গফুর মিয়া। একজন জন্মান্ধ এবং পঙ্গু ব্যক্তি। কাজ করার ক্ষমতা নেই বলে ভিক্ষা করে বেড়ায়। ঘরে তার পিচ কালো স্ত্রী আর দশ বছরের এক ছেলে। ছেলেটা আবার গফুর মিয়ার রঙ পেয়েছে। মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে সে। গফুর মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বানু দেখতে কুতসিত্ হলেও মনটা কিন্তু অন্য যেকোন মহিলার চেয়ে সাদা। তাছাড়া একজন পূণ্যবতী মহিলা ওনি। সেইসাথে মায়া মমতার রাজ কোষাগার। গফুর মিয়া খুবই সুখি এরকম জীবন সঙ্গিনী পেয়ে। কজনের ভাগ্যেই বা জোটে এমন অর্ধাঙ্গিনী! বাইরে কাল তাতে কি? দুনিয়ার সবকিছুইতো তার কাছে অমাবস্যার রাতের মত। বরং এরকম একটি বউ পেয়ে সে আগের তুলনায় কিছুটা দেখতে পায়। তার দৃষ্টি চক্ষু দিয়ে নয়, অন্তর চক্ষু দিয়ে। আল্লাহর কাছে তাই কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে দু হাত তুলে দোয়া করে সে, যেন বউটা তার আমৃত্যু কাছাকাছি থাকে। মরণ এলে আগে যেন তার হয়। মনে মনে এরূপ কামনাই করে সে।
এদিকে ছেলেটাও হয়েছে ঠিক মায়েরই মত। কারো দুঃখ কষ্ট একেবারে সইতে পারেনা। নিজে কষ্ট করে হলেও অন্যের দুঃখ-কষ্ট মুচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে। এইতো আজ ঈদের দিনটাতে পড়ার জন্য অনেক কষ্ট করে একটা নতুন জামা কিনে দিয়েছিল গফুর মিয়া। কিন্তু সেটা সে নিজে না পড়ে দিয়ে দিয়েছে তার বন্ধু সজলকে। সজলের বাবা মারা গেছেন বছর খানেক হবে। এখন অনেক কষ্টে শিষ্টে কোন রকমে দিন কাটে তাদের। সজল আর গফুর মিয়ার ছেলে আক্কাস খুব ভাল বন্ধু। একসাথে মাদ্রাসায় যায় ওরা। তাই বন্ধুর মুখে হাসি ফুটানোর জন্যই নিজের নতুন জামাটা ওকে দিয়ে দিয়েছে সে। অথচ নিজে পড়ে আছে একটা ছেঁড়া ফাটা পুরণো জামা। সজল অবশ্য নিতে রাজি হয়নি কিছুতেই। কারণ আক্কাস যেমন তাকে ভালবাসে, তেমনটি সেও বাসে আক্কাসকে। কিন্তু আক্কাস তাকে বলে দিয়েছে, যদি সে জামাটা না নেয় তাহলে আর কোনদিনও তার সাথে কথা বলবেনা। সজল সব মেনে নিতে পারে কিন্তু এরকম একজন বন্ধু কিছুতেই হারাতে পারেনা। তাই বাধ্য হয়েই তাকে জামাটা নিতে হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গফুর মিয়া প্রথমে অবশ্য ছেলের উপর খুব রাগ দেখায়। একটু বকাবকিও করে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল যে কাজটা করা উচিত ছিল কোন বিত্তবানদের, তার এ ছোট্ট ছেলেটা সেটা করে দেখিয়েছে। গর্বে ভরে উঠল গফুর মিয়ার বুক। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল সুখ বৃষ্টি। তাই ছেলেকে কাছে ডেকে আদর করে দিল সে। সেইসাথে বলে উঠল, বেশ করেছিস! জামাটা দিয়ে দিয়েছিস। আল্লাহ তোকে এ জন্য পরকালে অনেক পুরষ্কার দেবেন! বকুনি খেয়ে প্রথমে একটু মন খারাপ হলেও এখন বেশ ভাল লাগছে আক্কাসের। বাবা তার প্রশংসা করেছেন। তাই আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল তার মনে। বাবা আর যাই হোক, খুব ভাল মানুষ। মনে মনে ভেবে নিল আক্কাস।
এদিকে সজল আক্কাসের দেয়া নতুন জামাটা পরে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যেই বের হচ্ছিল। সেখানে গিয়ে তাকে নিয়ে একসাথে নামাযে যাবে বলে। কিন্তু তার চোখের কোণে পানি জমে উঠল এই ভেবে যে, সে নতুন জামা পড়ে আর বন্ধু হয়তো পুরণো ছেঁড়া ফাটা জামাটাই পড়ে আছে! ইচ্ছে করছিল জামাটা খুলে সেও পুরণো জামা পড়ে বেরুক। কিন্তু আক্কাসকেতো ও চিনে! যদি দেখে তার পরণে পুরণো জামা তাহলে হয়তো কথাই বলবেনা আর। ফলে ঈদের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই মনে মনে শপথ করে নিল- কখনো যদি তার টাকা কড়ি হয়, তাহলে সে টাকা থেকে বন্ধুকে সবচেয়ে দামি জামাটা উপহার দেবে সে। ছেলের মতি গতি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিলেন সজলের মা আম্বিয়া বেগম। ছেলেকে এমন গোমড়া মুখে বের হতে দেখে তাই একটু দাঁড়াতে বললেন তিনি। এরপর একটা নতুন জামা নিয়ে এসে হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোর বন্ধুকে দিবি। মায়ের হাতে নতুন জামা দেখে সজল অবাক হয়ে গেল। মা কোথা থেকে নতুন জামা পেল? সারাদিন পরের বাড়িতে খাটুনি খেটে যা বা পায় তাতে তো তিন বেলার খাবারই জোটেনা! মায়ের প্রতি নিরব জিজ্ঞাসা তার। ছেলের বিস্ময় মাখা মুখ দেখে আম্বিয়া বেগম জবাব দিলেন, আসলে সংসার খরচ থেকে কিছু কিছু করে বাঁচিয়ে রেখে জমিয়েছিলাম আজকের দিনে তোকে একটা নতুন জামা দেব বলে। কিন্তু আমার আগেই তোর বন্ধু দিয়ে দিল। তাই এটা তোর বন্ধুর জন্য তুলে রেখেছি। এবার যা, এটা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বন্ধুর বাড়ি যা। নামাযের সময় হয়ে এল যে। সজল একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, তুমি খুব ভাল মা। এরপর জামাটা নিয়ে একটা দৌড় লাগাল আক্কাসদের বাড়ির দিকে। সজল চলে যেতেই তার মা আঁচল দিয়ে নিজের বারণ করা সত্তেও চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জলের কয়েকটা ফোঁটা মুছে নিলেন। আসলে সজলকে ওনি মিথ্যে বলেছেন। জামাটা কিনে এনেছেন কাজের বাড়ি থেকে ঈদের বাজারের জন্য দেয়া টাকাটা থেকে। অন্যের ছেলে তার ছেলের জন্য ছেঁড়া জামা পড়ে ঈদ করবে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। যদিও চুলায় বসানোর মত ঘরে কিছুই নেই। তিনি জানেন, ছেলেকে ওরা না খাইয়ে ছাড়বেনা। তাই নিজের জন্য আর চিন্তা করেননা।
এদিকে আক্কাস সবে গোসল সেরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল নামাযের জন্য। এমন সময় সজল এসে হাজির হাতে একটা নতুন জামা নিয়ে। আক্কাস জিজ্ঞেস করল, এটা কোথায় পেলি? – মা দিয়েছেন তোর জন্য। আসলে মা অনেক কষ্ট করে জমিয়ে আমার জন্য কিনেছিলেন ঈদের উপহার দেবেন বলে। কিন্তু তার আগেই তুই দিয়েছিস। তাই আসার সময় মা এটা আমায় দিয়ে বললেন, আমি যেন তোকে দিয়ে দেই। তুই না নিলে কিন্তু মা খুব রাগ করবেন! – তোকে কে বলল, যে আমি নেবনা। দে। জামাটা আমার হাতে দে। জামাটা হাতে দিলে পরম যত্নসহকারে পড়ে নিল আক্কাস। এরপর দুবন্ধু মিলে খুশি মনে বেরিয়ে গেল মসজিদের দিকে। আক্কাসের মা ব্যাপারটি লক্ষ্য করে স্বামীকে জানালেন এবং স্বামীর অনুমতি নিয়ে সজলের মাকেও সারাদিনের জন্য বেড়াতে নিয়ে এলেন এখানে। গফুর মিয়া ভিখারি হলেও ঈদের দিন খাবারের জন্য একটু গোস্ত, পোলাউ আর সেমাই ঠিক জোগাড় করেছিল। আর তাই দিয়ে ঈদের দিনটা বেশ ভালভাবেই চলে গেল তাদের। খাবারের সাথে সাথে অনেক আনন্দও করেছে তারা। সমস্ত দিনটা যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দুটো গরীব পরিবারের জন্য ঈদের বিশেষ উপহার ছিল। আসলে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসে, আল্লাহও তাদেরকে এরূপই ভালবাসেন। তাদের ধন না থাকতে পারে। তাই বলে আনন্দ কারো চেয়ে কম নয়।