কাউন্ট ড্রাকুলার ইতিবৃত্ত

ড্রাকুলা আইরিশ লেখক ব্রাম স্টোকার রচিত একটি উপন্যাস। সারা বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমী মানুষ তাকে চেনে ড্রাকুলা স্রষ্টা হিসেবে। এই উপন্যাসখানি প্রধানত বিভিন্ন বর্ণনাকারীর দিনলিপি ও চিঠিপত্রের আকারে লিখিত। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের প্রধান খলচরিত্র ভ্যাম্পায়ার কাউন্ট ড্রাকুলা। ড্রাকুলা উপন্যাসটি সাহিত্যের একাধিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত। এগুলি হল ভ্যাম্পায়ার সাহিত্য, ভৌতিক সাহিত্য, গথিক উপন্যাস ও আক্রমণ সাহিত্য। এরপর এই উপন্যাস এবং কিছু পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে একে বিভিন্নভাবে রূপায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলি হল ভ্যাম্পায়ার সাহিত্য, ভৌতিক সাহিত্য, গথিক উপন্যাস ও আক্রমণ সাহিত্য। এটা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সিনেমা, টিভি সিরিয়াল।ব্রাম স্টোকারের লেখা ড্রাকুলা ইতিহাসে হয়তো একমাত্র উপন্যাস, যার চরিত্র নিয়ে প্রচুর পরিমাণে ছবি তৈরি করা হয়েছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত এ চরিত্র নিয়ে ২৭২টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। বইটি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আবারো নতুন টিভি সিরিজ ও একটি ছবি তৈরি করা হবে। শার্লক টিভি সিরিজের লেখক স্টিভেন মোফাট এবং মাইক গেটিস নতুন টিভি সিরিজের কাহিনী তৈরি করছেন। রবার্ট এগারস জার্মান মাস্টারপিস ছবি ‘নসফেরাতু, এ সিম্ফোনি অব হরর’ বানাচ্ছেন আবার নতুন করে। ড্রাকুলা নিয়ে তৈরি প্রথম ছবি নসফেরাতুর (১৯২২) পরিচালক এফ ডব্লিউ মুরনাউ ব্রাম স্টোকারের বইয়ের সরাসরি অনুকরণ করেননি। তিনি প্লট হিসেবে ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংল্যান্ড থেকে সরে গিয়ে সতেরো শতকের জার্মানিকে নেন এবং প্রধান চরিত্রের নতুন নাম দেন কাউন্ট অরলোক। কিন্তু এর নির্মাতা দেউলিয়া হয়ে যায় এবং জার্মান আদালত এ ছবির সব প্রিন্ট ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়। এরপর রবার্ট এগার ছবিটি নতুন করে তৈরির কথা ভাবেন। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় নসফেরাতু দ্য ভ্যাম্পায়ার। সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রাম স্টোকারের গল্পের ভেতরকার যৌনতা। তবে ব্রাম স্টোকারের গল্প সরাসরি ব্যবহার হয়েছে এমন ছবিও আছে প্রচুর। ১৯৩১ সালে টড ব্রাউনিং ড্রাকুলা ছবি তৈরি করেন। ১৯৫৮ সালের ড্রাকুলা ছবিতে ক্রিস্টোফার লি তার সেরা অভিনয় করেন। এখন পর্যন্ত তিনিই সেরা ড্রাকুলা হয়ে আছেন। ১৯৭২ সালের ব্ল্যাকুলা ছবিতে দাস ব্যবসা যুক্ত হয়। আফ্রিকার কালো মানুষদের দাস হিসেবে বিক্রির বিষয়টি এখানে উঠে আসে। তবে স্টোকারের বইয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছিল ১৯৯২ সালে তৈরি করা ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার ছবি।
মধ্যযুগে রোমানিয়া বিভক্ত ছিল তিনটি “প্রিন্সিপ্যালিটি” বা যুবরাজ-শাসিত রাজ্যে:ওয়ালাশিয়া, মলডাভিয়া ও ট্রানসিলভানিয়া। ১৪৩১ সালে কার্পেথিয়ান পর্বতমালার কোলে অবস্থিত ট্রানসিলভানিয়ার দক্ষিণে ওয়ালাশিয়া রাজ্যের যুবরাজ ভ্লাদ ড্রাকুলের স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর নাম তৃতীয় ভ্লাদ। রোমানিয়ান প্রথানুসারে তাঁকে ডাকা হত “ড্রাকুলা” নামে। ভ্লাদ ড্রাকুলের নামের অর্থ ছিল “ভ্লাদ দ্য ডেভিল” বা “শয়তান ভ্লাদ”। সেই অর্থে তাঁর পুত্রের নামের অর্থ হয় “শয়তানের পুত্র”। চতুর্থ ভ্লাদ ভ্যাম্পায়ার ছিলেন না বটে, কিন্তু তাঁর নামের সঙ্গে পরবর্তীকালে যে বিশেষণটি জুড়ে যায়, সেটি তাঁর “রক্তপিপাসু” প্রবৃত্তির কিছুটা আভাস বহন করে। তাঁকে বলা হত “ভ্লাদ দি ইমপেলার” বা “শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদ”। মধ্যযুগের ইতিহাসেও তাঁর নিষ্ঠুরতার কাহিনি একটু বেশি রকমেরআশ্চর্যজনক। সময়টা ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অস্থিরতার যুগ। তুর্কি মুসলমানেরা এই সময় সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এক বড়োসড়ো যুদ্ধাভিযানের ছক কষছিল। আর তাই নিয়ে ইউরোপের খ্রিষ্টান রাজশক্তির সঙ্গে চলছিল তাদের সংঘাত। ছেলেবেলায় একবার তুর্কিদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন ভ্লাদ। তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রিয় পদ্ধতি শূলে চড়ানোর কৌশলটিও তিনি শিখেছিলেন এই তুর্কিদের দেখাদেখিই। পদ্ধতিটা সহজ, তবে বর্বরোচিত একটা সূচালো আগাবিশিষ্ট কাঠ বা লোহার বিরাট একটি শলা বিঁধিয়ে দেওয়া হত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির শরীরে। তারপর ওই অবস্থাতেই শলাটিকে খাড়াভাবে দাঁড় করিয়ে মাটির সঙ্গে গেঁথে দেওয়া হত। শলার মাথায়দণ্ডপ্রাপ্ত লোকটি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে প্রাণত্যাগ করত।
১৪৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিরা ভ্লাদকে ওয়ালাশিয়ার সিংহাসনে স্থাপন করে। কিন্তু ভ্লাদ বিদ্রোহ করে পালিয়ে যান একটি খ্রিষ্টান মঠে। তুর্কিরা পূর্ব ইউরোপের বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল দখল করে নিলে ১৪৫৬
সালে ওয়ালাশিয়ায় ফিরে আসেন ভ্লাদ। তুর্কিদের সঙ্গে শুরু হয় তাঁর তুমুল সংগ্রাম। তাঁর সেনাবাহিনী প্রায় কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত গিয়ে দানিউব নদীর অববাহিকায় সবকটি দুর্গ পুনরুদ্ধার কর এবং নৃশংসভাবে হত্যা করতে থাকে
শত্রুদের। এই সময়েই সমগ্র অঞ্চল জুড়ে একই সঙ্গে খ্যাতি ও কুখ্যাতি
কুড়িয়েছিলেন ভ্লাদ। শোনা যায়, দু’জন তুর্কি দূত তাঁর সভায় পাগড়ি খুলতে অস্বীকার করলে, তিনি তাঁদের
পাগড়ি তাঁদের মাথার খুলির সঙ্গে পেরেক দিয়ে গেঁথে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। নিজের নিজের প্রজাদের সঙ্গেও যে ভ্লাদ খুব সুব্যবহার করতেন এমন নয়। কারণে অকারণে হানা দিতেন বন্ধুশহরে। অত্যাচার চালাতেন। মানুষ খুন করতেন। পুড়িয়ে মারতেন, জীবন্ত সিদ্ধ করতেন বা গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নিতেন। ১৪৬০ সালের সেন্ট বার্থালোমিও
ডে-এর দিনে ট্রানসিলভানিয়ার একটি শহরে হানা দিয়ে ৩০,০০০ লোককে শূলে চড়িয়েছিলেন ভ্লাদ। এটিই ছিল তাঁর নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। শেষদিকে ভ্লাদের সেনাবাহিনী তুর্কিদের হাতে পরাজিত হয়। তাঁর নিজের লোকজনও তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। জাল কাগজ বের করে তারা প্রমাণ করে যে ঘৃণিত তুর্কিদের সঙ্গে ভ্লাদের যোগসাজেশ ছিল। হাঙ্গেরির কিং মাথিয়াসে তাঁকে বারো বছর বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু মানুষকে শূলে চড়ানো তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছিল। জানা যায়, কারারক্ষীদের বশ করে তাদের দিয়ে নেংটি ইঁদুর বা অন্য ছোটো জানোয়ার নিজের কক্ষে আনিয়ে নেশাগ্রস্থের মতো শলায় বিঁধিয়ে মারতেন সেগুলোকে! ১৪৭৬ সালে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
শোনা যায় ১৪৭৮ সালে সিংহাসন ফিরে পাওয়ার দু’মাসের মধ্যে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুটি অবশ্য আজও রহস্যের অন্তরালে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই “শূলে- চড়ানিয়া” ভ্লাদের সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের কি সম্পর্ক? ”ড্রাকুলা” উপন্যাসের সেই কুখ্যাত রক্তচোষা কাউন্টের নাম হিসেবে ব্রামস্টোকার ব্যবহার করেছেন শূলে- চড়ানিয়া ভ্লাদের ডাকনামটি। শুধু
তাই নয়, কার্পেথিয়ান পর্বতমালার ভুতুড়ে নিসর্গ, মধ্যযুগীয় রোমানিয়ান ইতিহাসের নানা আবছায়া অনুষঙ্গ
নিয়ে ট্রানসিলভানিয়ার ইতিহাসের ছায়া অনেকটাই পড়েছে ওই বেস্টসেলার বইটির গল্পে। কাউন্ট ড্রাকুলা নামটি স্টোকার সম্ভবত পেয়েছিলেন উইলিয়াম উইলকিনসনের বই ”অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ দ্য প্রিন্সিপ্যালিটিস অফ ওয়ালাশিয়া অ্যান্ড মলডাভিয়া: ইউথ ভেরিয়াস পলিটিক্যাল অবজার্ভেশনস রিলেটিং টু দেম” থেকে। বইটির কথা
স্টোকার উল্লেখও করেছেন। বুদাপেস্টের এক হাঙ্গেরীয় প্রোফেসর ছিলেন স্টোকারের বন্ধু। কেউ কেউ তাই মনে করেন কাউন্ট ড্রাকুলা নামটি তাঁর বন্ধুর মুখ থেকেই শোনা। কেউ কেউ আবার বলে থাকেন কাউন্ট ড্রাকুলার নামটি ছাড়া শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদ সম্পর্কে আর কিছুইতেমন জানতেন না স্টোকার। তবে উপন্যাস বিভিন্ন অংশে কাউন্টের সংলাপে তাঁর অতীতের যে টুকরো ছবি পাওয়া যায়, তা পড়ে বলতেই হয়, রোমানিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে স্টোকার একেবারেই ক’অক্ষর গোমাংস ছিলেন না। তবে তিনি শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদের কোনো উল্লেখ করেননি, এমনকি তাঁর শূলে- চড়ানো অভ্যাসটিরও কোনো আভাস দেননি উপন্যাসে। এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হবে রোমানিয়ার ওই অঞ্চলে ভ্যাম্পায়ার মিথের জনপ্রিয়তা। ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় প্রাণীর উল্লেখ গ্রিস, মিশর এমনকি ভারতীয় লোককথাতেও পাওয়া যায়। কিন্তু ইউরোপীয় ভ্যাম্পায়ার মিথের উৎস দক্ষিণ স্লাভিক উপকথা। রোমানিয়ার সংস্কৃতিতে অবশ্য এই উপকথাগুলি পাওয়া যায় না। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে পূর্ব ইউরোপে ভ্যাম্পায়ার উপকথাগুলি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বলকান থেকে প্রত্যাগত পর্যটকদের হাত ধরে এই উপকথাগুলি এসে উপস্থিত হয় পশ্চিম ইউরোপে। কি আশ্চর্য সমাপতন! উনিশ শতকের শেষ ভাগে স্বয়ং কাউন্ট ড্রাকুলাও লন্ডনে এসেছিলেন এই রকম এক পর্যটকের সাহায্যে! শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদের কিংবদন্তি আর ভ্যাম্পায়ার উপকথা – পূর্ব ইউরোপের এই দুই উপাদানের সংমিশ্রণেই স্টোকার লেখেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ”ড্রাকুলা”। সম্ভবত ট্রানসিলাভানিয়া অঞ্চলে প্রচলিত ভ্যাম্পায়ার উপকথার কথা স্মরণ করেই স্টোকার তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত ভ্যাম্পায়ার চরিত্রটির পটভূমি সেখানেই স্থাপন করেন। আর পটভূমি নির্বাচনের পর এখানকার সবচেয়ে
কুখ্যাত শাসক ভ্লাদ ড্রাকুলার কথাও স্বভাবতই তাঁর মনে এসে থাকবে। তিনি জানতেন খুব কম লোকই ভ্লাদ ড্রাকুলার সঙ্গে কাউন্ট ড্রাকুলার সংযোগটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন। আর যাঁরা সক্ষম হবেন, তাঁরাও ভ্লাদ ড্রাকুলার “রক্তপিপাসু” প্রবৃত্তির সঙ্গে ভাল মতোই পরিচিত থাকবেন। আর তাই ভ্যাম্পায়ার হিসেবে ড্রাকুলাই ছিলেন স্টোকারের কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।