বিচিত্র খাবার

বিচিত্র সব খাবারের গল্প শুনতাম। সব চেয়ে মজার লেগেছিল ঝলসানো উটের কাবাবের গল্প। আরব দেশে রাজা বাদশাহদের বিয়েতে অমন উটের কাবাব বানায়। গিনেস বুকে ও এই কাবাবের কথা লেখা আছে।
প্রথমে তিতির পাখির ডিম সেদ্ধ করা হয়। সেদ্ধ ডিম ভরা হয় আস্ত মাছের ভেতরে। সেই মাছ বেকড করে আস্ত মুরগীর ভেতরে ভরা হয়। সেই মুরগী বেকড করে ভেড়ার ভেতরে ভরা হয়। সেই ভেড়া বেকড করে উটের ভেতরে ভরা হয়। সাথে দেয়া হয় চাল আর আলু। এই বার অনেক সময় নিয়ে উট ঝলসানো হয়। ঝলসানো শেষ হলে মেহমানদের সামনে পরিবেশন করা হয়। মেহমানরা ছুরি দিয়ে কেটে কেটে অদ্ভুত সেই উটের মাংস খায়। শুনে বেশ ভালই মনে হচ্ছে। সময় সুযোগ পেলেই খাব। এত কথা জানলাম রিচারড স্টারলিং -এর দ্যা ফেয়ারলেস ডিনার বই থেকে।
মারিয়ানা আইল্যান্ডে একটাই মাত্র শহর। নাম গ্রারাপান।
গ্রারাপানে হোটেল , ক্যাফে আর বারের অভাব নেই। এক কানা গলিতে আছে কোরিয়ান একটা ক্যাফে। নাম মনে নেই। হতে পারে নামটা – চঙ মং গং বা ধুন ফুং সাং । ওখানে এক টিন বিয়ার কিনলেই সিরামিকের এক পিচ্চি বাউলে করে ঝলসানো বেগুনের ফালি দেয়। ফালিগুলো একদম দেশলাইয়ের কাঠির সমান সরু। উপরে সাদা তিল আর লাল মরিচের কুঁচি দেয়া। পাতলা সয়াসসে ভেজানো থাকতো বেগুনের ফালিগুলো।
আমরা লোভীরর মত যেতাম ওখানে । অদ্ভুত একটা জিনিস বিক্রি হত- জ্যান্ত অক্টোপাস। কথা হল রেস্টুরেন্টে আবার জ্যান্ত অক্টোপাস বিক্রি হয় কেমন করে ? সেটাই বলছি।
জ্যান্ত একটা অক্টোপাস কেটে কুঁচি করে সিরামিকের বাউলে করে নিয়ে আসা হয় টেবিলে। তখনও সে টা কিলবিল করে নড়ছে। খদ্দের কাঠি দিয়ে তুলে নেয় অক্টোপাসের টুকরো। ভিনেগার আর সয়াসসে চুবিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। সাথে থাকে চাইনিজ বাঁধাকপি বা মূলার ঝাল আচার। যেটাকে কিমচি বলে (kimchi) । কাঁটা অক্টোপাসের টুকরো গুলো তখনও কিলবিল করে খদ্দেরের মুখের ভেতর থেকে বের হয়ে যেতে চায়।
দেখার মত এক দৃশ্য।
অকিশট বলে একটা পানীয় খায়। গ্লাসে করে কোরিয়ান মদ সুজু (soju) নেয়। সেই গ্লাসে ডুবিয়ে দেয় একটা জ্যান্ত অক্টোপাসের ঠ্যাঙ। তারপর আরকি। এক ঢোকে গিলে ফেলে।ওটা কিলবিল করতে করতে নেমে যায় গলা দিয়ে।
সিডনী শহরে একটা রাস্তার নাম হে স্ট্রীট । ভাল কথা। ট্রাম লাইনের পাশেই পিচ্চি এক গ্রিক দোকানে। কাচের জারে ভর্তি হরেক কোয়ালিটির জলপাই আর ভেড়ার দুধের সাদা পনির বিক্রি করে। টিনের গ্যালন ভর্তি জলপাই তেল। এক থুড়থুড়ে বুড়ো-বুড়ি দোকান চালায়। একদিন ঢুকে পড়লাম ভেতরে। দারুন দোকান। মসলায় মাখান শুকনো টম্যাটো ও বিক্রি করতে দেখলাম। সেমি ড্রাই টম্যাটো বলে। বার্গার আর পাস্তায় দেয়।
এক দেয়ালে কাচের জার ভর্তি অদ্ভুত কি যেন । মনে হল কতগুলো ভিন গ্রহের প্রাণী ভরে রেখেছে জারের ভেতরে।
‘ কি ওটা ?’ আগ্রহের সাথে জানতে চাইলাম।
‘ অক্টোপাসের আচার ।’ খ্যাক করে উঠলো বুড়ি।
থতমত খেয়ে গেলাম। ভুল শুনলাম না তো।
ভাল করে হাতে তুলে নিয়ে একটা জার দেখলাম। সোনালি জলপাই তেলে ডুবে আছে অক্টোপাসের ঠ্যাংগুলো। একটা বয়াম নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ইস্কুল জীবনে শেষ আচার খেয়েছিলাম। আজ আবার।
কাঁটা চামচ দিয়ে মুখে ফেললাম। অপূর্ব স্বাদের জিনিস। আগে বা পরে অমন কিছু খাইনি। গ্রিকরা বেশ অনেক আগে থেকেই এই অক্টোপাসের আচার খায়। শুনেছি। হাজার বছর আগে ডুবে যাওয়া গ্রিক জাহাজের ভেতরেও অমন মাটির জার পাওয়া গেছে। দেখে মনে হয় অমন অক্টোপাসের আচার ছিল ওতে।
রেসিপি একদম সোজা। পেল্লাই সাইজের অক্টোপাস দিয়েও আচার বানান যায়। অনেকে মনে করে বাচ্চা অক্টোপাস দরকার। আসলে তেমন না। অক্টোপাস পরিষ্কার করে ছোট টুকরো করে সেদ্ধ করতে হবে।সেদ্ধ হয়ে গেলেই অক্টোপাস লালচে মেরুন হয়ে যাবে। ভাল করে জল ঝড়িয়ে নিতে হবে সেদ্ধ অক্টোপাস থেকে।
এবার দরকার এক চামচ লবণ, আস্ত একটা লেবুর রস, ২টি তেজপাতা, ৫/৬টি রসুনের কোয়া কুঁচি করা , কয়েকটা গোল মরিচের দানা। সেইসাথে সামান্য জলপাই তেল। সব এক বাউলে রেখে সেদ্দ অক্টোপাসের সাথে মেশাতে হবে। পরিষ্কার দেখে একটা কাচের জারে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে জলপাই তেলে যেন সব অক্টোপাস ডুবে থাকে । যেই অংশ তেলের উপরে থাকবে সেই অংশ শক্ত আর শুকনো লাগবে। এই আচার ফ্রিজে রেখে দিতে হবে ১ সপ্তাহ। চাইলে এর সাথে ধনেপাতা বা পুদিনা পাতার কুঁচি দেয়া যায়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।
সব শেষে বলা যায়। আমি হয়তো অক্টোপাস আচারের দোকান খুলতে পারি। বড় করে লেখা থাকবে- অক্টোপাস আচার। বড় মজাদার। কপি রাইট- শ্রী শ্রী মিলন বাবু । আদি ও আসল। কোথাও কোন শাখা নেই।
মারিয়ানা আইল্যান্ডের আদিবাসী এক বন্ধুর নাম জুন কামাচু। সরকারী চাকরি করতো। এখন অবসর। বিরাট মদ্যপ। অবসর নেয়ায় মদ খায় নাকি সরকারী চাকরি করতো বলে মদ খায় পরিষ্কার না আমার কাছে। একদিন বলল – ‘মাছ ভাঁজা খাবে ? প্যারট ফিস ।’
প্যারট ফিস নামে কোন মাছ আছে জানতাম না। অবশ্য আমার জানার ভাণ্ডার সীমিত। মাহি মাহি নামে যে কোন মাছ আছে জানতাম ? জানতাম না । অয়াহু নামে যে কোন মাছ আছে জানতাম ? জানতাম না । শুধু জানতাম ইলিশ ইংরেজি হিলসা।
ছুটির দিনে দাওয়াত দিল জুন। এই দেশে খালি হাতে শনিবার কেউ কারো বাসায় যায় না। এক কেস বিয়ার নিয়ে যায়। আমিও গেলাম। আমাকে দেখেই ফ্রিজ থেকে একগাদা মাছ বের করলো জুন। দেখে অবাক হলাম। বিঘৎ খানেকের চেয়ে বড়। অমন অদ্ভুত মাছ জীবনেও দেখিনি। শরীরে সবুজ, নীল , হালকা বেগুনি রঙের আঁশ ভর্তি। কেমন যেন একটা রঙধনুর অংশ মনে হচ্ছিল। সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে মাছের ঠোঁট । একদম টিয়া পাখির ঠোঁটের মত। নিজে মাছ ধরতে গিয়ে যদি এমন মাছ ধরতাম দেখেই ভয় পেয়ে যেতাম।
চাকু দিয়ে আঁশ পরিষ্কার করলো জুন। সামান্য লবণ আর গোল মরিচের গুড়া মেখে রেখে দিল পাঁচ মিনিট । গরম ডুবো তেলে ভাঁজা হতেই দেখার মত একটা জিনিস হল। ঠাণ্ডা বিয়ারের সাথে অপূর্ব এক জিনিস হল সেই প্যারট ফিস। এখনও মুখে লেগে আছে স্বাদ। পলিনেশিয়ান দ্বীপগুলোতে প্যারট ফিস কাঁচা খায়। ওরা বলে রাজার খাবার। আগে নাকি দ্বীপের গোত্রের সর্দার এই মাছ খেত শুধু।
শ্রীলংকান বন্ধুর নাম- মিহিডিকুলা সুরিয়া তুসান্তা দিলহান গায়েন পেরেরা। এটা ওর আসল নাম না। ডাক নাম। আসল নাম বলতে গেলে এই লেখা শেষ হয়ে যাবে, অনেকটা সেই ধামাল সিনেমার ট্যাক্সিতে লিফট দেয়া দেয়া ভদ্রলোক শ্রী আট্টুবাট্টু রাজশেখরও শ্রীনিবাসনও পরম বাধুরাত ইয়াজ্ঞ পরম্বীর চেন্নাসোয়ামী মুত্তসোয়ামি ভেনুগোপাল আইয়ারের মত । আমরা শুধু গায়েন মামা বলতাম।
তো গায়েন মামা এক মজার জিনিস খাইয়েছিল। ভদকার তরমুজ। পেল্লাই সাইজের এক তরমুজ এনে উপরে সামান্য ফুটো করে ওখানে প্ল্যাস্টিকের এক ফ্যানেল ঢুকানো হল প্রথমে। ফ্যানেলে আস্তে আস্তে ঢালা হল ভদকা। তরমুজ শুষে নিল সেই ভদকা। টানা চারদিন ভদকা ঢালা হল ফ্যানেল দিয়ে। তরমুজটা টই টুম্বুর হয়ে গেল ভদকা খেয়ে খেয়ে। পঞ্চম দিনের দিন ফালি ফালি করে কাটা হল মিস্টার ওয়াটার মেলনকে।
এবার সবাই খাও ইচ্ছামত। সেটা ছিল জুলাই মাসের গরমের রাত। আহা, অদ্ভুত স্বাদ। ভদকায় ভেজান তরমুজ। ফ্রিজে ছিল। তাই চনমনে ঠাণ্ডা। আর জুনিপারের ঘ্রানঅয়ালা ভদকার স্বাদ তো ছিলই । হালকা নেশা নেশা। আরও খেতাম। এক বন্ধু চেঁচিয়ে উঠছিল হঠাৎ- ‘ মিলন আর খাস নে। তুই ঘোলা হয়ে যাচ্ছিস।’
বেচারা আসলে মাতাল হয়ে গিয়েছিল।
কবে যেন এক বইতে মাখন চায়ের কথা পড়েছিলাম।
মাখন চা। শুনতে কেমন না ? তিব্বতের লোকজন নাকি খায় ? কাজ শুরু করার আগে তিব্বতিরা নাকি কয়েক বাউল মাখন চা খেয়ে ফেলে। কাজে উদ্দীপনা পাওয়া যায় নাকি ? পাহাড়ের উপর হাড় কাঁপানো শীত। এই মাখন শীতের হাত থেকে বাঁচায় ওদের।
বইটা পড়ার পর থেকেই চোখের সামনে কল্পনায় ভেসে উঠত অচেনা তিব্বতের পাহাড়ি পথ। চারিদিকে বরফ। শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছে। সাথে বরফ কুঁচি। পথের এক ধারে একটা কাঠের হোটেল । ভেতরে কমলা আলো জ্বলছে । বাইরে ঝুলন্ত চারকোণা লণ্ঠন। ভেতরে একগাদা তিব্বতি বসা। সবার সামনে চীনামাটির বাউল। ফুরুত ফুরুত করে সেই মাখন চা খাচ্ছে সবাই। তিব্বতি ভাষায় যাকে পো চা বলে।
অনেক বছর হয়ে গেছে । সেই মাখন চা খাওয়া হয়নি। সিডনি শহরে এক তিব্বতির দেখা পেলাম। দেখতে জ্যাকি চ্যানের মত। বেশ নিরীহ মানুষ। কোন এক কারাখানায় কাজ করে। মুচি দেখলেই লোকের যেমন মনে হয় জুতা জোড়া কালি করা দরকার। তেমনি সেই তিব্বতিকে দেখেই আচমকা মাখন চায়ের কথা মনে হল। বলে ফেললাম।
তিব্বতি জ্যাকি চ্যান হেসে বলল- আচ্ছা সে আমাকে মাখন চা খাওয়াবে।
এক রোববার বানাল। তেমন কিছু না। সাধারন চা। বানানর পর চায়ের সাথে এক চামচ মাখন আর সামান্য লবণ নিয়ে আচ্ছা মত ঘুঁটে দিল। হয়ে গেল মাখন চা। আমি ও শীতের সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে দিতে শেষ করে ফেললাম তিব্বতীয় প্রাচীন এই পানীয়টা। তবে ওরা নাকি চমরী গাইয়ের দুধের মাখন ব্যবহার করে।
পরে আমি যখন একা বানিয়েছি লবণের বদলে চিনি দিয়েই খেয়েছি। বিচিত্র এক পানীয়।
বুদ্ধদেব গুহ আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন। সেই কবে উনার কোজাগর উপন্যাসটা পড়ে ভাল লাগা কাজ করেছিল। আজও করে। উনার একটা লেখায় একবার সালাদের অদ্ভুত এক রেসিপি পড়লাম। মারিয়ানা আইল্যান্ডে থাকতে ভাবলাম বানাই ওটা।
তেমন কিছু না। সাধারন সালাদের মতই শসা, টম্যাটো, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ একটা বাউলে নিয়ে সাথে সামান্য লবণ, চিনি , সর্ষের তেল দিয়ে মাখালাম। কাচের একটা বয়ামে করে সেই সালাদ রেখে দিলাম রোদে। ঠিক তিন থেকে সারে তিন ঘণ্টা রোদে রাখার পর খাবারের সাথে নিলাম রোদেলা সালাদ। কি অদ্ভুত স্বাদ। বলার মত না।
প্যাপিলন নামে বিখ্যাত এক বই পড়লাম ক্লাস সিক্সে থাকতে। হেনরি স্যারিয়ারের লেখা। বেস্ট সেলার বই। জেল পালানো এক কয়েদীকে নিয়ে। যদিও সে ছিল নিরপরাধ। তো , কাহিনির নায়ক প্যাপিলনকে জেলে শিমের দানা সেদ্ধ খেতে দেয়া হত রোজ। ব্যাপারটা দারুন। নিজেকে প্যাপিলন ভেবে বাসায় প্রচুর শিম খাওয়া শুরু করলাম। যদিও দানা তেমন বড় হত না।
ইস্কুলের স্যারকে একদিন জিজ্ঞেস করে ফেললাম- ‘ স্যার, জেলখানায় কি সত্যি শিমের দানা সেদ্ধ খেতে দেয় ?’
স্যার ফিচিক করে হেসে বললেন- ‘ সময় হলেই বুঝবি। তকে মনে হয় আটার রুটি আর গুড় দেবে। খিচুড়ি পাবি সপ্তাহে একদিন ।’
‘আপনি এত কিছু জানেন কি করে ? ‘ অবাক বিস্ময়ে বললাম। ‘ কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা ?’
হঠাৎ করেই বদলে গেল স্যারের চেহারা। ঘেউ ঘেউ করে বললেন- ‘ নিপাতনে সন্ধি আর অব্যয়ীভাব সমাস শিখে আসতে বলেছিলাম । তার বদলে কিনা শিমের দানা…খাড়া তর শিমের দানা আমি বাইর করতাছি।’
কি বিচ্ছিরি স্যারের ভাষা। আর মুখের অঙ্গভঙ্গি। যাক । অন্যের সমালোচনা করে লাভ নেই।
২০১২ আফ্রিকা গেলাম। ইউগানডা। হোটেলেই প্রথম রাতেই জিজ্ঞেস করলো- চাপাতি, কুরু আর বিজানজারো আছে । দেবে কি না।
চাপাতি মানে আমাদের ময়দার চাপাতি। কুরু মানে মুরগি। সোহালিলি ভাষা। আর বিজানজারো মানে শিমের দানা। হায় হায়। ওটাই খাই। নাকি ?
টানা এক বছর রোজ এক বেলা হলেও শিমের দানা খেয়েছি। লাল দানাগুলো দেখলে মনে হয় খনি থেকে সদ্য তোলা চুনি পাথর। পালিশ করা হয়নি। সারা রাত জলে ভিজিয়ে রাখতে হয় সেই চুনি মানে শিমের দানা। সকালে সেদ্ধ করতে হয় ঘণ্টা খানেক। সেদ্ধ হলে একটা পেঁয়াজ, টম্যাটো , সামান্য গাজরের কুঁচি দিয়ে নাম মাত্র কয়েক ফোঁটা তেল দিয়ে বাগার দিলেই হয়ে যায় আফ্রিকার সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার। শুধু পুষ্টিকর না। সহজেই পেট ভরে যায়। কি স্বাদ। আজও মুখে লেগে আছে ।
জুল ভান সাহেবের টুয়েন্টি থাউজ্যানড লিগস আন্ডার দ্যা সি ( Twenty Thousand Leagues Under the Sea) নামে দারুন একটা বই আছে । ১৮৭০ সালে ছাপা হয়েছিল বইটা। সেই সময় অমন একটা বই লেখা চাট্টিখানি কথা না। আজও বইটার আবেদন একটু ও কমেনি। সমুদ্রের তলায় অদ্ভুত সাবমেরিন নটিলাসে করে ক্যাপ্টেন নিমোর সাথে আমিও ২০ হাজার লিগস ঘুরে এসেছিলাম। খাবারের টেবিলে দেয়া হয়েছিল সমুদ্রের শ্যাওলার সালাদ, হরেক রকম মাছ, হাঙরের ডানার স্যুপ । মোদ্দা কথা সব খাবারই সাগর থেকে যোগার করা। এটা পড়ার সময় শ্যাওলার সালাদ জিনিসটা মাথায় রয়ে গেল।
এখন তো রাস্তায় একটা শিঙারা কিনলেই ৫০ গ্রাম খোসা সহ শসার টুকরো হাতে ধরিয়ে দেয় সালাদ হিসাবে, দিলখুস বিরিয়ানি হাউজে দেখি টোকাই মার্কা একটা ছোকরা বসে বসে হলুদ হয়ে যাওয়া শসা কাটে আর একই সাথে নাকের শিকনি ফেলতে থাকে। বিয়ে বাড়িতে সালাদ দিত। নোনা পানিতে ভেজানো টক হয়ে হয়ে যাওয়া টম্যাটো আর শসার আচারের মত কি একটা জিনিস এক হাতা ঢেলে দিতে দিতে পাত্রিপক্ষ বলতো – নিজের বাড়ি মনে করে খান। বাড়িতে কি খান না খান …।
এই অবস্থায় শ্যাওলার সালাদ ? নাহ না মুমকিন। ইস্কুলের এক বন্ধু পরামর্শ দিল পুকুরে যে পাতাঝিঝি মার্কা জিনিস ভাসে সেগুলো দিয়ে ট্রাই করব কি না ? রামবাবুর পুকুরে নেমে গেলাম শ্যাওলা তুলতে। সাথে সাথেই তিন জন লোক ঝাঁপিয়ে পরে আমার মাথার চুল টেনে তুলল । কান মুচড়ে বলল- ‘পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট হলেই আত্নহত্যা করতে হবে নাকি ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন একবার না পারিলে দেখ হাজার বার।’
রবীন্দ্রনাথ এমন কথা জীবনেও বলেনি।
মারিয়ানা আইল্যান্ডের একটা সৈকতের নাম লাউ লাউ বিচ ( lau lau beach) । হাতের বুড়ো আঙ্গুল থেকে তর্জনী পযন্ত যেমন আকার হয় সৈকতটা ঠিক তেমন। একদম জংলের ভেতরে। ওখানেই বসে ছিলাম একদিন। বুড়ো এক আদিবাসি মাছ অক্টোপাস ধরছিল। লোহার একটা শিক। এক মাথা ছাতার লাঠির মত বাঁকানো। ওটা দিয়েই পাথরের ফাঁক দিয়ে সুরুত করে টেনে আনছিল বালি রঙের কালো ছিট পরা এক একটা অক্টোপাস। পুরে রাখছিল কাপড়ের ব্যাগে। শেষে দেখি এক মুঠো সবুজ কি যেন তুলে আনল শাকের মত করে।
খাবে নাকি ? জানতে চাইল অক্টোপাস শিকারি।
কি এটা ? অবাক হলাম।
শ্যাওলা। রান্না করে সুপে দিয়ে খেতে পার বা সালাদ বানাতে পার।
বাসায় সেই শ্যাওলা নিয়ে ফেরার সাহস পেলাম না। তবে পরের সপ্তাহেই গ্রারাপানে একটা দোকানে পেলাম আলু আর শ্যাওলার সুপ। এক বাউল আলুর গরম সুপের সাথে শ্যাওলা আর আদার ফালি দেয়া। আদার ফালিগুলো সাইজে দেশলাইয়ের কাঠির সমান লম্বা আর সরু। শ্যাওলাগুলো লাগছিল ঠিক যেন পুঁইশাকের মত। মাত্র ২ ডলার দাম। দারুন স্বাদ।
শ্যাওলার সালাদ খাওয়া হল পরে। পরিষ্কার ফালি করা শ্যাওলার সাথে জলপাই তেল, সাদা তিল আর লাল মরিচের কুঁচি দেয়া। এটাও মনে হল পুঁই শাকের মতই। De costi সি ফুডে যখন বাবুর্চি হিসাবে কাজ নিলাম তখন থেকেই তো রোজ সকালে নিজের হাতে পেল্লাই এক বাউল ভর্তি করে শ্যাওলার সালাদ বানাতে শুরু করলাম। খারাপ না কিন্তু জিনিসটা।
জাপানী রেস্টুরেন্টগুলোতে টুনা মাছের চোখ বিক্রি হত। দেখতে খুব বিদঘুঁটে । রান্না করার ঝামেলা নেই। লবণ গোল মরিচ সামান্য আদা রসুন দিয়ে সেদ্ধ করে সিরামিকের তশতরীতে পরিবেশন করা হয়। সামান্য ঝোল ঝোল থাকে। দেখার মত একটা জিনিস। তরল ঝোলে চোখগুলো ভাসতে থাকে। একদম হরর গল্প। কখন খাইনি । ইচ্ছে করেনি। খেতে নাকি স্কুইড সেদ্ধর মত লাগে। পোণাপে দ্বীপের মেয়ে ছিল দুটো। প্রতিবেশী। কাঁচা টুনা মাছের চোখ ওদের চিবিয়ে খেতে দেখেছি। আলাস্কার লোকজন নাকি কাঁচা খায়।
আলাস্কা যাইনি। তাই দেখিনি।