এবং রাজস্ব আদায় করার দাপুটে কর্তৃত্বের অধিকারী। সিরাজের পূর্ববর্তী বাংলার নবাবদের আমলেই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তাঁরা এমন বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছিলেন। একইভাবে উমিচাঁদের সোরা, শস্য ও আফিমের একচেটিয়া ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। বণিক খোজা ওয়াজিদের লবণ ও সোরার ব্যবসাও তখন আকাশচুম্বী। কিন্তু সিরাজ নবাব হওয়ার পর এত দিন তাঁরা যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিলেন, তার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা করতে লাগলেন। তাঁদের পাশাপাশি শঙ্কিত হয়ে উঠলেন মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লতিফের মতো অভিজাত সেনানায়ক ও ভূস্বামীগোষ্ঠী, উল্লিখিত ব্যবসায়ী শ্রেণীর সঙ্গে যাদের গড়ে উঠেছিল প্রায় আত্মার আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক।

মীর জাফর, বাংলার ইতিহাসের অন্যতম খলনায়ক। ছবিসূত্রঃ Pinterest

তাঁদের এই আশঙ্কার মূলে ছিল সিরাজউদ্দৌলার সেই পদক্ষেপ, যার ফলে মীর বক্সির পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল মীরজাফরকে, মানিকচাঁদকে দেওয়া হয়েছিল কারাদণ্ড, দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী হাকিম বেগকে করা হয়েছিল বিতাড়িত; বিশেষ করে হাকিম বেগকে অপসারণ করার ফলে এই ধারণা বদ্ধমূল হলো যে, নবাব আলিবর্দির একান্ত অনুগ্রহভাজন ও তাঁর প্রিয়পাত্রদেরও পদচ্যুত বা ক্ষমতাচ্যুত করতে, তাঁদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না যুবক নবাব। এই আশঙ্কা চাপা থাকেনি। বস্তুত নবাব সিরাজের যত দুর্বলতাই থাকুক না কেন, তিনি এটা স্পষ্ট বুঝেছিলেন যে ইংরেজদের উদ্ধত আচরণ সংযত করা না গেলে ভবিষ্যতে তারা ভয়াবহ দানব হয়ে উঠবে। তাঁর পরাজয়ের ভেতর দিয়ে দিনে দিনে সেটাই প্রমাণিত হতে শুরু করে। ফলে এহেন ইংরেজবিরোধী সিরাজের বিরুদ্ধে তাঁরা এককাট্টা হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীরজাফররা যেমন তরুণ নবাবকে মসনদচ্যুত করার লক্ষ্যে ইংরেজদের সঙ্গে সখ্য স্থাপনে এবং প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আঁতাত করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন, তেমনি ইংরেজপক্ষও এই সুযোগ গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র পিছ-পা হলো না। বরং ষড়যন্ত্রের ঘোঁট পাকানো শেষে তাঁরা অচিরেই সজ্জিত হলেন সামরিকভাবে এবং তার পরিণতিতেই পলাশীর যুদ্ধ। আগেই সন্ধি হয়েছিল, যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হলে বাংলার নবাব হবেন মীরজাফর। পবিত্র কোরআন শরিফ ছুঁয়ে তিনি শপথ করেছিলেন, এই যুদ্ধে তাঁর দলবল নিয়ে তিনি নিষ্ক্রিয় থাকবেন। হয়েও ছিল তা-ই। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নামেমাত্র যুদ্ধে, যাকে ‘হাতাহাতি’ পর্যায়ের যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন কেউ কেউ, তাতে পরাজিত হয় সিরাজের বিশাল বাহিনী এবং সেটা হয় কেবল মীরজাফর ও তাঁর অধীন সেনাবাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই।

 

পরাজয়ের পরিণতিঃ

পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পরই ইংরেজদের পেয়ে বসল প্রাথমিকভাবে সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন নয়, যে কদিন ক্ষমতার দাপট আছে, সে কদিন যা পাওয়া যায়, তা লুটেপুটে নিয়ে নিজেদের অর্থ ও বিত্তের ভান্ডার পরিপূর্ণ করা। অর্থাৎ লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে কায়েম হলো লুটপাটের একচেটিয়া রাজত্ব। টাকা আদায়ের জন্য দেওয়ানি হাতে নিয়ে ক্লাইভ চালু করলেন দ্বৈত শাসন। তাঁর এই শাসনের পাঁচ বছরের মধ্যেই শুরু হলো বিশাল বাংলাজুড়ে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ। ফলে প্রবর্তন করতে হলো ইংরেজ শাসন। ইংরেজদের এই অর্থলোভের সূত্র ধরে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল বাঙালি-সমাজের পুরোনো রাষ্ট্রীয় ও বৈষয়িক কাঠামো।আর যারা সিরাজের মসনদচ্যুতির ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন, তাঁকে যাঁরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন, তাঁদের পরিণাম বা পরিণতি কী হলো? এবার সে কথাতেই আসা যাক।

পলাশীর যুদ্ধের শেষে রবার্ট ক্লাইভের সাথে মীর জাফর। ছবি সূত্রঃ Brights of Nettlebed

মীরজাফর খ্যাত হতে চেয়েছিলেন ‘মহবৎ জঙ্গ’ নামে, কিন্তু তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ল ‘ক্লাইভের গাধা’ হিসেবে। মীরজাফর এখন নামেমাত্র নবাব। ইংরেজদের প্রতিশ্রুত তিন কোটি টাকা দিতে অসমর্থ হওয়ায় তাঁর তহবিল শূন্য হয়ে গেল। জওয়ানরা মাইনে না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল। ফলে নবাবের সেনাবাহিনী খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল। অচিরেই রাজকার্যে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ভাং সেবন করে তিনি টাল হয়ে থাকতেন। লোকে তাঁর ছোট ছেলে মীরনকে ‘ছোট নবাব’ বলে ডাকত। বেঁচে থাকা পর্যন্ত এই নিষ্ঠুর প্রকৃতির নবাবজাদাই চালাতেন রাজকার্য। সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘষেটি বেগমও সিরাজ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সহযোগিতা করেছিলেন সর্বতোভাবে। বিপুল অর্থও ব্যয় করেছিলেন। সিরাজের পতনের পর সেই ঘষেটি বেগম ও সিরাজউদ্দৌলার মা আমিনা বেগমকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী জিঞ্জিরা প্রাসাদে। একপর্যায়ে মীরনের হুকুমে বুড়িগঙ্গার পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ঘষেটি ও আমিনা বেগমকে। মৃত্যুর আগে তাঁরা অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলেন, মীরনের যেন বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়। মীরন বজ্রাঘাতেই মারা গিয়েছিলেন। এদিকে ইংরেজদের টাকার খাঁই মেটাতে না পেরে মীরজাফর মসনদচ্যুত হলেন। শেষে মারা যান কুষ্ঠরোগের শিকার হয়ে। মৃত্যুর আগে ইংরেজদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনারা কি ভাবেন টাকার বৃষ্টি হয়?’ কিন্তু তাঁর এই প্রশ্ন নিষ্ফল আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
রায়দুর্লভ ছিলেন পলাশী ষড়যন্ত্রের শীর্ষচূড় নায়কদের অন্যতম। তাঁর পরিণতি কী হয়েছিল? মীরজাফর ও মীরনের অচিরেই সন্দেহ হলো রায়দুর্লভ বুঝি সিরাজের ছোট ভাই মির্জা মেহেদিকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্র করছেন। মীরন মেহেদিকে কালবিলম্ব না করে হত্যা করলেন; এবং রায়দুর্লভকে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে হত্যা করার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। ক্লাইভের কল্যাণে রায়দুর্লভ প্রাণে বেঁচে গেলেও হারালেন তাঁর দেওয়ানি। ধন-প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেলেন কলকাতায়। কিন্তু তাঁর ধনসম্পদ তাঁর উত্তরপুরুষেরা ভোগ করতে পারল না। রায়দুর্লভের বংশ লোপ পেল তাঁর জীবদ্দশাতেই, তাঁর একমাত্র সন্তান মুকুন্দ বল্লভের মৃত্যু হওয়ায়। লোকের কথায়, ‘এ নাকি সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে রায়দুর্লভ রায়ের নিমকহারামির ফল।’ আর মহারাজা নন্দকুমারকে ইংরেজরাই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিল ১৭৭৫ সালের ৫ আগস্ট তারিখে, তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা ঠুকে দিয়ে। আর ইংরেজদের তলে তলে সাহায্যকারী নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা তাঁর জমিদারি ধরে রাখতে পারল না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূর্যাস্ত আইনে সব নিলাম হয়ে গেল।
অন্যদিকে পলাশী ষড়যন্ত্রের ইংরেজপক্ষের নায়কদের কী হলো? অ্যাডমিরাল ওয়াটসন পলাশী যুদ্ধের পর কিছুকাল অসুখে ভুগে মারা যান। ক্লাইভের সঙ্গে তাঁর আধাআধি বখরার কথা থাকলেও তিনি তার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করলেন। ওয়াটসনের উত্তরাধিকারীরা তাঁর নামে মামলা ঠুকে দিলে একটা আপসরফা করে মামলা থেকে ক্লাইভ রেহাই পান। কিন্তু খোদ ক্লাইভের কী হলো? তিনি নিজের হাতে ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর। ভারত থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে উঠতে থাকে একের পর এক দুর্নীতির গুরুতর সব অভিযোগ। সেই জ্বালা সহ্য করতে না পেরেই এই আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া। আর ইংরেজ সেনাপতি স্ক্রাফটনের পরিণতি কী হয়েছিল? তিনি মারা গিয়েছিলেন জাহাজডুবিতে। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে, এসবই বুঝি তারই ফলাফল।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিণতির কথা বহুভাবে বহুবার বলা হয়েছে। যে মোহাম্মদী বেগ তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাতে আঘাতে হত্যা করেছিল, সে ছিল সিরাজ ও তাঁর পিতা-মাতার কাছ থেকে উদার মানবিক সাহায্যভোগী। সঠিক প্রতিদানই সে ফিরিয়ে দিয়েছিল তার মনিবের সন্তানকে!
আর সিরাজের অন্য আমিরদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? স্বল্প কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক। রায়দুর্লভ বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন অকৃত্রিম সিরাজভক্ত মোহনলালকে। খাজা আবদুল হাদি খানকে মীরজাফর মেরে ফেলেন বিশ্বাসঘাতকতা করে। ঢাকার ভূতপূর্ব নায়েব রাজবল্লভ সেনকে মীর কাশিমের হুকুমে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারা হয়। পাটনার নায়েব রামনারায়ণকেও মীর কাশিমের হুকুমে খুবই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। মোটের ওপর পলাশী যুদ্ধের ২০ বছরের মধ্যে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ আমির-ওমরাহকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করা হয়। নবাব মীর কাশিম নিজেও ইংরেজদের ফাঁদে পা দিয়ে নবাব হন। কিন্তু অচিরকালের মধ্যে ইংরেজদের অর্থের খাঁই মেটাতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পান এ কী দুঃসাধ্য কাজ! ফলে স্বাধীনচেতা হতে শুরু করেন তিনি। ইংরেজদের বিরোধিতায় মুখর হওয়ার ফল পেলেন তিনি হাতেনাতে। তাঁকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে কালবিলম্ব না করে বিতাড়িত করা হলো।
আর অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানি ভবানীর কী হলো? খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল তাঁর জমিদারি। অস্তমিত হলো তাঁর বিশাল জমিদারির আকাশ থেকে লাল সূর্য। ঘোর অন্ধকার নেমে এল তাঁর জীবন ও তাঁর হাতছাড়া হয়ে যাওয়া জমিদারির প্রান্তরের পর প্রান্তরজুড়ে। সে ইতিহাস বড়ই করুণ, বড়ই মর্মন্তুদ! রানি ভবানী জীবিত থাকতেই প্রথম ইংরেজ শাসনবিরোধী আন্দোলন, ইতিহাসে যা ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে পরিচিত, শুরু হয়ে যায়। অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর বঙ্গভূমিজুড়ে। এ ছিল হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত আন্দোলন। ১৭৬৩ সাল থেকে শুরু হয়ে তা চলে ১৮০০ সাল পর্যন্ত। এই বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ভবিষ্যতে এ রকমের কত বিদ্রোহ ও সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হবে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে। সিরাজের পরাজয় কেবল ‘যবন’ তথা মুসলমানদের পরাজয় ছিল না, পরাজয় ছিল সমভাবে হিন্দু তথা সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়েরও, ভবিষ্যৎ যার প্রমাণ তুলে ধরবে পদে পদে।
এবার আসা যাক শেষ কথায়। কী পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল সিরাজের বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গিনী লুৎফুন্নেসাকে? তিনিও ধরা পড়েছিলেন তাঁর একমাত্র কন্যা উম্মে জোহরাসহ ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন। ধরা পড়ার পর লুৎফুন্নেসার ওপর মীর কাশিম অত্যাচার চালান গোপনে রাখা সোনাদানার সন্ধান চেয়ে। ১৭৫৮ সালে তাঁদের ঢাকায় পাঠানো হয়। বন্দী করে রাখা হয় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী জিঞ্জিরা প্রাসাদে। এখানে তাঁরা বন্দী থাকেন সাত বছর পর্যন্ত। মীরজাফর ও মীরন দুজনই তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন বারবার। ১৭৬৫ সালে লুৎফুন্নেসা মুক্তি পেয়ে কন্যাসহ ফিরে যান মুর্শিদাবাদে। ইংরেজরা তাঁকে সামান্য ভাতা দিত। তাই দিয়ে জীবন নির্বাহ করতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭৯০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্বামী সিরাজউদ্দৌলার কবরের ওপর প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতেন। পড়তেন দোয়া-দরুদ। দূর থেকে লোকজন এসবই দেখত। সজল হয়ে উঠত তাদের দুই চোখ।

 

#তথ্যসূত্র: বই, পত্রিকা, ইন্টারনেট এবং সাময়িকী ।