অন্ধকারের ছায়া – ১

এক

বিড়িতে লম্বা করে একটা টান দিয়ে ঘন কুয়াশার মধ্যে ধোয়াটা অনেকখন ধরে ছাড়ল শাহজাহান।
কালো কুচকুছে রোদেপুরা মুখটা তার আরও কুত্সিত দেখায় একটা চোখ নেই বলে । বিরাশিতে যখন বসন্ত হয়ে গ্রামকে গ্রাম উজার হতে চলেছে তখন এক সন্ধায় সারা গা জুড়ে ম্যাজম্যাজে ব্যাথা নিয়ে বাড়ি ফিরল সে।
রাত্রে গা গুলিয়ে এল তীব্র জ্বর ।সে জ্বরের ছটায় সারারাত গুঙিয়ে কাটাল সে। সকালে তার সারা গা জুড়ে বেরোল কালচে কালচে ঘা এর মত গুটি বসন্ত।
তার মা গিয়েছিল ভাইয়ের বাড়ি।
এসে দেখে ছেলের এই অবস্থা। খবর পেয়ে লোক এলো ছুটে। সবাই ভাবল শাহজাহান বুঝি আর বাঁচেনা।
তার মা গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগল দিনরাত। তিনকুলে একমাত্র ছেলে ছাড়া আর কেউ ছিলোনা তার। বাপ মরা ছেলেটাও এবার গেলে একেবারেই নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হবে তাঁকে। এইসময় কোথা থেকে যেন উড়ো খবর আসলো  শাহজাহানের মায়ের কাছে। মেঘনার পাড়ে মাস ছয়েক আগে একটা নতুন চর ভেসে উঠেছিল। দিনে দিনে ঘরহারা মানুষ জড়ো হয়ে ওখানে একটা গ্রামের মতোই গড়ে উঠেছে। আর সেই গ্রামে কোত্থেকে যেন এসেছে কবিরাজ।আলেম লোক। নাম হাসেব। লোকে ডাকে হাসেম কবিরাজ বলে।
ভয়ানক ক্ষমতা তার। হেন কোন রোগ বালাই নাই যেটা ওনি দুর করতে পারেন না। খবর পেয়ে শাহজানের মা ছুটলেন হাসেম কবিরাজের সন্ধানে।
সেইরাতে নিমপাতা ছিটিয়ে ঝাড়ফুক করে দিয়ে গেল হাসেম কবিরাজ।দরজার সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে গেল একটা কাপড়ে বাঁধা মাদুলি।
বলে গেলোঃ “মা, আর ভয় নেই। আল্লাহ রহম করব!”।
সেই মাদুলি আর ঝারফুকের জুড়ে হোক আর শাহজাহানের মনে জুড়েই হোক দু সপ্তাহ ভোগে একটা চোখ বিসর্জন দিয়ে সেরে উঠল সে।

বসন্ত থেকে উঠে নতুন করে জীবন শুরু করল শাহজাহান।
১০০টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসল। সেই টাকায় বাজারে ব্যবসা দিয়ে কদিনেই কপাল ফিরাল।
বছরান্তে তার ঘর জুড়ে এলো ফুটফুটে মেয়ে। শখ করে সে নাম রাখল ফুলমতি। ফুলের মতই মেয়ে বটে তার । রুপ পেয়েছে মায়ের, কিন্তু বুদ্ধি পেয়েছে শাহজাহানের। আদতে শাহজাহানের বউটা তেমন চালাক চতুরও না। সুতরাং মেয়ের বয়স বছর সাতেক পেরোতে না পেরোতেই মাকে পরাজিত করে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে নিল সে।  শাহজাহানের মুদির দোকান বেশ ভালোই ফুলে ফেপে উঠেছিলো বাজারে। কিন্তু সে ভাগ্যেরও একদিন শিকে ছিড়লো।
একদিন পাতা কুড়াতে গিয়ে সন্ধা করে বাড়ি ফিরল ফুলমতি। সেরাতে তার গা জুড়ে এলো ভয়ানক জ্বর।
শাহজাহান চিন্তিত হয়ে গেল। তার মা বলল ‘বদ বাতাস লাগছে ,কবিরাজ ডাক !’
সে রাতে দুমাইল হেটে কবিরাজ নিয়ে আসলো শাহজাহান। কিন্তু মেয়েটা বাচলনা।
শাহজাহান সারা রাত ঘরের বারান্দায় বসে রইল। কাঁদলনা ।কিছু বললওনা । বউটা ঘরে মেয়ের শোকে মাথা কুটে সারারাত কাঁদল। তাকে সান্তনাও দিলনা ।
সকলেই জানে , এরপর থেকে কানা শাহজাহান গোমরে গেছে ।
ব্যবসায় মন নেই। কদিনেই ব্যবসা লাটে উঠল। বাধ্য হয়ে শেষমেষ পরের খেতে কামলা খাটা শুরু করল।

: কি শাজান ভাই , ঘন্টা ধরে বিড়ি খাইলে কাম করবা কহন ?
কবির মোল্লার কথায় সম্বিত্ ফিরে শাহজাহানের। হাতের বিড়িটা ছুড়ে ফেলে দূরে ।দু হাতে কচি ধানেয় চারা ধরে সযত্নে উপড়াতে থাকে সেগুলো। কবিরও পাশের ক্ষেতে বসে পড়েছে । কবিরকে শাহজাহান পছন্দ করেনা ।
পোলা বেশি কথা বলে। মুখে মধু হলে কি হবে , অন্তরে তার বিষ ।
একবার কথা বলা শুরু করলে আর থামতে চায়না ।
কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে দেয় ।
: শাজান ভাই ,এবার পোষেই যে জার মাঘের শীতে তো বাচার পথ দেখিনা ।
শাহজাহান উত্তর দেয়না ।চুপচাপ কাজ করে চলে । ধানের চারা তুলে সাজিয়ে রাখে একপাশে । তারপর মুঠি মুঠি চারা একসাথে করে করে খর আটি বেঁধে পাশে রাখা ঝুড়িটায় ছুড়ে ফেলে আরেকটা বিড়ি ধরায় ।
: শাজান ভাই , বিড়ি ধরাইলা নাকি আবার। দুইটান দিও।
: তোর বিড়ি কই ?
রাগ করে বলে শাহজাহান।
: আর কইওনা । বউডা অইছে মনভুলা । কত কই বিড়ি..
বিড়বিড় করে কি বলে কবির কানে আসেনা শাহজাহানের ।সে মনে মনে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে কবিরকে । কৃপন হিসেবে গ্রাম নাম আছে কবিরের । অবশ্য আলসে সে নয় । বাপ মরার সময় কবিরের বয়স আট কি দশ । সেই বয়সসথেকেই সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে সে । দশ বছরেই বাপের রেখে যাওয়া জমিকে করেছে দ্বিগুন ।
ছনের ঘর ভেঙে তুলেছে টিনের ঘর । কয়েকদিন আগে দুহাজার টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়েও করেছে । বিয়েতে তার ৩০০টাকা খরচ হয়েছে বলে নাকি একমাস সে রাতে ঘুমাতে পারেনি বলে সমাজে একটা কানাঘুসা আছে ।

আধখাওয়া বিড়িটা বিরসমুখে কবিরের দিকে এগিয়ে দেয় শাহজাহান ।
বিড়িটা নিয়ে জুত্ করে লম্বা একটা টান মারে কবির ।
তারপর বলে ,
: ভূঁইয়ার কামলা আর কদ্দিন খাটবা ভাই ? এবার নিজে কিছু কর । পরের খেতে আর কদ্দিন ?
শাহজাহানের হাত থেমে যায় ।
: কামলা খাডি ভালা কলি । তোমার বাইতও আর একবেলা খাইবার যাইনাই !
রাগ সামলাতে পারেনা সে ।
শাহজাহানের আকস্মিক রাগে অবাক হয়ে যায় কবির ।
বড় বড় টানে বিড়িটা দ্রুত শেষ করে ফেলে । পাছেনা আবার শাহজাহান সেটা ফিরিয়ে নেয় ।
: রাগ অও ক্যান ভাই । খারাপ কতা কইছিনি কোন ? আসলে জাননি ভাই এইডা অইল শেষ জামানা । বড়ই আজব জামানা ।
কাওরে বাল কতা কইলে রাগে তার গা জ্বইল্লা যায় আর খারাপ কতা কইলে তো ..
শাহজাহান চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে দেখে থেমে যায় সে ।

কুয়াশা কেটে গেছে । সুর্যটা আস্তে ধীরে একটু একটু করে উকি দিচ্ছে । যেন চিন্তায় আছে । ভাবতে বসে ছে । ভেবে কুল পাচ্ছেনা , উঠবে কি উঠবেনা ।
কয়েকটা খেতে আজ ধান বুনা হবে ।কামলারা বিড়ি মুখে পুরে দড়ি গেরে কাঁদা পানিতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে লাইন ঠিক করেছে নিচ্ছে ।
করিম মোল্লা খেতে মই দিচ্ছিল মতি মিয়া। একটা অতিথী পাখি ক্যাক করে চেচিয়ে উঠতেই গরু গুলো ভড়কে দিল উল্টো দৌড় ।সেখানে পা বিছিয়ে চিত্ হয়ে উল্টে পড়ল মতি মিয়া ।
রাস্তা দিয়ে দলবেঁধে মক্তব থেকে ফিরছিল ছেলেমেয়েরা । এই কান্ড দেখে তারা হাত তালি দিয়ে উঠলো ।
মতি মিয়া গরু ছেড়ে তাদের বড় রাস্তা পর্যন্ত দৌড়িয়ে নিয়ে গেল ।