ড্রাগন আর রাজকুমারী

মোটামুটি অনেক দিন আগের কথা।
দিন তারিখ ঠিক বলতে পারব না। মনে নেই। অনেক দুরে ছিল পিচ্চি একটা দেশ। এইসব দেশের নাম তোমরা ম্যাপে হাজার খুঁজলেও পাবে না। কারন যারা ম্যাপ বানায় তারা বেশ অলস ধরনের মানুষ। ছোট আর দুর্বল দেশের নাম বেশির ভাগ সময় উনারা ম্যাপে দেয় না। ইচ্ছা করে বা ভুল করে। দুর্বল দেশ মানে না যেই সব দেশ শাক সবজি কম খায়।
তো এই পিচ্চি দেশে এক রাজকুমারী ছিল। নাম কঙ্কাবতী। একদম পরীর মত সুন্দরী। আর ছিল এক রাজকুমার। নাম- বেদানা কুমার। দেখতে বেশ । দুইজনকে দারুন মানায়। বেশ পছন্দ করে একে অপরকে। এরা ঠিক করল বিয়ে করবে।
কঙ্কাবতী বিশাল একটা রাজপ্রাসাদে থাকে। দারুন সব দামি আর সুন্দর পোশাক পরে সব সময়। চৈতালি মেঘের মত ওর চুল ।
একদিন দুইজন বাগানে বসে গল্প করছিল। ঘাসের দানার সবুজ শরবত আর গরম গরম গুড়ের জিলিপি খাচ্ছিল। অমন সময় উড়ে এলো বিশাল এক ড্রাগন। ভীষণ দুষ্টু ছিল সেই ড্রাগনটা। এসেই করল কি লেজের বাড়ি দিয়ে কঙ্কাবতীর প্রাসাদ ভেঙ্গে ফেলল। ড্রাগনের মুখ হা করলেই দলা দলা আগুন বের হয়ে আসে। সেই আগুনের ভীষণ তাপ। সব কিছু পুড়িয়ে ছাই করে দিল এক মুহূর্তেই। ফাজিল ড্রাগনটা চলে যাবার সময় রাজকুমারকে পিঠে তুলে উড়ে ভেগে চলে গেল।
বেচারি কঙ্কাবতী হতাশ হয়ে বসে রইল। চারিদিকে একগাদা ছাই। প্রাসাদের পোড়া বিম আর কড়িবর্গা পরে আছে। কেউ নেই। কিছু নেই।
রাজকুমারী ঠিক করল ড্রাগনের পিছন পিছন গিয়ে সে রাজকুমারকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে। ভালবাসে যে।
ড্রাগনের আগুনে সবকিছু পুড়ে গেছে । ওর জামা কাপড়সহ। চেয়ে দেখে দুরে একটা আধপোড়া চটের ব্যাগ পরে আছে। রাজকুমারী সেটাই গায়ে দিয়ে জামার মত পরে নিল। তারপর দ্রুত পা চালাল। ড্রাগনকে ধরতে হবে। ব্যাপারটা কঠিন কিছু না। দুষ্টু ড্রাগন যে দিক দিয়ে উড়ে গেছে সেইদিকের সব বনজঙ্গল আগুনে পুড়ে পরে আছে। সেই সাথে পোড়া জীবজন্তুর হাড় গোড় রয়ে গেছে।
সেই পথেই পা বাড়াল রাজকুমারী।
অনেক লম্বা পথ। হেঁটে যেতেই লাগল সে। ভাল করেই জানে সামনের কোন পাহাড়ে ড্রাগনটা থাকে। ড্রাগনরা পাহাড়ের গুহাতেই থাকে। কে না জানে ।
শেষ মেস রাজকুমারী ঠিকই পৌঁছে গেল বিশাল এক পাহাড়ের সামনে। সবচেয়ে বড় গুহাটায় ড্রাগন থাকে। বাইরে লোহার দরজা। দরজার বাইরে বড় বড় পিতলের হরফে লেখা-
ড্রাগন সাহেব বাসায় আছে। বিরক্ত করবেন না।’
দরজার কড়া ধরে নক করলো রাজকুমারী। বেশ জোরেই করল।
ভেতর থেকে ঘুম ঘুম চোখে বের হয়ে এলো ড্রাগন। রাজকুমারীকে দেখেই যা বুঝার বুঝে গেল। হাই তুলতে তুলতে বলল- ‘ খামাখা এত রাস্তা হেঁটে এসেছেন। রোজ সকালের নাস্তায় একটা রাজকুমার আমার লাগে। প্রচুর মাখনের প্রলেপ দিয়ে রাজকুমার খাওয়ার মজাই আলাদা। ভিনেগারে চুবিয়ে খেতেও ভাল লাগে। সাথে মেক্সিকান মরিচের ফাঁকি । আপনি চলে যান। আমি ভীষণ ব্যস্ত ড্রাগন। কাল আবার রুমঝুমপুরের রাজ প্রাসাদ আগুনে পোড়াতে হবে। আজ ক্লান্ত।’
এই বলেই ধিমাই করে দরজা বন্ধ করে দিল ড্রাগন।
রাজকুমারীর নাকটা প্রায় ভর্তা হয়ে যেত দরজার আঘাতে।
আবারও দরজা নক করলো রাজকুমারী।
বিরক্ত হয়ে গলা বের করে দিল ড্রাগন। লাল চোখে বলল -’ দেখুন আজ পেটটা খারাপ। হজমশক্তি কম। নইলে আপনাকেও খেয়ে ফেলতাম। চলে যান বলছি।’
‘ আচ্ছা শুনেছি আপনি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে চালাক আর ভয়ংকর ড্রাগন, সত্যি নাকি ?’ জানতে চাইল রাজকুমারী।
‘ নিজের মুখে নিজের প্রশংসা খারাপ লোকেরা করে।’ তোম্বা মুখে বলল ড্রাগন।
‘ একবার হা করে আগুন বের করে নাকি দশটা জঙ্গল পুড়িয়ে ফেলতে পারেন ?’
‘ দশটা না, পনেরটা । আপনি ভুল শুনেছেন।’ খানিক বিরক্ত হয়ে বলল ড্রাগন। ‘ এই দেখুন।’
বলেই হা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো ড্রাগনটা। গল গল করে ভীষণ শব্দ করে বের করে এলো আগুনের হলকা। সেই আগুনে কমপক্ষে ত্রিশটা জঙ্গল পুড়ে যাবে।
‘ আরেকবার দেখান তো।’ অনুরোধ করল রাজকুমারী।
মনের আনন্দে তাই করল ড্রাগনটা। এইবার তেমন একটা আগুন বের হল না। আরও একবার হা করলো। এইবার কোন আগুন বের হল না। একটা শুকনো পাতাও পুড়বে না।
‘ কাল সকালে আবার ঠিক হয়ে যাবে।’ সাফাই গাইল ড্রাগন।
‘ মাত্র এক মিনিটে নাকি সারা পৃথিবী ঘুরে আসতে পারেন।’ জানতে চাইল রাজকুমারী।
‘ উহু, ভুল শুনেছেন। এই সব অপপ্রচার। আমার সুনাম নষ্ট করার জন্য মানুষ ভুল বলে । চাইলে ত্রিশ সেকেন্ডে পারি। এই দেখুন।’
বলেই ভীষণ দুই ডানা তুলে উড়াল দিল ড্রাগনটা। কি কাণ্ড । মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডে ফিরে এলো সে।
‘ আরেকবার দেখাবেন। ভালমত দেখতে পাইনি। একেবারে ধূলার মত মনে হল।’ অনুরোধ করলো রাজকুমারী।
আবার উড়াল দিল ড্রাগন।
ফিরে এলো ক্লান্ত হয়ে। এসেই ধপাস করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো । হালকা নাক ডাকতে লাগল।
‘ ড্রাগন সাহেব আপনি জেগে আছেন ?’ কানের কাছে গিয়ে চেচিয়ে বলল রাজকুমারী।
কোন সাড়া নেই।
রাজকুমারী ড্রাগনের কানের লতি ধরে মোচড় দিয়ে মাথায় চাঁটি মেরে বলল- ‘ ড্রাগন বাবু ঘুমাচ্ছেন ?’
কোন সাড়া নেই। পাথরের টুকরার মত ঘুমাচ্ছে দুষ্ট ড্রাগন।
দরজা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকে পড়লো রাজকুমারী। ভেতরের পরিবেশ জঘন্য। বর্ণনা দেয়ার কোন মানে নেই। চারিদিকে শুধু ঘোড়া আর মানুষের হাড় গোড়। রক্তের আমসত্ত্ব আছে কয়েক রোল।
এক কামরায় বন্দি রাজকুমার। চুপচাপ বসে আছে। কঙ্কাবতীকে দেখেই মুখ বেঁকিয়ে বলল- ‘ ছি, তোমাকে খুব বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। শরীরে ময়লা , চুলে জটা, ছাইয়ের বাজে গন্ধ। ভূতের কালো দেখাচ্ছে তোমাকে। আর কি বিচ্ছিরি চটের ব্যাগ পরে এসেছ। কাগজ টোকানি মেয়েদের মত লাগছে তোমাকে। পরের বার ভাল করে সেজে ভাল জামা কাপড় পরে দেখা করবে। একদম রানীর মত যেন দেখতে লাগে তোমাকে। ’
‘ রাজকুমার ।’ বলল কঙ্কাবতী । ‘ তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে।একদম সত্যিকারের রাজকুমারের মতই। প্রথম যে দিন তোমাকে দেখেছিলাম সেই দিনের মতই সুন্দর। কিন্তু তুমি একটা ছোটলোক।’
এই বলে হন হন করে রাজকুমারী চলে গেল।
ভাল কথা , ওদের আর বিয়ে হয়নি।
আমার মনে হয় রাজকুমারী ভুল করেনি। তোমার কি মনে হয় ?
( Robert Munsch এর The Paper Bag Princess গল্পের ছায়া অবলম্বনে )