অচেনা ক্ষুদে এক জগৎ

লোকটা আসলে ছিল মুদি দোকানদার।
জন্ম ১৬৩২ সালের ২৪ অক্টোবর। হল্যান্ডের ডালফ শহরে।
লেখাপড়া তেমন জানতো না।
মাত্র ষোল বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় ইশকুল ছেড়ে কাজে লাগতে হয়েছিল।
বাবা তেমন মস্ত বড় লোক ছিলেন না। ঝুড়ি বানিয়ে বিক্রি করতেন।
যাই হোক উনার নাম হচ্ছে- আন্টনি ভ্যান লেভিনহুক।
উনি কিন্তু বিজ্ঞানী না।
তারপরও মস্ত বড় বিজ্ঞানী হয়ে গেলেন । কি করে ?
কৌতূহল ছিল তার ।
চশমা দেখেছিলেন লেভিনহুক।
চশমার কাঁচে পিচ্চি জিনিস বড় দেখায়। এটা জানতেন তিনি। ভাবলেন চশমার কাঁচ
যদি একটু ভাল মত মেরামত করা যায় তবে নিশ্চয়ই ক্ষুদে জিনিস আরও বড় দেখা যাবে ?

তো কাজে লেগে গেলেন তিনি।
কাজ বলতে তেমন কিছু না। চ্যাপ্টা একটা পেতলের হাতলওয়ালা পাতের সাথে কায়দা করে একটু শক্তিশালী কাঁচের টুকরো বসিয়ে দিলেন। শখ করে সেই বিদঘুটে
খেলনার নাম রাখলেন – মাইক্রোস্কোপ।মাইক্রো শব্দের মানে – খুব ছোট জিনিস। আর
স্কোপ মানে দেখা। অর্থাৎ -যে জিনিস দিয়ে খুব ছোট জিনিস দেখা যাবে।
আমরা যেটা অণুবীক্ষণ যন্ত্র বলি আর কি।
সেই বিদঘুঁটে যন্ত্র বানিয়ে লোকটা যেন পাগল হয়ে গেল।
সারাক্ষণ সেই কাঁচের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। কি দেখেন কে জানে।
দেখেন আর বিড়বিড় করে কথা বলেন – ‘হায় হায়। এটা কি ? এ তো সাংঘাতিক
জিনিস রে ভাই।’
এমন সব কথা বলেন।
আবার নোট বইতে কি সব যেন লিখে রাখেন।
হাতের কাছে যা পান তাই সেই বিদঘুটে কাঁচের যন্ত্রের নীচে রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
দেখেন। গাছের পাতা।বাসি পাউরুটি। পাথরের টুকরো। মাংসের টুকরো , সব কিছুই
তিনি তার মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখে দেখেন।
কি মনে করে পুকুর থেকে এক লোটা পানি এনে সেই যন্ত্রের নীচে রেখে চোখ রাখতেই
হায় হায় করে উঠলেন তিনি।
দেখে তো পরিষ্কার টল টলে পানি বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ওখানে কি সব কিলবিল
করছে।
মনে হচ্ছে ব্যস্ত এক শহরের রাস্তা, অনেক মানুষ গিজ গিজ করছে।
সেই শহরের সবাই হুক সাহবেকে পাগল বলেই জানতো।
সবাই বলতো- জাদুর কাঁচে সে নাকি সারাদিন কি সব দেখে।অথচ খালি চোখে কেউ সেই সব দেখে না।
লেভিনহুক তেমন লেখাপড়া জানতেন না। তাই যা দেখতেন তার ছবি এঁকে রাখতেন।
পরিচিত শিক্ষিত লোকদের সাথে কথা বলতেন। কেউ বুঝতই না।
অথচ তিনি পরিষ্কার দেখতেন গাছের কোষ যেন ইটের তৈরি দেয়াল। মাংসের পেশি যেন মোটা দড়ির তৈরি কিছু। রক্তের ভেতরে গলগল রক্ত কণিকা দৌড়া দৌড়ি করে।
শেষে কোত্থেকে যেন খবর পেলেন লন্ডনে রয়্যাল সোসাইটি নামে একটা জায়গা আছে ওখানের লোকজন অনেক জ্ঞানী। নতুন খবর পেলে খুশি হবে।
সব কিছু গুছিয়ে একটা চিঠি লিখলেন তিনি।
রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা লেভিন হুকের চিঠি পেয়ে হাসতে হাসতে মারা
যায় আরকি।
কাণ্ড দেখ। কোন এক পাগল চিঠি লিখেছে , এক বালতি পানি ভেতরে নাকি হাজার হাজার জীব জন্তু সাঁতরে বেড়াচ্ছে। পাগল আর কাকে বলে।
কিন্তু লেভিন হুক অনেকগুলো মাইক্রোস্কোপ বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে তাদের কাছে।
তারা ওর ভেতর দিয়ে তাকিয়ে কেমন ভম্বল হয়ে গেল।
আরে সত্যি তো।
এই সব কি ?
চিঠি চালাচালি হতে লাগল লেভিনহুক আর রয়্যাল সোসাইটির মধ্যে।
শহরের লোকজন তত দিনে বুঝে গেছে লেভিন হুক লোকটা নেহায়েত খারাপ না।
কারন রয়্যাল সোসাইটি থেকে চিঠি আসে তার কাছে।
তোমরা কিন্তু জানো না আমাদের এই আন্টনি ভ্যান লিউয়েন হুক পৃথিবীর প্রথম
মাইক্রোবায়োলজিস্ত। তার সেই ‘পিচ্চি জীবজন্তু’ আর কিছুই না। জীবাণু।
তার এই আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগৎ পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল।
১৭২৩ সালের ৩০ আগস্ট মারা যান এই বিজ্ঞানী।
মৃত্যুর আগে তার বয়স ছিল প্রায় একানব্বই। সারা জীবন তিনি কাঁচের মধ্যে দিয়ে
অচেনা ক্ষুদ্র এক জগতের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
কারন এই জগতের দরজা তিনিই খুলেছেন।