শিকারের শেষ মৌসুম

বসন্ত প্রায় শেষ।
বাতাসে শীতের ছোঁয়া।
সন্ধ্যার পর তো ভালই শীত লাগে।অচেনা কিছু ফুল ফুটেছে দুই ধারে, যেগুলো শুধু বসন্তের শেষে ফোটে।শিকারের মৌসুম প্রায় শেষ। এখন আর কেউ আসবেনা শিকারে। এসে কোনো লাভও নেই। জঙ্গলটা ন্যাড়া হয়ে যাবে। সব জীবজন্তুগুলো চলে যাবে শীত ঘুমে। শুকনো পাতার স্তুপ এত উঁচু হবে যে, হাঁটতে গেলে মনে হবে পাঁপর ভাজার উপর দিয়ে হাঁটছে কেউ।
নিজের উপরই ক্ষেপে আছে বদরুল।বড্ড ভুল সময়ে এসেছে এবার শিকারে।না এলেও পারত। কিন্তু নেশা। এ এক ভয়াল নেশা। গত দশটা বছর নিয়মিত আসছে সে শিকারে, এই জঙ্গলে। এখানকার প্রত্যেকটা গাছপালা ওর কাছে দারুণ পরিচিত। প্রত্যেকটা ঘন ঝোপ, বুনো গুল্ম, অর্কিড, প্রজাপতি সব কিছু টানে ওকে। তাইতো প্রত্যেক বছর বসন্তের শেষে চলে আসে জঙ্গলের ভেতরে। দক্ষ শিকারী হিসেবে নাম আছে ওর। আর এই জঙ্গলের বুনো হরিণগুলোও বেশ বিখ্যাত। কানাডার আর কোনো গহীন বনভূমিতে এরকম বড় শিং ওয়ালা হরিণ পাওয়া যায়না। স্থানীয় লোকেরা হরিণগুলোকে বলে’ মুস ‘।
এবছর কোম্পানি ওর ছুটিটা দিল একটু দেরি করে। এত দেরি করল যে, শিকারের মৌসুমটা গেল শেষ হয়ে। অন্য কেউ হলে আসত না। বদরুল অন্য ধাতুতে গড়া। অরন্যের স্বাদ যে একবার পেয়েছে সেই শুধু জানে এর টান উপেক্ষা করা কত কঠিন। চলে এসেছে সে কাঁধের উপর প্রিয় রাইফেলটা নিয়ে।
সবাই অবশ্য বলাবলি করেছে এবার খালি হাতে ফিরতে হবে বদরুলকে। গত সপ্তাহে তিনজন শিকারী গিয়েছিল বনে। লাভ হয়নি। হরিণ তো দুরের কথা, হরিণের “লাদা”ও দেখেনি কেউ।বুনো ঘাসের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে বদরুল। সতর্ক চোখে নজর রাখছে চারদিকে। ভোর ছয়টায় এসে ঢুকেছে বনের ভেতরে।এখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। জঙ্গলের ভেতর কাকের পালকের মত অন্ধকার নেম আসছে।
আর কেউ হলে ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে যেত। বদরুল শক্তপাল্লা।ফেরার প্রশ্ন তো ওঠেই না, বরং বনভূমির আরো ভেতরে ঢুকছে সে। বুনো ঝাঁঝালো গন্ধে নেশা নেশা লাগছে ওর।সত্যি তাই, এইবার বোধহয় জীবনের প্রথম খালি হাতে ফিরতে হবে। ওর অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে কষে কিছু গালিগালাজ দিল। সবই বিচ্ছিরি গালি, কর্মকর্তার মায়ের সাথে জড়িত। তারপরও রাগ কমছে না।
দুপুরে শুকনো একটা রুটি আর কৌটার মাছ দিয়ে খাবার সেরেছে ও। পানির ক্যানটিনটা খালি হয়ে গেছে। তেষ্টা পেয়েছে অনেকক্ষণ হল। ভয়ের কিছু নেই। আর কিছুটা সামনে একটা ঝর্ণা আছে। সেখান থেকে ক্যানটিনটা ভরে নিতে হবে। পানিও গিলতে হবে পেট ভরে। তারপর কোনো গাছের ডালে বসে রাতের জন্য আশ্রয় নিতে হবে। রাতের বেলা ঝর্নার পানি খেতে আসতে পারে কোনো হরিণ। তখন. . .চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
পায়ের নিচে শুকনো ডাল আর ঝরা পাতা পড়ছে। তারপরও শব্দ হচ্ছেনা। অনেক বছর জঙ্গলে হেঁটে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শিখে গেছে সব কৌশল।ঝর্ণাটা দুরে থাকতেই আগুনের কুন্ডটা চোখে পড়ল বদরুলের।
এ আবার কী! কেউ ক্যাম্প ফায়ার করেছে নাকি? তাইতো মনে হচ্ছে। কারা এল এই শিকারের শেষ মৌসুমে? সতর্ক পায়ে আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে গেল সে। বড় একটা গাছের গুড়িতে ঠেস দিয়ে দাড়াল। রাইফেলটা তুলে নিল কাঁধে যত্ন করে। চোখ রাখল রাইফেলে ফিট করা টেলিস্কোপের উপর।
সাথে সাথে লাফ দিয়ে ঝর্ণাটা সামনে চলে এল। ঝিরিঝিরি বয়ে যাচ্ছে ঝর্ণা। নানান সাইজের পাথর। শেওলায় সবুজ। বুড়ো নাবিকের দাড়ির মত সাদা ফেনা জমেছে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে। ঝর্ণা থেকে একটু দুরেই আগুনের কুন্ডটা। ধীরে ধীরে জ্বলছে। তার উপরে গাছের ডালে গেঁথে ঝলসানো হচ্ছে বড় একটা মাছ। সম্ভবত ট্রাউট মাছ হবে। এখানকার ঝর্ণাগুলোতে তাই পাওয়া যায়।
একটা বড় কেতলিও ঝুলছে। ভেতর কি সেদ্ধ হচ্ছে কে জানে। কফি?ডানদিকে ছোট্ট একটা তাবু। খোলা। ভেতর বসে আছে দুজন নর নারী। ব্যস্ত। নিজেদের নিয়েই। এই গভীর নির্জনে কাছাকাছি চলে আসায় ভুলে গেছে আর সব কিছুর অস্তিত্ব! কল্পনাওও করতে পারেনি শিকারের শেষ মৌসুমে আর কেউ আসতে পারে।
ছেলেটা হাসিমুখে কী যেন বলল। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। আদিম পরিবেশে আদিম অবস্থায় রয়েছে ওরা। আবিষ্কার করছে একে অপরকে! টেলিস্কোপের ফোকাস অ্যাডজাস্ট করতেই দুজনের চেহারা আর মাথা আরো পষ্ট হয়ে উঠল। মাথা দুটো ফুটবলের মত বড় বড় দেখাচ্ছে।
এইমূহুর্তে ট্রিগারে চাপ দিলে মাত্র এক গুলিতে দুজনেরই মারা যাবে।
পরীক্ষা করে দেখবে নাকি? ভাবল বদরুল। হাতটা নিশপিশ করছে।
শিকারের মৌসুম শেষ। তাতে কী?
এবছর না হয় অন্য রকম শিকার করা যাক! ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ট্রিগারে চাপ দিল সে।