ওরা সত্যি এসেছিল

দীর্ঘ দশ বছর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেও তেমন একটা নাম করতে পারেনি তৌফিক আজিজ।অথচ এমন নয় যে ভাল লেখার যোগ্যতা তার নেই।আছে।এমন নয় যে রিপোর্টিং ভাল হয়না।হয়। তারপরও!
একসাথে যে সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিল তৌফিক তাদের সবাই টপাটপ প্রমোশন পেয়ে কোথায় কোথায় চলে গেছে!সবচেয়ে গাধা যেটা সেই কবির মুৎসুদ্দি পর্যন্ত একটা মাসিক পত্রিকার সম্পাদক হয়ে বসে আছে।কয়েকজন কানাডা,ইংল্যান্ডসহ আরো খ্যাত অখ্যাত নানান দেশে চলে গেছে বিদেশী প্রতিনিধি হিসেবে।শুধু তৌফিক রয়ে গেছে আগের মতই।
তৌফিকের বয়স মাত্র ছত্রিশ।অবিবাহিত।দেখতে রাজপুত্র বলা দোষের হয়ে যাবে।চলে আরকি!তবে একটা জিনিস তৌফিকের আছে যেটা দুষ্ট লোকেরা বলে ধান্ধা!সাংবাদিকতা মহৎ কোনো পেশা নয় তৌফিকের কাছে।একটা নিউজ করে আর তক্কে তক্কে থাকে কতটা মাখন তোলা যাবে সেখান থেকে।
কারো বউ মারা গেছে আত্মহত্যা করে?বানাও রিপোর্ট-জামাই মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে।ছাপা হবার আগে হাত পাত জামাইয়ের কাছে,এসে যাবে কয়েক পেটি।দুহাজার বোতল বিদেশী মদ ধরা পড়েছে?সুন্দর রিপোর্ট করে থানার দারোগার কাছে ফোন দাও।এসে যাবে নতুন ফ্ল্যাট বুকিং দেয়ার টাকা।তারপর ভুলে যাও রিপোর্টটার কথা।পৃথিবীতে কে কার?
উঠতি নায়িকার নামে লেখ-টাকা।প্রচার প্রিয় লেখক,অধ্যাপক,ব্যাবসায়ীদের সাক্ষাতকার লেখ-টাকা আসবেই।কাজেই তৌফিকের দিনগুলো দুধেভাতেই কাটছিল।কিন্তু পেট ভরলে মনের ক্ষুধা বাড়ে।খ্যাতি চাইছিল তৌফিক।একটু খ্যাতি!নাম,যশ হলে জীবনের নৌকাটা মৌসুমী বায়ু পেয়ে সুন্দর ছুটে যায়।কাজেই তক্কে ছিল তৌফিক এমন একটা নিউজ করার যাতে হঠাত করেই লাইম লাইটে চলে আসে।যেন মঞ্চের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে সে।চারিদিক অন্ধকার।উজ্জল স্পট লাইটের সরেস আলো ঝুপ করে পড়ে আছে শুধু তার উপর।সবাই দেখছে তাকে।শুনছে তার কথা।চারিদিকে শুধু তৌফিক চর্চা।এমন হলে বেশ হত কিন্তু!হয়না কেন এমন?আসলেই হচ্ছেনা।ব্যাটে বলে মিলছে না তৌফিকের।
তারপরই ঘটে গেল ঘটনাটা।যে রকম ঘটনার জন্য তৌফিক অপেক্ষা করছিল অনেকগুলো বছর ধরে।আমার তো ধারনা সবাই করে!
দুই
মনটা বেশ খারাপ আজ তৌফিকের।সম্পাদক সাহেব তৌফিককে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশ করে লেবু কচলানোর মত করে কচলে দিয়েছেন।কারন তৌফিক ফাটাফাটি কোনো নিউজ বানাতে পারছেনা।শাস্তি হিসেবে তৌফিককে পাঠানো হয়েছে মফস্বলে।অফিস থেকে পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে-সুপারহিট কোনো নিউজ দিতে না পারলে সম্ভবত বাকী জীবন মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবেই কাজ করতে হবে তাকে!
জায়গাটার নাম নিমপুর।
সব মফস্বলেরই এক চেহারা।শেওলা পড়া কিছু ঘর বাড়ি।দালান কোঠা।একটা কলেজ,মিষ্টির দোকান,চায়ের দোকান,চালের আড়ত,মাছের বাজার,ছাপা-খানা,এইতো।এই জায়গাতে থেকে চমৎকার নিউজ কিভাবে যোগাড় করবে তৌফিক?কি ই বা ঘটে মফস্বল শহরগুলোতে?ঢাকা শহরে চায়ের দোকানে ঘন্টা খানেক বসলেই পরের দিনের সংখ্যা তৈরি হয়ে যায়।মহিলা পাতা আর ছোটদের পাতা বাদে অবশ্য।
আজ এক সপ্তাহ হলো, তৌফিক এসেছে নিমপুরে।থাকে পুরনো একটা বাসায়।সারাদিন হোন্ডাটা নিয়ে ভট ভট করে ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক।
মন কাঁদে ঢাকার জন্য।একটা ফাঁটাফাটি নিউজ করে আবার ফিরে যাবে ঢাকায়।টাকা কামানোর জায়গা তো ওটাই।সারাদিন রোদে পুড়ে ঘোরাঘুরি করে ঠিক আটটায় টাইপ রাইটারটা নিয়ে লিখতে বসেছে তৌফিক।
আজ যে সংবাদটা লিখবে তা হচ্ছে-নিমপুরে বেগুনের বাম্পার ফলন।চাষীরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেনা।মোটামুটি ঘষামাজা করে লিখলে,কিংবা একটু আবেগ মাখিয়ে দিতে পারলে ভালই একটা নিউজ হবে।এইফাঁকে একটা হাঁড়িতে দুই পট চাল আর কয়েকটা আলু এক সাথে বসিয়ে দিয়েছে তৌফিক।হয়ে গেলে একটা ডিম ভেজে নিলেই রাতের খাবার হয়ে যাবে।
সারাদিন বাইরে হোটেল থেকেই খেয়ে নিয়েছে।লিখতে বসে বারবার ঢাকার কথা মনে হচ্ছে।পত্রিকা অফিসের আড্ডা,কাপের পর কাপ চা,বাড়তি আয়।নতুন একটা নায়িকা এসেছে এফডিসিতে।নাম ঝুমুর।রাত বারটার পর মিহি গলায় ফোন দিত তৌফিককে।বলত তৌফিক ভাই,আমাকে নিয়ে কয়েকটা নিউজ করুন না।ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তৌফিক।
সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল নাহ,তুলকালাম করা একটা নিউজ ওকে করতেই হবে।
হঠাত তৌফিককে চমকে দিয়ে মোবাইলটা বেজে উঠল।রিংটোনটা বড্ড বিচ্ছিরি।অচেনা নাম্বার ভেসে উঠল।
হ্যালো,খুক করে কেশে গলাটা ঠিক করে চমৎকার ভাবে বলল সে।দীর্ঘ দিনের চর্চা।,তৌফিক বলছি।
কেডা হাংবাদিক ভাই নি?
জী,কে বলছেন?
ভাই,আমি তাহের।
কোন তাহের?
ঐ যে কলার পাইকার।দুপুরে এক লগে চা আর বিসকুট খাইলাম।পরে আপনের নাম্বার দিলেন আমারে।কইলেন ভাল কোনো খবর পাইলে য্যান রিং করি।
হ্যা,হ্যা,মনে পড়েছে।
এবার চিনতে পারল তৌফিক।রোগা ছোটখাট কলার ব্যাবসায়ীকে।গত পরশু পরিচয় হয়েছিল বাজারে।
ভাই মনে হয় আপনের লেইগা খবর আছে।
তাই নাকি?বলতো কী হয়েছে?উৎসাহী হয়ে পড়ল তৌফিক।
এরপর তাহের ‘আব আব’ করে যা বলে গেল শুনে তৌফিকের চোখদুটো বাকরখানির মত বড় বড় হয়ে গেল।একবার ভাবল শুনতে ভুল করেছে সে।
পরক্ষণেই চিন্তাটা বাতিল করে দিল।তাহের যা বলল,তা অনেকটা এরকম-নিমপুরের রেল স্টেশন ছাড়িয়ে আধা মাইল গেলেই বিশাল একটা মাঠ।শুধু বুনো ঘাসে ভর্তি।সেখানে কাঠের এক বাড়িতে বুড়ো এক দম্পতি থাকে একাই।আর কেউই থাকেনা।সেই কাঠের বাড়ির পেছনে নাকি তাহের একটু আগে একটা ছোটখাট ‘বিমান’ ল্যান্ড করতে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে।কিছুদুর এসে মনে পড়েছে ‘হাংবাদিক’ ভাইয়ের কথা।তারপর ফোন করেছে তৌফিককে।
মাগুর মাছের মত কলজেটা লাফ দিয়ে উঠল তৌফিকের।একেই বলে কপাল।এক্ষুনি বেরুতে হবে।
চুলা বন্ধ করে ভাতের হাড়ি নামিয়ে রাখল।তারপর আলনা থেকে খাকি রঙের ভেস্টটা চড়াতে চড়াতে হোন্ডার দিকে দৌড় দিল।ভেস্টটা পকেটে ভর্তি।আর সব সাংবাদিকরা যেমন পরে।পকেটেই আছে ডায়েরী,কাঠপেন্সিল,আর চার পাঁচটা কলম।ক্যামেরা নেই অবশ্য।সে তো আর ফটো সাংবাদিক না।তাই ডাঁট দেখাতে গিয়ে ক্যামেরা বহন করেনা তৌফিক কখনো।দরকার হলে পত্রিকা অফিসে ফোন দেয়।দুজন ভাতে মরা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার দৌড়ে আসে তৌফিককে সাহায্য করার জন্য।ব্যাপারটা তৌফিক উপভোগ করে।দুজন এসিস্টেন্ট ফটোগ্রাফার!কম কথা!
জায়গাটা চেনে তৌফিক।যতদূর সম্ভব স্পীডে হোন্ড চালাল সে।ভয়ে কয়েকটা ঘেয়ো রাস্তার কুকুর ‘কাওয়াই,কাওয়াই,কাওয়াই’ করতে করতে ছুটে পালাল যার যেদিকে চোখ যায়।অথবা মনিবের বাড়ির দিকে।
রাত বেশি হয়নি।মাত্র পৌনে নয়টা।মফস্বল শহর,মনে হচ্ছে মধ্যরাত।রাস্তায় লোকজনও বেশি নেই।আকাশটা পরিষ্কার।নখের মত এক ফালি চাঁদ আকাশে।অনেক তারা ঝিকমিক করছে।সুন্দর বাতাস ভেসে আসছে দূরের শঙ্খ নদী থেকে।হোন্ডার গতি বাড়িয়ে ইস্টিশন পার হয়ে চলে এল তৌফিক।সামনে ধূ ধূ মাঠ।দীঘল ঘাস দুলছে বাতাসে।সুন্দর একটা বনজ বনজ গন্ধ।শেওড়া আর বন পালং গাছগুলো।এতো জোনাকী পোকা জ্বলছে,অন্য সময় হলে মুগ্ধ হয়ে যেত তৌফিক।এখন সেরকম মুড নেই ওর।
তারার আলোতে দূর থেকেই কাঠের বাড়িটা দেখতে পেল সে।
বাহ!দারুণ তো।
একেবারে বিদেশী ছবিতে দেখা বাড়িগুলোর মত।টাকা পয়সা হলে এমন একটা বাড়ি বানাবে সে।সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।ঢাকা এয়ারপোর্টের কিছু খবর চেপে গেলেই পাওয়া যাবে সে রকম টাকা পয়সা।বাড়ীটার সামনে এসে হোন্ডা থামিয়ে ফেলল তৌফিক।কই?কিছু তো দেখা যাচ্ছেনা।
তাহের হারামজাদা …পোলাটা কি ফাজলামো করল নাকি ওর সাথে?ওকেই একটা ফোন দেয়া যাক আগে।মোবাইলটা হাতে নিতেই মেজাজটা খাট্টা হয়ে গেল তৌফিকের।চার্জ নেই।ব্যাটারি ডাউন হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে কোন ফাঁকে।আগেই খেয়াল করেছিল সে।ভেবেছিল খেতে বসার সময় চার্জ দেবে।তাছাড়া সন্ধ্যার সময় কারেন্টও ছিলনা।
সাত পাঁচ ভেবে বাড়ির দিকে এগোল তৌফিক।দেখাই যাক না নক করে।
অন্তত বুড়ো বুড়ির সাথে পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলা যাক।কখন কী কাজে লেগে যায়।একজন সাংবাদিকের কাছে মানুষ হচ্ছে বড় পন্য।ওর পত্রিকার সম্পাদক প্রায়ই বলেন কথাটা।
কাঠের বাড়ি ,কাঠের বেড়া।শুধু ছাদটা টিনের।পুরো বাড়ি সাদা রঙ করা।রাতের বেলা মনে হচ্ছে হাতির দাঁতে তৈরি সব কিছু।সামনেই কাঠের বারান্দা।।দুটো চেয়ার সেখানে।সম্ভবত বুড়ো বুড়ি বসে আড্ডা মারে।সুন্দর টিনের একটা শেডে পাকা কমলার মতো আলো জ্বলছে।
গট গট করে হেটে গেল তৌফিক।এরই মধ্যে ভেস্টের অনেকগুলো পকেটের একটার মধ্য থেকে বের করে ফেলেছে পরিচয়পত্রটা।এটাই ওর সবচেয়ে বড় অস্ত্র।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক মুহুর্ত ইতস্তত করল।নক করবে কিনা সিধান্ত নেয়ার আগেই ছোট পুচকে কলিংবেলটা দেখতে পেল।আর যায় কোথায়?চাপ দিলো সর্ব শক্তিতে।বাড়ির ভেতর বীটোভেনের খুবই পরিচিত একটা সুর বাজতে লাগল।ওটাই তাহলে কলিং বেলের আওয়াজ!প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝপাং করে খুলে গেল কাঠের দরজাটা।
দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন বুড়ো আর বুড়ি।বুড়োর চেহারা বেশ হাসি খুশি।রাতের বেলা অচেনা অতিথী দেখেও হাসিটা মলিন হল না একটুও।মাথা ভর্তি চকচকে টাক।শুধু কানের দুপাশে একমুঠো করে শিমুল তুলার মত সাদা চুল যেন আঠা দিয়ে সেঁটে দেয়া দিয়েছে কেউ।গোঁফ আছে একটা বাহারী।সেটাও সাদা।এত বড় গোঁফ থাকলে দুধের সর খায় কিভাবে মানুষ-ভাবলো তৌফিক।বুড়ির চেহারাও হাসিখুশি।চুলগুলো পনি টেইল করে বাঁধা।চোখে গোল ‘দিদিমনি’ মার্কা চশমা।দুই হাতে উলের কাঁটা।ব্যাস্ত ভঙ্গিতে উল দিয়ে সোয়েটার বা মাফলার জাতীয় কিছু একটা বুনছেন তিনি।কার জন্য কে জানে?
কী ব্যাপার বলুন তো?বুড়োই প্রথম প্রশ্ন করল।বিরক্তির বিন্দুমাত্র আভাস নেই চোখেমুখে।
ইয়ে মানে।খুক করে কেশে পেশাদারী ভঙ্গিতে বলল তৌফিক।আমার নাম তৌফিক আজিজ।আমি দৈনিক ভোরের আলো পত্রিকা থেকে এসেছি।
বুড়োবুড়ির চেহারাতে অবশ্য কোনো ভাবান্তর হলনা।সম্ভবত এরা এই পত্রিকা পড়ে না বা রাখে না।
কী যেন একটু চিন্তা করল বুড়ো।তারপর উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চেহারা।বলল,ওহ,আপনি কি আমার বাগানের গোলাপ ফুলের জন্য রিপোর্ট করতে এসেছেন?কিন্তু গত মাসেই তো ‘চ্যানেল নোজ’ থেকে শাইক জাফরী এসেছিলেন।বলেছেন এধরনের গোলাপ খুব একটা দুষ্প্রাপ্য নয়।আমাজনের গহীন বনে নাকি পাওয়া যায়।রাজা গোবিন্দের আমলেও আমাদের দেশে এর চাষ হয়েছে আগে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তৌফিক।বিনীতভাবে বলল,জী না,আমি গোলাপ চাষের ইন্টারভিউয়ের জন্য আসিনি।
তাহলে বোধহয় আমাদের পোষা ময়নাটা যে গত সপ্তাহে মারা গেছে সেটার জন্য ময়নাতদন্ত করতে এসেছেন।কি ঠিক বলিনি?যেন গোপন কোনো ব্যাপার ধরে ফেলেছে এমনভাবে বলল বুড়ো।জী না,আরো বিব্রতভাবে হাসল তৌফিক।আমি এসেছিলাম…
হ্যা বলুন,বলুন।উৎসাহ এবং তাগাদা দুটোই দিল বুড়ো।
বুড়ি সোয়েটার বা মাফলার বোনা বন্ধ করেছে।
ইয়ে মানে,আমাদের ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’ জানিয়েছে একটু আগে নাকি আপনাদের বাড়ির পেছনে…ইয়ে মানে…একটা প্লেন ল্যান্ড করেছে।জানি ব্যাপারটা একেবারেই অসম্ভব।তবুও মানে…বুঝতেই পারছেন।
প্লেন!অবাক হয়ে বুড়ো বুড়ি একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহুর্ত।নারে বাবা!প্লেন আসবে কোত্থেকে? এ দেখছি থ্রিলার কাহিনীর প্লট মনে হচ্ছে।অবাক হয়ে বলল বুড়ো।যেন বইয়ের নাম ‘শত্রু বিমান-১’ আর ‘শত্রু বিমান-২’।দুই খন্ডে সমাপ্ত।
তারপর প্রাণ খোলা হাসি হেসে ফেলল বুড়ো ক্যাত ক্যাত শব্দ করে।
ভাল কথা।নিজের ডান হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল বুড়ো।আমি মোতাহার চৌধুরী।অবস্রপ্রাপ্ত অধ্যাপক।আর এই হচ্ছে আমার গিন্নি।আগে নারায়নগঞ্জ থাকতাম।পরে এই খামার বাড়িটা বানিয়ে এখানে চলে আসি।ভালো করেছি না?শহরের যে পরিবেশ এই বুড়ো বয়সে আর পারছিলাম না।
বুড়োর হাত ধরে ঝাঁকাল তৌফিক।বুড়ি মানে,মিসেস চৌধুরীকে সালাম দিল।মিসেসও সালামের জবাব দিতে গিয়ে উলের কাটাটা প্রায় তৌফিকের চোখের মনিতে ফুটিয়ে দিয়েছিল আরকি!
তাহলে খবরটা ভুয়া বিড় বড় করে বলল তৌফিক। খুব একটা আশা করেনি,তারপরও মনটা খারাপ হয়ে গেল।
একদম তাই,সাংবাদিক সাহেব।হাসতে হাসতে বলল মোতাহার চৌধুরী।প্লেন নামেনি আমার খামার বাড়ির পেছনে।তবে একটা ফ্লাইং সসার নেমেছে একটু আগেই।
কী বললেন?ঠাট্টা করার বা শোনার মুড নেই তৌফিকের।বিরিক্ত হল বেশ।
ঠিকই শুনেছেন।উড়ন্ত সসার বা ইউএফও(UFO)।যাই বলুন না কেন ভাই।কী বিশ্বাস হচ্ছেনা?জানি বিশ্বাস হবার কথাও নয়।আসুন না, নিজের চোখেই দেখে যান।ওরা বেশিক্ষন থাকবেনা।এই তো যাবার সময় হল বলে।
ওরা?ওরা কারা?অবাক হল তৌফিক।
ওরা মানে ফ্লাইং সসারে করে যে দুজন এসেছে।ওদের গ্রহের নামটা ঠিক বলতে পারছিনা।বড় খটমটে শব্দ।আসুন না,দেখে যান।
বাড়ির ভেতর ঢুকতে বলছে বুড়ো।বুড়িও হাসছে।
সতর্ক হয়ে গেল তৌফিক।পাগলের পাল্লায় পড়েছে নাকি!আজ তো এপ্রিল মাসে এক তারিখও না!তাহলে?তারপরও সাংবাদিক সুলভ কৌতুহলের কাছে পরাজিত হল সে।ঢুকে পড়লো দরজার ভেতরে।তারপর বুড়ো বুড়ির পেছন পেছন হেঁটে বাগানে চলে এল।
প্রায় দুই একর জায়গার উপর বাগানটা।বিদেশী কিছু গার্ডেন ল্যাম্প জ্বলছে নানান জায়গাতে।বেশ লাগছে দেখতে।বেশ কিছু গোলাপ গাছের সারি।তারপর নানান রকমের অর্কিডের গাছ।কিছু বনসাঁই আর ক্যাকটাস।এক পাশে ছোট একটা জায়গাতে হাঁস মুরগী বা কবুতরের জন্য তৈরি ঘরদোর।ভালই খামারবাড়ি বানিয়েছে মিস্টার এবং মিসেস মোতাহার।কোথায় আপনার ফ্লাইং সসার?বিরক্ত হল তৌফিক।বুড়ো বুড়ির ভীমরতি ভাল লাগছেনা তেমন একটা।ঐ যে!আঙুল তুলে দেখালেন মোতাহার চৌধুরী।তার দেখানো জায়গাটাতে তাকিয়ে প্রথম কিচ্ছু দেখতে পেলনা তৌফিক।বেশ কিছু কামিনী ঝোপ সেখানে।তার নীচেই ছায়া ছায়া অন্ধকারে কী যেন একটা।উৎসাহের চোটে এগিয়ে গেল সে।
এবার দেখতে পেলো জিনিসটা।গোল একটা লাটিমের মতো জিনিস।আকারে মাঝারি একটা কামরার মতো।ধাতুর তৈরী।আবার আলোতে চক চক করছে।কোনো দরজা জানালা অবশ্য নেই।আরো এগিয়ে গিয়ে হাত দিল তৌফিক জিনিসটার উপর।কিছু বোঝার আগেই ছিটকে পড়ল সে কয়েক হাত দূরে।
এহহে।ছুটে এল বুড়ো বুড়ি দুজনেই।
এই প্রথম কথা বললেন মিসেস চৌধুরি।আগেই সাবধান করে দেয়া উচিৎ ছিল তোমার ছেলেটাকে।বেচারা কিভাবে জানবে ঐ ভিনগ্রহের মানুষগুলো কী একটা ‘ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক ফিল্ড’ বানিয়ে রাখে সসারটার চারপাশে যাতে অবাঞ্চিত কেউ এটার ক্ষতি করতে না পারে।
সত্যিই বড় ভুল হয়ে গেছে।চুক চুক করে আফসোস করলেন মোতাহার চৌধুরী।
হাত বাড়িয়ে উঠতে সাহায্য করলেন তৌফিককে।বোকার মত উঠে দাঁড়াল তৌফিক।মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।কিছুই বুঝতে পারছেনা।
জলদি ভেতরে চলো,আবার বললেন মিসেস।ওদের যাবার সময় হয়ে গেল বলে।
হ্যা,হ্যা,চল,চল।ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেলেন মোতাহার চৌধুরী।পেছন পেছন অন্য দুজনও।
সব কিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছে তৌফিকের কাছে।কী হচ্ছে এখানে?
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই প্রথমে পড়ল ড্রয়িংরুমটা।আর দশটা উচ্চ মধ্যবিত্তের সাজানো ড্রয়িংরুমের মতোই।ঢাউস চামড়ার এক সেট সোফা।মেঝেতে সুন্দর কার্পেট।একটা টিভি চলছে।এক পাশে একটা শো-কেস।তাতে রাজ্যের সব চীনেমাটির পেয়ালা আর তশতরী বোঝাই।সারাজীবিনের সংগ্রহ মিসেস মোতাহার চৌধুরীর।দেয়ালে বিশালে একটা পেইন্টিং।তেলরঙের।কী আঁকা সেটা একমাত্র শিল্পী ছাড়া কেউই বুঝতে পারবেনা।বেশ রঙ-চঙে অবশ্য।দেয়ালের আরেক পাশে বড় একটা কাঠের আলমারি।তাতে বেশ কিছু বইপত্র।সবই গবেষনামূলক।কিছু ঈদসংখ্যা,নানান পত্রিকাও রয়েছে।আর চামড়ার ঢাউস সোফাতে বসে আছে দুটি বাচ্চা।বসে বসে টিভি দেখছে আর টুস টাস করে শব্দ করে বাদাম ভেঙ্গে খাচ্ছে।
এতক্ষনে একটু চমক লাগল তৌফিকের কাছে।বাচ্চাদুটোকে দেখেই।কাঠের পুতুলের মত বসে আছে দুজন।একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।দুজনের পরনেই বিচিত্র পোষাক।আগে কখনো এ রকম বিচিত্র পোষাক কাউকেই পড়তে দেখেনি সে।দুজনের গায়ের রঙ হালকা গোলাপী।শরীরের ভেতর থেকে যেন আলোর ছটা বেরিয়ে আসছে।দুজনের চেহারাই প্রায় এক রকম।মনে হয় জমজ ভাই বোন।চোখ দুটো বড় বড় আর ড্যাব ড্যাবে।যেন খোসা ছাড়ানো লিচু।সবচেয়ে অদ্ভুত যেটা তা হল এদের হাতদুটো।ঠিক যেন অক্টোপাসের শুড়।বিদঘুঁটে।তৌফিককে দেখে দুজনেই মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে হাসার মতো একটা ভঙ্গি করল।এতক্ষনে তৌফিক বুঝতে পারল এরা বাচ্চা নয়।দেখতে ছোটখাট কোনো মানুষ।খুবই বেঁটে।
এসব কী?রাগ সামলাতে পারল না তৌফিক।বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল।এটা কি হ্যালোউইনের কোনো উৎসব নাকি,অ্যাঁ?নাকি যেমন খুশি তেমন সাজো?
জী না,অনাবিল হাসি হেসে বললেন মোতাহার চৌধুরী।এরাই সেই ভীনগ্রহের মানুষ।আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।তিন বছর আগেও একবার এসেছিল।
ফাজলামো পেয়েছেন?রাগে ফেঁটে পড়ল তৌফিক।এতবড় প্র্যাকটিক্যাল জোক করবার বুদ্ধি আপনাকে কে দিয়েছে?আমার সম্পাদক?নাকি অন্য পত্রিকার কোনো হারামি সাংবাদিক বন্ধু,অ্যাঁ?
তৌফিকের মারমুখী চেহারা দেখে একটু ভয়ই পেয়ে গেলেন মোতাহার চৌধুরী।দুই পা পিছিয়ে গেলেন দ্রুত।হাত দুটো তুলে ফেললেন মুখের সামনে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে।
প্লিজ,দয়া করে আমার কথা বিশ্বাস করুন।দ্রুত বলে গেলেন তিনি।আমি মিথ্যা বলছিনা।মিথ্যা বলে কোনো লাভও নেই।সত্যি বলছি ওরা অন্য একটা গ্রহ থেকে এসেছে।প্রথম আসে তিন বছর আগে।কী সব সংগ্রহ করছিলো ওরা।আমার কাছে আসে এক ডজন হাঁস আর মুরগীর ডিমের জন্য।ওরা গ্রহে নিয়ে গিয়ে ফোটাবে।তারপর সেই হাঁস মুরগীর বাচ্চা দিয়ে খামার বানাবে।তবে সেবার দীর্ঘ সময় লাগে সসারটা ওদের গ্রহে পৌছাতে।কাজেই সব ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়।আবার এসেছে আমার কাছে ডিম চাইতে।আমি এবার ডিমের বদলে বড় একটা খাচা ভর্তি করে ছয়টা মুরগী আর ছয়টা হাঁস দিয়ে দিচ্ছি ওদের।সাথে প্রচুর ক্ষুদ-কুড়োও দিচ্ছি।যাতে ফ্লাইং সসারের ভেতরে দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে প্রাণীগুলো।
এক নাগারে বলে দম নেবার জন্য একটু থামলেন মোতাহার চৌধুরী।
আর তৌফিক?উজবুকের মত দাঁড়িয়ে আছে।
এমন সময় একটা কান্ড হল।সেই অপার্থিব দেখতে দুজনের একজন উঠে দাড়াল পুরুষটা।
খুবই বেঁটে বেচারা।বড় জোর তৌফিকের কোমর পর্যন্ত হবে।হেলে দুলে হেঁটে এসে দাঁড়াল তৌফিকের সামনে।অক্টোপাসের শুঁড়ের মতো একটা হাত বাড়িয়ে দিল সামনে।তৌফিক পরিষ্কার দেখতে পেল তাতে চারটে করে আঙ্গুল।আঙ্গুলগুলো দিয়ে আলতো করে চেপে ধরল তৌফিকের কপালটা।অনেকটা জ্বর মাপার মত করে।কী যেন হলো তৌফিকের।
সারা শরীর দিয়ে অচেনা একটা শিহরন বয়ে গেলো।
পরিষ্কার দেখতে পেল-আলকাতরার মতো কালো মহাশুন্য।দপ দপ করে জ্বলছে বড় ছোট অনেক নক্ষত্র।মেঘের কুন্ডুলীর মত ছায়া পথ।গোলাপী,কমলা আর সাদা রঙের অনেক অনেক অনেক গ্যালাক্সী।ছোট,বড়।নিজ নিজ কক্ষপথে নানান গতিতে ঘু্রে বেড়াচ্ছে অসংখ্য গ্রহ।আর ছোট একটা স্পেস শিপে করে ছুটে চলেছে দুজন পিচ্চি পিচ্চি মানুষ।কে যেন ফিস ফিস করে বলল,আমরা এসেছি অনেক দূরের পথ থেকে।দূরের এক নক্ষত্রপুঞ্জে আমাদের বাড়ি।আমাদের শুভেচ্ছা নিন।
চমকে উঠলো তৌফিক।
চট করে হাত বা শুঁড় সরিয়ে নিল লোকটা।
কে,কে কথা বলল?বোকার মতো জিজ্ঞেস করলো তৌফিক।উতেজনায় বুক ধুক পুক করছে।
কেউ বলেনি।ফিস ফিস করে বললেন মোতাহার চৌধুরী।এটা এক ধরনের মানসিক যোগাযোগ।এভাবেই ওরা কথা বলে আমাদের সাথে।
তারমানে ওরা সত্যি ভীনগ্রহের মানুষ!চোখ বড় বড় করে ওদের দেখছে তৌফিক।পুরোপুরি বিশ্বাস এসে গেছে ওর মধ্যে।অন্য গ্রহের প্রানীদুটোও তৌফিকের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি ভঙ্গি করে আছে।হ্যা,ঠিক তাই!বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে আসছেন মোতাহার চৌধুরী।
অনেক দূর থেকে এসেছে?
হ্যা,কয়েকশ আলোকবর্ষ দূর থেকে।আলোর গতি জানেন তো? এক সেকেন্ডে প্রায় এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।অর্থাৎ প্রতি মিনিটে এক কোটি এগারো লক্ষ ষাট হাজার মাইল।এভাবে এক বছরে আলোটা যতদূরে যাবে সেটাই এক আলোকবর্ষ।এরকম কয়েকশ আলোকবর্ষ দূর থেকে এসেছে ওরা।
সব্বোনাস!
সংখ্যাটা আপনার কাছে বড় মনে হচ্ছে,তাইনা?তবে আমাদের পূর্বপুরুষরা কিন্তু ক্যালকুলেটর ছাড়াই বড় বড় সংখ্যা হিসেব করতে পারত।বৈদিক যুগে ওরা ‘মহৌর্ঘ’ পর্যন্ত হিসেব করত।মানে হচ্ছে,এক শত লক্ষে এক কোটি।এক লক্ষ কোটিতে এক শংকু।এক লক্ষ শংকুতে এক মহাশংকু।এক লক্ষ মহা শংকুতে এক বৃন্দ।এক লক্ষ বৃন্দে এক মহাবৃন্দ।এক লক্ষ মহা বৃন্দে এক পদ্ম।এক লক্ষ মহা পদ্মে এক খর্ব।এক লক্ষ খর্বে এক সমুদ্র।এক লক্ষ সমুদ্রে এক মহৌর্ঘ।কাজেই সেই সময়….
আপনি থামুন তো।কড়া একটা ধমক দিয়ে চুপ করাল তৌফিক মোতাহার চৌধুরীকে।এত দূরের পথ ওরা আসে যায় কি করে?আপনিই না বললেন তিন বছর আগে এসেছিল?তাহলে এত জলদি আবার ফিরে এল কি করে যদি কয়েকশত আলোকবর্ষ দূরে থাকে ওদের বসতি?
আসলে ভিন্ন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে ওরা।হাসি হাসি মুখে ব্যাখ্যা করলেন মোতাহার চৌধুরী।চোখের পলকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে ওরা এই পদ্ধতিতে।কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সূত্র অনুসারে…
থাক,থাক।বাধা দিল তৌফিক।বুঝতে পেরেছি আমি।দ্রুত চিন্তা চলছে ওর মাথায়।দুনিয়ে কাঁপানো সংবাদ তৈরী করবে সে।এখনই।বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামাতে হবে।সবই ওর হাতের মুঠোয়।আপনার কাছে টেলিফোন আছে?জিজ্ঞেস করল তৌফিক।এই মুহুর্তে আমাকে ঢাকার অফিসে খবর দিতে হবে।
না রে বাবা।লজ্জিতভাবে বললেন মোতাহার চৌধুরী।কিছুদিন আগেও ছিল।বড় ছেলে ইংল্যান্ড থেকে ফোন করত প্রতি মাসে।তারপরই হঠাৎ করে সব ভৌতিক বিল আসা শুরু করল।টেলিফোন অফিস থেকে বলল।আমরা নাকি লং ডিসট্যান্সে কিরগীস্তানে ফোন করি!এক মাসে বিল এল দশ হাজার টাকা।বলুন এবার!তাই বাধ্য হয়ে ফোনটা বাদ দিয়ে দিলাম।
মোবাইল ফোন নেই আপনার বা মিসেসের কাছে?
না রে বাবা।ছিলো একটা।দুজনেই শেয়ার করে ব্যাবহার করতাম।গতকাল বিকেলে বাজারে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি।যে পেয়েছে সে ফেরত দেবে বলে মনে হয়না।সেটটা একেবারে নতুন ছিল।মেয়ের জামাই কানাডা থেকে পাঠিয়েছিল।আর পকেটমারে নিয়ে গিয়ে থাকলে তো প্রশ্নই আসেনা ফেরত পাঠাবার।
উফ!বিরক্ত হলো তৌফিক।মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর দ্রুত।প্রতিবেশী কারো বাসায় পাওয়া যাবে?
তা হয়ত যাবে।একটু চিন্তা করে বললেন চৌধুরী।কিন্তু সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী গনেশ পাইনের বাড়ি তো আধমাইল দূরে।তাকেও পাওয়া যাবে কিনা বলা মুশকিল।ব্যাচেলর মানুষ তো।প্রায়ই রাত বিরেতে বাড়ি ফেরে।
রাগে দিশেহারা হয়ে গেল তৌফিক।
ব্যাটা বুড়ো হাঁদা কোথাকার!
এমন সময় চটজলদি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ভিনগ্রহের মানুষ দুটো।
কী ব্যাপার?জিজ্ঞেস করলো তৌফিক।
মানে ওদের চলে যাবার সময় হয়ে গেছে কিনা।বললেন বুড়ো মোতাহার
।না।ওদের থাকতে বলুন,প্লিজ।আমি পত্রিকা অফিসে খবর দিতে চাই।ওদের ইন্টারভিউ নিতে চাই।ফটোগ্রাফার এনে ওদের ছবি তুলে রাখতে চাই।সারা পৃথিবী জানুক ওদের কথা।আমাকে সাহায্য করুন।
শেষের দিকে হাস্যকরভাবে গলা ভেঙ্গে গেল তৌফিকের।
তা সম্ভব না।বিষন্ন হেসে বললেন মিসেস চৌধুরী।একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর এদের ফ্লাইং সসারের আশে পাশের চৌম্বকক্ষেত্র বদলে যেতে থাকে।সাথে সাথে চলে যেতে হবে ওদের।
ভীনগ্রহের মানুষ দুটো বেশ অস্থির হয়ে পড়েছে বোঝাই যাচ্ছে।একজন বার বার পকেট থেকে পুরনো আমলের ট্যাঁক ঘড়ির মতো কী একটা বের করে দেখছে।অসংখ্য ডায়াল আর কাটায় ভর্তি সেটা।টুপ টুপ করে শব্দও হচ্ছে।
মিসেস চৌধুরী দৌড়ে গিয়ে বড় একটা লোহার খাঁচা এনে রাখলেন তাদের সামনে।ভেতরে বেশ কিছু হাঁস আর মুরগী বসে বসে ঝিমুচ্ছে।হাসি হাসি ভঙ্গি করে হাত অথবা শুঁড়ের সাহায্যে তুলে নিল সেটা ভীনগ্রহবাসী পুরুষটা।তারপর দুজন একসাথে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
চলে যাচ্ছে ওরা!আতংকের সাথে উপলব্ধি করল তৌফিক।দূর মহাকাশের দুজন প্রাণী চলে যাচ্ছে নিজেদের গ্রহে।বাইরে ওদের ফ্লাইং সসার।সবই ঘটছে ওর চোখের সামনে।কিন্তু কাউকে বললে বিশ্বাস করবে?
প্রমাণ কোথায়?কিছুই কি করতে পারবেনা সে?
ওদের থামতে বলুন মোতাহার সাহেব।পাগলের মত চিৎকার করে বলল তৌফিক।
দুঃখী মানুষের মত হাসলেন মোতাহার দম্পতি।কিছু বললেন না।
আপনার কাছে ক্যামেরা আছে?হঠাত করেই মনে পড়ল কথাটা তৌফিকের।
আছে।মাথা ঝাকালেন মোতাহার চৌধুরী।
জলদি নিয়ে আসুন।যে করেই হোক ওদের কয়েকটা ছবি তুলে রাখতে হবে।
ঝড়ের বেগে অন্য কামরাতে চলে গেলেন মোতাহার চৌধুরী।সম্ভবত ওটা তার স্টাডিরুম কিংবা বেডরুম।
বিশাল এক টেবিল।কমপক্ষে ছয়টা ড্রয়ার তাতে।‘হড়াত’ করে টান দিয়ে খুলে ভেতরের জিনিসগুলো ঘাঁটতে লাগলেন বেচারা ।
ধীরে ধীরে বাইরে চলে গেল গ্রহান্তরের প্রানীদুটো।ঝুপ ঝুপ করে অসংখ্য নীল কমলা আলো জ্বলে উঠল ফ্লাইং সসারটার মাথার উপর।ভেতর থেকে নেমে এল চলন্ত একটা সিড়ি।
জলদি করুন মোতাহার সাহেব।ওরা চলে যাচ্ছে।চেচিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলল তৌফিক।
ইয়ে মানে…কোথায় যে রেখেছি জিনিসটা খুজে পাচ্ছিনা।বিব্রত গলায় বললেন মোতাহার চৌধুরী।টুসির জন্মদিনেই তো ব্যাবহার করলাম ক্যামেরাটা।কোথায় যে রাখলাম।দরকারের সময় কিচ্ছু যদি পাওয়া যেত
!হাঁস মুরগীর খাঁচা নিয়ে ধীরে ধীরে চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল অপার্থিব প্রাণীদুটো।একেবারে উপরে উঠে তৌফিক আর মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে হাত না নাড়ল।বিদায় নেয়ার ভঙ্গিতে।ধীরে ধীরে উঠে গেল সিঁড়িটা।বন্ধ হয়ে গেল দরজা।ভেতর থেকে দৌড়ে চলে এলেন মোতাহার চৌধুরী।হাত খালি।ক্যামেরা নেই।বাচ্চা ছেলের মত হাত পা নাড়ছেন।সসারটার উদ্দেশ্যে।খুশি খুশি গলায় বললেন,ভাল থেকো তোমরা।ভালোভাবে বাড়ি ফিরে যাও।
ক্যামেরা কোথায়?গর্জে উঠল তৌফিক।
পাচ্ছিনা খুজে।নির্লিপ্তভাবে বললেন তিনি।এখনো হাত পা নাড়ছেন।হাসি গিয়ে ঠেকেছে দুই কানের লতি পর্যন্ত।
বড় একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে শুন্যে উঠে গেল সসারটা।তারপর আরো,আরো উপরে উঠে যেতে লাগল।আরো অনেক উপরে।তারপর এক সময় ছোট্ট একটা বিন্দু হয়ে হারিয়ে গেল রাতের আকাশে।
ওরা আবার আসলে সত্যি খুশি হব আমি।বললেন মোতাহার চৌধুরী।এখনো হাত পা নাড়ছেন তিনি।
আমি জানি।সায় দিলেন মিসেস।কিন্তু ওরা আর কখনই আসবে না।বলেছে আমাকে।আরো অনেক গ্রহে নাকি যেতে হবে ওদের।
বাইরে গভীর হাওয়ার রাত।আকাশ ভর্তি নক্ষত্র।বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ঘাসের গন্ধ।বুক ভরা বেদনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৌফিক।চোখের সামনেই ঘটে গেল বিচিত্র এক নাটক।কোনো প্রমাণ রাখতে পারল না সে।এতক্ষনে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি অথবা বৈদিক আমলের হিসেব অনুযায়ী মহাপদ্ম মাইল দূরে চলে গেছে ওরা।
আর কখনই ফিরবে না পৃথিবীতে।বোকা তৌফিক কোনো প্রমাণ রাখতে পারেনি।ওর সম্পাদক সাহেব শুনলে গুলী করে মারবে ওকে!ব্যার্থতাবোধ মানুষকে ক্লান্ত করে তুলতে পারে অতি সহজেই।খুবই দুর্বলবোধ করছে তৌফিক।হাটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে যেন।হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসতেই দৌড়ে মোতাহার চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।এখনো হাত পা নাড়ছে দুজন।
মোতাহার সাহেব!উত্তেজিতভাবে বলল তৌফিক।প্রথমবার যখন ওরা আপনার কাছ থেকে হাঁস মুরগীর ডিম নিয়েছিল,বদলে কি আপনাকে কোনো কিছু দিয়েছিল মূল্য হিসেবে?
হ্যাঁ,হ্যাঁ, দিয়েছিল তো।ওদের দেয়া মুদ্রা বা টাকাগুলো দেখাতে পারবেন আমাকে?
ওরা তো টাকা পয়সা দেয়নি বাবা।মুদ্রার প্রচলন নেই ওদের গ্রহে।
তাহলে কী দিয়েছিল?
একহালি ডিম দিয়েছিল।ওদের গ্রহের হাঁসের ডিম।
ডিমগুলো কোথায়?
সেগুলো আমরা খামারের হাঁস দিয়ে ‘তা’ দিয়েছিলাম।বড় কুৎসিত ডিমগুলো।রং বেগুনী।ইয়া বড় বড়।মনে হয় উট পাখির ডিম।আর ডিমের খোসাও খুবই রুক্ষ।মনে হয় ঝামা।
তারপর?
তারপর আর কী।দুটো ডিম ফুটে বাচ্চা হল।আর দুটো ফুটলোই না।নষ্ট হয়ে গেল।
সেই ভীনগ্রহের হাঁসের বাচ্চাদুটো কোথায়?নিজের অজান্তেই গলার স্বর চড়ে গেল কয়েক ধাপ তৌফিকের।
অনেকদিন পর্যন্ত আমরা হাঁসের বাচ্চাদুটো পুষেছিলাম।দেখতে অবশ্য কুৎসিত হয়েছিল প্রাণীদুটো।ছয়টা করে পা।আর চোখদুটো যেন বড় বড় কাঁচের পেপার ওয়েট।অন্যসব হাঁসের মত প্রচুর শামুক আর গুগলী খেতে পছন্দ করত ওরা।পালকগুলো ছিল কমলা রঙ্গের।স্মৃতিচারণ করছেন মোতাহার চৌধুরী।
কোথায় ও দুটো? চিৎকার করে উঠল তৌফিক।বুড়োটার মুখে একটা বিরাশি সিক্কা ওজনের ঘুষি মেরে বসবে নাকি?
ওই হাঁসদুটো তো নেই রে বাবা।
সে কী!কেন?
গতবছর নববর্ষের সময় লেখক মিলন গাঙ্গুলী এসেছিল আমাদের বাড়িতে।ছেলেটা আমার বড় ছেলের সাথে একই ক্লাসে পড়ত।তো সেই হাসদুটো কেটে কুটে আমরা রান্না করে খেয়ে ফেলেছি সে সময়।খারাপ হয়নি খেতে।আমার গিন্নির রান্নার হাত খুবই ভাল।প্রচুর দারুচিনি আর জায়ফল দেয়া হয়েছিল।কষা কষা মাংস।উহ!
রাগে পিত্তি পর্যন্ত জ্বলে গেল তৌফিকের।
মিলন গাঙ্গুলীর পিন্ডি চটকাতে চটকাতে ভাঙা গলায় বলল,হাঁসদুটোর কংকালটা কোথায়?মানে হাড়গোড়গুলো কী করেছিলেন?বাগানের কোথাও ফেলেছিলেন?
না রে বাবা।হাড্ডিগুলো আমাদের পোষা কুকুরটা খেয়ে ফেলেছিল।
কুকুরটা কোথায়?
আহ!বড্ড দুঃখের কথা।
মাস তিনেক আগে কুকুরটা মারা গেছে।জলাতংক হয়েছিল।পৌরসভার লোক এসে ওর লাশটা কোথায় নিয়ে ফেলে দিয়েছে কে জানে।ওরই নাম ছিল টুসি।আমার গিন্নি ওরই জন্য একটা সোয়েটার বুনছে।
চরম হতাশায় ডুবে গেল তৌফিক।কী বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।এত বড় একটা ঘটনার কোনও প্রমাণই রইল না আমাদের হাতে।বিড়বিড় করে বলল সে।
তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।সায় দিলেন মোতাহার চৌধুরী।
দোয়া রাখি আপনাদের মত বুড়ো গাধা যেন বাংলার ঘরে ঘরে না থাকে।ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে বাইরের দিকে এগোল তৌফিক।
বাসায় ফিরতে হবে।প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে ওর।
এক মিনিট!কী যেন মনে পড়তেই চিৎকার করে উঠলেন মোতাহার চৌধুরী।তারপর দৌড়ে চলে গেলেন ঘরের ভেতরে।আশায় বুকটা ধক করে উঠল তৌফিকের।
এক মুহুর্ত পরেই ফিরে এলেন মোতাহার চৌধুরী।হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,পেয়েছি!পেয়েছি!
কী?আগ্রহে দুই পা সামনে চলে এল তৌফিক।
ক্যামেরা!হাসি হাসি মুখে বললেন মোতাহার চৌধুরী।