খোঁচা

তীব্র কানের যন্ত্রনায় পশুরাজ সিংহ আর একবার গর্জণ করিয়া উঠিল। তিনটা কুকুর আপন মনে ঘেউ ঘেউ করিতেছিল। গর্জনের ভয়াবহতায় ঘেউ ঘেউ বর্জন করিয়া লেজ গুটাইয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হইল। দেখিয়া বাঘ্র মশাই বিরক্ত হইয়া বলিল, ”আগে শুনিয়াছিলাম ’মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা, এখন দেখিতাছি সিংহের কানের ব্যথায় কুত্তা পালায়’ অবস্থা।

সিংহের কানের ব্যথা দিন বাড়িয়াই চলিতেছে। রাজ বৈদ্যিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেও ব্যথা কমিবার কোন লক্ষণ নেই। ইতি মধ্যেই তিন জন বৈদ্যি বিফলতার পুরস্কার স্বরূপ সিংহ মশাইয়ের খাবার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছে। রাজ্যে কোন সুখ নাই। গোটা রাজ্যে অশান্তি বিরাজমান। সারদিন সিংহ মশাই কানের ব্যথায় গর্জন করে, মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। কিন্তু ব্যথা যায় না। পশুরাজ সিংহ এইবার ঘোষনা করিল, “যে তাহার কানের ব্যথা ঠিক করিয়া দিতে পারিবে তহাকে উপযুক্ত পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হইবে।” পুরস্কারের আশায় অনেকেই এল, অনেকেই সিংহের পেটে গেল। কিন্তু কানের ব্যথা কিছুতেই যায় না। অবশেষে এল বানর। সে কিছুক্ষণ সিংহের কান পরীক্ষা করিয়া দেখিল। অতপর একখানা কাঠি দ্বারা সিংহের কানে খোচা দিয়া কানের ভিতর আটকে থাকা ময়লা বাহির করিয়া দিল। সিংহ মহাশয় আবারও মাটিতে গড়াগড়ি খেলেন। তবে এইবার ব্যথায় নয়, খুশিতে। তিনি সুস্থ হইয়া গিয়াছেন। অতএব প্রতিশ্রুতি মত বানরকে পুরস্কৃত করা হল।

বনের অন্যান্য পশুপাখি বানরের ভাগ্যে ঈর্ষা অনুভব করিতে শুরু করিল। তাহারা এত কষ্ট করিয়া রাজাকে তৈল মর্দন করিয়া রাজার শুভদৃষ্টির আওতায় আসিতে পারে না। আর বানর কি না এক খোঁচায় সিংহের মন জয় করিয়া লইল। ইহা কিভাবে মানিয়া লওয়া যায়? আমরাও খোঁচাখুচি শিখিব। যা ভাবা, তাই কাজ। শুরু হইল খোঁচাখুচি। এ ওকে খোচা দেয় তো ও দেয় সে কে। খোঁচার মহাৎসব শুরু হইল সারা রাজ্যে। এই খোঁচাখুচিতে  সবথেকে এগিয়ে জনাব গর্ধব চন্দ্র যাকে গাধা নামে ডাকা হইয়া থাকে। সে যাকে পায় তাকেই খোচায়। একদিন বাঘ্র মহাশয় ঘুমাইয়া ছিলেন। গাধা নিজেকে নিয়ন্ত্রন করিতে পারিল না। দিল এক খোঁচা। আর যাবে কোথায়? একে তো বাঘ্র মহাশয়ের কাচা ঘুম ভেঙ্গে গেছে, তার উপর ক্ষুধাও লেগেছিল। দেরী না করে বাঘ্র মশাই দিল খোঁচা, মানে থাবা। সেই থাবায় গাধার এক কান গেল কেটে। কান কাটা গাধা দেখে বাঘ্র মহাশয় খিদা ভুলে হাসিতে লাগিলেন। গর্ধব আর কি করিবে? গিয়ে রাজা সাহেবের কাছে নালিশ জানাইলেন। সিংহ দেখিল, বিষয়টা গুরুতর। সারা রাজ্য খোঁচাময় হইয়া গিয়াছে। সবাই কাজ কর্ম বাদ দিয়া খোঁচাখুচিতে ব্যস্ত। সবাই পরোপকারও ভুলে গেছে। কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করা বাদ দিয়া খোঁচা মারিতে থাকে। অতএব খোঁচা বন্ধ। এই রাজ্যে আর কেউ খোঁচা মারিতে পারিবে না। খোঁচার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সারা রাজ্যে ঢেরা পেটানো হইল। যে খোঁচা দিবে তার শাস্তি নির্ধারিত হইল, ৫০ বার নিজেই নিজেকে খোঁচা দেয়া। খুব শীঘ্রই রাজ্য থেকে সকল প্রকার খোচাখুচি বিদায় নিল।

কয়েক বৎসর পরের ঘটনা। রাজ্য হইতে সকল প্রকার খোঁচা বিতারিত। এমন সময় সিংহের আবার কানের ব্যথা উঠিল। সিংহ মহাশয় বানর কে ডাকিয়া পাঠাইল। বানর আসিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া “আমি পারিব না” বলিয়া প্রস্থান করিল। সবাই অবাক। ব্যাপার খানা কি? শেয়ালকে প্রধান করিয়া তিন সদস্য বিশিষ্ঠ তদন্তকমিটি গঠন করা হইল। অনেক চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে তদন্ত কমিটি অবশেষে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করিল। তাহাতে লেখা, ”রাজা মহাশয় এর কানের ব্যথার কারণ নির্ণয় সম্ভব হয় নাই। তাই তারা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটির সুপারিশ করিতেছে। দীর্ঘ দিন খোঁচাখুচি হইতে বিরত থাকার কারনে বানর মহাশয় খোঁচা দেবার ক্ষমতা হাড়াইয়া ফেলিয়াছেন। তাই তিনি খোঁচা দেয়ায় অপারগতা প্রকাশ করিয়াছেন। কমিটি বিস্তারিত অনুসন্ধান পূর্বক একজন খোঁচা বিশারদ কে খুজিয়া বাহির করিয়াছে। সে খোঁচাখুচির স্বর্ণ যুগে খোঁচাপ্রদানে প্রথম ছিল। কমিটি খোঁচাবিশারদ জনাব কানকাটা গাধা কে রাজা মহাশয় এর কানে খোঁচা প্রদানে করিতে দেবার অনুমতি প্রদানের পরামর্শ দিচ্ছে।”

আসল ঘটনা কিন্তু ভিন্ন ছিল। রাজা মহাশয়ের কানে এবার কোন ময়লা ছিল না। অন্য কোন কারনে কান ব্যথা করছিল। তাই বনর মশাই ভেগেছিল। কিন্তু গাধা তার গাধামীর প্রমাণ রাখিবার জন্যই মনে হয় খোঁচা দিতে রাজি হইয়াছিল। সে ভাবিল, “বানর হালকা খোঁচা দিয়াই রাজা মন জয় করিয়াছিল, আমি বেশি জোড়ে খোঁচা দেই। তাহা হইলে রাজন আমাকে বেশি পুরস্কারে পুরস্কৃত করিবেন।” তাই সে কোন পরীক্ষা ছাড়াই সিংহ মহাশয়এর কানে সর্ব শক্তি দিয়া খোঁচা মারিল। সিংহ মহাশয় প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠল, ”আ আ আ আ আ আ আ……………………………….”