Site icon খিচুড়ি

স্যার পড়াবেন কাকে, ছাত্রকে না গরুকে?

একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির ক্লাসে এক ছাত্র জানতে চেয়েছিল যে, ‘ইউ’ একবচন হলেও এরপর ক্রিয়াপদ ‘আঃর’ হবে কেন। স্যার বিষয়টির গ্রামার বুঝাতে বললেন, ভাষার সৌন্দর্যের জন্য ইউ এর পর ‘আর’ বসে। স্যার আবার বললেন, “দেখ, শুদ্ধভাবে বললে কি সুন্দর শুনায়- অ্যাইইইই অ্যাম, ইউউউউউউ আঃর; এভাবে এইটা মুখস্থ করতে হবে, এর আর কোন গ্রামার নাই।”

একজন মাদ্রাসা-শিক্ষক আমাদের বাড়িতে নিয়মিত দুধ সরবরাহ করেন। প্রথমত শিক্ষক, দ্বিতীয়ত ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। পেশা ও ধর্মীয়’র দ্বিগুন দায়িত্ত্বে নিয়োজিত ওই শিক্ষক, উন্নতজাতের গাভি নিয়ে দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠা করেন এবং দুধ ফেরি করার জন্য একটা মোটর বাইক কিনেছেন। খামারটি নিয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত এবং আশাবাদী এবং বিদেশি জাতের গাভী-পালনে অতিরিক্ত সতর্কতার প্রয়োজনে স্যারের সারাদিন কেটে যায় গাভিচর্চায়। কিন্তু, মাদ্রাসার কি হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে স্যার বলেন, ‘মাদ্রাসা তো ভেঙ্গে পড়ছে না, সব যেভাবে চলে এটিও চলছে।’

আরেকজন স্যার, রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। একদা, স্কুলের চাবি বাড়িতে রেখে তিনি ১০ বছর বিভিন্ন কারখানায় চাকুরি করেন। সর্বশেষ, ঢাকার অদূরে সাভারে একটি ডেইরী ফার্মে কাজ করেন। এখানেও, গাভি নিয়ে কায়কারবার এবং যত্নআত্তি ও খাটাখাটুনির ব্যাপার। যাই হোক, রেজিস্টার্ড স্কুল জাতীয়করণের পর তিনি আবার স্কুলটি খুলেন। পাশাপাশি তিনিও, সাভারের ডেইরী ফার্মের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠা করেন।

কথা হল, হবিগঞ্জ জেলাকে নমুনা ধরলে দেখা যায়, কলেজ, মাদ্রাসা, বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত এক হজার সাত শ’য়ের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর বেশীরভাগ সময় বন্ধ থাকে এবং অধিকাংশ শিক্ষক নিজ নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন অথবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অসংলগ্ন অবস্থা বিরাজ করছে। এক দশ বা শতজন নন, হাজার- লক্ষ শিক্ষকের প্রধান পেশার পাশাপাশি শিক্ষকতার নামে ধোঁকাবাজি করছেন। ফলে,সংবাদপত্র আইন প্রশাসন বিচারসহ সবকিছুতে প্রতারণা- তাল মিলানো- ভণ্ডামি বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্মে অবতীর্ণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তময়না অধ্যাপক ভণ্ডামির জন্য পদক পেয়ে থাকেন। তাই, সচেতন সমাজের নিকট আমাদের জিজ্ঞাসা যে, স্কুল- কলেজে আসা-যাওয়া করে এরা কারা এবং স্যার পড়াবেন কাকে; ছাত্রকে না গরুকে।

কার্যত, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশায় পতিত। বিপরীতে, অশিক্ষা-অজ্ঞতা-কুসংস্কার এখন মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক বা অধ্যাপকের আচরণের সাথে শিক্ষার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না; বই-পুস্তকের বাণী ও শিক্ষিতের মুখের ভাষার সাথে স্বশিক্ষারও মিল নেই। ভিসি কিংবা শিক্ষক নেতাদের সাথে ওয়ার্ড কমিশনার কিংবা ইউপি মেম্বারের বক্তব্যর ব্যাপক মিল পাওয়া যায়। স্বভাবতই, শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবহার ও অবস্থার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও বিরোধিতা বাড়ছেই, যেমনভাবে বাড়ছে প্রাইমারি-কেজি স্কুল হতে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। পরীক্ষায় জালিয়াতি, শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা, মেধার অপমূল্যায়ন ইত্যাদি নিয়মিত চলছে। মেধা ও যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কঠোরতা কাম্য হলেও, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ শত রকমের অবৈধ উপায়ে ভর্তি করে নেওয়া হচ্ছে অযোগ্য ভর্তিচ্ছুককে। স্বীকার্য যে, ৩৪টি সরকারী ও ৭২টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ২২টি সরকারী ও ৫৩টি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজসহ বাংলাদেশের সকল স্তরের দেড় লক্ষাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবং এসবের শিক্ষক- শিক্ষার্থীর সাথে বাংলাদেশের মানুষের নীতিগত অথবা আত্মিক সম্পর্ক নেই।

তবে, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা দুর্নীতির লীলাভূমিতে পরিণত হতে পেরেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পর্যন্ত ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ নিরক্ষর এবং শিক্ষিতর অধিকাংশই অন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশকৃত শিক্ষার্থী মেধাহীনতার বৈচিত্র বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। সম্প্রতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষায় বিগত শিক্ষার অসারতার প্রকাশ পায়। পাঠ্যপুস্তক পাঠে অক্ষম সিংহভাগ শিক্ষার্থী। অন্যদিকে, শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থী-লাঞ্চনা, ভূয়া সনদপত্র দাখিল করা, অর্থ আত্মসাতসহ কোন না কোন শিক্ষকের অনিয়ম বা দুর্নীতির সংবাদ প্রতিদিনই থাকে। কারণ, অন্য কোন কাজ জুটাতে অক্ষম ব্যক্তির সর্বশেষ ভরসা হিসাবে দাঁড়িয়ে যেতে বা গজিয়ে ওঠতে পারে একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অধিকাংশক্ষেত্রে, শিক্ষকতাকে শুধুই চাকুরীর মত ব্যবহার করা হয়।

শিক্ষকগণ ক্লাস,পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ ফেলে রেখে নিজেরাই নিজেদের বেতন-ভাতার দাবী তোলেন; অন্যদিকে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জলকামানের ব্যবহারে গরম জল ঢেলে শিক্ষকদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বাংলাদেশের শিক্ষকদের আন্দোলনও নীতিগতভাবে গতিহীন, বহুধাবিভক্ত ও জনবিচ্ছিন্ন। শিক্ষকদের দাবী-দাওয়া নিয়ে গঠিত সংগঠন কিছুদিন পর কয়েকটিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ঐক্য-মেধা-সততা-সাহসে মূল্যবোধসম্পন্ন ও অধিকার সচেতন শিক্ষায় গর্বিত এবং জাতির পৃষ্ঠপোষকতায় উজ্জীবিত এমন শিক্ষক বাংলাদেশে খুব কমই আছেন। তাই, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবড়ানি খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালানোকে অপমানজনক মনে করেন না।

বাংলাদেশে এখন চতর্মুখী অস্থিরতা বিরাজ করছে; শিক্ষাসমাজ ওই অস্থিরতা কর্তৃক বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছে। তাই, সুশিক্ষা দান কিংবা স্বশিক্ষা অর্জনের কোন প্রয়াস এখানে দেখা যাবে না। মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়তেই পারে। তবে, এসব শেষ কথা নয়। খিস্ট্রপূর্বাব্দ থেকে দুই হাজার খ্রিস্টাব্দ সময়েও, বহু জাতি অবনমনের শেষ প্রান্তে নেমে গিয়েও শিক্ষাকে প্রধান সম্বল করে স্বাধীনচেতা, স্বতন্ত্র ও উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেবল ‘ঘোষণা’ আর সময়ে সময়ের অসার ফল প্রকাশ।

Exit mobile version